শুক্রবার, ৮ মে, ২০১৫

বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড থামছে না


সরকারের বার বার প্রতিশ্রুতেও বিচারবহির্ভূত পন্থায় হত্যাকান্ড থামছে না। ফলে জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের পরিসংখ্যান। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জনবান্ধব দাবিদার মহাজোট সরকারের আমলনামায় একের পর এক যুক্ত হচ্ছে বিনা বিচারের হত্যাকান্ড। বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে ইতোমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ।
গত সাড়ে তিন মাসে বিচারবহির্ভূতভাবে নিহত হয়েছেন ৭০ জন। নিহতদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী। একই সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুলীবিদ্ধ হয়েছেন কমপক্ষে ৩০ জন। সাধারণত পায়ে গুলী লাগার ঘটনাই বেশি। অন্যদিকে, নিহতদের ৫৩ জনই প্রাণ হারিয়েছেন কথিত ক্রসফায়ারে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ সালে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৩২৯ জন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৯, ফেব্রুয়ারি মাসে ৬৭, মার্চ মাসে ৫২, এপ্রিলে ৯, মে মাসে ৭৪, জুনে ১০, জুলাইয়ে ১৩, আগস্টে ১০, সেপ্টেম্বরে ৫, অক্টোবরে ১৫, নবেম্বরে ১২ এবং ডিসেম্বরে ৫৩ জন নিহত হয়।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ৩৯, ফেরুয়ারিতে ১৭, মার্চে ১৪, এপ্রিলে ১৮, মে মাসে ৯, জুনে ১০, জুলাইয়ে ১৫, আগস্টে ৭, সেপ্টেম্বরে ৭, অক্টোবরে ২০, নবেম্বরে ৬ এবং ডিসেম্বরে ১০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন।
চলতি বছরের প্রথম সাড়ে তিন মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৭০ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১৮, ফেব্রুয়ারিতে ৩৮, মার্চে ১২ এবং এপ্রিলের অর্ধমাসে দুইজন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। এসব ঘটেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। এর বাইরে গত সাড়ে তিন মাসে ৩০ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১২, ফেব্রুয়ারিতে ৭, মার্চে ৮ এবং এপ্রিলে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
চলতি বছরের সাড়ে তিন মাসে শুধু ক্রসফায়ারেই নিহত হয়েছে ৫৩ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩০, মার্চে ৯ জন এবং এপ্রিলে ২ জন ক্রসফায়ারের শিকার হন। এই সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা পায়ে গুলীবিদ্ধ হন কমপক্ষে ৩০ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬ এবং মার্চে ৭ জন গুলীবিদ্ধ হয়েছেন।
গত ৭ জানুয়ারি নোয়াখালীর চৌমুহনীতে পুলিশের গুলীতে নিহত হন বেগমগঞ্জ উপজেলার ছাত্রদল কর্মী মহসীন উদ্দিন ও সেনবাগ উপজেলা যুবদল কর্মী মিজানুর রহমান রুবেল। ৮ জানুয়ারি যশোরে ক্রসফায়ারে নিহত হন রাজু নামে এক যুবক। ১৬ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট এলাকায় র‌্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ছাত্রদল নেতা মতিউর রহমান। ঘটনার পর র‌্যাব-৫ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ক্যাম্পের ইনচার্জ মেজর কামরুজ্জামান গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, বিশেষ অভিযানে মতিউরসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে নাশকতায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। পরে তাকে নিয়ে র‌্যাব অভিযানে বের হলে মতিউরের সহযোগীরা র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলী চালায়। এ সময় র‌্যাবও পাল্টা গুলী চালায়। একপর্যায়ে মতিউর গুলীবিদ্ধ হন। তবে মতিউরের পরিবারের দাবি তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
১৭ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পূর্ব টিমের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মতিঝিলের এজিবি কলোনি এলাকায় নিহত হয়েছেন ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি নড়াইল পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ইমরুল কায়েস। ইমরুলের স্ত্রী জান্নাতুলের দাবি, তার নির্দোষ স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তবে পুলিশের দাবি কায়েসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ রয়েছে।
২০ জানুয়ারি রাজধানীর খিলগাঁও জোড়পুকুরপাড় থেকে উদ্ধার করা হয়েছে খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান জনির লাশ। নিহত জনির বাবা ইয়াকুব আলী গণমাধ্যমে জানান, তার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ২২ জানুয়ারি লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্রদলের সাবেক নেতা জিসান দাউদকান্দিতে র‌্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
ঝিনাইদহের শৈলকুপার কুসুমবাড়ি গ্রামের হাশেম আলী বিশ্বাসের ছেলে সুলতান বিশ্বাস ৩৫ দিন নিখোঁজ থাকার পর ২৬ জানুয়ারি র‌্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন। ওই দিনই ক্রসফায়ারে আবুল কালাম নামে আরো একজন নিহত হন। ২৭ জানুয়ারি সাতক্ষীরার তালায় রফিকুল ইসলাম নামে একজনকে ডাকাত সন্দেহে পুলিশ গ্রেফতার করে। পরে ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হয়। একই দিন রাজশাহীর বিনোদপুরে জামায়াত নেতা অধ্যাপক নুরুল ইসলাম শাহীনকে আটকের পর ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হয়।
২৯ জানুয়ারি রাজশাহী মহানগর বিএনপি নেতা আইনুর রহমান মুক্তাকে পুলিশ আটক করে নির্যাতন করায় তার মৃত্যু হয় বলে দলীয় সূত্র জানায়। একই দিন সাতক্ষীরায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। ২০ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শিবিরকর্মী সাকিবুল ইসলামকে পুলিশ আটক করে। পরে পুলিশী নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৯ জানুয়ারি তার মৃত্যু হয়।
২৯ জানুয়ারি সদরঘাটের লঞ্চ থেকে সাদা পোশাকের লোকজন নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ছাত্রদল নেতা আরিফুল ইসলাম মুকুলকে তুলে নিয়ে যায়। পরদিন ৩০ জানুয়ারি তার লাশ পাওয়া যায় ঢাকার রূপনগর এলাকায়। আগের দিন অপহৃত হওয়া এদিন যশোরের চৌগাছা উপজেলা বিএনপি কর্মী সামাদ মোল্লার লাশ উদ্ধার করা হয়।
১ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় সাইদুল ইসলাম নামে এক জামায়াত নেতা পুলিশের গুলীতে আহত হয়ে পরের দিন তিনি মারা যান। এদিন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকার শাহ আলী থানা সভাপতি এমদাদ উল্লাহ পুলিশের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন। ৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে র‌্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন সাখাওয়াত হোসেন রাহাত নামে এক যুবক। একই স্থানে নিহত হন মুজাহিদুল ইসলাম জাহিদ নামে আরো একজন। এদিন ভাষানটেক থানা এলাকা থেকে আল আমিন নামে এক যুবকের এবং বিএনপির সাবেক মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ভাগ্নে গাজি মোহাম্মদ নাহিদের গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি মিরপুরে বন্দুকযুদ্ধে মনির হোসেন নামে এক যুবকসহ একইস্থানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অজ্ঞাত নামে এক যুবক নিহত হন।
৬ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন কাটাখালী বাজারে শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তথ্য গবেষণা সম্পাদক শাহাবুদ্দিন, বিনোদপুর আবাসিক মেস শাখার সভাপতি মফিজুর রহমান ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ হবিবুর রহমান হল সভাপতি হাবিবুর রহমান বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত খেতে যান। সেখান থেকে ফিরে মোটরসাইকেলে কাটাখালী পৌরসভার সামনে পৌঁছলে মতিহার থানা পুলিশ তাদেরকে আটক করে। এরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রাত আড়াইটার দিকে পুলিশ গুলীবিদ্ধ অবস্থায় তিনজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার শাহাবুদ্দিনকে মৃত ঘোষণা করেন। একইদিন যশোরে পুলিশের গুলীতে নিহত হন শহিদুল ইসলাম নামে এক জামায়াত কর্মী। তবে পুলিশ বলেছে, শহিদুলকে আটকের পর তিনি পুলিশের গাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন বন্দুকযুদ্ধে শহিদ নিহত হন। এছাড়া এদিন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা ছাত্রশিবির সভাপতি সাহাব পাটওয়ারী (২৪) পুলিশের গুলীতে নিহত হয়েছেন। নিহতের মা ছাকিনা বেগমের দাবি, তার ছেলেকে ৫ ফেব্রুয়ারি সাদা পোশাকধারী পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। সকালে হাসপাতালে তার লাশ পাওয়া যায়।
৭ ফেব্রুয়ারি বাচ্চু নামে এক জামায়াত কর্মী ক্রসফায়ারে নিহত হন বলে জানা যায়। ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানায় জসিম উদ্দিন নামে এক শিবির নেতা পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। একই দিন কুমিল্লায় নিহত হন স্বপন মিয়া নামে এক বিএনপি নেতা। ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ির কাঠেরপুল এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় বিএনপি সমর্থক রাসেল সরদার। এদিন দাউদকান্দিতে ক্রসফায়ারে নিহত হন চৌদ্দগ্রামের বিএনপি নেতা সোহেল মিয়া।
১৩ ফেব্রুয়ারি মিরপুর থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নূরে আলমের গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয় গাজীপুর থেকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি বরগুনার আমতলীতে বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় মোজাম্মেল নামে এক বিএনপি সমর্থক। একইদিন সীতাকুন্ডে পুলিশের গুলীতে নিহত হন আরিফ নামে এক যুবদল নেতা। হাতকড়া পরানো অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার হয়।
১৫ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের রানীবন্দরে শিবিরনেতা মতিউর গুলীতে নিহত হন। একই দিন ময়মনসিংহে বিএনপি সমর্থক লিটন মিয়াকে গুলী করে হত্যা করে পুলিশ। এছাড়া মাগুরার শালিখা উপজেলার ছয়ঘরিয়ার মশিয়ার রহমান নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। তার শরীরে গুলীর চিহ্ন রয়েছে।
১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর বুড়িরঘরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শিবিরকর্মী মোস্তফা মঞ্জিল নিহত হন। তিনি গাইবান্ধার তুলসীঘাটে বাসে পেট্রোল বোমা হামলার আসামী। একইদিন ঝিনাইদহে র‌্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন রফিউল ইসলাম ওরফে রফি ওরফে তারেক নামে এক যুবক। ১৭ ফেব্রুয়ারি যশোরের মনিরামপুরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন বিএনপি নেতা আবু সাইদ ও বজলুর রহমান।
১৮ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে বিজিবির সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন হোসেন আহমদ নামে এক যুবক। একইদিন ১৮ ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন রফিকুল ইসলাম খোকন নামে এক ব্যক্তি।
১৯ ফেব্রুয়ারি লক্ষ্মীপুরের যুবদল নেতা মাঈন উদ্দিন ওরফে বাবলুর গুলীবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। অজ্ঞাত ব্যক্তিরা ডেকে নিয়ে যাওয়ার পরদিন তার গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর বরিশালের আগৈলঝাড়ায় পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন যুবদল নেতা কবির হোসেন মোল্লা ও তাঁতীদল নেতা টিপু হাওলাদার।
২২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন শ্রমিকদল নেতা আব্দুল ওদুদ। ওই দিন ঝিনাইদহে গুলীতে নিহত হন এক বিএনপি নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ছেলে পলাশ এবং বিএনপি কর্মী দুলাল। পরিবার বলেছে দুই দিন আগে তাদেরকে আটক করা হয়েছিল।
২৪ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন শাহীন নামে এক যুবক। পুলিশ বলেছে, শাহীনের নেতৃত্বে পুলিশের ওপর হামলার পর সেখানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শাহীন নিহত হন। একই দিন মাগুরায় নিহত হয়েছেন টাইগার দাউদ নামে এক যুবক। ২৬ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনে বন্দুকযুদ্ধে তিনজন নিহত হয়েছে। র‌্যাব জানিয়েছে, তারা বনদস্যু।
২৭ ফেব্রুয়ারি চিরিরবন্দরে পুলিশের গুলীতে নিহত হয়েছে যুবদল নেতা রেজওয়ানুল ইসলাম। জানা যায়, রেজওয়ানুলের বাবা স্থানীয় বিএনপি নেতা হাবিবকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এসময় হাবিবের স্ত্রী স্বামীকে রক্ষার জন্য গেলে পুলিশ তার ওপর নির্যাতন শুরু করে। তখন মায়ের ওপর নির্যাতনের ছেলে প্রতিবাদ করলে পুলিশ তার ওপর গুলী চালায়।
৮ মার্চ রাত ৩টায় মিঠাপুকুরের বলদী পুকুরে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি নাজমুল হুদা লাবলু নিহত হন। পুলিশের দাবি গাছকাটার সময় বাধা দিলে দুর্বৃত্তরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ও পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে। তখন পুলিশ পাল্টা গুলী চালালে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। পরে পুকুর থেকে তাকে গুলীবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে সে মারা যায়। তবে তার পিতা নুরুন্নবী শাহ গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, ‘ঘটনার দিন রাতে আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে পুলিশ নাটক সাজিয়েছে’।
১১ মার্চ যুবদল কর্মী আরিফ পঙ্গু হাসপাতালে নিহত হয়। লক্ষ্মীপুরের কমল নগরে ১ মার্চ রাতে বন্দুকযুদ্ধে সে আহত হয়। ১৬ মার্চ যশোর-মাগুরা সড়কে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ইউনুস আলী। সহকারী পুলিশ সুপার রেশমার দাবি সে ডাকাতি করছিল। পুলিশ গেলে গুলী ছোঁড়ে। পুলিশ তখন পাল্টা গুলী ছোঁড়ে। এতে ইউনুস মারা যায়।
১৯ মার্চ যশোর সদর উপজেলায় যুবদল নেতা ও ইউপি মেম্বার মেজবাহ উদ্দিন চন্টুর লাশ উদ্ধার করা হয়। তার পরিবারের অভিযোগ, পুলিশই তাকে হত্যা করে পরে রেললাইনে নিয়ে নাটক সাজায়। নিহত চন্টুর ভাই রুহুল কুদ্দুস মন্টু গণমাধ্যমে জানান, দুই দিন আগ থেকে তার ভাই পুলিশের হেফাজতে ছিলেন। তবে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা চন্টু নামে কাউকে আটকের কথা অস্বীকার করেন। ২১ মার্চ ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এক যুবক নিহত হয়। সে ডাকাত ছিলো বলে পুলিশের দাবি। ২২ মার্চ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ রাজধানীর শাহজাহানপুরে মোবারক হোসেন ওরফে মন্টি নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘অভিযোগ রয়েছে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের কথিত ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড অব্যাহত থাকায় দেশে আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।’ (তথ্য সূত্র : নয়াদিগন্ত- ১৯.০৪.২০১৫)
বলাবাহুল্য যে, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- নতুন না হলেও গত কয়েক বছরে তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সেই সাথে সন্দেহবশত গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনাও মাঝে মধ্যে ঘটছে। উভয় ক্ষেত্রেই আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে মারাত্মকভাবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ঘটছে বিচারবহির্ভূত হত্যা; আর উত্তেজিত বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা দিচ্ছে গণপিটুনি। দেশে আইনের শাসন থাকলে কেউ পিটিয়ে কিংবা ক্রসফায়ারে কাউকে হত্যা করা সম্ভব হতো না বলে আমরা মনে করি। বিশেষ করে আইনের রক্ষকেরা যখন ‘ভক্ষক’ হয়ে দাঁড়ান, তখন জাতি উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। তদুপরি, কথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে যাদের হতাহত ও পঙ্গু করা হচ্ছে, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই সরকারবিরোধী রাজনীতি সংশ্লিষ্ট এবং চলমান আন্দোলনে সক্রিয়। এতে এ ধারণাই প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে যে, ক্ষমতাসীন মহলের সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে এবং সরকারি বাহিনীকে ব্যবহার করে তাদের পরিকল্পিতভাবে ক্রসফায়ারে দেয়া হচ্ছে। আটকের পর প্রধানত পায়ে গুলী করার ঘটনা জনমনে এ ধারণাকে আরো জোরালো করছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-আতঙ্ক বাড়ছে।
আমরা আশা করি, ক্ষমতা নয়, বরং আইনের শাসনকে দৃঢ় ভিত্তি প্রদানে বিচারবহির্ভূত হত্যার লাগাম টেনে ধরে সরকার বাহাদুর সদয় হবেন। সংবিধান ও আইনকে সর্বার্ধ্বে স্থান দিয়ে বিচারিক পন্থায় সব অপরাধ ও অভিযোগের সুরাহা করাই দেশবাসীর কাম্য। তাছাড়া বন্দুকের নলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য অশনি সংকেতও বটে। মনে রাখা দরকার, ‘ভীতির রাজত্ব’ কখনো গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকারকে প্রতিফলিত করে না। বরং রাষ্ট্রের ক্ষতিই সাধন করে।
এম. কে. দোলন বিশ্বাস

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads