রবিবার, ৩ মে, ২০১৫

নির্বাচন, খন্দকার মোশতাক, লাঠি ও গাজর


সদ্য-সমাপ্ত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের ‘বিজয়’ না ‘বিদায়’ হয়েছে, সে প্রসঙ্গে দেশে-বিদেশে তুমুল বিতর্ক চলছে। প্রবল সন্ত্রাসের মুখে নির্বাচনের দিনটিতে কয়েক ঘণ্টাও টিকে থাকতে পারেনি বিরোধী পক্ষের প্রার্থী ও এজেন্টরা। সাধারণ জনগণকেও কেন্দ্রে আসার সুযোগ দেওয়া হয়নি। দেশীয় মিডিয়া আর বিদেশী পর্যবেক্ষণে ব্যাপক কারচুপি ও জালিয়াতি স্পষ্ট। ভোট নিয়ে একটি পত্রিকার শিরোনাম: ‘ডিজিটাল যুগে এনালগ কারচুপি’। বন্ধু রাষ্ট্রের দূতগণও সরেজমিন পর্যবেক্ষণের পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ভোট বাতিল ও তদন্তের দাবি করেছেন প্রায়-সকলেই; কেবল সরকার ও তার বশংবদগণ নির্বাচনী-সন্ত্রাস-পরবর্তী উল্লাসে লিপ্ত।
আওয়ামী নির্বাচনের ব্যাপারে যারা অভিজ্ঞ, তারা জানেন, এ দলের অধীনে নির্বাচনের রূপ-চরিত্র এমনই কুৎসিত। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে যে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিয়েছিল, তাতে স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ নির্বাচনী সন্ত্রাস করা হয়েছিল। বহু প্রার্থীকে কিডন্যাপ করা হয়; অনেককে প্রার্থীতা প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়; ভোটকেন্দ্রগুলো দখল করে আওয়ামী প্রার্থীদের বিজয়ী করা হয়। ৩০০ আসনের জাতীয় সংসদে মাত্র ৭ জন বিরোধী দলের প্রার্থী বিজয়ী হতে সক্ষম হন। সন্ত্রাস ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে স্বচ্ছ, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক আওয়ামী নির্বাচনের ফলে দেশ, জনগণ এবং খোদ আওয়ামী লীগই ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশ ও জনগণ গণতন্ত্রের পতনের শিকার হয়ে একদলীয় বাকশালী স্বৈরশাসনের নিগড়ে আবদ্ধ হয়। আর আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় নির্বাচনে সন্ত্রাস ও বলপ্রয়োগের  মাধ্যমে শেখ মুজিবের হত্যাকারীর উত্থান ঘটিয়ে। কারণ সুষ্ঠু নির্বাচন হলে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে খন্দকার মোশতাক কখনোই বিজয়ী হতেন না। সেখানে বিজয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন জাসদের ইঞ্জিনিয়ার আদুর রশীদ। প্রচ-ভাবে সন্ত্রাস, সহিংসতা করে এবং প্রশাসন ও ক্যাডারদের লেলিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ কি রকম নিলর্জ্জভাবে খন্দকার মোশতাককে বিজয়ী করেছিল, সে ইতিহাস অতি ন্যাক্কারজনক ও নিন্দিত। অতএব, জবরদস্তিমূলক নির্বাচনে গণরায়কে লুট করে বিজয়ানন্দ করার আগের অতীতের কথাও কথিত বিজয়ীদের ভাবা দরকার।
২.
আওয়ামী আমলের নির্বাচনী বিপর্যয়ের হাত ধরে পরবর্তী সামরিকতন্ত্রীরা বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার পবিত্রতা পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেয়। হোন্ডা আর গু-া দিয়ে ভোটকেন্দ্র দখলের উৎসব শুরু হয়। গণরায় একেবারেই ভূলুণ্ঠিত হয়। কতিপয় পদলেহীকে ক্ষমতা দখলকারীরা সংসদে আসার সুযোগ দেয়। প্রকৃত জনপ্রতিনিধি ও জনসমর্থিত ব্যক্তিগণের পক্ষে নির্বাচনের সঠিক রায় পাওয়ার কোনোই সুযোগ রাখা হয়নি। এমনই অবনতিশীল পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে সঠিক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির রূপরেখার প্রস্তাব করে জামায়াতে ইসলামী। কারণ, অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন বাংলাদেশে করা সম্ভব হয় না। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে একদা আওয়ামী লীগ ও জামায়াত পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করেছে। বর্তমানে জামায়াত ও বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতের এই আন্দোলন যে কতোটা যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয়, সদ্য-সমাপ্ত সিটি নির্বাচনের ঘটনাবলি সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল। আজ বাংলাদেশ ও বিশ্বের সবাই একবাক্যে স্বীকার করছেন, দলীয় সরকার ও দল-অনুগত নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রহসনের নির্বাচনই সম্ভব। নির্বাচনে জনরায়ের প্রকৃত প্রতিফলনের জন্য দরকার তত্ত্বাধায়ক সরকার ব্যবস্থা।
৩.
যদিও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত বিএনপি নির্বাচনে যোগ দেয় এবং ভোটের দিন দুপুরের আগেই নির্বাচন বয়কট করে । সারাদিন বিএনপি’র পক্ষে আর কোনো বক্তব্য আসে নি। মূলত যে সত্যটি বিএনপি উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে, তা হলো আওয়ামী লীগের অধীনে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ভোট সম্ভব নয়। জামায়াতে ইসলামী আগাগোড়াই এ সরকারের অধীনে প্রকৃত নির্বাচন অসম্ভব বলে মত দিয়েছে এবং এ নির্বাচনের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি। এতে অবশ্য সরকারের কোনো মাথা ব্যথা হয়নি। তারা অতীতের মতোই বিকারহীনভাবে বিতর্কিত নির্বাচনের কথিত বিজয়ীদের নিয়ে আনন্দ-উল্লাস করছে এবং ক্ষমতাকে আরো পাকাপোক্ত করার নানা প্রকাশ্য ও গোপন পরিকল্পনায় ব্যস্ত হয়েছে। নির্বাচনের আগে ও পরে আওয়ামী কার্যক্রমের দ্বারা এই বার্তাই দেওয়া হয়েছে, “দেখি, কে আমাদের ক্ষমতা থেকে হটায়!” ভোটার বিহীন বিগত সংসদ নির্বাচনের মতোই তারা এবারের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে নিয়েও উৎফুল্ল। এটাই তাদের ভাষায় ‘গণতন্ত্রের বিজয়’।
৪.
প্রত্যুত্তরে বিরোধী দলের পক্ষে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের নির্বাসন’ হয়েছে। গণতন্ত্রের নির্বাসন বা বিদায়, যা-ই হোক না কেন, বিরোধী দল একটি চরম শিক্ষা লাভ করেছে। তা হলো, আন্দোলন ছাড়া এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির কোনো পথ খোলা নেই। সমঝোতা বা এক সাথে কাজ করার কোনো সুযোগ বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাখা হয়নি। দিন যতই যাবে, কোণঠাসা পরিস্থিতি আরো জোরালো হবে এবং শেষ পর্যন্ত দমবন্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, তারা সেটা আঁচ করতে পারছেন। হামলা, মামলা অক্টোপাশের মতো ঘিরে আসছে। টার্গেট করে নেতৃবৃন্দকে ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছে। যারা আন্দোলনে সাচ্চা, আদর্শে অটল এবং আপোস বা দালালিতে নারাজী, তাদেরকে রেহাই দেওয়া হচ্ছে না। বাস্তব সত্য ও দালিলিক প্রমাণ বলছে, আঘাত এসেছে সবচেয়ে বেশি জামায়াত ও শিবিরের বিরুদ্ধে। আর চলছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে চরম ষড়যন্ত্রমূলক আক্রমণ। ইসলামী আদর্শ, সংগঠন, নেতৃত্ব চরম আঘাত ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। প্রতিপক্ষের ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ সাহসিকতার সঙ্গে রুখে দেওয়ার জন্য জান-মাল বাজি রেখে ইসলামপ্রিয় জনতাও আন্দোলন-মুখর।
৫.
আন্দোলনের চলমান ধারায় সিটি নির্বাচন তাহলে কেন এসেছিল? এসেছিল ইংরেজি ‘স্টিক অ্যান্ড ক্যারেট’ থিওরি অনুসারে। বাংলায় এটাকে বলা হয় ‘লাঠি ও গাজর তত্ত্ব’। একদিকে লাঠি দিয়ে ভয় দেখাবে আর আরেক দিকে গাজরের লোভ দেখিয়ে আয় আয় বলে ডাকবে। কাছে এলে গাজর সরিয়ে লুকানো লাঠি দিয়ে মাথায় আঘাত করবে। বশ মানানোর জন্য বা শায়েস্তা করার জন্য ইংরেজরা ‘লাঠি ও গাজর তত্ত্ব’/ ‘স্টিক অ্যান্ড ক্যারেট’ থিওরি প্রয়োগ করে থাকে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে (সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে) সম্ভবত এ তত্ত্বটিই সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে দ্বিবিধ লাভ পাওয়া গেলো। বিরোধীদের আন্দোলন থেকে সরিয়ে আনা হল এবং তাদেরকে গাজর দেখিয়ে ডেকে এনে আচ্ছামতো আঘাতও করা সম্ভব হলো। প্রতিক্রিয়ায় আঘাতপ্রাপ্ত এবং রাজনৈতিক কৌশলের কাছে বিপর্যস্ত বিরোধীরা কি প্রতিকৌশল প্রয়োগ করে, এখন সেটাই দেখার বিষয়।
৬.
একচ্ছত্র ক্ষমতাসীন সরকারি দল এবং তাদের একতরফা উল্লাস ও দলীয়করণ গণতন্ত্রের বহুদলীয় শাসনের পরিপন্থী। বিরোধী দলহীন গণতন্ত্র দুর্বল এবং একদলেরই নামান্তর। গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে বলে যারা সুখের ঢেকুর তুলছেন, তারা এই গুপ্তক্ষতটি দেখছেন না। দুর্বল ও একদল-মার্কা গণতন্ত্র নানাবিধ বিপদ ডেকে আনবে। শাসনের ক্ষেত্রে দেশে ও বাইরে আস্থার সঙ্কট ঘটাবে এবং নানারূপ ঝুঁকির সৃষ্টি করবে। সবচেয়ে বড়ো ঝুঁকি হলো, ভোটের নামে গায়ের জোরের একতরফা ক্ষমতাপ্রাপ্তদের মধ্যেকার আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও লড়াই। বিরোধী দলের পক্ষে এই মুহূর্তে বিপদের কারণ নেই, সেটা টের পেয়ে এখন তারা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত হবেই। পঁচাত্তর-পূর্ব আওয়ামী লীগে সেটাই হয়েছিল। যুবলীগ, ছাত্রলীগেও সেটাই দেখা গিয়েছিল এবং এখন আবার সেটাই দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংঘাত-সংঘর্ষের যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো আভ্যন্তরীন। যেমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে ছাত্রলীগের হাতে মারা যাচ্ছে ছাত্রলীগ। প্রতিদিন এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে আক্রমণ করছে। এদের সামলাতে খোদ নেতারাই নাকাল। যারা জোর খাটিয়ে নেতা বানায় বা যাদের জোরে নেতা তৈরি হয়, তারাই বা কতদিন বানানো নেতাকে মানবে? অবস্থা এখন সেই দিকেই যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, চেপে রাখলেও শীর্ষ পর্যায়ের নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাত-মনোমালিন্যের কথা মিডিয়ায় মাঝে মাঝেই চলে আসছে। মেয়র বা কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন চেয়েও পায়নি, এমন অসংখ্য নেতা-কর্মীর অসন্তোষ কেমনে মেটানো হবে? সব মিলিয়ে শুধু বিরোধী দলের দিক থেকেই নয়; নিজের ভেতর থেকে সুপ্ত চাপের মুখে ক্ষমতাসীনরা। জোরপূর্বক সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আপাত বিজয় হলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বস্তি প্রতিষ্ঠা করা  তাই এখনো অনেক দূরের বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads