বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০১৫

সংলাপকে ভয় করছে সরকার


উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী করার জন্য সরকারের নিরলস প্রচেষ্টার প্রশংসায় বিশ্ব পঞ্চমুখ-এ মর্মে আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পাচ্ছেন, দেশে কোন সংকট নাই, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক, খালেদা জিয়া খুনি, তাকে গ্রেফতার করতে হবে, বিএনপি-জামাত দেশে জঙ্গি হামলা চালাচ্ছে প্রভৃতি ডামাঢোল যখন সরকারের লোকরা বাজাচ্ছে, তখন বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনায় দেখা যায় এর ভিন্ন চিত্র। দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রকৃত অর্থে দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। ঢাকা ও গোটা বাংলাদেশের চিত্র এক নহে। ঢাকাতেও ৩৫% মানুষ বস্তিতে বা ফুটপাতে বসবাস করে। পত্রিকা বা বিভিন্ন মিডিয়া চ্যানেলের নিত্যদিনের যা ঘটনা তা দেখে সরকারের ডামাঢোল প্রতিবাদের সব রাস্তা সরকার দিন দিন গলা চেপে ধরেছে। প্রতিবাদের অর্থই গাড়ি পোড়ানো মামলার আসামী হয়ে রিমান্ডে যাওয়া। প্রতিদিন খুন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক আটক করে অস্বীকার বা ক্রসফায়ার, দখলবাজি ও টেন্ডার নিয়ে ছাত্রলীগ বনাম যুবলীগ খুনাখুনি, এখানে যেখানে লাশ আর লাশ, আসামী ধরতে গিয়ে পুলিশ কর্তৃক নারী নির্যাতনের অভিযোগ, পুলিশী নির্যাতন থেকে সাংবাদিকও বাদ পড়ছে না। পুলিশ হেফাজতে রাজনৈতিক কর্মীর মৃত্যু, প্রতিদিনই জেলায় জেলায় রাজনৈতিক কর্মী গণগ্রেফতার, প্রতিনিয়তই বর্ডার এলাকায় বাংলাদেশীর লাশ, ফেলানীর বিচার ধুকে ধুকে কাঁদছে, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ কর্তন প্রভৃতি কোথাও ঘটনা আবার কোথায় নাটক, গণমানুষের অস্বস্তিরতার দিন আর কাটছে না।
নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার জন্য নিয়ন্ত্রণ করা হবে মর্মে দেশবাসী যা আশা করে ছিল; ফল হয়েছে তার উল্টো। ইলিয়াস আলীসহ বিরোধীদলীয় অনেক নেতা-কর্মী খুন ও গুম হওয়ার পর একটি বৃহৎ দলের মুখপাত্র ও সাবেক মন্ত্রীকে জোরপূর্বক ধরে নেয়ার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অস্বীকার-দেশবাসীকে আরো বেশি ভাবিয়ে তুলেছে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ- রেহমান সোবহান বলেছেন যে “দেশের আমলাতন্ত্র দলীয়করণের মাধ্যমে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে- যে কোনভাবেই সে ক্ষতি পোশানো কঠিন হয়ে যাবে”।
লাঙ্গলবন্দ ট্যাজেডি, বিল্ডিং ধস, অভিনব পদ্ধতিতে ক্রাইম বৃদ্ধি, অহরহ সড়ক, লঞ্চ দুর্ঘটনা, এরশাদের ভাষায় ঘরে থাকলে খুন, বাহিরে গেলে গুম প্রভৃতি পরিস্থিতিতে আকাশ যখন ভারী হয়ে উঠে তখনো সরকারের মুখে রসালো রসিকতা আরও বৃদ্ধি পায়। জনগণের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে পালিত সরকারের অধিদপ্তর, ডিপার্টমেন্ট, এজেন্সি, বিভিন্ন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ ওয়াসা পাইপে পড়ে যাওয়া শিশু জিহাদের উদ্ধার কাজ সরকারিভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করার পর আনাড়ি যুবকরা (প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নহে) দেশীয় প্রযুক্তিতে শিশু জিহাদের লাশ উদ্ধার করার পরও নিজ যোগ্যতা ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সরকারের কোন বোধোদয় হয় নাই। ফলে সকল লঞ্চ ডুবি, অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধসে উদ্ধার কাজ সম্পর্কে জনগণের আস্থাহীনতা আরো প্রকট থাকার ধারণ করেছে। এমনিতেই রানা প্লাজার রোকশানা উদ্ধার কাজকে মানুষ নাটক বলে মনে করে। তার পর চলছে মড়ার উপর খাড়ার ঘা। প্রতিদিনই চলছে গণমামলা, গণগ্রেফতার, গণরিমান্ড, গণস্বীকারোক্তিসহ আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানদের দিয়ে জনগণকে ধমকানো; ফলশ্রুতিতে দেশে মানুষের মধ্যে যখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো তখন সংলাপের প্রস্তাবকারী সুশীল সমাজকে ধমক দিলেন- স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বললেন- সুশীলদের ১৮ জনের মধ্যে ১১ জনই আমার নিকট বিভিন্ন তদবিরে এসেছিলেন। সুশীল সমাজ রাষ্ট্রপতির মধ্যস্থতায় একটি সংলাপ চেয়েছিলেন। সংবিধানে যাহাই থাকুক না কেন ড. আকবর আলি খানের ভাষায়- “রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা একজন সেকশন অফিসারের চেয়েও কম। কেননা, এই কর্মকর্তারা সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত করতে পাবেন; কিন্তু রাষ্ট্রপতির সে সুযোগ নাই”। যা হউক মান্না-খোকার টেলিফোনিক আলাপের পর রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার ভয়ে ভীত সুশীল সমাজ এমন নিথর ও স্তব্ধ হয়ে পড়েছে- তাদের মোবাইল নাকি এখন বন্ধ। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির নিজ উদ্যোগে কোন উদ্যোগ আশা করা যায় না। কারণ যে অনির্বাচিত সংসদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সে সংসদকে সকল সমস্যার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করার জন্য তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া রাষ্ট্রপতি কোন উদ্যোগ নিতে পারবেন কি? জাতীয় স্বার্থে তিনি এতোটুকু রিস্ক নেয়ার পূর্বে তিনি নিশ্চয় তার অবস্থানের কথা গভীরভাবে চিন্তা করবেন।
ইতঃপূর্বে সংলাপের কথা বলায় বঙ্গবন্ধুর এককালীন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেনকে রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে গ্রেফতারের হুমকি দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। ড. কামাল অবশ্য এ মর্মে “ইটাকা জবাব পাত্থরে দিয়েছেন;” তার পর থেকে তাকে গ্রেফতারের দাবি এখন চুপ। প্রধানমন্ত্রীর কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করায় বঙ্গবন্ধুকে যিনি পিতা হিসাবে জানেন সেই বঙ্গবীর আ. কাদের সিদ্দিকীকে পূর্বেই নব্যরাজাকার টাইটেল দেয়া হয়েছে, সংলাপের দাবিতে প্রায় ৬০ দিন তিনি রাস্তায় অবস্থান করেছেন। বামপন্থী জোট, ২০ দল বহির্ভূত ইসলামী বিভিন্ন দল, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন জোট, সাবেক রাষ্ট্রপতি বি. চৌধুরীসহ সকলেই সংকট নিরসনে সংলাপ দাবি করেছেন।
সংলাপের মাধ্যমে সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি ১৫টি ইউরোপীয়নে রাষ্ট্রদূতের যৌথ স্বাক্ষরে চিঠি দিলেও সরকার এর কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে নাই বরং জাতি সংঘের মানবাধিকার তদন্ত কমিশনের সাথে সাক্ষাৎকারের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অপব্যাখ্যা দেয়ায় কমিশন দুঃখ প্রকাশ করেছে যা জাতির জন্য লজ্জাজনক। উক্ত চিঠির কথাও সরকার গোপন রেখেছে দীর্ঘ দিন।
সংলাপের জন্য জাতিসংঘ বার বার তাগিদ দিয়ে সংকট নিরসনের কথা বলার সাথে এও বলেছে যে- সংসদের বাহিরে বিরোধী দলের সাথে সংলাপে বসতে হবে। কারণ বিশ্ব জানে যে, সংসদের ভিতরের বিরোধী দল গৃহপালিত ও সরকারের দোসর মাত্র। গণতন্ত্র নিধনে সরকারের অসংবিধানিক কর্মের সমর্থন আদায়ের জন্য গৃহপালিত বিরোধী দলটি হোটেল রেডিসনে রাষ্ট্রদূতদের সাথে একটি নৈশ ভোজে মিলিত হয়েছে। সরকার ৩টি বিষয় খুব ভালো করে প্রচার করছে। (১) স্বাধীনতার চেতনা, (২) বার্ন ইউনিট ও (৩) সংবিধান রক্ষা। প্রধান রাজনীতিবিদ ও মুজিবনগর সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহাম্মদ সরকার ভূষিত “স্বাধীনতা পদক” গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, এতেই প্রতীয়মান হয় যে- স্বাধীনতার মূল চেতনা অর্থাৎ গণতন্ত্র রক্ষার প্রতি প্রধানমন্ত্রী কতটুকু যত্নবান? বার্ন ইউনিটের জন্য আমি/আমরা/জাতি/বিশ্ব মর্মাহত, দুঃখিত এবং যেভাবেই হউক এর অবসান অবশ্যই হওয়া উচিত; নতুবা দেশের কোন নাগরিকেরই জীবন নিরাপদ নহে। সকল কিছুর উর্ধ্বে ওঠে এ মর্মে সোচ্চার হওয়া দরকার। কিন্তু কেন এই অভিশপ্ত বার্ন ইউনিট? ড. কামাল হোসেনের ভাষায়- “৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের জন্যই দেশে এই অস্বাভাবিক অবস্থা”। গণতন্ত্রই স্বাধীনতার মূল চেতনা। সে চেতনাকে বুটের তলায় পিষে চেতনার শ্লোগান দেয়া হচ্ছে শুধুমাত্র শাক দিয়ে মাছ ঢাকার জন্য।
সংবিধান রক্ষার জন্য সরকার এখন মরিয়া হয়ে ওঠেছে। দেশী-বিদেশী সকলের কাছে “সংবিধান মত দেশ চলছে ও চলবে বলে সাফাই গাওয়া হচ্ছে।” জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ- “একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিনশত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার (অর্থাৎ মহিলা আসন) কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্য দিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ সদস্য বলিয়া অবিহিত হইবেন।” যেখানে ১৫৩ জন বিনা ভোটে ও বাকি একতরফা ভোটে তথাকথিত নির্বাচনী মহড়া হয়েছে তাকে কি সংবিধানের ভাষায় “প্রত্যক্ষ নির্বাচন” বলা যাবে? তখন শেখ হাসিনা বলেছিলেন নিয়ম রক্ষার জন্য নির্বাচন। এখন তিনি বেমালুম সে ওয়াদা ভুলে গিয়ে এখন (১) স্বাধীনতার চেতনা, (২) বার্ন ইউনিট ও (৩) সংবিধান রক্ষার ডামাঢোল বাজাচ্ছেন যা কারো নিকট গ্রহণযোগ্য নহে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গন ও বিবেকবান মানুষ তা মেনে নিচ্ছে না; এক ভারত ছাড়া। কারণ বাংলাদেশের সাথে ভারতের অনেক স্বার্থ জড়িত। সবে মাত্র বিনা শুল্কে সড়ক পথে ত্রিপুরা যাওয়ার জন্য ভারতীয় চালের জাহাজ আশুগঞ্জে পৌঁছেছে। এরশাদ তখনই বলেছিলেন যে- ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং একতরফা নির্বাচনে যেতে তাকে চাপ প্রয়োগ করেছেন।
পাকিস্তানের অনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক সম্পর্কে (যিনি ১৭ আগস্ট ১৯৮৮ প্লেন ক্রাসে মৃত্যুবরণ করেন) একটি গল্প চালু ছিল যা নিম্নরূপ :-
[ জিয়াউল হক যখন চুল ছাটতেন তখন নাপিত বার বার তাকে জিজ্ঞাসা করতো- “স্যার, পাকিস্তানের নির্বাচন কবে দিবেন?” একথা শুনলেই তিনি রাগে টগবগিয়ে কিছু না বলে চোখ রাঙ্গিয়ে নাপিতের দিকে তাকাতেন। বার বার প্রশ্নের পর একদিন জিয়াউল হক নাপিতকে জিজ্ঞাসা করলেন- পাকিস্তানের নির্বাচন দিলে তোর লাভ কি? প্রতি উত্তরে নাপিত বললো- স্যার, নির্বাচনের কথা বললে আপনার চুল সব খাড়া (সোজা) হয়ে যায়, তখন আমার চুল ছাটতে সুবিধা হয়]
সরকার সব শুনতে রাজি একমাত্র সংলাপ ছাড়া। সংলাপের কথা শুনলেই সরকারের মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়, যাদের মাথায় চুল নাই তাদেরও। কারণ সংলাপে বসলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। তাই সরকারের মন্ত্রীরা সংলাপ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য করে রসিকতা করছেন। কেহ বলেন খালেদার সাথে সংলাপ হবে কারাগারে। কেহ বলেন জামাত ছাড়া আসতে হবে। আবার বলেন- সংবিধান মেনে আসতে হবে অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে আলোচনা হবে না- শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। এরা সন্ত্রাসী বিধায় বিএনপি-জামাতের সাথে সংলাপ হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রচ- রোদে অনেকেই খেই হারিয়ে ফেলেন। সরকারের হয়েছে এখন সে অবস্থা। তাই সকলের দাবি উপেক্ষা করে সংলাপের বিষয়ে তাদের কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নেই; বরং খালেদা জিয়া সংকট নিরসন ও সংলাপের বিষয় বস্তু সম্পর্কে তার কার্যালয়ে ১৩/৩/২০১৫ তারিখে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন যা কোন প্রকার বিচার-বিবেচনা ছাড়াই সরকার তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যান করেছে। বরং “সংলাপ নয়, শক্তিতেই সমাধান খুঁজছে সরকার” মর্মে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা মতামত ব্যক্ত করেছে। ১৯৯৬ সনে মতিউর রহমান নিজামীকে সাথে নিয়েই শেখ হাসিনা সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। তখন জামাতের গায়ে গন্ধ ছিল না? সন্তু লারমা হাজার হাজার বাঙ্গালী খুন ও সম্পদ লুট করেছেন। সেই সন্তু লারমার সাথে কি শেখ হাসিনা শান্তি চুক্তি করেন নাই? এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে প্রশ্ন তুলছেন তিনি কি ১৯৯৬ সানের ১২ই জুন তত্ত্বাবধায়কের মাধ্যমে নির্বাচিত হন নাই? জামাত, ইনু, মেননকে সাথে নিয়ে তিনি কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে হরতাল-অবরোধ করেন নাই? তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলের জুজুর ভয় দেখান। ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা পরিষদের অধীনে নির্বাচন করে তিনি কি নির্বাচিত হন নাই? তখন এই প্রধানমন্ত্রীই বলেছিলেন- “এটা আমাদের আন্দোলনের ফসল এবং তাদের সকল কাজের  বৈধতা আমি দিবো” এবং তিনি তা দিয়েছেন।
পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, সার্বিক সংকট মোচনের জন্য জাতির স্বার্থের চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় থাকার স্বার্থটি তিনি বড় করে দেখছেন। কারণ সংলাপ হলে কার লাভ কার ক্ষতি- এ বিষয়টি তিনি ভালোই বুঝেন। সংলাপের প্রথমই আসবে, কেন বা কার স্বার্থে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি সংবিধানে সংশোধন করা হলো? দ্বিতীয় প্রশ্ন, ৫ই জানুয়ারি ২০১৪ তারিখের নির্বাচন কি প্রত্যক্ষ ভোটে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য কোন নির্বাচন ছিল? তৃতীয় প্রশ্ন, দুদক কর্তৃক দায়েরকৃত শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সব মামলা থেকে অব্যাহতি; পক্ষান্তরে খালেদা জিয়া ও বিএনপি সংক্রান্ত সব মামলা সচল রয়েছে কোন যুক্তিতে? পর্যালোচনায় উত্তর নেগেটিভ আসবে জেনেই সরকার সংলাপে বসতে চায় না। সংলাপে না বসাটাই প্রধানমন্ত্রী নিজকে লাভবান মনে করছেন। তাই পরিস্থিতি ভিন্ন পথে নেয়ার জন্য শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করে বিরোধী দলকে সরকার দমন করার দৃঢ়তা দেখাচ্ছে। ড. জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেছেন যে- এ কারণেই পুলিশকে সম্প্রতি ১২০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
সংলাপে না বসলে কি হতে পারে? বিএনপি-জামাতকে সরকার জঙ্গিবাদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে। যদিও ২০ দল বার বারই দৃঢ়তার সাথে বলছে যে তারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী যা করতে সরকার বন্দুকের নলে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকারও জানে ২০ দল গণতান্ত্রিক দল এবং বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী যার প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। বিএনপি একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে না বিধায় বাকশালের পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য সংবিধান সংশোধন জিয়ার উদ্যোগেই হয়েছিল। কিন্তু সরকার সন্ত্রাসবাদ, সন্ত্রাসবাদ বলে সন্ত্রাসবাদের শুড়শুড়ি ও উস্কানি দিচ্ছে মাত্র। এখানে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন- “আমেরিকা জামায়াতকে অর্থায়ন বন্ধ করলে জঙ্গিবাদ বন্ধ হবে।” জামায়াত সম্পর্কে বামদের এলার্জি অনেক আগে থেকেই। গোটা বিশ্ব মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে সে সুবিধাটাই সরকার পেয়ে যাচ্ছে। মুসলিম দেশগুলোতে বিশৃঙ্খলার পেছনে বড় বড় শক্তির গোয়েন্দাদের ইন্ধন রয়েছে। বিশ্ব রাজনীতি এখন গোয়েন্দাদের নিয়ন্ত্রণে। ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন সংলাপের মাধ্যমে সংকটের মীমাংসা না হলে চরমপন্থী উত্থান ও গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করে ২৩/২/২০১৫ তারিখে বিবৃতি দিয়েছে যা পরের দিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিশ্লেষকদের মতে স্বৈরতন্ত্রের কারণে জঙ্গিবাদের যেন উত্থান না হয়- এটাই দৃঢ়ভাবে কামনা করি। কারণ জঙ্গিবাদ আন্তর্জাতিক অর্থায়নে নীল নকশার ষড়যন্ত্রের একটি বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এতে কল্যাণ বয়ে আনবে না বরং দেশ থেকে শান্তি চলে যাবে।
পর্যালোচনায় এটাই পরিষ্কার যে- সংলাপ না হলে আপাতত দৃষ্টিতে অনির্বাচিত সরকার সময়িক লাভবান হবে, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাষ্ট্র তথা জনগণ। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রই রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার উত্তম পন্থা হিসেবে বিবেচিত। সে কারণেই এ সরকার সংকট নিরসন ব্যতীত চলতে পারবে না। তাদের সাময়িক লাভ কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য অন্ধকার। সংলাপ না করে আমলাদের ওপর প্রধানমন্ত্রীর নির্ভর করাটা কতটুকু নির্ভরযোগ্য হবে তা সময়ই বলে দিবে। জাতি সে সময়ের অপেক্ষায়।
এখন জাতির বিবেকের নিকট প্রশ্ন- দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী কি সঠিক পথে এগুচ্ছেন?
অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads