রবিবার, ১০ মে, ২০১৫

রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও হিংসার রাজনীতি


১.
ষাটের দশকের গোড়ার দিকে  আততায়ীর গুলীতে নিহত হলেন মার্কিন  প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। তখন গোটা বিশ্ব মুহ্যমান হয়ে গিয়েছিল। সেই হত্যাকান্ড নিয়ে বই লিখলেন উইলিয়াম ম্যাঞ্চেস্টার। বইটির শিরোনাম ছিল ‘ডেথ অফ অ্যা প্রেসিডেন্ট’ আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বইটির অনুবাদ প্রকাশ পেতে থাকল বিশ্বের প্রায় সকল দেশের সংবাদপত্র এবং সাময়িকীসমূহে।
যখন মার্টিন লুথার, ম্যালকম এবং বাদশাহ ফয়সাল আততায়ীর হাতে মারা যান, নড়ে ওঠেছিল সারা দুনিয়া। বিগত বিংশ শতাব্দীতে চাঞ্চল্যকর বহু রাজনৈতিক হত্যাকান্ড হয়েছে এবং হিংসার রাজনীতিও বিকাশ লাভ করেছে। যার রক্তাক্ত ধারাবাহিকতা এখনো চলছেই।  গবেষণায় প্রকাশিত হত্যাকান্ডের তালিকাটি দিলেই অনুধাবন করা যায়, কতো রক্তপাত হয়েছে রাজনীতির নামে ক্ষমতার শীর্ষ মহলে। আব্রাহাম লিংকন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট ১৫ এপ্রিল ১৮৬৫, জেমস এ গারফিল্ড যুক্তরাষ্ট্রের ২০তম প্রেসিডেন্ট ২৯ সেপ্টেম্বর ১৮৮১, ম্যাককিনলি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ০৬ সেপ্টেম্বর ১৯০১, ফ্রান্সিস ফার্ডিন্যান্ড অষ্ট্রিয়ার যুবরাজ ২৮ জুন ১৯১৪, নিকোলাস দ্বিতীয় রাশিয়ার জার সম্রাট ১৬ জুলাই ১৯১৮, লিওন ট্রটস্কি রুশ বিপ্লবের নায়ক ও যুদ্ধমন্ত্রী ২০ আগস্ট ১৯৪০, মহাত্মা গান্ধী ভারতের স্বাধিকার আন্দোলনের নেতা ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮, ফক বার্নাডেট জেরুজালেমে জাতিসংঘের সুইডিস সমন্বয়কারী ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮, হোসনী জাইম সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আগস্ট, ১৯৪৯, আব্দুল ইবনে হুসেন জর্ডানের বাদশা ২০ জুলাই ১৯৫১, লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ১৬ অক্টোবর ১৯৫১, বাদশা ফয়সাল ইরাকের বাদশা ১৪ জুলাই, ১৯৫৮, সলোমান বন্দরনায়েক শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯, প্যাট্রিক লুবুম্বা কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী ১৭ নবেম্বর ১৯৬১, রাফায়েল ট্রুজিলো ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের নায়ক ৩০ মে ১৯৬১, আব্দুল করিম কাসেম ইরাকের প্রধানমন্ত্রী ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩, নগো দিন দায়েম ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট ১২ নবেম্বর ১৯৬৩, জন এফ কেনেডী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ২২ নবেম্বর, ১৯৬৩, জিগমে দোরজী ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ৫ এপ্রিল ১৯৬৪, হাসান আলী মনসুর ইরানের প্রধানমন্ত্রী ২১ জানুয়ারি ১৯৬৫, আবুবকর তাফাওয়া নাইজেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬, আবদুল্লাহ জর্ডানের সুলতান ২০ জুলাই ১৯৬৬, এইচ এফ ভারওয়ার্ড দঃ আফ্রিকার প্রধানমন্ত্রী ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬, মার্টিন লুথার কিং মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনের নেতা ০৪ এপ্রিল ১৯৬৮, রবার্ট এফ কেনেডী মার্কিন সিনেটর ও এটর্নি জেনারেল ০৫ জুন, ১৯৬৮, শের মার্ক সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট ১৫ অক্টোবর, ১৯৬৯, টম মুবয়া নাইরোরির মন্ত্রী ০৬ জুলাই ১৯৬৯, ওয়াশকিতাল জর্ডানের প্রধানমন্ত্রী ২৮ নবেম্বর, ১৯৭১, লুইস কারেরাব্যালানকো স্প্যানিশ প্রধানমন্ত্রী ২০ ডিসেম্বর, ১৯৭৩,বাদশা ফয়সাল সৌদি আরবের বাদশা ২৫ মার্চ ১৯৭৫, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, জেনারেল মুর্তালা মুহম্মদ নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬,ওরল্যান্ড লেটেরিয়ার চিলির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬, ইব্রাহিম আল হামদী ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট অক্টোবর, ১৯৭৭, কামাল জুমলাত মধ্য লেবাননের দ্রুজ নেতা ১৬ মার্চ, ১৯৭৭, মুহম্মদ দাউদ আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ২৭ এপ্রিল, ১৯৭৮, লর্ড মাউন্টব্যাটেন বৃটিশ ভারতের শেষ বড় লাট ও স্বাধীন ভারতের ১ম গবর্নর জেনারেল ২৭ আগস্ট, ১৯৭৯, পার্ক চুংহি দঃ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ২৭ অক্টোবর, ১৯৭৯, আনাসচমমিও সামেজা নিকারাগুয়ার সাবেক একনায়ক ১৯৮০, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ৩০ মে ১৯৮১, মোহাম্মদ আলী রাজাই ইরানের প্রেসিডেন্ট ৩০ আগস্ট, ১৯৮১, মোহাম্মদ জাভেদ বাহোনার ইরানের প্রধানমন্ত্রী ৩০ আগস্ট, ১৯৮১, আনোয়ার সাদাত মিসরের প্রেসিডেন্ট ৬ অক্টোবর, ১৯৮১, বশির জাময়েল লেবাননের প্রেসিডেন্ট ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৮১, বেনগুইনো একুইনো ফিলিপাইনের বিরোধী দলের নেতা ১৯৮৩, ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪, ওলফ পালমে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬, রশীদ কারামী লেবাননের প্রধানমন্ত্রী ১ জুন, ১৯৮৭, আবু জিহাদ প্যালেস্টাইনি কমান্ডো প্রধান ১৯৮৮, জিয়াউল হক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ১৯৮৮, লুইস কার্লোস কলাম্বিায়ার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ১৯৮৯, রেনে মুয়াদ লেবাননের প্রেসিডেন্ট ১৯৮৯, আহম্মেদ আব্দুল্লাহ কমোরভোর প্রেসিডেন্ট ১৯৮৯, রিফাত মাহজিন মিসরের স্পিকার ১৯৯০, ভ্যানিচামন লেবাননের খ্রিষ্টান রাজনৈতিক নেতা ১৯৯০, রাজিব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ২১ মে, ১৯৯১, আবু ইয়াদ ফিলিন্তিনী নেতা ১৯৯১, মোহাম্দ বোদিয়াফ আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ২৯ জুন ১৯৯২, ললিত আতুলাথ মুদালী শ্রীলঙ্কার বিরোধী দলের নেতা ১ মে, ১৯৯৩, রানাসিঙ্গে প্রেমাদাসা শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি ১ মে, ১৯৯৩, হ্যাবাইয়া বিমানা রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট ৭ এপ্রিল, ১৯৯৪, এন্টারাইয়াসিয়া বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট ৭ এপ্রিল, ১৯৯৪, যামিনী দেশানায়েক শ্রীলঙ্কার বিরোধী দলের নেতা অক্টোবর, ১৯৯৪, আইজ্যাক রবিন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ৫ নবেম্বর ১৯৯৫, নজিবুল্লাহ আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, ইব্রাহিম বারি নাইজারের প্রেসিডেন্ট ৯ এপ্রিল, ১৯৯৮, লই মারিয়া আগ্রাসিয়া প্যারাগুয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট ২ মার্চ ১৯৯৯, ভাজাগেন সার্কিসিয়ান আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ২৭ অক্টোবর ১৯৯৯, সিভি গুনরত শ্রীলঙ্কার শিল্পমন্ত্রী ৭ জুন ২০০০, বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহদেব নেপালের রাজা ১ জুন ২০০১, বেহাভান জিভি ইসরায়েলের পর্যটনমন্ত্রী ১৭ অক্টোবর ২০০১, হাজি আব্দুল কাদির আফগান ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পূর্তমন্ত্রী ২৬ জুলাই ২০০২, শেখ ইয়াসিন আহমেদ হামাসের প্রতিষ্ঠাতা ও আধ্যাতিক নেতা ২২ মার্চ, ২০০৪, আবদেল আজিজ রানতিসি হামাসের প্রধান ১৭ এপ্রিল, ২০০৪, রফিক হারিরি লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০০৫, বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ২৭ ডিসেম্বর ২০০৭ প্রমুখ।
২.
রাজনীতির পরিসমাপ্তিহীন সংঘাত যখন যুদ্ধ ডেকে আনে, তখনো হয়েছে ভয়াবহ রক্তপাত। শতবর্ষ আগের ১ম বিশ্বযুদ্ধের তথ্য দিয়ে বলা যায়, রক্তের ধারা কেবল রক্তই বাড়িয়েছে। ১৯১৪-১৯১৮ সালের মধ্যে মানুষের ওপর মানুষের নজিরহীন নিষ্ঠুরতা আর সৃষ্টিবিনাশী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ অকল্পনীয় বিষয়। সঠিক হিসাব অনুযায়ী যুদ্ধটি চলেছিল চার বছর তিন মাস। যুদ্ধ-প্রয়াসে লিপ্ত ছিল তিরিশটি দেশের শত শত রাজনীতিবিদ ও জেনারেল। পরিসমাপ্তি ঘটেছিল চারটি বহুজাতিক সা¤্রাজ্যের। অভ্যুদয় হয়েছিল সাতটি নতুন রাষ্ট্রের। ৮.৫ মিলিয়ন সামরিক এবং ১০ মিলিয়ন বেসামরিক মানুষের প্রাণের বিনাশ হয়েছিল। প্রত্যয় ব্যয় ছিল ১৮০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পরোক্ষ ব্যয় হয়েছিল ১৫১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
হিরোশিমা আর নাগাসাকির আণবিক বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এসেছিল আরো ভয়াবহরূপে। ক্ষয়-ক্ষতির পরিণামও প্রথমটির চেয়ে দ্বিগুণ। আর এখন বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে, ইরাকে, আফগানিস্তানে, ফিলিস্তিনে, ভিয়েতনামে, আফ্রিকায় থেমে থেমে যে যুদ্ধ চলছে, তার ক্ষতি কয়েকটি বিশ্বযুদ্ধের সমান।
৩.
এতো কিছুর পরেও কি রাজনৈতিক হত্যাকান্ড আর হিংসা কমেছে ? না। বরং বেড়েছে। নতুন নতুন নামে বাড়ছেই হত্যার পরিধি। যেমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড। এটি হলো কপ্রকার বেআইনী হত্যাকা- যা সাধারণত রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, সামাজিক ব্যক্তিত্ব বা অপরাধীকে রাষ্ট্রপ্রদত্ত আইনত বিচারের পূর্বেই হত্যা করা হয়। এটি সাধারণত সরকার, প্রাদেশিক সরকারের মাধ্যমে, যেমন: পুলিশ বা সশস্ত্র বাহিনী, অথবা বিভিন্ন অপরাধী সংগঠন, যেমন: ইতালীয় মাফিয়ার মাধ্যমে হয়। উইকিপিডিয়ার হিসাব অনুযায়ী, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড এবং ডেথ স্কোয়াড (death squads) সবচেয়ে বেশি দেখা যায় মধ্যপ্রাচ্যে, মধ্য আমেরিকা, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত (জম্মু ও কাশ্মীরসহ অন্যান্য রাজ্য), আফ্রিকায়, জ্যামাইকায়, কসোভোয়, দক্ষিণ আমেরিকার বেশকিছু অংশ, চেচনিয়ায়, রাশিয়ায়, উজবেকিস্তান, উত্তর ওশেনিয়ায়, থাইল্যান্ডের কিছু অংশে এবং ফিলিপাইনে। লক্ষণীয়, তালিকায় বাংলাদেশের নামটিও রয়েছে।
৪.
বাংলাদেশে প্রায়-সকল ঘটনার মতোই মৃত্যুতেও রাজনীতির গন্ধ পাওয়া যায়। সেটা প্রেসিডেন্ট, নাসিরউদ্দিন পিন্টু বা সাধারণ নাগরিক, যে কেউই হতে পারেন। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও হিংসার অভিযোগ ওঠে প্রায়শই। বিভিন্ন ধরনের বিচারের পেছনে রাজনৈতিক অভিযোগের বহর লক্ষ্য করা যায় পত্রিকার পাতা খুললেই। বলা হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও হিংসাই হত্যা বা বিচারের প্রধান কারণ। ন্যায় ও আইনের বদলে রাজনৈতিক স্বার্থচিন্তাই যদি প্রধান বিষয় হয়, তাহলে স্বচ্ছতা থাকে না। হিংসাই যদি মূল উদ্দেশ্য হয় তবে ন্যায়বিচারের বারোটা বাজতে বাধ্য। পুরো ঘটনাপ্রবাহই তাহলে রাজনৈতিক হিংসার স্রোতে আবর্তিত ও পঙ্কিল হতে থাকবে। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন আবিল হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শতবর্ষের অভিজ্ঞতায় ইউরোপ যথেষ্ট সতর্ক হয়ে নিজের ভূখন্ডে রাজনৈতিক হত্যা ও হিংসা কমিয়ে দিয়েছে এবং এগুলোকে চাপিয়ে দিচ্ছে এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যে। আমরা যদি বিশ্বের ভয়াবহ যুদ্ধ আর হিংসার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সাবধান না হই, তাহলে হিংসার চক্করে জর্জরিত হবোই। হিংসা থেকে বাড়বে প্রতিহিংসা এবং আসবে বিনাশ। শান্তিকামী একটি দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে এমন হিংসা, প্রতিহিংসা ও বিনাশের চ-নীতি এবং ক্ষতিকর ধারা কখনোই কাম্য হতে পারে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads