শনিবার, ২৩ মে, ২০১৫

সরকার গরিবের বন্ধু নয় বরং যেন গরিব মারার সরকার


সরকার মুখে বলে তারা  গরিব মানুষের সরকার । কিন্তু কার্যকলাপের দ্বারা তারা প্রমাণ করেছে যে তারা গরিব মারার সরকার। বড় লোকরা আজ যা দাবি করে কাল তারা সেই মোতাবেক কাজ করে। এইগুলো কোন কথার  কথা নয় । চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশের বড় লোকরা অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই দাবি করল যে ব্যাংকের লেন্ডিং রেট কমাতে হবে। অর্থাৎ তারা ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেয় সেই ঋণের সুদের হার  কমাতে হবে। এই সুদের হার  কমাতে হলে সরকার ও ব্যাংকের কাছে সাধারণ মানুষের যে আমানত থাকে সেই আমানতের সুদের হার কমাতে হবে। ব্যবসায়ীদের এই দাবির এক সপ্তাহের মধ্যেই সরকার বিভিন্ন প্রকার আমানতের সুদের হার কমিয়ে দেয়। 
এভাবে আবার সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর হামলা করা হয়েছে। দেখা যায়, স্থায়ী আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট বা এফডিআর) এবং সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রায়শই হামলা হয়। এতে সরকারের যে কি লাভ হয় সেটা বোধগম্য হয় না। যে দেশে ব্যাংকের অলস তারল্যের পরিমাণ ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, সেখানে সঞ্চয়পত্র বা এফডিআরের ২ শতাংশ সুদ কমিয়ে বিনিয়োগের কি এমন বেগবান স্রোত সৃষ্টি হয়? বরং ক্ষুদ্র সঞ্চয় উৎসাহিত করার পেছনে গরিব ও মধ্যবিত্তকে সাহায্য করার সরকারের যে বিঘোষিত লক্ষ্য সেটাকেই বার বার বানচাল করা হচ্ছে।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের এক ঘোষণা থেকে জানা যায় যে, সরকার ৫ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১৩.২৬ শতাংশ থেকে প্রায় ২ শতাংশ কমিয়ে ১১.১৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। তবে এ সম্পর্কে সরকারিভাবে এখনও কোনো গেজেট নোটিফিকেশন বা প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। অর্থমন্ত্রী বলেন, সুদের হার বেশি হওয়ায় সঞ্চয়পত্র বিক্রির হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এটা চলতে থাকলে এ খাতে বিনিয়োগ আরো বেড়ে যাবে। সরকারের ভবিষ্যৎ ঋণের বোঝাও বেড়ে যাবে। অর্থ মন্ত্রী বলেন, সে কারণেই আমরা এটাকে কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর আগে আমরা সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়িয়েছিলাম। সেটা আর রাখা সম্ভব হলো না।
৫ বছর  মেয়াদী পরিবার সঞ্চয়পত্রে সুদ বা মুনাফা ছিল ১৩.৪৫%। পেনশনার সঞ্চপত্রে ১৩.১৯ শতাংশ। বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ১৩.১৯ শতাংশ। ৩ বছর মেয়াদী তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের ১২.৫৯ শতাংশ সুদ দেয়া হতো। আর তিন বছর মেয়াদী ডাকঘর সঞ্চয়পত্র এবং ব্যাংক মেয়াদী সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ছিল ১৩.২৪%।
চলতি অর্থ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে পরিবার সঞ্চয়পত্র। আটমাসে এর নিট বিক্রি দাঁড়ায় ৮ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। এরপর পর্যায়ক্রমে বিক্রির শীর্ষে ছিল তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ৫ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা, ৫ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্র ১ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। পোস্ট অফিসের মেয়াদী সঞ্চয়পত্র ১ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা এবং ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড ২৫৯ কোটি টাকা।
যেহেতু এখন পর্যন্ত গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশিত হয়নি তাই সরকারি সিদ্ধান্তের বিস্তারিত জানা যায়নি। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে আরো কিছু অস্পষ্টতা আছে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ছয় প্রকার সঞ্চয়পত্র আছে। কোনগুলোর সুদ হ্রাস করা হলো আর কোনগুলোর করা হলো না সেটি পরিষ্কার নয়। সংবাদে বলা হয়েছে যে ৫ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো (অর্থমন্ত্রীর ভাষায় রিভিউ) হয়েছে। এ ছাড়া ২ বৎসর এবং ১ বৎসর মেয়াদী সঞ্চয়পত্র রয়েছে। সেগুলোর সুদের হার কমলো কি না বলা হয়নি।
মৎস্য চাষ, মুরগির খামার, বীজ উৎপাদন, গরুর খামার, মাশরুম চাষ প্রভৃতির আয় থেকে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে। তবে এই আয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আয়করের ডেপুটি কমিশনারের নিকট থেকে প্রত্যয়নপত্র আনতে হবে। এটি চালু হয়েছে ১৯৯৭ সালে। ২০০৯ সালে যে পরিবার সঞ্চয়পত্র চালু হয় সেটির ৫ বছর মেয়াদী সুদ ছিল ১৩.৪৫ শতাংশ। এটির সর্বোচ্চ সীমা ছিল ৪৫ লাখ। ৩ মাস পরপর মুনাফা তোলা যাবে যেমন ৩ বছর মেয়াদী পরিবার সঞ্চয়পত্র চালু হয় ১৯৯৮ সালে। এর সর্বোচ্চ সুদ হলো ১২.৫৯ শতাংশ। ৫ বছর মেয়াদী ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদ ১২.২০ শতাংশ। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য চালু হয় পেনশনার সঞ্চয়পত্র। এটি কেনার শর্ত হল (১) ক্রেতাকে সরকারি, আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী হতে হবে (২) তার চাকরি জীবন অন্তত ২০ বছরের হতে হবে। (৩) যেকোনো অবসরভোগী যিনি ৫৫ বছরে পৌঁছেছেন (৪) এই ক্যাটাগরিতে পেনশনারের মৃত্যু হলে তার স্বামী-স্ত্রী/সন্তান-সন্ততিরা কিনতে পারবেন। এক্ষেত্রে বয়সের কোনো সীমারেখা  নেই। ৫ বছর মেয়াদী মুনাফা ১৩.১৯%।
ওপরের এই আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বিগত ১৭ বছর ধরে সঞ্চয় পত্রের কার্যক্রম চলে আসছে। বিএনপি-আওয়ামী লীগ নির্বিশেষে প্রতিটি সরকারই বলে এসেছে যে নি¤œবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের রিলিফ দেয়ার জন্যই এই স্কিমটি চালু করা হয়েছে এবং আজও চলছে। দেশের গরিব এবং মধ্যবিত্তের জন্য সরকারকে যদি দুই-চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিতে হয় তাহলে সেটা কি বিরাট বোঝা হতে পারে? বিশেষ করে আগামী জুলাই থেকে যে দেশের বাজেট ৩ লাখ কোটি টাকা হতে যাচ্ছে? যেখানে এক লাখ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে?
অর্থমন্ত্রী বলছেন, ঋণের বোঝা বেড়ে যাবে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের সভায় অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বলা হচ্ছে ভিন্ন কথা। ওরা বলেছিলেন যে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে উচ্চহারে সুদ দিতে হয়। সেই সুদের হার কমানোর জন্যই সঞ্চয়পত্র শুধু না, স্থায়ী আমানতের সুদের হারও কমাতে হবে। এফডিআর বা স্থায়ী আমানতের সুদের হার তো ইতোমধ্যেই ৪ থেকে ৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। অতীতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হয়েছিল। তার ফলে বেসরকারি খাতে কি বিনিয়োগ বেড়েছে? সরকার একটি তথ্য দিয়ে প্রমাণ করুক যে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি হওয়াটাই সব অনিষ্টের মূল। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, সরকার এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হবে না। বরং ড. জায়েদ বখতসহ একাধিক অর্থনীতিবিদ বলেছেন যে, এফ ডি আরের ঋণ অসম্ভব হ্রাস এবং শেয়ার বাজার অলাভজনক হওয়ায় সঞ্চয় পত্রের পালে হাওয়া লেগেছে। এটিই যদি কারণ হয়ে থকে তাহলে তার জন্য দায়ী হলো সরকারের ত্রুটিপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তাদের অর্থনৈতিক ভাষ্যে এবং কলামে মন্তব্য করেছে যে হঠাৎ করে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার দুই শতাংশ কমানোর ঘোষণায় বিপাকে পড়েছেন অবসর জীবন-যাপন করা হাজার হাজার মানুষ । সঞ্চয়ের লভ্যাংশে সংসার পরিচালনাকারী  ছাড়াও মধ্যবিত্ত  শ্রেণীর একটি বড় অংশ বিপাকে পড়ে যাবে। নির্ধারিত  আয়ের এই মানুষগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে  এমনিতেই হিমশিম  খাচ্ছে । সঞ্চয়পত্রের সুদের  ওপরই নির্ভর করছে যাদের জীবন। হঠাৎ করে সুদ কমে যাওয়ায়  তারা পড়েছেন হতাশায়। কারণ, জীবনের পড়ন্ত  বেলায় সংসার  চালানোর বিকল্প কোন  অবলম্বন নেই ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, এ সিদ্ধান্ত যুক্তিসঙ্গত ও বিবেচনাপ্রসূত হয়নি। এর ফলে  সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত  হওয়ার পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগেও  নিরুৎসাহিত হবেন। এমন কি এর মাধ্যমে তারা তাদের বর্তমান পুঁজিটাও হারাবে বলে মনে করেন তিনি।
এক প্রাক বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মহিত সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোর  ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ, সুদের হার কমিয়ে দেয়া এবং  মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ কর ধার্য করার কথা জানান । আর এতে বিপাকে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে তাদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। অনেকে আবার সঞ্চয়পত্র থেকে বিনিয়োগ তুলে নিয়ে অন্য খাতে বিনিয়োগের চিন্তা করছেন। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে গেলে সরকারের অর্থের জোগানে ঘাটতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।  এছাড়া দ্রব্যমূল্যের বাড়তি চাপ মোকাবিলায় তাদের অনেক সময় অন্যের ওপর নির্ভর করতে হতো অথবা নানাভাবে তাদের সমন্বয় করে চলতে হচ্ছিল। হঠাৎ  অর্থমন্ত্রীর এই ঘোষণা তাদেরকে ক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্ত করেছে বলে জানা গেছে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেজ্ঞরা মনে করেন যে, এতে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাবের পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সুদের হার কমানোর ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবে। তারা বলেন, শেয়ারবাজারের  মতো বিনিয়োগের অন্যান্য উপায়গুলোতে মানুষ আর ভরসা পাচ্ছে না। ফলে সাধারন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জানা যায় এ খাতে বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগই হচ্ছেন পেনশনভোগী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী । নিরাপদ  বিনিয়োগ  হিসেবে এতদিন তারা বাজারে থাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতেন। ভুক্তভোগীরা বলেন, সরকার বিনিয়োগকারীদের কথা চিন্তা  না করে আমলাদের  পরামর্শে  এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যার ফল ভোগ করছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষ। তারা বলছেন, সঞ্চয় পত্রে নিরাপদ বিনিয়োগ করে পরিবার চালানোসহ ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালানো যেত। এখন সেটা অনেকটা হুমকির মুখে পড়বে।
ওপরে এতক্ষণ ধরে  যা কিছু বলা হল সেটা শুধু আমাদের কথা নয়। দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যাংকার এবং অর্থনীতিবিদরাও একই ধরনের মতামত প্রকাশ  করেছেন।
এফবিসিসিআই এর নির্বাচনে তিনটি প্যানেলের প্রত্যেকটির ওয়াদা ছিল এই  যে নির্বাচিত হলে ব্যাংকের লেন্ডিং রেট তথা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের  সুদ তারা কমিয়ে দেবেন। গত বৃহস্পতিবার একটি প্যানেলের নেতা ঘোষণা করেছেন যে নির্বাচিত হলে তারা ব্যাংকের লেন্ডিং রেট অন্তত ৯ শতাংশ নামিয়ে আনবেন। মন্ত্রীর  এই বক্তব্য যদি সঠিক হয় তাহলে আমানতের সুদের হার ৯% এর নিচে হবে। লেন্ডিং রেটের সুদের হার এবং আমানতের সুদের হারের মধ্যে কম করে হলেও নাকি ৪ শতাংশ হতে হয় । এটিকে ব্যাংকের পরিভাষায় বলে Spread (স্প্রেড)। সেক্ষেত্রে আমানতের সুদের হারকে উর্ধ্বে ঠেললেও ৫ শতাংশের উপর যাবে না।
 সরকার কি সেই পথেই অগ্রসর হচ্ছে? তাহলে আর এ সরকার গরিবের বন্ধু হয় কিভাবে? আসলে এই সরকার গরিবের বন্ধু নয়, বড় লোকের বন্ধু ।
আসিফ আরসালান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads