শনিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

বিপন্ন রোহিঙ্গাদেরকে বর্মী হায়েনাদের হাতে ঠেলে দেবেন না


গত বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি আলোচনা সভায় সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমানে বিকল্প ধারা বাংলাদেশের প্রধান অধ্যাপক ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী রোহিঙ্গা বিতাড়ন সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করেন। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, পাশের দেশের মুসলমানদের আমরা আশ্রয় দেই না, এর চেয়ে মর্মান্তিক কি হতে পারে। আমরা কেমন করে ভুলে যাই, একাত্তর সালে এক কোটি মানুষ আমরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, এটা কেন আমাদের মনে আসে না।
রোহিঙ্গা মুসলমানদের সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের এই অগ্রহণযোগ্য অবস্থান এবারেই প্রথম নয়; ২০১২ সালে যখন বার্মার সামরিক সরকার মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালায় তখনও নিকটতম এবং অভিন্ন প্রতিবেশি হিসেবে রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশে আশ্রয় লাভের চেষ্টা করে। বাংলাদেশ এবং আরাকান বা রাখাইন প্রদেশের মাঝখানে প্রবাহিত হয়েছে নাফ নদ। তাই প্রায় অধিকাংশ রোহিঙ্গা মুসলমান যখন নিজ দেশ থেকে নির্যাতিত ও বিতাড়িত হয় তখন নাফ নদ দিয়ে তারা নৌকাযোগে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করে। গতবারে অর্থাৎ ২০১২ সালে যেমনটি ঘটেছিল এবারও ঠিক তাই ঘটছে। নাফ নদের এপারে পাহারা দিচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি এবং নৌবাহিনীর কোষ্ট গার্ড। সরকারের এই অবস্থান দেখে গতবার ৩২ জন বুদ্ধিজীবী এক বিবৃতির মাধ্যমে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
আজ থেকে ৪ বছর আগে ২০১২ সালে বিপন্ন রোহিঙ্গাদেরকে একটি যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন তারা। ঐ আবেদনে বলা হয়েছিল, “এই দাঙ্গার যারা শিকার (বিবৃতির ভাষায় ভিকটিম) হয়েছেন তারা  উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছেন এবং বাংলাদেশে আশ্রয় চাচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকার সীমান্ত বন্ধ করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেই সিদ্ধান্ত পূর্নবিবেচনা করার জন্য তারা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, “আমাদের গৌরবময় ইতিহাস এই বিবৃতি দিতে আমদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমারা বিশ্বাস করি যে, মানবাধিকার অবিভাজ্য। এক দেশে কোনো জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার যদি লঙ্ঘিত হয় তাহলে সেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের যারা শিকার হয় তাদের দুঃখ র্দুদশা ভাগাভাগি করার দায়িত্ব অন্যদেশের, বিশেষ করে সেই দেশটি যদি প্রতিবেশী হয়।” বিবৃতিতে আরো বলা হয়, “আমরা একথা স্মরণ করছি যে, জাতি হিসাবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে  ভারতের নিকট থেকে আমরা অনুরূপ সুবিধা ভোগ করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ কালে আমরা দেখছি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ উদ্বাস্তু মাইগ্রেশন। যারা বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে গিয়েছিলেন তারা ছিলেন পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ শরণার্থী’।” বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, “এডভোকেট সুলতানা কামাল, রাজা দেবাশীষ রায়, ড. রওনক জাহান, এডভোকেট সিগমা হুদা, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ড. হামিদা হোসেন, ড. শাহদিন মালিক, ড. ইফতেখার উজ্জামান, প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদ, কামাল লোহানী, শাহীন রেজা নুর, মোহম্মদ কামাল উদ্দিন প্রমুখ।” বিবৃতিটি ছাপা হয়েছে ডেইলি স্টারসহ অন্যান্য পত্রিকায়, ২০১২ সালের ১৭ই জুন রবিবার।
॥ দুই ॥
মাঝখানে ৪ বছর পার হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি। বরং ২০১২ সালে যে পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল ৪ বছর পর ২০১৬ সালে সেই পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। গত কয়েকদিনের পত্র-পত্রিকায় রোহিঙ্গাদের ওপর রাখাইন বৌদ্ধ এবং বর্মী সেনাবাহিনীর যে অব্যাহত হামলা চলছে সেটাকে একদিকে বলা যায় গণহত্যা অন্যদিকে সুপরিকল্পিতভাবে জাতিগত নির্মূল অভিযান। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, গত রোববার ও সোমবার ৩৪ রোহিঙ্গাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে মিয়ানমারের  সৈন্যরা। এ কারণেই সেনা অভিযানে তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে শত শত রোহিঙ্গা। বিজিবির নজরদারি কঠোর হওয়ায় বাংলাদেশে ঢুকতে পারছে না রোহিঙ্গারা। দেশটিতে সেনা অভিযানে ৪০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি হারিয়েছে। এরা বর্তমানে বন-জঙ্গল, সাগরকূল ও সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। বিশেষ করে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের নাফ নদের ওপারে রোহিঙ্গাদের ভিড় জমেছে। প্রতি রাতেই সীমান্ত পার হয়ে এরা বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাত থেকে গত বুধবার সকাল পর্যন্ত কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার পর বিজিবির হাতে আটক হয়েছে। ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার জানান, আটক ৬৬ মিয়ানমার নাগরিককে খাবার ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এদিকে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির সরকারি বাহিনীর বর্বরতা ও মগ দস্যুদের নৃশংসতা থেকে বাঁচতে নাফ নদে ঝাঁপ দিয়ে আসা ৬৭ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে বাংলাদেশের পুলিশ। এদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। গত বুধবার তাদের আটক করা হয়। এ সময় পাচারের সহযোগী হিসেবে চার স্থানীয় বাংলাদেশীকেও আটক করে পুলিশ। আটককৃত নারীরা এ সময় আর্তকণ্ঠে জানায়, ‘যাদের ভয়ে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসেছি দয়া করে আমাদেরকে তাদের হাতে তুলে দেবেন না। আপনারা আমাদের গুলী করে মেরে ফেলুন এতে আমাদের কষ্ট কম হবে। কারণ মিয়ানমারের বর্বর বাহিনী আমাদের নৃশংসভাবে হত্যা করবে।
আটককৃতরা মিয়ানমারের মংডু কেয়ারীপাড়ার বাসিন্দা। মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ায় গত কয়েক দিন লতাপাতা খেয়ে তারা বনজঙ্গলে অবস্থান করছিল। তারা পাহাড়ি পথ হেঁটে নাফনদী পর্যন্ত এসে নৌকায় উনচিপ্রাং সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছে।
তারা বলেন, কতটুকু অসহায় হলে মানুষ নিজ জন্মভিটা ছাড়ে তা আমাদের অবস্থায় না পড়লে কেউ বুঝবে না। এখানকার (বাংলাদেশ) সরকার কারাগারে দিলেও তো প্রাণে বাঁচব। ওখানে বর্বর নির্যাতনের মাধ্যমে পশুর মতো আমাদের হত্যা করা হচ্ছে। তারা আরো জানান, রাখাইন প্রদেশ মংডুর বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে রোহিঙ্গাদের পুড়িয়ে মারার ঘটনা সে দেশের নীতিনির্ধারক মহলের নতুন কৌশল।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ করেছেন। এটা ছাড়া মিয়ানমার সরকারের বোধোদয় হবে না বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনার উপদেষ্টা এইচ. টি. ইমাম। বৃহস্পতিবার বিবিসি বাংলার প্রবাহ টিভির সাথে এক সাক্ষাৎকারে মি. ইমামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, রোহিঙ্গাদের নিয়ে বর্তমান সঙ্কটের সমাধান কিভাবে হতে পারে? জবাবে তিনি মিয়ানমারের ওপর স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলেন। এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, অতীতে অনেক দেশেই এমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এইচ টি ইমাম বলেন, ‘’পরমাণু অস্ত্র নিয়ে জাতিসংঘ ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। সিরিয়া, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।’ ‘এখন মিয়ানমারের ওপর যদি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তাহলে সম্ভবত তাদের বোধোদয় হবে। নইলে হবে না।’
জনাব এইচ টি ইমাম যা বলেছেন সেটি তার ব্যক্তিগত মত হতে পারে। এই মত বাংলাদেশের জনমতেরই প্রতিধ্বনি করে। কিন্তু সরকারের ভুমিকায় উপদেষ্টার এই মত মোটেই প্রতিফলিত হচ্ছে না। কারন দেখা যাচ্ছে যে সরকারি বাহিনী প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদেরকে গ্রেপ্তার করছে এবং তারপর বর্মী সেনাদের হাতে তুলে দিচ্ছে। বর্মী সেনারা ওদেরকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করছে এবং গুলি করে মারছে অথবা পুড়িয়ে মারছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী রোহিঙ্গা মুসলমানদের দুর্দশায় সহানুভূতি ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। একই নিশ্বাসে তিনি বলেছেন যে, এই সমস্যা সমাধানের দ্বায়িত্ব বর্মী সরকারের। আন্তর্জাতিক মহলের চাপ সৃষ্টি করার জন্য তিনি দাবি করেছেন। এই ভয়াবহ সমস্যায় মৌখিক একটি দাবি জানালেই সবকিছু করা হল না। সেই দাবি মোতাবেক যাতে কাজ হয় সেজন্য বাংলাদেশকে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে।
॥ তিন ॥
যখন বাংলাদেশে সংকটের সৃষ্টি হয় তখন যেহেতু ভারত ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটতম এবং অভিন্ন প্রতিবেশী তাই সেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্যাতনে লক্ষ লক্ষ শরনার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। তখন ভারত বলেছিল যে, যেহেতু ভারত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী তাই বাংলাদেশের এত বড় ঘটনায় ভারত নিশ্চুপ বসে থাকতে পারে না। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশে বলেছিলেন যে এটি একটি রাজনৈতিক সমস্যা এবং রাজনৈতিক ভাবেই সেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী এই কথা বলে নীরবে বসে থাকেননি। তার বক্তব্যে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। পরবর্তী ঘটনাবলী সকলেই জানেন। বাংলাদেশকেও এক্ষেত্রে ভারতের মত ভূমিকায় নামতে হবে। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশকেই জাতিসংঘের দুয়ারে করাঘাত করতে হবে। জাতিসংঘে এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করলে বহু দেশের সমর্থন পাওয়া যাবে। বিচ্ছিন্নভাবে অনেক দেশ তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং বর্মী সরকারের জাতিগত নিধন অভিযানের তীব্র সমালোচনা করেছে।
বার্মার ডিফ্যাক্টো প্রেসিডেন্ট হলেন অং সান সু চি। শান্তির জন্য তাকে নোবেল প্রাইজ দেয়া হয়েছে। কিন্তু যার দেশে সামরিক বাহিনী এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায় এত বড় অশান্তির সৃষ্টি করেছে সেখানে এই শান্তির দেবী পরোক্ষভাবে গণহত্যা এবং জাতিগত নিধনকে সমর্থন করে যাচ্ছেন। মিশাল হোসেন নামক লন্ডনের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার সাংবাদিক তার ইন্টারভিউ গ্রহণ করেছিলেন। ঐ ইন্টারভিউয়ে তিনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের দুর্দশার কথা সু চির কাছে তুলে ধরেন। পরে সু চি জানতে পারেন যে ঐ সাংবাদিক ছিলেন একজন মুসলমান। তখন তিনি বলেন, আগে যদি তিনি জানতেন যে ঐ সাংবাদিক একজন মুসলমান, তাহলে তিনি তাকে ইন্টারভিউ দিতেন না। এমনই মুসলিম বিদ্বেষ সু চির। এমন একজন মুসলিম বিদ্বেষীকে কিভাবে নোবেল প্রাইজ দেয়া হল সেটি এখন বিরাট জিজ্ঞাসার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাই হোক, গতস্য শোচনা নাস্তি। কিন্তু এখন যখন তার মুসলিম বিরোধী চেহারা উন্মোচিত হয়েছে তখন শান্তির নোবেল পুরস্কার ধারণ করার কোনো অধিকার তার আর নাই। নোবেল কমিটির উচিত সু চির নিকট থেকে নোবেল পুরস্কারটি প্রত্যাহার করে নেয়া। ইতোমধ্যেই লক্ষাধিক মানুষ একটি লিখিত আবেদন করেছেন এবং সু চির নোবেল প্রাইজ প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের ৯২ শতাংশ মানুষ মুসলমান। রোহিঙ্গা মুসলমানদের এত বড় মানবিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশ নীরব থাকতে পারে না। ইসলামী শীর্ষ সম্মেলন বা ওআইসিকে এবং একই সাথে জাতিসংঘকে বাংলাদেশ বলতে পারে যে, বর্মী সামরিক জান্তার আচরণে যে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশ সীমান্তে এসে জড় হচ্ছে তার ফলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিশ্ব সমাজের অবশ্যই কিছু করণীয় রয়েছে। বাংলাদেশ যৌক্তিকভাবে এ কথা বলতে পারে যে, রোহিঙ্গারা বংশানুক্রমিকভাবে রাখাইন বা আরাকান তথা বার্মার অধিবাসী। অথচ ১৯৮২ সালে জেনারেল নে উইনের সামরিক জান্তা তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে। যারা জন্মগতভাবে বর্মী নাগরিক কোনো এক সামরিক সরকারের মুখের কথায় সেই নাগরিকত্বের অধিকার হরণ করা যায় না। সুতরাং এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হলো, রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, অবিলম্বে তাদের ওপর সব ধরনের নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। তৃতীয়ত, অবিলম্বে তাদেরকে দেশে ফেরত নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। চতুর্থত, গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকারসহ তাদেরকে তাদের সব ধরনের নাগরিক অধিকার দিতে হবে। এটিই হলো রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান।

বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাঁচাতে হবে


প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর দমন-নির্যাতন অমানবিকতার সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দমন-নির্যাতনের সঙ্গে সম্প্রতি শুরু হয়েছে ভয়াবহ গণহত্যাও। শত শত রোহিঙ্গা মুসলমানকে নির্বিচারে হত্যা করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যাকাণ্ডের অসহায় শিকার হচ্ছে বিশেষ করে পুরুষ রোহিঙ্গারা। নারী ও শিশুরাও নিস্তার পাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। এ ধরনের অনেক চিত্রই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ধারণ ও প্রচার করা হয়েছে।
মিয়ানমার সরকার অভিযোগ তুলেছে, রোহিঙ্গারা নাকি রাষ্ট্রদোহী এবং তাদের জঙ্গিরা নাকি সম্প্রতি কয়েকজন সেনা সদস্যকে হত্যা করেছে। অন্যদিকে তথ্যভিত্তিক খবরে জানা গেছে, রোহিঙ্গারা নয়, কথিত ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী আসলে দেশটির মাদক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, যারা ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক সামগ্রী বাংলাদেশে চোরাচালানের অবৈধ পথে পাচার করে থাকে।  সেনাদের হত্যার পেছনেও মাদক ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী চক্রই জড়িত রয়েছে। কিন্তু  প্রকৃত সত্য পাশ কাটিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযান শুরু করেছে।
বিস্ময়ের কারণ হলো, সুদীর্ঘ সেনা শাসনের পর মাত্র কিছুদিন আগে মিয়ানমারে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসেছে এবং শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু কি সে সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আশা করা হয়েছিল, বিশেষ করে নতুন নেত্রী নিশ্চয়ই রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাশে দাঁড়াবেন এবং সেনাবাহিনীকে গণহত্যা চালানো থেকে নিরস্ত করবেন। অন্যদিকে নিজে ইয়াঙ্গুনের সামরিক সরকারের হাতে নির্যাতিত হলেও ক্ষমতায় আসার পর অং সান সু কিও মিয়ানমারের নিন্দিত রোহিঙ্গা নীতির পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। বিশ্ববাসীকে হতবাক করে তিনিও ঘোষণা করেছেন, রোহিঙ্গা মুসলমানরা নাকি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ‘বাঙালি’ এবং তাদের মিয়ানমারে বসবাস করার কোনো অধিকার নেই। রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমার থেকে বহিষ্কারের ঘোষণাও দিয়েছেন অং সান সু কি। বলা হচ্ছে, নেত্রীর এই ঘোষণা দেশটির সেনাবাহিনীকে নিরস্ত করার পরিবর্তে গণহত্যার নিষ্ঠুর অভিযান চালানোর ব্যাপারে উল্টো প্রশ্রয় দিয়েছে। এমন অবস্থারই অসহায় শিকার হয়েছে রোহিঙ্গা মুসলমানরা।
এদিকে গণহত্যাসহ দমন-নির্যাতনের কারণে শুধু নয়, আশ্রয়হীন হয়ে পড়ার কারণেও রোহিঙ্গা মুসলমানরা ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। রাখাইন প্রদেশের প্রতিটি গ্রাম ও শহর থেকেই তাদের তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমারের কোথাও যাওয়ার এবং আশ্রয় নেয়ার মতো কোনো জায়গা পাচ্ছে না তারা। ফলে বাধ্য হয়ে রোহিঙ্গারা নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। ছোট ছোট নৌকায় চড়ে তারা লুকিয়ে লুকিয়ে কক্সবাজারের উখিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে এসে হাজির হচ্ছে। যারা আসছে তাদের বেশিরভাগই স্বজন হারানো নারী ও শিশু। কিন্তু  আওয়ামী লীগ সরকার তাদের আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। সরকারের নির্দেশে বিজিবি ও কোস্টগার্ড অনেককে জোর করে ফেরতও পাঠিয়েছে। এর অর্থ হলো, বাংলাদেশ এই অসহায় রোহিঙ্গাদের নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। এখনো সরকারের ওই নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ফলে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে গিয়ে পড়তে এবং মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে।
এমন অবস্থার মধ্যে সঙ্গত কারণেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার ও প্রাণে বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এই আহ্বানের জবাবে না হলেও সরকারকে কিছুটা ইতিবাচক অবস্থান নিতে দেখা গেছে। গত বুধবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে প্রথমবারের মতো তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে পররাষ্ট্র সচিব রাষ্ট্রদূতের হাতে একটি কূটনৈতিক নোট তুলে দিয়েছেন। এতে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান দমন-নির্যাতন ও গণহত্যার ব্যাপারে বাংলাদেশের গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়ে অবিলম্বে এসব বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব পরে সাংবাদিকদের বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান মিয়ানমারের ভেতরেই হতে হবে। কথাটার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন কি না সে প্রশ্ন উঠলেও মিয়ানমারের ওপর প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক পন্থায় চাপ সৃষ্টির উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে। 
বলার অপেক্ষা রাখে না, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে দেশটির সেনাবাহিনীর দমন-নির্যাতন ও গণহত্যার অভিযান নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আশংকাজনক এবং ভীতিকর। ঘটনাপ্রবাহে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি জাতিসংঘ, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তো বটেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা সম্পর্কেও জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়েছে। মুসলিম দেশগুলোতে সামান্য কিছু ঘটলেও যারা দুনিয়াজুড়ে শোরগোল তোলে তাদের কেউই কেন রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করছে না সে প্রশ্নও উঠেছে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই। অং সান সু কির সঙ্গে প্রাধান্যে এসেছে তিব্বতীদের বৌদ্ধ নেতা দালাই লামার ভূমিকার দিকটিও। কারণ, নিজে নির্যাতিত হলেও এই নোবেল বিজয়ী নেতাও এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের পক্ষে এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি। ওদিকে অং সান সু কি তো রোহিঙ্গা মুসলমানদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ও ‘বাঙ্গঙালি’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। এভাবে প্রমাণিত হয়েছে, মুসলমান হওয়াটাই আসলে রোহিঙ্গাদের প্রধান অপরাধ! ঘটনাপ্রবাহে তথাকথিত অহিংস ধর্মাবলম্বী বৌদ্ধদের স্বরূপও ন্যক্কারজনকভাবে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। বৌদ্ধরা আসলে যে মোটেও অহিংস নীতিতে বিশ্বাস করে না এবং সুযোগ ও ক্ষমতা পেলে তারাও যে রক্তপিপাসু হয়ে ওঠে তারই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বর্তমান মিয়ানমারে।
আমরা মনে করি, সরকারের উচিত বিপন্ন রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানো এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই তাদের সাময়িক সময়ের জন্য আশ্রয় দেয়া। সরকারকে একই সঙ্গে মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক পন্থায় চাপও সৃষ্টি করতে হবে, দেশটি যাতে গণহত্যা ও দমন-নির্যাতনের অভিযান বন্ধ করে এবং রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিকের মর্যাদা ও অধিকার দিয়ে পুনর্বাসনের আশু পদক্ষেপ নেয়।

বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সুন্দর মুখের আড়ালে এমন অসুন্দর মন!


জাতিগত নিপীড়নের ধারাবাহিকতায় মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে এবার ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তারা জানিয়েছে, স্যাটেলাইটে সেসব ভস্মীভূত গ্রামের ছবি ধরা পড়েছে। ঘটনা তদন্তে জাতিসংঘের প্রতি সংগঠনটি আহ্বান জানিয়েছে বলে জানায় আল-জাজিরা। ১২ নবেম্বর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২ অক্টোবর থেকে ১০ নবেম্বরের মধ্যে উত্তরাঞ্চলীয় মংগদাউ জেলার তিনটি গ্রামে ৪৩০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘নতুন স্যাটেলাইট ইমেজ রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের নিদর্শনই শুধু প্রকাশ করেনি বরং এটাও নিশ্চিত করেছে যে, আমরা আগে যা ভেবেছিলাম পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ।’ এইচ আর ডব্লিউ’র তথ্য অনুযায়ী যে তিনটি গ্রাম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো হলো- পায়উংপিত, কিয়েতইযোপিন এবং ওয়াপেইক। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সেখানে ঘর-বাড়িতে আগুন দেয়া, নারীদের ধর্ষণসহ নানান ধারার শারীরিক মানসিক নিপীড়ন চলছে।
সম্প্রতি সিএনএন মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে, ‘শ্যুট ফার্স্ট আস্ক কোয়েশ্চেন লেটার’। এদিকে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান যিনি রাখাইন স্টেটে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে গঠিত অ্যাডভাইজারি কমিশনের প্রধান তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, উত্তর রাখাইন এলাকায় সাম্প্রতিক সহিংসতা গভীর উদ্বেগজনক যা অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং এ ঘটনায় নতুন করে মানুষ ঘর-বাড়ি ছাড়া হচ্ছে। রাখাইন অঞ্চলে প্রায় ১০ লাখ মুসলমান থাকলেও তাদের কোনো নাগরিক স্বীকৃতি দেয়নি মিয়ানমার সরকার। তারা স্বাভাবিকভাবে যাতায়াত করতে না পারায় কাজকর্মও করতে পারছে না। রোহিঙ্গা মুসলমানদের জমি বা সম্পদের কোনো অধিকার নেই। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সন্ত্রাসী বৌদ্ধদের হামলায় বেশ কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও তাদের ফেরত নিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। এদের অনেকে সাগর পথে পালিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়ার অভিযাত্রায় ক্ষুধায় ও নৌকাডুবিতে মৃত্যুবরণ করেছেন।
রাখাইন স্টেটে গত মাস থেকে শুরু করা অভিযানে সেনা সদস্য ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে স্থানীয় বৌদ্ধ যুবকরাও। অভিযানের সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকেও রাখাইন স্টেটে গুলিবর্ষণ করা হয়। তারা ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কমপক্ষে আড়াই হাজার বাড়ি ঘর ভস্মীভূত হয়েছে। গুলিবর্ষণে ও আগুনে পুড়ে মারা গেছে প্রায় তিনশ’ জন। আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্য মা ছেলেকে নিয়ে যখন বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন মার কাছ থেকে ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে আগুনে নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে। মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের যেন কোন শেষ নেই। মানবাধিকার সংগঠনগুলো স্বল্পমাত্রায় কিছু উহ্-আহ্ করছে কিন্তু জ্বালাও-পোড়াও হত্যাযজ্ঞ বন্ধে বর্তমান বিশ্বসভ্যতা যৌক্তিক ও কার্যকর কোন ভূমিকা পালন করছে না। গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অংসান সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরও পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং নির্বাচনের আগে-পরে ফাঁস হয়েছে সু চির মুসলিমবিদ্বেষী নানা কথা। নির্বাচনে তিনি কোন মুসলমানকে প্রার্থীও করেননি। ফলে প্রশ্ন জাগে ভেতর বা বাইরে থেকে তথা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় কি রোহিঙ্গা মুসলমানদের মুক্তির কিংবা মানুষের মত বাঁচার কোনো বার্তা নেই? এমন প্রশ্নের মধ্যে অন্য একটি বার্তা আছে। আর তা হলো বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা, সভ্যতা ঠিক পথে চলছে না।
এক সময় বলা হতো, সব কবি কবি নয়, কেউ কেউ কবি। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় এখন আবার অনেকে বলছেন, সব মানুষ মানুষ নয়, কেউ কেউ মানুষ। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিরীহ মানুষের ওপর নিষ্ঠুর ও অমানবিক কর্মকাণ্ড দেখে এমন উপলব্ধি খুবই সঙ্গত। বিশেষ করে আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমারে এখন রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে জুলুম-নির্যাতন ও জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান চলছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। রোহিঙ্গাদের হত্যা ও ধর্ষণের সাথে সাথে তাদের বাড়িঘরও জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে মানবাধিকার সংগঠনগুলো কিছু কথাবার্তা বললেও বিশ্বের প্রতাপশালী রাষ্ট্রগুলো নীরব। তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর কিছু মানুষের জীবন খুবই মূল্যবান, আর অনেক মানুষের জীবনের কোন দামই নেই। আলো ঝলমলে ও বিজ্ঞানমনস্ক বর্তমান পৃথিবীতে এমন বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা কেমন করে চলছে তা ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। এক সময় ভাবা হতো মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী সামরিক জান্তার কারণে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অকথ্য জুলুম নির্যাতন চলতে পারছে। গণতন্ত্রমনা নেত্রী অং সান সুচির ব্যাপারে অনেকে আশাবাদী ছিলেন। তারা ভেবেছিলেন ক্ষমতার পরিবর্তন হলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জীবনে মুক্তি আসতে পারে। মিয়ানমারে ক্ষমতার পালাবদল তো হলো কিন্তু রোহিঙ্গাদের জীবনে কোন পরিবর্তন এলো না। মন-মানসিকতায় অংসান সু চিও উদারতার পরিচয় দিতে সক্ষম হননি। বরং তার মধ্যেও মুসলিম বিদ্বেষ কাজ করছে।
অং সান সু চির মুখোশ ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে। ফলে তার কৃত্রিম ইমেজের পালকও খসে পড়ছে। সু চির শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অনলাইন আবেদনে ইতিমধ্যে স্বাক্ষর করেছেন লক্ষাধিক মানুষ। দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার ব্যাপারে অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় এই আবেদন জানানো হয়। নরওয়ের নোবেল শান্তি কমিটি, যারা এ পুরস্কার দেয় তাদের প্রতি আবেদনে এ পুরস্কার প্রত্যাহারের আবেদন জানানো হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে চেঞ্জ ডট অরগে এই আবেদনটি করা হয়েছে। আবেদনে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক শান্তি এবং ভ্রাতৃত্ববোধ রক্ষায় যারা কাজ করেন তাদেরই নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। সু চির মতো যারা এই পুরস্কার পান তারা শেষ দিন পর্যন্ত এই মূল্যবোধ রক্ষা করবেন এটাই আশা করা হয়। যখন একজন নোবেল শান্তি বিজয়ী শান্তি রক্ষায় ব্যর্থ হন তখন শান্তির স্বার্থেই নোবেল শান্তি কমিটির উচিত এই পুরস্কার হয় জব্দ করা, নয় ফিরিয়ে নেয়া।’
লক্ষাধিক মানুষের অং সান সু চির নোবেল প্রত্যাহারের দাবিটি গণমাধ্যমে গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়েছে। নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলমাদের ব্যাপারে সঙ্গত ভূমিকা পালনে সু চি ব্যর্থ হওয়ায় মানুষ অবাক হয়েছে। সু চি যে ইমেজ সংকটে পড়ে গেছেন তা তিনি এবং তার দল কতটা উপলব্ধি করতে পারছেন তা আমরা জানি না। তবে লক্ষাধিক মানুষ তার নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের যে দাবি জানিয়েছেন তা তিনি এড়িয়ে যাবেন কেমন করে? বিষয়টি যে শুধু তার নিজের এবং দলের জন্য ক্ষতিকর তা নয়, মিয়ানমার নামক রাষ্ট্রের জন্যও তা কলঙ্কজনক। আর দেশে-দেশে যদি সংখ্যালঘু মানুষদের প্রতি জুলুম-নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণের মতো অমানবিক কর্মকাণ্ড চলতে দেয়া হয়, তাহলে এ পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য থাকবে কেমন করে? আর আখেরে ওই অপকর্মগুলো মিয়ানমারের জন্যও কি কোন শুভ ফল বয়ে আনবে? এ বিষয়টি নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি বুঝতে সক্ষম না হলে তার নোবেল প্রত্যাহার করাই সমীচীন বলে আমরা মনে করি।
২৩ নবেম্বর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস হামলা অব্যাহত থাকায় আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়ছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যটিতে জঙ্গি নিধনের নামে নির্বিচারে হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। গত মাসে সেনাবাহিনীর দমনপীড়ন শুরুর পর আন্তর্জাতিক ত্রাণকর্মীদেরও রাখাইন রাজ্যে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদল মিয়ানমার পৌঁছার খবর পাওয়া গেছে। প্রতিনিধি দলটি পরিস্থিতি নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান মিন অং লাইংয়ের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, উদ্বিগ্ন এই সব মানুষ দেখা করলে, কথা বললে কি পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে?
এমন প্রশ্নের কারণ আছে। মিয়ানমারের সবচেয়ে পরিশীলিত ও গণতন্ত্রমনা মানুষ হিসেবে পরিচিত নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির চিন্তা-চেতনা ও মনোভঙ্গি এখন বিরাট প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে : মিয়ানমারের নতুন সরকার জনগণের মানবাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেছিল। অনেকে আশা করেছিলেন সু চি হয়তো রোহিঙ্গাদের সংকট দূর করবেন।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, যা আশা করা হয়েছিল তা ছিল ভুল। কারণ অং সান সু চি রোহিঙ্গাদের বিদেশি হিসেবে বিবেচনা করছেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা বাঙালি। তিনি আরও বলেছেন, পুলিশের ওপর হামলার জবাবে সেনাবাহিনীর এই অভিযান চলছে আইনের ওপর ভিত্তি করে। নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণে যে চিত্র ফুটে উঠলো, তাতে মনে হচ্ছে, সু চি যেন মুক্ত বায়ুর অক্সিজেন নিয়ে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সুরে সুর মিলাবার শপথ নিয়েছেন। বিশেষত তিনি যখন বলেন, রোহিঙ্গারা বিদেশি এবং বাঙালি, তখন বাংলাদেশের চিন্তিত হওয়ার কারণ থাকে। নোবেল বিজয়ী একজন মানুষ ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করে এমন মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা কী করে বলেন? তিনি যে নোবেলের অযোগ্য তা আবারও প্রমাণ করলেন। সুন্দর মুখের আড়ালে এমন অসুন্দর মন কী করে লুকিয়ে থাকে?
সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে, মানবাধিকারের বুলি, উদ্বেগ প্রকাশ ও আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাঁচানো যাবে না। এখন প্রয়োজন, ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর’। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদে যারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা তো বেশ শক্তিশালী। বিশ্ববাসী ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও সিরিয়ায় তাদের শক্তিমত্তার প্রমাণ পেয়েছে। জল্লাদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সেই শক্তির কিঞ্চিৎ প্রয়োগে তো কোনো আপত্তি থাকার কারণ নেই। বরং এর মাধ্যমে তারা প্রমাণ করতে পারবেন যে, তাদের উদ্বেগ প্রকাশটা খাঁটি ছিল এবং তারা যথার্থই মানবতাবাদী।

শনিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পর্কে বেগম জিয়ার অর্থবহ ফর্মুলা আওয়ামী লীগের তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান : অতঃপর?


গত শুক্রবার এক সংবাদ সন্মেলনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়া নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পর্কে কতিপয় সুনির্দ্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন। আরও বলা হয়েছে যে, নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কেও তিনি শীঘ্রই একটি রূপরেখা দেবেন। এই প্রস্তাবটি পড়া এবং বিবেচনার আগেই অর্থাৎ প্রস্তাব পেশের ২ ঘন্টার মধ্যেই আওয়ামী লীগের তরফ থেকে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সেসব প্রস্তাব পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছেন। সুতরাং স্বাভাবিকভাবে পরবর্তী প্রশ্ন আসেঃ বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট এরপর কি করবে? কারণ আওয়ামী লীগ তো বেগম জিয়ার রূপরেখা সামারিলি রিজেক্ট করে দিয়েছে। তারা বলেছে, সংবিধান মোতাবেকই নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। এ ব্যাপারে তিনি আরও কিছু কথা বলেছেন যেগুলো এই ইস্যুটির সাথে মোটেই প্রাসঙ্গিক নয়।ওবায়দুল কাদের সাহেবের কথার অর্থ এই দাঁড়ায় যে বিরোধী দল যখন যা কিছুই বলে বা করে সেগুলো আসলে ফালতু হয়ে দাঁড়ায়। তারা বিরোধী দলের কোনো যৌক্তিক প্রস্তাবকেও ফালতু হিসাবে উড়িয়ে দেয়। নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পর্কে বেগম জিয়া যে ফর্মুলা দিয়েছেন সেটি যুক্তি-তর্কের কষ্টি পাথরে বিবেচনা করলে অস্বীকার করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ সম্পর্কে পাল্টা যুক্তি না দিয়ে আওয়ামী লীগ সংবিধানের দোহাই দিয়েছে। সংবিধানে তো এক কথা বলেই সব কিছু শেষ করে দেয়া হয়েছে। কারণ, সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন’।
সংবিধান ও মানুষ
ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে, সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। তিনি আরও বলেন যে, ‘ইসি গঠনে আমরা সংবিধান মোতাবেক চলতে চাই। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠন করে যেভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন, সে প্রক্রিয়া থেকে আমাদের সরে যাওয়ার সুযোগ নেই’। এ সময় ইসি গঠনে বিএনপির প্রস্তাবকে ‘অন্তঃসারশূন্য’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘যারা এই নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক করছেন, বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন, তারা আমাদের পবিত্র সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মিথ্যাচার নতুন নয়, ক্রমাগত ভুলের কারণে তার দল জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তারা বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নিয়ে ভাবে না, বিদেশের কোন দেশে কোন দল ক্ষমতায় আসে, তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।’ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘তিনি (খালেদা) জনগণের ওপর আস্থা রাখেন না। ভোটে তার বিশ্বাস নেই।’ তিনি বলেন, ‘জাতির কাছে কোনো ধরনের প্রেসক্রিপশন দেয়ার আগে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় মানুষ হত্যার জন্য তাদেরকে ক্ষমা চাইতে হবে। শোক দিবসে জন্মদিন পালনের জন্যও ক্ষমা চাইতে হবে।’ ওবায়দুল কাদের বলেন, এখন যে তিনি (খালেদা) সুন্দর সুন্দর ভালো কথাগুলো বলছেন, এগুলো মাগুরা, ঢাকা-১০ এর উপ-নির্বাচনে কোথায় ছিল। নিজেরা যেটা প্রাকটিস করে না, সেটা অন্যকে বলাও ঠিক নয়।
দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, জনাব ওবায়দুল কাদের ধান ভানতে শিবের গান গাচ্ছেন। বেগম জিয়ার প্রস্তাবে নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর কি আছে? আর এসব কথা বললেই সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয় কিভাবে? তাহলে এর আগে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওয়াজ উঠেছিলো তখন আওয়ামী লীগও কি সংবিধানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছিলো? কারণ তখন তো সংবিধানে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিলো। আন্দোলনের মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল হয় এবং কেয়ারটেকার সরকারের ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। এটিকেই বলা হয় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী। তখন কেউতো বলেনি যে, আওয়ামী লীগ তথা বিরোধী দল রাষ্ট্রদ্রোহিতা করছে অথবা তারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ তো বার বার বলেছে যে মানুষের জন্য সংবিধান, সংবিধানের জন্য মানুষ নয়। সুতরাং মানুষের ইচ্ছা বা দাবি মোতাবেক সংবিধান যখন তখন পরিবর্তিত বা সংশোধিত হতে পারে। বেগম খালেদা জিয়া যে সব প্রস্তাব দিয়েছেন সে সব প্রস্তাব সরকার মেনে নিলে নেবে, না হলে সেসব দাবি আদায়ের জন্য বিরোধী দল শান্তিপূর্ণ পথে, গণতান্ত্রিক পথে, নিয়মতান্ত্রিক পথে জনগণের কাছে যাবে। জনগণ তাদের দাবি গ্রহণ করলে সংবিধান সংশোধিত হবে, গ্রহণ না করলে হবে না। তাই বলে এসব প্রস্তাবের মধ্যে তিনি মিথ্যাচার কোথায় দেখলেন?
॥ দুই ॥
আমরা খালেদা জিয়ার ব্রিফ নিয়ে বসিনি। কিন্তু যখন তিনি বলেন যে, বেগম জিয়া জনগণের ওপর আস্থা রাখেন না তখন তিনি ইতিহাসকে সঠিকভাবে বিব্রত করেন না। ভোটে নাকি বেগম জিয়ার বিশ্বাস নাই  (দৈনিক সংগ্রাম, শনিবার, ১৯ নবেম্বর)। ভোটে কোন দলের বিশ্বাস আছে আর কোন দলের নাই সেই বিতর্কে আমরা যাব না। তবে একটি শক্তিশালি, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করে এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হোক যেখানে সব দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে এবং যেখানে জনগণ নির্ভয়ে অবাধে তাদের ভোট দিতে পারে। এমন একটি নির্বাচন দিতে হবে যেখানে জনগণ যে মার্কায় তার ভোটটি দিতে চায় সেই মার্কাতেই যেন ভোটটি পড়ে। সেখানে যেন এমন নির্বাচন না হয় যেখানে, ‘আমার ভোট আমি দেব, তোমার ভোটও আমি দেব’, অবস্থা না হয়। এমন একটি পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হোক। তখন দেখা যাবে কোন দল ভোটে যায়, আর কোন দল ভোটে যায় না। সেই রকম একটি অবস্থার সৃষ্টি না করে এমন একটি ভোট করা হলো যেখানে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ¦ীতায় পাস করল। তেমন একটি ইলেকশনে বিরোধী দল যাবে কিভাবে? সেই ইলেকশন বয়কট করার পর যদি বলা হয় যে, বিরোধী দল ভোটে বিশ্বাস করে না তাহলে সেটা সত্যের চরম অপলাপ হবে।
অনেকের ধারণা ছিল যে, ওবায়দুল কাদের সাহেব হয়তো দলের অভ্যন্তরেও গণতন্ত্রের চর্চা করবেন। কিন্তু মাত্র ১ মাসের মধ্যেই সেই ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা না চাওয়া এবং শোক দিবস পালনের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা তিনি যতদিন না চাচ্ছেন ততদিন পর্যন্ত বেগম জিয়া কোনো রাজনৈতিক প্রস্তাব দিতে পারবেন না, এমন কথা কোনো গণতান্ত্রিক নেতার মুখে শোভা পায় না। একমাত্র ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটররাই এ ধরনের কথা বলতে পারেন। এটিকেই বলা হয় গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার টুঁটি চেপে ধরা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে আমরা একটু পেছনে ফিরিয়ে নিতে চাই, যখন কেয়ার টেকার আন্দোলন দানা বাঁধে এবং চূড়ান্ত পরিণামে ত্রয়োদশ সংশোধনী নামে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়।
॥ তিন ॥
কেয়ারটেকার সরকারের ইতিহাস নিয়ে এই ক্ষুদ্র পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। তবে বিষয়টি আজকের আলোচনার সাথে প্রাসঙ্গিক বলে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করছি।
জেনারেল এরশাদের ৯ বছরের শাসনামলে ভোট নিয়ে অনেক কারচুপি হয়। তখন অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে এবং দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা তথা সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে প্রবল গণআন্দোলন হয়। এই গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ পদত্যাগ করেন এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। অনেকেই এটিকে দেশের কেয়ারটেকার সরকার বলতে চান। যাই হোক, শাহাবুদ্দিন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ১৯৯৪ সালে মাগুরায় অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে সরকারের বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ তোলে বিরোধী দল। এখান থেকেই হয় কেয়ার টেকার সংজ্ঞার উৎপত্তি। এর আগে সর্বপ্রথম জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ৮০’র দশকে এক সাংবাদিক সন্মেলনের মাধ্যমে কেয়ারটেকার সরকারের সংজ্ঞা জনগণের নিকট উপস্থাপন করেন। বিষয়টি জনগণ কতৃক নন্দিত হলেও সেটি আর বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। ১৯৯৪ সালে মাগুরার উপনির্বাচনে কারচুপি হলে আওয়ামী লীগ কেয়ারটেকার সরকার আদায়ের দাবিতে রাজপথে নেমে আসে। তাদের দাবিতে জামায়াতের কেয়ারটেকার সরকারের ছায়াপাত ঘটেছিল। কেয়ারটেকার সরকারের এই দাবিতে আওয়ামী লীগ রাজপথে যে আন্দোলন শুরু করে সেই আন্দোলন ধীরে ধীরে সারা দেশে উত্তাপ ছড়াতে থাকে। সরকার কেয়ারটেকার দাবি মানতে অস্বীকার করে। জামায়াতও এই ইস্যুতে আন্দোলন করে, তবে ভিন্ন প্লাটফর্মে। আন্দোলনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ মাসের পর মাস ধরে সংসদের অধিবেশন বর্জন করে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৯৬ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু আন্দোলনের প্রবল চাপে সেই সংসদ অর্থাৎ ৬ষ্ঠ সংসদ বাতিল করা হয়। বাতিল করার আগে সেই সংসদই কেয়ারটেকার সরকার বিল পাস করে, যেটি এদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে ত্রয়োদশ সংশোধনী নামে খ্যাত।
ওপরের এই আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, রাজপথের আন্দোলন ছাড়া বাংলাদেশে কোনো দিন গণদাবি আদায় হয় না। বেগম জিয়া গণমুখী নির্বাচন কমিশন গঠনের যে ফর্মুলা দিয়েছেন সেটি আওয়ামী লীগ তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। দীর্ঘদিন ধরে পড়াশুনা করে, ইতিহাস ও রাষ্ট্র বিজ্ঞান ঘাঁটাঘাঁটি করে বিএনপি যে ফর্মুলা দিয়েছে সেটি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে শাসক দল আওয়ামী লীগ। এখন বিএনপি কি করবে? বেগম জিয়ার সাংবাদিক সন্মেলনে আরও বলা হয়েছে যে, খুব সহসা অবাধ নির্বাচনের একটি ফর্মুলা দেয়া হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সেই ফর্মুলাও আওয়ামী লীগ তাৎক্ষণিকভাবেই নাকচ করে দেবে।
আজ শনিবার এই কলামটি লেখার সময় দেখলাম, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন যে, নির্বাচন কমিশন পুনরায় গঠন করার জন্য বেগম জিয়া যে ফর্মুলা দিয়েছেন সেই ফর্মুলা জনগণের মাঝে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। এজন্য জনগণের মাঝে এই ইস্যুটি ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। যখন এই দাবিটি জনগণের গ্রহণযোগ্যতা পাবে, তার পরেও যদি আওয়ামী লীগ তার জেদ বহাল রাখে, অর্থাৎ সকলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে নির্বাচনী সরকার গঠনের দাবি প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে জনগণকে সাথে নিয়ে বিএনপি তথা ২০ দলকে সর্বাত্মক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। অভিজ্ঞ মহলের মত, মির্জা ফখরুল যে আন্দোলনের চিন্তাভাবনা করছেন সেটি বাস্তবায়িত করতে হলে বিএনপিকে এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।  প্রস্তুতি পর্বে একদিকে মানববন্ধন, সেমিনার সিম্পোজিয়াম প্রভৃতি অনুষ্ঠান করতে হবে, অন্যদিকে ধীরে ধীরে রাজপথে নেমে আসতে হবে। বিএনপির প্রস্তাবিত আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। একবার যদি জনগণকে আন্দোলনে সামিল করা যায় তাহলে আন্দোলনের সফলতা দমন নীতি দিয়ে ঠেকানো যাবে না। বিগত মার্চ আন্দোলনের পর ১ বছর ৮ মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। আর সময় ক্ষেপণ করলে বিএনপি তথা ২০ দল আন্দোলন গড়ে তোলার সময় পাবে না। যদি দাবির বাস্তবায়নই না হয় তাহলে সেই দাবিনামা প্রস্তুত করার পেছনে শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাংবাদিক এবং গবেষক দিয়ে সেই দাবিনামা প্রস্তুত করা অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। 

মঙ্গলবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

নেপালের রাজনীতিতে ভারতপন্থীদের বিপর্যয়


আঠার বছর পর এ মাসের প্রথম সপ্তাহে নেপাল সফরে এসেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। নেপালের ওপর ভারতের খবরদারির ইতিহাস দীর্ঘকালের। কিন্তু ২০০৮ সালে নেপালে রাজতন্ত্র অবসানের পর সেখানে শুরু হয় গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। সেই লক্ষ্যে নেপালে একটি সাংবিধানিক পরিষদ নির্বাচিত হয়। এই পরিষদের প্রধান কাজ ছিলো একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য সংবিধান প্রণয়ন করা। তার জন্য নেপালের দীর্ঘ সময় লেগেছে। তাকে খুব অস্বাভাবিক বলা যাবে না। কারণ নেপালে রাজতন্ত্র কায়েম ছিল ২৭০ বছর ধরে। সেই বৃত্ত থেকে বেরুনো খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। অনেক আলাপ আলোচনা আর বিতর্ক শেষে ১৯১৫ সালের ৩০ অক্টোবর নেপালের প্রথম গণতান্ত্রিক সংবিধান সাংবিধানিক পরিষদে গৃহীত হয়। নেপালের ৬০১ সদস্যের এই পরিষদে ৫০৭ সদস্যই সংবিধানের পক্ষে ভোট দেন এবং সংসদে সংবিধান গৃহীত হয়। বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র থেকে নেপাল প্রজাতন্ত্রে রূপ নেয়। ভারত ও নেপালের মধ্যকার সঙ্কটের শুরু হয় সেখান থেকেই।
নেপালের সংবিধান গৃহীত হয়েছিল ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার ভেতর দিয়ে। নেপালের দক্ষিণাঞ্চলের তেরাইতে মাধেসী বলে এক জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটতে থাকে ষাটের দশক থেকে। তেরাই অঞ্চল নেপালের সমতল ভূমি ও অত্যন্ত উর্বর এলাকা। ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক লোককে দিল্লী ঐ এলাকায় বসতি স্থাপনের জন্য পাঠিয়ে দেয়। তারা এসে বসবাস ও চাষাবাদ শুরু করে। এখানে নেপালিরাও চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে। নেপালের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ এই তেরাই অঞ্চলে বসবাস করে। তাদের মধ্যে ২০ ভাগ ভারতীয় বংশোদ্ভূত মাধেসী। নেপালের রাজতন্ত্রের আমলে আশির দশকে রাজা ভারতীয় বংশোদ্ভূত অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সরকার এই উদ্যোগের বিরোধিতা করে রাজতন্ত্র অবসানের হুমকি প্রদান করেন। বরং ভারতের অবৈধ অভিবাসীদের আত্মীকরণের জন্য নেপালের রাজাকে চাপ দেন। নিজের গদী রক্ষার জন্য রাজা তা মেনে নিতে বাধ্য হন। ভারতীয় মাধেসীরা আসন গেড়ে বসে।
এখানে ভারতীয় পরিকল্পনা কারও কাছে অস্পষ্ট ছিলো না। তাদের লক্ষ্য ছিলো, ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে তারা কোনোদিন মণিপুর বা সিকিমের মতো নেপালের তেরাই অঞ্চল দখল করে নেবে। আর নেপাল দখল করতে পারলে তাদের পক্ষে চীনকে মোকাবিলা করা অনেক সহজ হয়ে উঠবে। নেপালের রাজার ওপর ঐ চাপ সৃষ্টির পর থেকে ভারত অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে নেপালে মাধেসীদের বসতি বাড়াতে শুরু করে। কিন্তু সেখানে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর বিষয়টির প্রতি তারা মনোযোগী হয় এবং মাধেসী জনসংখ্যা নেপালে যাতে আর বাড়তে না পারে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে আগের মতো ধমক দিয়ে ফায়দা হাসিলের পরিবেশ আর নেপালে নেই। ফলে এ যাত্রা ভারত নতুন কৌশল গ্রহণ করে। তার একটি নেপালের নবগঠিত সংবিধান সংশোধন। এই সংশোধনের মাধমে ভারত মাধেসীদের জন্য অধিক আসন ও স্বতন্ত্র প্রদেশ তৈরি করতে চায়।
নেপালের ৬০১ আসনের সাংবিধানিক পরিষদ দীর্ঘ আট বছর আলাপ-আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত সংবিধানের ওপর ভোটাভুটি করে। তাতে সকল দলের মোট ৫০৭ জন ঐ খসড়া সংবিধানের পক্ষে ভোট দেন আর ৯৪ জন এর বিরুদ্ধে ভোট দেন। আবার এই সাংবিধানিক পরিষদে মাধেসীদের ভোট সংখ্যা ছিল ১১৬। তাদের মধ্যে ভোটাভুটির সময় ১১১ জন নয়া সংবিধানের পক্ষে ভোট দেন। অর্থাৎ মাধেসীরাও ব্যাপকভাবে এই সংবিধানের পক্ষে ভোট দেন। এখানেই প্রমাদ গোণে ভারত সরকার। ভারত দেখতে পায় যে নেপালের ওপর চাপ প্রয়োগের এত বড় একটা হাতিয়ার তাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আর তাই তারা মাধেসী দলগুলোর নেতাদের দিল্লীতে ডেকে নিয়ে এবং কাঠমান্ডুতে ভারতীয় দূতাবাসে বৈঠক করে সংবিধানের বিরুদ্ধে তাদের উস্কে দিতে থাকে। আর এই সুযোগে নেপালকে মাধেসীদের অসঙ্গত দাবি মেনে নেওয়ার জন্য ভারত চাপ দিতে শুরু করে। তারই অংশ হিসেবে ভারত গত বছর প্রচণ্ড শীতের মধ্যে নেপালে চার মাসেরও বেশি সময় ধরে অবরোধ আরোপ করে রাখে। নেপালে জ্বালানি তেল, খাদ্যশস্য, শাকসবজি, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
কিন্তু নেপালের সাধারণ মানুষ এতে দমে যাননি। তারা সকল কষ্ট সহ্য করেও নিজেদের আত্মমর্যাদা বজায় রেখে যান। নেপাল তার জ্বালানি তেলের জন্য শতভাগ নির্ভরশীল ভারতের ওপর। রান্নার গ্যাসও আসে ভারত থেকে। ভারত সেই জ্বালানির সরবরাহ বন্ধ করে দিলে ওলি চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। চীন আপৎকালের জন্য প্রায় ৫০ লক্ষ্য লিটার জ্বালানি স্থলবেষ্টিত নেপালকে বন্ধুত্বের স্মারক হিসেবে উপহার দেয়। সেই সঙ্গে সরবরাহ করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধও। দেয় লাখ লাখ সিলিন্ডার গ্যাস। জ্বালানি তেলে রেশন ব্যবস্থা চালু করা হয়। নেপালীরা এমনিতেই কষ্টসহিষ্ণু জাতি। তারা পায়ে হেঁটে চলাফেরা করতে শুরু করেন। নিজেদের ঊষ্ণ রাখার জন্য ও রান্নার জন্য তারা গ্যাসের বদলে ব্যবহার করতে শুরু করেন জ্বালানি কাঠ। সরকার সে কাঠ রেশন ব্যবস্থায় জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করে। ভারতের ওপর বাড়ে আন্তর্জাতিক চাপ।
আবার মাধেসীদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভারত তার সীমান্তের ভেতরে মাধেসীদের জন্য তৈরি করে দেয় অস্থায়ী ক্যাম্প। সেখানে আন্দোলনকারীদের জন্য রান্না ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়। মাধেসীরা নেপালের ভেতরে ঢুকে নানা ধরনের নাশকতা চালিয়ে যেতে থাকে। এক সময় এসব মাধেসী আন্দোলনের বদলে নানা ধরনের নিত্যপণ্যের চোরাচালানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আবার আন্দোলন করার জন্য লোকেরও অভাব দেখা দেয়। আন্দোলন করে না হয় তাদের নিজেদের পেট চলছিল, কিন্তু তাদের পরিবার পরিজনের খাওয়া-পরার জন্য তো অর্থের দরকার। কাজ দরকার। ফলে ধীরে ধীরে ভারতের তৈরি করা আন্দোলনের ক্যাম্প ফাঁকা হয়ে যেতে থাকে। লোকের অভাবে মাধেসীদের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। ভারতীয় পণ্যের সরবরাহ ফের শুরু হয়।
নেপালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি চুক্তি সম্পাদন করেন। তার মধ্যে আছে রেল ও সড়ক যোগাযোগ চুক্তি ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের সরবরাহ চুক্তি। যাতে ভবিষ্যতে ভারতের এ ধরনের চাপ প্রয়োগের বিপরীতে নেপালের সরবরাহ লাইন একেবারে বন্ধ হয়ে না যায়। চীনের সঙ্গে নেপালের এই চুক্তি ভারত ভালোভাবে নেয়নি। ফলে তারা ওলি সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সফলও হয়। ওলি নেপালের মাওবাদী নেতা পুষ্পকমল দাহাল ওরফে প্রচণ্ডকে নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন। প্রচণ্ড ওলির কোয়ালিশন থেকে বের হয়ে এসে এখন নেপালি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জোট বেঁধে সরকার গঠন করেছেন। শর্ত হলো যে, উভয় দল এগারো মাস করে ক্ষমতায় থেকে নতুন নির্বাচন দেবেন। উল্লেখ্য, নেপালে নতুন সংবিধান গ্রহণের সময় নেপালি কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল। এখনও কাঠমান্ডু দিল্লীর সম্পর্ক নিয়ে নানা টানাপোড়েন চলছে। মাধেসীরা সংবিধান সংশোধনের দাবি জানিয়েই যাচ্ছে। কূটনৈতিক উদ্যোগও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু মাধেসীদের দাবি অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের বড় ধরনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
এর মধ্যেই নেপাল সফরে এসেছিলেন ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি। তার বার্তাও একই ছিল। নেপাল যেন মাধেসীদের দাবি অনুযায়ী তাদের সংবিধান দ্রুত সংশোধন করে নেয়। তার এই বক্তব্যে নেপালের সাধারণ মানুষ ও পার্লামেন্টারিয়ানদের মধ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তাদের মতে, সংবিধান সংশোধনকামী কিছুসংখ্যক ভারতীয় বংশোদ্ভূত’র মাধ্যমে দিল্লী নেপালের অখণ্ডতা ধ্বংস করতে চায়। তাদের আশঙ্কা, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ভারত কার্যত নেপালের উর্বর ও সমতলভূমি দখল করে নিতে চায়। বস্তুত প্রণব মুখার্জি নেপাল ত্যাগের আগে সেখানকার রাজনীতিকদের প্রতি এই আহ্বান জানিয়ে গেছেন যে, তারা যেন মাধেসীদের দাবি অনুযায়ী দ্রুত নেপালের সংবিধান সংশোধন করে।
আসলে প্রণবের এই নেপাল সফরে কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনেনি। ভারতীয় পত্রিকা ফার্স্টপোস্ট লিখেছে, নেপাল ও ভারতের প্রেসিডেন্টের মধ্যে যে আলোচনা হয়েছে, তাতে দু’দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান, জনগণের মৈত্রী প্রভৃতি বিষয় স্থান পেলেও তাদের সম্পর্কের অবনতি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও নেপালের সংবাদপত্রগুলো বরং প্রণবের সংবিধান সংশোধন প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনাই করেছে। মিডিয়া বলেছে, এটা অপর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ। ভারতের অর্থনৈতিক অবরোধের ফলে নেপালের জনগণের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, প্রণবের সঙ্গে আলোচনায় সে বিষয়টি স্থান না পাওয়ায় নেপালের রাজনীতিকরা সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দাহাল তার ভারত সফরের আগে সংবিধানের কিছু সংশোধন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানের প্রধান বিরোধী দল ওলির সিপিএন ইউএমএল ও তার মিত্রদের বাধায় তা করতে পারেননি। অথচ এই দাহালই গত বছর বলেছিলেন, ‘সংবিধান গ্রহণ করে আমরা কেবল আমাদের সাংবিধানিক অধিকারই প্রতিষ্ঠা করেছি। কারও চাপের কাছে আমরা নতি স্বীকার করবো না। এটা আমাদের বিবেক ও আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। এবার নেপালি জনগণ তাদের নিজেদের সংবিধান নিজেরাই প্রণয়ন করেছে। এটা ছিল আমাদের ৭০ বছরের স্বপ্ন।’
তবে সিপিএন ইউএমএল-এর সমর্থন ছাড়া নেপালের সংবিধান সংশোধন করা যাবে না। ওলির দল ও তাদের সহযোগী আরপিপি-এন ২০০ আসনের অধিকারী। ওলি জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সংবিধান সংশোধনে সায় দেবেন না। সংবিধান সংশোধন করতে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন দরকার। নেপালের সংসদে সদস্য সংখ্যা ৫৯৫। এ ছাড়াও নেপাল মজদুর কিষাণ পার্টি, সিপিএন-এমএল, ন্যাশনাল পিপলস ফ্রন্ট জানিয়েছে, তারা সংবিধান সংশোধনের পক্ষে ভোট দেবেন না। এ ছাড়াও ভারতপন্থী বলে পরিচিত নেপালি কংগ্রেসের তরুণ সদস্যরাও সংবিধান সংশোধনের পক্ষে ভোট দেবেন না বলে প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেছেন। ওলি সরকারের পতন ঘটিয়ে ও সংবিধান সংশোধনের পক্ষ নিয়ে কাঠমান্ডু ভ্যালিতে মাওবাদী ও নেপালি কংগ্রেস তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছে। নাম প্রকাশ না করে নেপালি কংগ্রেসের এক নেতা বলেছেন, ‘এখানে গত নির্বাচনে তারা ১১টি আসন পেয়েছিলেন, সামনের নির্বাচনে তিনটি আসনও পাবেন না।’
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ট্রাম্পের হাই জাম্প এবং আশা ও প্রত্যাশা


দৃশ্যটি প্রথম দেখিয়েছে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল। তারপর দেখলাম ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। পাঠকদের অনেকেও সম্ভবত এর মধ্যে দেখে ফেলেছেন। দৃশ্যটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় কুস্তি বা রেসলিং-এর। দেখার পর মনে পড়লো, বেশ কয়েক বছর আগে কোনো এক টিভি চ্যানেলে দেখেছিলাম। এ দৃশ্যে দেখা গেছে, মঞ্চে যখন দুই কুস্তিগীরের যুদ্ধ চলছে তখন মঞ্চের বাইরে এক কুস্তিগীরের কোচ বা ম্যানেজারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছেন স্যুট-টাই পরা সুঠাম দেহের একজন। দেখে বোঝা যাচ্ছিল, এই ব্যক্তিও এক সময় জাঁদরেল কুস্তিগীর ছিলেন। তিনি শুধু ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং যথেচ্ছভাবে মারপিট করেই থেমে যাননি, ওই কোচ বা ম্যানেজারকে পেটাতে পেটাতে মঞ্চেও উঠিয়ে ছেড়েছেন। এখানেও শেষ নয়, লোকটি মঞ্চে চেয়ার আনিয়েছেন, ওতে প্রতিপক্ষের কোচ বা ম্যানেজারকে জোর করে বসিয়েছেন এবং তারপর নিজের পক্ষের আরো একজনকে সঙ্গে নিয়ে বেচারার চুল চেছে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে নাটকীয়তাও যথেষ্টই করেছেন তিনি। রীতিমতো শেভিং জেল মাখিয়ে তিনি নিজেই রেজার দিয়ে চুল চেছেছেন। মার্কিন দর্শকরাও দৃশ্যটি উপভোগ করেছেন। অন্যায় এবং আইনত অপরাধ হলেও আয়োজকদের পক্ষ থেকে স্যুট-টাই পরা লোকটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বোঝাই যাচ্ছিল, মার্কিন কুস্তির জগতে অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি তিনি। টিভির ধারা ভাষ্যকারদের বদৌলতে তার নামও জানা গিয়েছিল। ভাষ্যকাররা বারবার ‘ট্রাম্প, ডোনাল্ড ট্রাম্প’ বলে চিৎকার করছিলেন।
হ্যাঁ, এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথাই বলা হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকে আমার স্ত্রী কিন্তু বারবার বলে এসেছেন, ট্রাম্পকে কেন যেন তার খুব চেনা চেনা লাগে। তখন আমি কোনো গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু নির্বাচনের পরদিনই যখন কুস্তির ওই দৃশ্যটি দেখার সুযোগ পেলাম তখন আর কোনো সন্দেহ রইল না। বুঝলাম, আমার বেগম সাহেবার ট্রাম্পকে কেন চেনা চেনা মনে হয়েছিল। এর অর্থ, ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধু রিয়েল এস্টেটের একজন সফল ব্যবসায়ী নন, এক সময় নিজে তো কুস্তিগীর ছিলেনই, কুস্তির ব্যবসায়ও তিনি যথেষ্টই দেখিয়ে এসেছেন। কে জানে, ক্যাসিনো ও জুয়ার যে বিশাল ব্যবসার কথা শোনা যাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রেসলিং বা কুস্তির ব্যবসাও ছিল কি না। সেটা থাকুক আর না-ই থাকুক, উল্লেখিত ওই একটি মাত্র দৃশ্যের মধ্য দিয়েও কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে ধারণা করা যায়। অতি উৎসাহী অনেকে আবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। পুটিন সম্পর্কে ধারণা দেয়ার জন্য একবার টিভির এক অনুষ্ঠানে দেখানো হয়েছিল, কুস্তি বা মল্লযুদ্ধে কতটা দক্ষ ও শক্তিশালী তিনি। পুটিন নাকি অতি ভয়ংকরও ছিলেন, যার জন্য তাকে ব্ল্যাক বেল্টের সম্মান দেয়া হয়েছিল। মূলত সে কারণেই মানুষ অবাক হয়নি নির্বাচনী প্রচারণার দিনগুলোতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুটিনের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কথা শুনিয়েছেন। বলা দরকার, সাধারণ মার্কিনীরা কিন্তু এখনো রাশিয়াকে নিজেদের মিত্র রাষ্ট্র বলে ভাবতে পারেন না। অন্যদিকে সেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুটিনের প্রতি প্রকাশ্যে সম্মান দেখানোর ঘোষণা দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পুটিনও ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এখন বোঝা যাচ্ছে, কুস্তি বা মল্লযুদ্ধ দু’জনের সুসম্পর্কের পেছনে একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে থাকতে পারে। এ পর্যন্ত এসে থেমে গেলে অবশ্য আপত্তির কারণ নেই। ভীতি ও আপত্তির কারণ সৃষ্টি হবে যদি তারা বিশ্বের নিরীহ ও শান্তিকামী মানুষের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ শুরু করেন। অর্থাৎ বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে দেশে দেশে যদি দুই পরাশক্তির আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞ বেড়ে যেতে থাকে। অমন আশংকা কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের অনেকেই ইতিমধ্যে ব্যক্ত করেছেন।
এ ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্প তো নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই জানান দিয়ে এসেছেন। যেমন মুসলিম মাত্রকে জঙ্গি-সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। যারা বৈধ বা অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন তাদের সকলকেও বহিষ্কার করবে তার সরকার। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছিলেন তিনি। প্রশ্নসাপেক্ষ কারণে সৌদি আরবের ব্যাপারে তাকে অবশ্য অন্য রকম মনে হয়েছে। কারণ, মুসলিম বিরোধী প্রচারণায় সোচ্চার হলেও একই ট্রাম্প আবার বলেছিলেন, সৌদি আরবের হাতে পারমাণবিক সমরাস্ত্র তুলে দেবেন তিনি। এ ছিল এক বিস্ময়কর ঘোষণা। কারণ, সৌদি আরবকে মুসলিম বিশ্বের নেতা বা প্রধান রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেজন্য একদিকে মুসলিম বিরোধী প্রচারণা এবং অন্যদিকে সৌদি আরবের হাতে পারমাণবিক সমরাস্ত্র তুলে দেয়ার ঘোষণায় বিশ্বজুড়ে আলোড়ন উঠেছিল। অনেকে ‘ব্যবসায়ী’ ট্রাম্পকে প্রাধান্যে আনলেও সাধারণভাবে বলা হয়েছিল, মূলত টাকার প্রয়োজনে সৌদি আরবকে খুশি করতে চেয়েছেন ট্রাম্প। এই ব্যাখ্যার সুফলও অবশ্য ট্রাম্পের পক্ষে যায়নি। কারণ, কথায় বলে, গাছের শিকড় কেটে ফেলে ওপরে পানি ঢেলে কোনো লাভ হয় না। একই কারণে মুসলিম বিরোধী ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সৌদি আরবের হাতে পারমাণবিক সমরাস্ত্র তুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়ে লাভবান হতে পারবেন না ট্রাম্প।
প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হতে না হতেই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প অবশ্য নাটকীয় পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে ট্রাম্প বলেছেন, জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড বন্ধ করার লক্ষ্যে এটা ছিল তার একটি পরামর্শ, কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নয়। অর্থাৎ মুসলিমরা আগের মতোই যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াত ও বসবাস করতে পারবেন। কথা শুধু এটুকুুই নয়। নির্বাচনের পরপর প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওয়েবসাইট থেকে মুসলিম বিরোধী সকল বক্তব্য ও বিবৃতি ‘গায়েব’ হয়ে গেছে! এখন আর সহজে প্রমাণ করা যাবে না, মুসলিমদের বিরুদ্ধে ট্রাম্প কোনো কঠোর বক্তব্য রেখেছিলেন। উল্লেখ্য, বিদেশীদের বহিষ্কার প্রসঙ্গেও কথা পাল্টে ফেলেছেন ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর দিনগুলোতে তিনি বলেছিলেন, প্রায় দেড় কোটি মেক্সিকানকে তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসরত সকল বিদেশীকেও ঝেঁটিয়ে তাড়ানো হবে। নির্বাচিত হওয়ার পর একই ট্রাম্প শুনিয়েছেন নতুন কথা। বলেছেন, অবৈধভাবে বসবাসরত সকলকে নয় বরং শুধু অপরাধীদের তাড়ানো হবে। অবৈধভাবে প্রবেশ করা এবং বসবাস করাটাও যে বড় ধরনের অপরাধ সে কথা বেমালুম পাশ কাটিয়ে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এর সকল প্রেসিডেন্টই কথা পাল্টানোর ও নিজের বলা কথা অস্বীকার করার ব্যাপারে সব সময় এগিয়ে থাকেন। কথা বা অঙ্গীকারও তারা সাধারণত রক্ষা করেন না।
এ প্রসঙ্গে উদাহরণের ভিড়ে গিয়ে হিমশিম খাওয়ার পরিবর্তে দু-একটি মাত্র তথ্যের উল্লেখই যথেষ্ট হতে পারে। কথিত মুসলিম জঙ্গি নেতা ওসামা বিন লাদেনের আড়াল নিয়ে টুইন টাওয়ার ধ্বংস করা থেকে শুরু করে সর্বশেষ সিরিয়ায় গণহত্যাসহ যুদ্ধ ছড়িয়ে দেয়া পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের পর্যালোচনায় দেখা যাবে, সব অজুহাত ও উপলক্ষই যুক্তরাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। দেশটির নেতৃত্বে ইরাকের পর লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো একের পর এক ধ্বংস ও পঙ্গু হয়ে গেছে। এখন চলছে সিরিয়ার পালা। দীর্ঘ এই সময়ের মধ্যে জর্জ বুশ এসে চলে গেছেন, এসেছেন মুসলিম নামধারী বারাক হোসেন ওবামা। তাদেরও আগে বিল ক্লিনটনও যথেষ্টই দেখিয়ে গেছেন। ধারণা করা হয়েছিল, বিশেষ করে ওবামার আমলে হয়তো মুসলিমরা কিছুটা হলেও নিস্তার পাবে। কিন্তু সেটা হয়নি। ঘটনাপ্রবাহে বরং আইএস তথা ইসলামিক স্টেট নামের নতুন একটি জঙ্গি সংগঠনের জন্ম ও বিস্তার ঘটেছে, যার পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন ওবামার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। ডোনাল্ড ট্রাম্প তো বেশ কিছু উপলক্ষেই অভিযোগ করেছেন, হিলারি ক্লিনটনই আইএস-এর প্রকৃত জন্মদাত্রী। ট্রাম্পের অভিযোগটি সারা বিশ্বেই সত্য বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। অথচ এই হিলারি ক্লিনটনকে নিয়েই অন্য অনেক রাষ্ট্রের মতো মুসলিম প্রধান বাংলাদেশেও প্রচুর হৈচৈ হয়েছে। তিনি হেরে যাওয়ায় দুঃখে মরি মরি হয়েছেন এদেশের অনেকেই!
তারও আগে নির্বাচনী প্রচারণার দিনগুলোতে বাংলাদেশের মিডিয়ার ভূমিকার কথা স্মরণ করে দেখুন। নির্বাচনের তারিখ ৮ নভেম্বরও একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের প্রথম কলামের শিরোনাম ছিল, ‘ঐতিহাসিক জয়ের পথে হিলারি ক্লিনটন’। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশিষ্ট বিশ্লেষক হিসেবে পরিচিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিখেছিলেন, বিজয় নাকি হিলারির একেবারে ‘হাতের মুঠোয়’ এসে গেছে! শুধু তা-ই নয়, একই দৈনিকের দ্বিতীয় প্রধান খবরে সেদিন বলা হয়েছিল, হিলারি নাকি ৯০ শতাংশ ভোট পেতে চলেছেন! অন্যদিকে বাস্তবে কী ঘটেছে সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই বলার দরকার পড়ে না। পপুলার তথা সাধারণ ভোটারদের ভোটেও হিলারি ক্লিনটন মাত্র দশমিক তিন-চার শতাংশে এগিয়ে থাকতে পেরেছেন। আর ইলেক্টোরাল ভোটে তো তার ভরাডুবিই ঘটেছে।
এখানে হিলারি ক্লিনটন এবং তারও আগে বারাক ওবামার উদাহরণ দেয়ার কারণ আসলে একটি কঠিন সত্য জানানো। আর সে সত্যটি হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে যিনিই নির্বাচিত হোন না কেন, এতে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোর তো বটেই, বিশেষ করে মুসলিমদের জন্য লাভবান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সুতরাং আশাবাদী হয়ে ওঠাও অনুচিত। এ ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অবশ্য ধন্যবাদ দেয়া দরকার। কারণ, অনেক কথা পাল্টে ফেললেও একটি বিষয়ে তিনি ধারণা পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রশ্নে আপসহীন থাকবে তার সরকার। আর মার্কিন স্বার্থের অর্থই যে দেশে দেশে যুদ্ধ বাধানো এবং সমরাস্ত্র বিক্রি করা সে কথা এতদিনে শিশু-কিশোররাও বুঝতে পেরেছে। আমাদের ভীতি ও আতংকের কারণও সেটাই। তা সত্ত্বেও আমরা আশা করতে চাই, অতীতের মতো মল্লযুদ্ধে নামার পরিবর্তে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেই নিজেকে বেশি নিয়োজিত রাখবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই প্রচেষ্টায় তিনি যদি ব্ল্যাক বেল্টধারী আরেক মল্লবীর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøদিমির পুটিনকে নিজের পাশে আনতে পারেন তাহলে বিশ্বের নির্যাতিত ও শান্তিকামী মানুষ ডোনাল্ডের নামে জয়ধ্বনি করে উঠবে। আমরা আবশ্য জানি না, এই বারতা নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছাবে কি না এবং কোনোভাবে পৌঁছালেও শান্তির আহ্বানে তিনি সাড়া দেবেন কি না! সাড়া দিন আর না-ই দিন, ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফল ‘হাই জাম্প’-এর কথা বিশ্ববাসীর মনে থাকবে বহু বছর পর্যন্ত।
আশিকুল হামিদ 

বুধবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

পরিবর্তনটা আগে কোথায় হওয়া প্রয়োজন?


আবারও হামলা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে। ৪ নবেম্বর ভোর রাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে ভাংচুর ও লুটপাটের ৫ দিন পর একই উপজেলায় দ্বিতীয় দফায় এ অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলো। এসব ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের ৩ নেতাকে বহিষ্কার করেছে জেলা আওয়ামী লীগ। নাসিরনগরের পর হামলার ঘটনা ঘটেছে হবিগঞ্জের মধুপুর মন্দির ও বরিশালের বানারীপাড়া পৌরসভার কেন্দ্রীয় হরিসভা মন্দিরে। এ ছাড়া হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ঠাকুরগাঁও সদরের একটি মন্দিরে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে নারগুন ইউনিয়ন পরিষদের সদ্য নির্বাচিত চেয়ারম্যান পয়গাম আলিকে পুলিশ আটক করেছে। বগুড়ার ধুনটের ইছামতী নদীর তীরে কেন্দ্রীয় শ্মশানঘাট সংলগ্ন মন্দির থেকে চুরি হয়ে গেছে চারটি প্রতিমার মাথা। হঠাৎ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন।
আমরা জানি, বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। শত শত বছর ধরে এই জনপদের মানুষ নানা ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পরও সম্প্রীতির সাথে বসবাস করে আসছে। আর এই দেশের একটি ইতিবাচক বিষয় হলো, জনসংখ্যার ৯০ শতাংশই মুসলিম। মুসলমানদের ধর্ম ইসলাম অন্য ধর্মের মানুষদের সাথে শুধু সদাচরণেই উদ্বুদ্ধ করেনি, অন্যায় আচরণ থেকে বিরত থাকারও নির্দেশনা দিয়েছে। এ কারণে অন্য ধর্মের লোকদের উপর হামলা কিংবা নিপীড়ন ইসলাম ধর্মে গর্হিত বা গুনাহের কাজ। ফলে প্রশ্ন জাগে, এরপরও এ দেশে বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালালো কারা? এদের পরিচয় কি? কী তাদের উদ্দেশ্য? তবে একটি বিষয় সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, ইসলাম ধর্মে অনুরাগী কিংবা ধর্মপ্রাণ কোন মুসলমান এই ধরনের হামলার সাথে জড়িত থাকতে পারে না। এ কাজ যারা করেছে তারা অবশ্যই মন্দ লোক। ধর্ম ভাবনায় সমৃদ্ধ কোন মানুষ এমন কাজ করতে পারে না। এসব মন্দ লোকদের আইনের আওতায় এনে যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রশাসনের দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি। তবে সঙ্গত এই কাজটি করতে হলে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের ব্লেমগেম থেকে মুক্ত থাকতে হবে। যথাযথ তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রকৃত অপরাধীদের সনাক্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা বন্ধ হতে পারে। তবে দুঃখের বিষয় হলো, এমন ন্যক্কারজনক ঘটনাকে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার মতো লোকও আছে এ দেশে। মতলববাজ এমন লোকদের অপপ্রচার ও শঠতার ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে দেশের জনগণকে। কিছু কিছু অদ্ভুত কথাও শোনা যাচ্ছে বর্তমান সময়ে। যেমন ৪ নবেম্বর রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেছেন, গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগে জামায়াতীকরণ হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের ভেতরে জামায়াতে ইসলামীর লোকজন ঢুকে পড়েছে। তারা সাম্প্রদায়িক হামলায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। এমন বক্তব্য জনমনে নানা সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করতে সমর্থ হলেও প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করতে আদৌ কোন অবদান রাখতে সক্ষম হবে কিনা সেই প্রশ্ন জাগতেই পারে। সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ন্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বক্তব্য রাখার পরিবর্তে কিছু রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী ব্লেম-গেমে মত্ত থাকতেই পছন্দ করছেন। জাতির জন্য এটাও একটি বড় আপদ।
আমরা মনে করি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে এক হিন্দু যুবকের ফেসবুক আইডি থেকে কা’বা শরীফের ছবির উপর মূর্তি বসিয়ে পবিত্র কা’বার অবমাননার যে কাজটি করা হয়েছে তা খুবই আপত্তিকর। কেন এ কাজটি করা হলো? সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় এনে প্রকৃত মোটিভ উদ্ধার করা প্রয়োজন। আর এই ঘটনাকে পুঁজি করে যারা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মতো ন্যক্কারজনক কাজ করেছে তাদেরও আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি বিধান করা প্রয়োজন। কারণ দু’টি কাজই ধর্ম ও মানবিক বিবেচনায় নিকৃষ্ট কাজ। এমন কাজের কারণে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়েছে এবং ক্ষুণ্ন হয়েছে দেশের ভাবমর্যাদা। তাই এসব বিষয়ে সততার সাথে ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও রাজনৈতিক কোন্দল ঘটনার সাথে জড়িয়ে যাওয়ায় সততার বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ভারত। এ উদ্বেগের কথা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করার জন্য ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। খবর পিটিআইএর। উল্লেখ্য যে, ৬ নবেম্বর এক টুইট বার্তায় সুষমা স্বরাজ লিখেছেন, আমি ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দুদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের ব্যাপারে আমাদের গভীর উদ্বেগের কথা জানাতে বলেছি। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ফেসবুকে দেওয়া ধর্মীয় অবমাননাকর একটি ছবিকে কেন্দ্র করে ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ২০টি হিন্দু বাড়ি ও ১৫টি মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে পুলিশ ইতোমধ্যে ৫৩ জনকে গ্রেফতার করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর অভিযান এখনও অব্যাহত রয়েছে। নাসিরনগরের ইউএনওকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। উপজেলা সদরসহ বিভিন্নস্থানে র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবিসহ অন্তত ৫০০ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে।
নাসিরনগর উপজেলায় হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার ঘটনা শুধু অন্যায় নয়, ন্যক্কারজনকও। এলাকার জনগণ এবং দেশের মানুষ ওই ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে ও রুখে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসন অপরাধীদের গ্রেফতার করে শাস্তি প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। এলাকার মন্ত্রী ঘটনাকে ষড়যন্ত্রমূলক বলে অভিহিত করেছেন। পদবঞ্চিতদের প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন তিনি। খবরে দলীয় কোন্দলের বিষয়টিও উঠে এসেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে যা বোঝায় নাসিরনগরে তা লক্ষ্য করা যায়নি। যথাযথ তদন্ত শেষে বিচারের মাধ্যমে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পাবে এবং প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে বলে আমরা আশা করি।
নাসিরনগর উপজেলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। তিনি ভারতীয় হাইকমিশনারকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দুদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের ব্যাপারে ভারতের উদ্বেগের কথা জানাতে বলেছেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে যে ভাষায় উদ্বেগ প্রকাশ করলেন তাতে আমাদের আত্মমর্যাদায় আঘাত লেগেছে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে নাসিরনগর উপজেলার সব মানুষ তো বাংলাদেশের নাগরিক। নাগরিকদের জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তাবিধান সরকারের দায়িত্ব। সরকার প্রশাসনের মাধ্যমে তার দায়িত্ব পালন করে থাকে। যারা সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তারপরও বাংলাদেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের ব্যাপারে এভাবে গভীর উদ্বেগ প্রকাশের কী কারণ থাকতে পারে? আলোচ্য ঘটনায় তো একজন মানুষেরও প্রাণহানি হয়নি। তবে যা হয়েছে তার বিরুদ্ধেও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষপাতি আমরা। যে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলেন, প্রসঙ্গত সেই দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সম্পর্কেও প্রশ্ন এসে যায়। ভারতের মত এত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পৃথিবীর আর কোথায়ও হয় কী। গরুর গোস্ত খাওয়ার অপরাধে তো ভারতে মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কুরবানির গোস্ত বহন করার অপরাধে ভারতে নারী ও শিশুদের ট্রেন থেকে লাথি মেরে ফেলে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন। কই এইসব বিষয় নিয়ে তো বাংলাদেশ সরকার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। তবে করলে ভালো হতো। কারণ কোথায়ও সীমালঙ্ঘন হলে, বাড়াবাড়ি হলে এবং সংশ্লিষ্ট সরকার যৌক্তিক পদক্ষেপ না নিলে, সে ক্ষেত্রে উদ্বেগ প্রকাশ করা অবশ্যই মানবিক দায়িত্ব। কিন্তু বাংলাদেশে তেমন কিছু হয়েছে কী? আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তার ব্যাপারে যে মাত্রায় সচেতন ও আন্তরিক, তারপরও তার সরকারকে এভাবে উদ্বেগ জানানোর বিষয়টি আমাদের কাছে সম্মানজনক বলে মনে হয়নি। কিছুটা অযৌক্তিক বলেও মনে হয়েছে।
মানুষ সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে, সৌন্দর্য সম্পর্কে চমৎকার চমৎকার সংজ্ঞা আছে। কিন্তু দুঃখের বিয় হলো, বর্তমান সময়ের রাজনীতি আমাদের সেখানে পৌঁছতে দিচ্ছে না। এই বিষয়টি আমরা দেশে, উপমহাদেশে এবং লক্ষ্য করছি বৈশ্বিক পরিমন্ডলেও। নাসির নগরের মত ঘটনা নানা বর্ণে নানা মাত্রায় আমরা বিভিন্ন দেশে লক্ষ্য করছি। এই ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের করণীয় আছে। তবে রাজনীতিবিদদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের রয়েছে প্রচুর অভিযোগ। এই সব অভিযোগ থেকে মুক্ত না হয়ে তারা গণআকাক্সক্ষার অনুকূলে কাজ করতে সক্ষম হবেন কী? অর্থাৎ আমরা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছি। তবে এখানে একটি প্রশ্ন জাগে- পরিবর্তনটা আগে কোথায় হওয়া প্রয়োজন? আচরণে, নাকি বচনে?

শুক্রবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

আওয়ামী নেতৃত্বের পরিবর্তন ও সম্ভাবনার প্রশ্ন


আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত বা নিযুক্ত হওয়ার পর সেতু ও সড়ক যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন পর্যায়ে আলোচনা যথেষ্টই হয়েছে।  দলের সভানেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘কদমবুছি’ করার ছবি দেখেও মুগ্ধজনেরা তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কাউন্সিলকেন্দ্রিক দিনগুলোতে সাধারণ সম্পাদক কে হতে পারেন- এ বিষয়টি নিয়ে যখন জোর জল্পনা-কল্পনা চলছিল তখন ওবায়দুল কাদের বলে রেখেছিলেন, ‘আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখতে পাবে’। সেই ‘চাঁদ’ হিসেবে তিনি নিজেই এসেছেন দৃশ্যপটে। শুধু আসেননি বরং দল থেকে ‘আবর্জনা’ দূর করার মতো কিছু অঙ্গীকার ঘোষণার কারণে এখনো আলোচিত হয়ে চলেছেন। বলা হচ্ছে, প্রকারান্তরে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন, আওয়ামী লীগের ভেতরে আসলেও এমন অনেকে রয়েছে- ‘শুদ্ধ’ মানব ওবায়দুল কাদের যাদের ‘আবর্জনা’ মনে করেন। বলা দরকার, সেতু ও সড়ক যোগাযোগমন্ত্রী হওয়ায় ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে আলোচনা চলছে বহুদিন ধরে। এই আলোচনা বেশি জমে ওঠে বিশেষ করে ঈদের মতো উপলক্ষগুলোতে, লাখ লাখ মানুষকে যখন খানাখন্দকে ভরা সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে যাতায়াত করতে হয়। যখন প্রাণও হারাতে হয় অনেককে। ওবায়দুল কাদের তখনও চমৎকার ভাষায় কথা বলে থাকেন। আশ্বাস তো শোনানই। কাজের কাজ অবশ্য কমই হতে দেখা যায়। কারণ, মন্ত্রী ব্যস্ত থাকেন তাদের উড়াল সেতু আর চার-ছয়-আট লেনের কিছু মহাসড়ক নিয়ে। পদ্মা সেতু নিয়েও ওবায়দুল কাদেরই এ পর্যন্ত বেশি বলেছেন। এখনো বলা শেষ হয়েছে বলে মনে হয় না।
আজকের নিবন্ধ অবশ্য কেবলই ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে পরিকল্পিত হয়নি। তিনি এসেছেন উপলক্ষ হিসেবে। শুনে অতি কৌতূহলী পাঠকদের কারো কারো মুখে বাঁকা হাসি দেখা দিতে পারে, কিন্তু সত্য হলো, জনাব ওবায়দুল কাদেরের নাম শোনা মাত্রই আমার মনে ‘পাঠশালা’ শব্দটি এসে যায়। শুধু পাঠশালা নয়, ‘কারাগারের পাঠশালা’ও! কথাটা তথাকথিত ১/১১-এর অন্যতম ভিক্টিম ওবায়দুল কাদেরই বলেছিলেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি আসলে কি ঘটানো হয়েছিল, সে সম্পর্কে এতদিনে অনেক কথা ও কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে। এখনো হচ্ছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রধান কর্তব্যকে পাশ কাটিয়ে জেনারেল মইন উ আহমেদের নেতৃত্বাধীন ‘উদ্দিন সাহেবরা’ কতোটা নিষ্ঠুরতার সঙ্গে রাজনীতি ও রাজনীতিক বিরোধী অভিযান চালিয়েছিলেন, সে সম্পর্কেও বিস্তারিতভাবেই জানা গেছে। এখনো অনেক কাহিনী বেরিয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এ ব্যাপারে জাতীয় সংসদে বলেছেন, অভিযোগ তুলেছেন। সব মিলিয়েই তত্ত্বাবধায়ক নামের ওই সরকারকে বৈধতা দেয়া-না দেয়ার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু সেটা ওঠেনি। আসলে উঠতে দেয়া হয়নি। রাজনীতিকদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টিকে তো ধামাচাপাই দেয়া হয়েছে। তাই বলে ধামা একেবারে চাপা দেয়া যায়নি। বিশেষ করে রাজনীতিকদের ওপর চালানো নির্যাতনের বিষয়টি। উদাহরণ দেয়ার জন্য দু’চারজন রাজনৈতিক নেতার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা হলে পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
প্রথমে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের কথা, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের পর ওবায়দুল কাদের যার উত্তরসূরী হিসেবে নির্বাচিত বা নিযুক্ত হয়েছেন। ‘উদ্দিন সাহেবরা’ বিদায় নেয়ার এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপর নিজের অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনাতে গিয়ে ঝড় বা আলোড়ন শুধু নয়, তুফানও তুলেছিলেন নওগাঁর আবদুল জলিল। মাঠে-ময়দানে বা বঙ্গভবনের সামনের চত্বরে নয়, এই তুফান তুলেছিলেন জাতীয় সংসদে। ওই ভাষণে অবশ্য নতুন কোনো গৃহযুদ্ধের হুমকি দেননি আবদুল জলিল। তেমন হুমকি দেয়ার মতো আবস্থাই তার ছিল না। না থাকার কারণ, তিনিও উদ্দিন সাহেবদের রাজনীতিক বিরোধী অভিযানের অসহায় শিকার হয়েছিলেন। আবদুল জলিল জানিয়েছিলেন, কিভাবে চোখ বেঁধে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। উচ্চারণের অযোগ্য অশালীন শব্দযোগে তাকে গালাগাল করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন সম্পর্কে তিনি সম্ভবত লজ্জায় সব কিছু জানাননি। তবু এটুকু অন্তত না জানিয়ে পারেননি যে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলানোর জন্য তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। বাজারে সে সময় যে সিডির ছড়াছড়ি ঘটেছিল, তার ছবিতে আবদুল জলিলকে চোখ খোলা অবস্থায় শেখ হাসিনা সম্পর্কে ‘যা-তা’ বলতে দেখা গেছে। কিন্তু সংসদের ভাষণে আবদুল জলিল জানিয়েছিলেন, কথা বলার সময় তার চোখ বাঁধা অবস্থাতেই ছিল। পরে ক্যামেরার কারুকাজে ও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার করে দেখানো হয়েছে, যেন তিনি চোখ খোলা থাকা অবস্থায় কথাগুলো বলেছিলেন!
আবদুল জলিল দাবি করেছিলেন বলে ধরে নেয়া যায়, কথাগুলো তাকে দিয়ে বলানো হয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যও স্মরণ করা দরকার। বাজারে যখন আবদুল জলিলের সেই সিডির ছড়াছড়ি এবং সিডির কথাগুলো নিয়ে যখন মানুষের মধ্যে আলোচনা জমে উঠেছিল, তেমন এক সময়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, প্রাণ বাঁচানোর জন্য যার যা খুশি বলতে থাকুক। তাকে (শেখ হাসিনাকে) বাঁচানোর জন্য যেন কাউকে মরতে না হয়। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে উদ্দিন সাহেবদের নিষ্ঠুরতা এতটাই ভয়ংকর ছিল যে, শেখ হাসিনার মতো নেত্রীকেও তখন ‘হাল’ ছেড়ে দিতে হয়েছিল। সে অবস্থার অন্য ব্যাখ্যা থাকলেও এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, আবদুল জলিলের ওপর এমন কঠোর নিষ্ঠুরতাই চালানো হয়েছিল যে, এত বড় একজন নেতা হয়েও তিনি উদ্দিন সাহেবদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অথচ এই আবদুল জলিলই ১/১১-পূর্ব এবং লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাস পরবর্তী ভীতিকর দিনগুলোতে প্রতিদিন কয়েকবার করে প্রেসিডেন্টকে গৃহযুদ্ধের ভয় দেখিয়েছিলেন। সে কারণে ধরে নেয়া যায়, নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে কাহিল থাকা আবদুল জলিল যদি জানতেন, তাকে ছেলের বয়সীদের ‘স্যার’ ডাকতে হবে এবং মান-সম্মান খোয়ানোর পর আবেদন-নিবেদন করে চিকিৎসার নামে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে নিজেকে বাঁচাতে হবে, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই ওই দিনগুলোতে কথার তুবড়ি ছুটাতেন না। কথায় কথায় গৃহযুদ্ধের ভয় তো দেখাতেনই না। শুধু আবদুল জলিলের কথাই বা বলা কেন? লগি-বৈঠার তাণ্ডব থেকে সংবিধান নির্দেশিত সংসদ নির্বাচন ভণ্ডুল করে দেয়ার কর্মকাণ্ড চালানো পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে আরো অনেক নেতাই সে সময় উস্কানিমূলক ভূমিকা পালন করেছিলেন। কেউ এমনকি বঙ্গভবনের ‘অক্সিজেন’ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়ার এবং প্রকারান্তরে দেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন।
আবদুল জলিলের মতো আরো অনেক রাজনীতিককেই উদ্দিন সাহেবদের দু’বছরে নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়েছিল। তারাই পরবর্তীকালে একের পর এক মুখ খুলেছেন। ওবায়দুল কাদের অবশ্য কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ বৃত্তান্ত জানানোর পরিবর্তে সূচনা বক্তব্য হিসেবে তিনি শুধু এটুকু জানিয়েছিলেন যে, ‘কারাগারের পাঠশালায়’ তাকে ‘বহুকিছু’ শিখতে হয়েছে! আওয়ামী লীগেরই এক প্রবীণ নেতা মহিউদ্দিন খান আলমগীরসহ আরো কয়েকজন কিন্তু মুখ খুলেছিলেন। তারা তাদের ওপর চালানো নির্যাতন সম্পর্কে জানিয়েছেন। বলেছেন, কতটা অন্যায় ও আইন বহির্ভূতভাবে তাদের স্ত্রী-সন্তানদের পর্যন্ত নাজেহাল করা হয়েছিল। একই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলেন বিএনপির নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ আরো অনেকেই। তাকে ভয় দেখানোর জন্য পাশের কক্ষে নির্যাতিত অন্য একজনের ‘মাগো-মাগো’ ধরনের আর্তনাদও শোনানো হয়েছিল। এসবই উদ্দিন সাহেবরা করিয়েছিলেন জুনিয়র অফিসারদের দিয়ে- যারা কথায় কথায় রাজনীতিকদের ‘চোদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার’ করেছেন এবং বলেছেন, রাজনীতিকরা জনগণের ‘সবচেয়ে বড় শত্রু’। রাজনীতিকরা দেশের জন্য ‘কিছুই করেননি’! ব্যারিস্টার মওদুদ জানিয়েছিলেন, শেখ হাসিনার একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিসহ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকেই বুট দিয়ে বুকের ওপর লাথি মেরেছেন ওই জুনিয়র অফিসাররা।
এভাবে উদাহরণের সংখ্যা বাড়ানো বর্তমান নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য আসলে ‘কারাগারের পাঠশালায়’ বহুকিছু শিখে আসা নেতা ওবায়দুল কাদের এবং উদ্দিন সাহেবদের দু’বছরের বাংলাদেশ সম্পর্কে সংক্ষেপে জানানো। প্রধান দুই উদ্দিন জেনারেল মইন উ এবং ড, ফখরুদ্দিন আহমদের খোঁজ-খবর নেয়ার উদ্দেশ্যও রয়েছে। পাঠকরা তাই বলে বেশি আশা করবেন না। কারণ, প্রধান দুই উদ্দিনেরই আসলে খবর নেই বহুদিন ধরে। বছরখানেক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে পাওয়া এবং ঢাকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, দীর্ঘদিন পর জনসমক্ষে এসে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে ক্ষমতা দখলকারী গোষ্ঠীর প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমদ। খবরে ভদ্রতা করে বিব্রতকর পরিস্থিতির কথা বলা হলেও বাস্তবে বাংলাদেশীদের ধাওয়ার মুখে পড়েছিলেন তিনি। ঘটনাস্থল ছিল জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার মসজিদ। সেখানে জুমার নামাযের পর এক বাংলাদেশী বন্ধুর জানাযায় অংশ নিতে গেলে শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ, প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশী মুসল্লীরা। কয়েক মিনিটের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় শখ মিটে গিয়েছিল ফখরুদ্দিন আহমদের। বক্তব্য রাখার সুযোগ পাওয়া দূরের কথা, তিনি এমনকি মসজিদের ভেতরেও থাকতে পারেননি। মসজিদ কমিটি কোনোভাবে বাইরে অপেক্ষমান একটি গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিল তাকে। তখনও প্রতিবাদী স্লোগান এবং তুমুল বিক্ষোভ চলছিল। বিক্ষোভকারীরা চিৎকার করে বলছিলেন, এই লোকটি দেশে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন এবং বাংলাদেশকে ১০০ বছর পিছিয়ে দিয়ে এসেছেন। দেশকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার দায়েও অভিযুক্ত করেছিলেন অনেকে।
জেনারেল মইন উ সম্পর্কে অবশ্য তেমন কিছু জানা যায় না। মাঝখানে সমাজ সেবা ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার এবং অতি সঙ্গোপনে দেশে যাতায়াত করার কথা শোনা গেলেও বলা হচ্ছে, তিনি আসলে ‘আন্ডার গ্রাউন্ডে’ রয়েছেন! স্মরণ করা দরকার, ২০১০ সালে একবার দেশে এসে মইন উ বলেছিলেন, তিনি নাকি ‘জেনে বুঝে’ কোনো ভুল করেননি! তিনি আরো বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘ভালো কাজ করেছে’ বলেই তিনি জানেন। ওই সরকারের মূল্যায়ন এখনই করা উচিত নয়। এজন্য নাকি ৫০ বছর লাগবে! অন্যদিকে সত্য হলো, সবকিছু এত নগ্নভাবেই তারা করেছিলেন যে, এসবের কোনো একটি বিষয় নিয়েই গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। ৫০ বছর লাগার তো প্রশ্নই উঠতে পারে না। কারণ, ‘নাটের গুরু’ ও প্রধান ‘উদ্দিন’ জেনারেল মইন উ আহমেদ যে অস্ত্রের মুখে রাষ্ট্রপতিকে বাধ্য করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন, সে কথা জানতে জাতির কয়েকদিনও সময় লাগেনি। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার সময় লাইনচ্যুত ট্রেনকে লাইনে উঠিয়ে আনাসহ মিষ্টি-মধুর অনেক কথাই শুনিয়েছিলেন তিনি। অন্যদিকে দুর্নীতি উচ্ছেদের নামে মইন উ ও তার সহচররা দেশে ব্ল্যাকমেইলিং-এর রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। ক্ষুদে ব্যবসায়ী থেকে বড় ব্যবসায়ী পর্যন্ত কাউকেই রেহাই দেননি তারা। সমৃদ্ধি অর্জনের ধারে-কাছে যাওয়ার পরিবর্তে বিনিয়োগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা সৃষ্টির ব্যাপারেই তাদের বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। দুর্নীতি দমনের নামে ওই সরকার এমন সব শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেই ঢালাও ব্যবস্থা নিয়েছিল- বছরের পর বছর ধরে যারা দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ করেছেন, শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, লাখ লাখ মানুষকে চাকরি দিয়েছেন এবং দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছেন। এসব শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রেফতার হওয়ায় এবং অনেকে ভয়ে পালিয়ে থাকায় তাদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়েছিল, অর্থনীতির সকল সূচক হয়েছিল নিম্নমুখী।
রাজনীতির ক্ষেত্রে মইন উ’রা রীতিমতো ‘মহাবিপ্লব’ ঘটানোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাসহ প্রধান নেতা-নেত্রীদের অনেককেই ‘জেলের ভাত’ খাইয়েছিলেন তারা। মামলার পর মামলা চাপিয়ে নেতা-নেত্রীদের ব্যতিব্যস্ত রেখেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সংস্কারের আদেশ চাপিয়েছিলেন। কথায় কথায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ করেছেন মইন উ। কিন্তু বছর না ঘুরতেই তার নিজের বিরুদ্ধেই নানা ধরনের নোংরা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। অর্ধ ডজন আপন ভাই এবং ঘনিষ্ঠ সহচরদের জন্যও ‘ফুলে-ফেঁপে’ ওঠার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। ভারতের স্বার্থে সীমান্ত খোলা রেখে বিডিআরকে দিয়ে ‘দোকানদারি’ করিয়েছেন মইন উ। তার হুকুমে হকার উচ্ছেদের নামে লাখ লাখ গরীব মানুষের পেটে লাথি মারা হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন তিনি সেনাবাহিনীর। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় সেনাবাহিনীর পেশাগত দক্ষতা কমে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে চাকরির নামে  সৈনিকদের মধ্যে তিনি অর্থ-বিত্তের লোভ ঢুকিয়েছেন, ব্ল্যাকমেইলিং-এর কাজে নিয়োজিত রেখে সেনাবাহিনীতে দুর্নীতির বিস্তার ঘটিয়েছেন। সব মিলিয়েই দেশ ও জাতিকে মইন উ পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে গেছেন। ক্ষমতায় সত্যিকার কোনো গণতান্ত্রিক সরকার থাকলে অনেক আগেই মইন উ’কে কারাগারে ঢুকতে এবং বিচারের সম্মুখীন হতে হতো। অন্যদিকে মইন উ’র ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারকে প্রথম থেকেই ‘অন্য রকম’ মনে হয়েছে। এর কারণ সম্পর্কেও জেনে গেছে সাধারণ মানুষ। সবকিছুর পেছনে রয়েছে একই ‘রোডম্যাপ’। এই ‘রোডম্যাপের’ ভিত্তিতেই লগি-বৈঠার তাণ্ডব এবং ১/১১ ঘটানো হয়েছিল। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিল। এর ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে।
এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তীকালে করা যাবে। বর্তমান নিবন্ধের সমাপ্তি টানার আগে শুধু এটুকুই বলে রাখা দরকার যে, জেনারেল মইন উ’র আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া এবং ফখরুদ্দিন আহমদের ধাওয়া খাওয়ার ‘মধুর’ অভিজ্ঞতার মধ্যে শিক্ষণীয় রয়েছে। দেখা যাক, কারাগারের পাঠশালায় ‘বহুকিছু’ শিখে আসা এই নেতা কিভাবে কোন পথে হেঁটে বেড়ান এবং আওয়ামী লীগকে সত্যিই আবর্জনামুক্ত করতে পারেন কি না। আমাদের বেশি আগ্রহ অবশ্য সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে। এসব বিষয়ে ওবায়দুল কাদের কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবেন কি না, নাকি তিনিও কেবলই নেত্রীর নির্দেশ অনুসারে চলবেন এবং তার ইচ্ছা পূরণে ব্যস্ত থাকবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। অভিজ্ঞতা কিন্তু আদৌ আশাবাদী করে না আমাদের।
আশিকুল হামিদ 

বুধবার, ২ নভেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সন্ত্রাসে ভারতীয় অস্ত্র


বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলায় ভারতে তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। এ উদ্দেশ্যে বিহারসহ বিভিন্ন রাজ্যে অস্ত্র তৈরির গোপন কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। এসব কারখানায় তৈরি অস্ত্র পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন জেলার মধ্য দিয়ে চোরাচালানের অবৈধ পথে বাংলাদেশের জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের হাতে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এজন্য পশ্চিম বঙ্গের মালদহ ও বর্ধমানসহ সীমান্তের নিকটবর্তী বিভিন্ন জেলায় অস্ত্র ব্যবসার ঘাঁটি বানিয়েছে ভারতীয়রা। দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ভারতীয়দের সহযোগিতায় বাংলাদেশে একটি অস্ত্র ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাদের মাধ্যমে অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। মাঝে-মধ্যেই বিভিন্নস্থানে ভারতে তৈরি অস্ত্রসহ গ্রেফতার হচ্ছে সন্ত্রাসীরা। ৩১ অক্টোবর রাতে গাবতলী থেকে ১০টি অস্ত্রসহ গ্রেফতার হওয়া এক ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের কাছে অস্ত্র তৈরির ও পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে। সে নিজেও এর সঙ্গে জড়িত।
বলা দরকার, বিভিন্ন সময়ে আলোচিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি হামলায় ভারতের অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি প্রাধান্যে এসেছিল গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের পর। গত ১ জুলাই গুলশানের এই রেস্টুরেন্টে ২০ জন দেশী-বিদেশীকে হত্যা করেছে জঙ্গি গোষ্ঠী। এরপরই বাংলাদেশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের পক্ষ থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তশেষে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা এএনআই-ও স্বীকার করেছে, গুলশানে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো ভারতের তৈরি এবং পাঠানোও হয়েছিল ভারত থেকে।
দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে আসা সকল অস্ত্র তৈরি করা হয় ভারতের রাজ্য বিহারের কিছু গোপন আস্তানায়। কোনো কোনো অস্ত্রে এমনকি বিহারের মুঙ্গের সমরাস্ত্র কারখানার সিলও পাওয়া গেছে, যার অর্থ সরকারী পর্যায়ে না হলেও ব্যক্তিগতভাবে মুঙ্গের কারখানার অনেকে এই কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে প্রশ্ন উঠেছে, সমরাস্ত্র কারখানার মালিক যেহেতু সরকার সেহেতু ভারত সরকারের পক্ষেও দায় এড়ানো সম্ভব কি-না। উল্লেখ্য, সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, সেখানে গ্রেফতার হওয়া কয়েকজন জঙ্গির কাছে জানা গেছে, বিহারে তৈরি করার পর অস্ত্রগুলো বালুর ট্রাকে করে পশ্চিম বঙ্গের বাংলাদেশ সংলগ্ন বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়া হয়। গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো পশ্চিম বঙ্গের মালদহ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাঠানো হয়েছিল। ভীতি ও আতঙ্কের কারণ হলো, এসবের মধ্যে পিস্তল ও রিভলবারের মতো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত সাধারণ অস্ত্রের পাশাপাশি একে-৪৭ ও এ কে-২২ ধরনের ভয়ঙ্কর বিভিন্ন অস্ত্র এবং গ্রেনেডও রয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতীয় অস্ত্রের বিষয়টিকে অবশ্যই যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া দরকার। কারণ, পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ এবং অ্যান্টি টেরোরিজম স্কোয়াড এটিএসসহ বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে ভারতে। দেশটির বিভিন্ন রাজ্যেরও রয়েছে নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের সন্ত্রাস বিরোধী কার্যক্রম সম্পর্কেও নিয়মিত খবরে জানা যায়। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও একই ভারতে অবৈধ কারখানায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরি হচ্ছে এবং সে অস্ত্রগুলারই একটি অংশ বাংলাদেশে পাচার হয়ে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের হাতে পৌঁছাতে পারছে- এমন খবর নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক শুধু নয়, অবিশ্বাস্য ও প্রশ্নসাপেক্ষও বটে।
গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি আমরা মনে করি, এই সত্য উভয় রাষ্ট্রের সরকারকেই বুঝতে হবে যে, জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ যে নামেই চিহ্নিত করা হোক না কেন এটা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। জঙ্গি-সন্ত্রাসীরাও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের আওতায় হত্যার মতো ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। ভারতে তৈরি অস্ত্র দিয়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার খবরও একই বিপদজনক সত্যকেই অনস্বীকার্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।  সুতরাং কোনো ঘটনা ঘটলেই তার জন্য এদেশের কোনো রাজনৈতিক দলকে দায়ী করার যুক্তি বা সুযোগ থাকতে পারে না। অন্যদিকে বিশেষ করে বাংলাদেশে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত এবং পরিপূর্ণরূপে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দলগুলোর দিকে আঙুল ওঠানোর আপত্তিকর তৎপরতা চালানো হচ্ছে। আমরা মনে করি, সত্যিই সন্ত্রাস দমন ও প্রতিরোধ করতে চাইলে এই প্রবণতার অবসান ঘটানো উচিত। কারণ, এর ফলে প্রকৃত জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা নিরাপদে পার পেয়ে যায় এবং জনমনে অযথা রাজনৈতিক দল সম্পর্ক প্রশ্ন ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়। অথচ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক দলগুলো প্রতিটি উপলক্ষে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা তথ্য-প্রমাণসহ অস্বীকার করেছে। শুধু তা-ই নয়, দল দু’টি সরকারের জঙ্গিবাদ বিরোধী কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন তো জানিয়েছেই, একই সাথে ওই প্রচেষ্টায় অংশ নেয়ার ও সহযোগিতা করারও ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু মূলত নিজের অশুভ কৌশল ও উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সহযোগিতার এই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। একই কারণে দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে এবং এখনো তাদের সম্পূর্ণরূপে প্রতিহত ও নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।
আমরা মনে করি, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের কোনো দেশ নেই এবং তারা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের অধীনে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে- এই সত্য অনুধাবন না করা হলে এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অযৌক্তিকভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা অব্যাহত রাখা হলে বাংলাদেশে কখনোই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন করা যাবে না। আমরা তাই আশা করতে চাই, ভারত ও বাংলাদেশের সরকার অস্ত্র তৈরি ও পাচারের বিষয়টি নিয়ে সততার সঙ্গে অনুসন্ধান চালাবে, এই কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে এবং উভয় দেশের জনগণকে প্রকৃত সত্য জানিয়ে দেবে। দু’দেশের সরকারকে একই সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র তৈরি ও বিক্রি বা পাচারের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নিতে হবে, যাতে কোনো দেশের কোনো জঙ্গি-সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পক্ষেই এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালানো সম্ভব না হয়।

মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১৬

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

চতুর্দিকে বিপন্ন মানুষের আর্তধ্বনি


গা শিউরে ওঠার মতো আদিম অন্ধকারের দিকে আমাদের সমাজকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অনির্বাচিত সরকার। কান পাতলেই চতুর্দিক থেকে ভেসে আসছে বিপন্ন মানুষের আর্তধ্বনি। কান্নার ধ্বনি শোনা যায় শিশুর, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, মা-বাবার-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার কান্নার আওয়াজ। এ আর্তনাদের কারণ একটি নয়, বিবিধ। কেউ কাঁদে স্বজন হারিয়ে, কেউ কাঁদে নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে। কেউ দুর্বৃত্তের চাপাতির কোপে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আর্তনাদ করছে। কেউ বা এসিড-দগ্ধ। কারও কোনো স্বজনের বুক এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে সরকার দলের লোকদের গুলীতে কিংবা কারও স্বজনের প্রাণ গেছে ক্রসফায়ার নামক এক অবিশ্বাস্য কিচ্ছায়। কোথায়ও ধর্ষিতা হচ্ছে শিশু, কোথায় কোনো দুর্বৃত্ত তুলে নিয়ে গেছে কোনো যুবতী বা গৃহবধূকে। রাজনৈতিক মতবিশ্বাস ভিন্ন বলে বহু মানুষকে অকাতরে প্রাণ দিতে হচ্ছে। পুত্রহারা পিতার কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে আশপাশের বাতাস। সান্ত¡না দেবার কোনো ভাষা কারও জানা নেই। আর সব চাইতে বিপদের দিক হলো এর প্রতিকার চাওয়ার কোনো জায়গা নেই। 
একটা সময় ছিল, যখন মানুষ এসব অন্যায় অত্যাচারের প্রতিকার চাইতে পুলিশের কাছে হাজির হতো, কিন্তু পুলিশের কাছে মানুষের জানমাল থেকে শুরু করে নারীর সম্ভ্রম কোনো কিছুই এখন আর নিরাপদ নয়। প্রতিকার চাইতে গিয়ে বহু নারী-তরুণী-কিশোরী যুবতী হারিয়েছে সম্ভ্রম। প্রতিকার চাইতে গিয়ে আটক হয়েছেন অনেকেই। শেষ পর্যন্ত মুক্তিপণ দিয়ে বেরিয়ে এসেছেন কিংবা বিনা কারণেই পুলিশ ডজন ডজন লোককে আটক করে থানায় পুরেছে। ভোর না হতেই থানা ছাপ। রাতভর দেনদরবার করে মুক্তিপণের মাধ্যমে ফিরে গেছে, এ যেন উপনিবেশ আমলের এক বাহিনী। তারা কোনো কিছুরই পরোয়ানা করছেন না, আইন-কানুন-বিচার বিভাগ সব কিছুই তাদের কাছে উপেক্ষিত। এমনি বাহিনী এখন র‌্যাব, তারাও একইভাবে ভয় পাইয়ে দেয়। এখন র‌্যাব-পুলিশ দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। 
পুলিশের ধারণা, তারাই সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে, হয়তো এই ধারণাই সত্য। বাংলাদেশ এখন পুলিশ রাষ্ট্র বই আর কিছুই না। ফলে পুলিশ অত্যন্ত বেপরোয়া। কোথায়ও কোনো ঘটনা ঘটলেই পুলিশ অভিনব কায়দায় মামলা দায়ের করে। সে মামলায় আসামী করা হয়, কয়েকজনের নাম লিখে হাজার হাজার লোককে। তারপর যাকে খুশি তাকে ধরে থানায় নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে। এ অভিযোগ অসংখ্য, এ অভিযোগ যেমন সাধারণ মানুষের তেমনি ব্যবসায়ীদেরও। ব্যবসায়ীদের পরিবারও মাঝেমধ্যে প্রেস কনফারেন্স করে জানান দেন, মুক্তিপণের দাবিতে তাদের পরিবারের ব্যবসায়ী সদস্যকে পুলিশ অপহরণ করেছে। আর এই যে অজ্ঞাত ব্যক্তির নামে মামলা সে এক মহাফাঁদ। এই ফাঁদে সাধারণ মানুষকে আটকানোর জন্য আকস্মিকভাবে তারা মধ্যরাতে হামলা চালায় কোনো গ্রামে, জনপদে। মানুষ ধরে আনে দাস ব্যবসার কায়দায়। ফলে গ্রামকে গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে যায়। পুরুষ শূন্য হয়ে গেছে। নারীরাও এখন আর নিরাপদ নন পুলিশের হাত থেকে। তারা ছাত্রী মেসে হানা দেন। ছাত্রীদের ধরে এনে জানান দেন, এরা জঙ্গি। ব্যস, হয়ে গেল। একবার জঙ্গির তকমা এঁকে দিতে পারলেই, এই যে নারীদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে, সেটি হালাল হয়ে যায়। তারপর পত্রিকায় ফলাও করে ছবি ছাপা হয়। বিনা কারণে কেবল পর্দা-পুষিদার জন্য ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলিম নারীরা এখন নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। 
এছাড়া প্রতিনিয়তই সমাজের একই ধরনের অপরাধমূলক ও নির্যাতনমূলক ঘটনা ঘটছে। তার জন্য দায়ী প্রধানত শাসক দলের লোকেরাই। আর এই দলের প্রধান পান্ডা ছাত্রলীগ নামক এক ভয়ঙ্কর বাহিনী। এরা করছে না সমাজের মধ্যে এমন কোনো অপকর্ম নেই। চাঁদাবজি, টেন্ডারবাজি, মুক্তিপণ আদায়, মাদক বা অস্ত্রের ব্যবসা- এসব কিছুতে যেমন ছাত্রলীগ আছে, তেমনি আছে নারী নিগ্রহের সঙ্গেও। কিছু দিন আগে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রলীগ পা-া বদরুল প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রকাশ্যে খাদিজা নামের এক ছাত্রীকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ফেলে দিয়েছিল। খাদিজা এখনও চিকিৎসাধীন, ভয়ে-আতঙ্কে তার স্মৃতি বিভ্রম ঘটেছে। সে কখনো তার বাবাকে ‘আঙ্কেল’ ডাকছে, কখনো কখনো মাকে ডাকছে ‘আন্টি’। কিন্তু বদরুলের বিরুদ্ধে তেমন কেনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এই বদরুল অচেনা কেউ নয়, একটি হাস্যকর খবর বেরিয়েছে- বদরুলকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এমন হাস্যকর খবর পুলিশ নিয়েও প্রকাশিত হয়। পুলিশ যখন কোনো অপরাধ করে, তখন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি হিসেবে বলা হয়- এদের ‘ক্লোজড’ করা হয়েছে। কিংবা বলা হয়, বদলি করা হয়েছে। অর্থাৎ কিছুদিন তারা পুলিশ সদর দফতরে বসে থাকেন, তারপর যথারীতি তাদের পোস্টিং হয়ে যায়। আর বদলি কোনো শাস্তি নয়। শুধু পুলিশ কেন, সকল সরকারি চাকরিই বদলিযোগ্য। ফলে চাকরির ক্ষেত্রে এটা তাদের জন্য খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। ছাত্রলীগ প্রসঙ্গেও একই কথা বলা যায়। যখন ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগের কোনো সদস্য বড় ধরনের অপরাধ করে, তখন ছাত্রলীগের তরফ থেকে বলা হয়, তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পুলিশও ছাত্রলীগের অপরাধীদের দেখেও দেখে না। ঐ ছাত্রলীগাররা কিছুদিন হয়তো চুপ করে থাকে। তারপর আবার মিছিল-টিছিলে সামনে এগিয়ে আসে। আবার নানা ধরনের অপকর্মে জড়াতে থাকে। অস্ত্রবাজি, টেন্ডারজিতে মেতে ওঠে, কেউ কিছুই করে না। এদের গ্রেফতারের ঘটনা অপরাধের তুলনায় অতি নগণ্য। গ্রেফতারের পর কারো শাস্তি হয়েছে এমন শোনা যায় না।
সম্প্রতি রাজধানীর গুলিস্তানে হকার উচ্ছেদের সময় অবৈধ অস্ত্র হাতে মহড়া দেন ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ সারির নেতা। তাদের একজন ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির হোসেন, অপর জন ওয়ারি থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান। তাদের সম্পর্কে জানা যায়, এই পদে আসার আগে তাদের কেউ চিনতোই না। আর পদ পাওয়া মাত্রই এরা এলাকায় দোকান দখল করে অফিস বানিয়েছে। সেই অফিস ঘিরেই তার সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ করে তুলেছে এলাকার ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষদের। এরা অচেনা কেউ নয়। এদের স্পষ্ট ছবি পত্র-পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। যথারীতি ছাত্রলীগ বলেছে যে, ঐ দুজন অস্ত্রবাজকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল এ নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের তরফ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সর্বশেষ খবরে বলা হয়েছে, ৬ দিন পর পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কিন্তু এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। অস্ত্রবাজদের এমনই বান্ধব এই সরকার। 
কিন্তু বিপরীতভাবে দেখা যায়, যদি ছাত্রদল বা শিবিরকর্মীর হাতে এরকম অস্ত্র দেখা যেত, তাহলে হয়তো ইতিমধ্যে তারা পুলিশের ক্রসফায়ারে প্রাণ হারাতো অথবা পুলিশ তাদের হান্ডকাপ পরিয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করতো। বলতো, এদের কাছ থেকে আরও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র পাওয়া গেছে। আর মামলার তো অভাব নেই। যে লাখ লাখ অজ্ঞাত লোকের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে, তার কোনো একটিতে তাদের নিশ্চিতভাবে ফাঁসিয়ে দেয়া হতো। সেটা বলা মোটেও অসঙ্গত হবে না। এছাড়া খুন-ধর্ষণও ছাত্রলীগের অঙ্গের ভূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের ভেতরে কোনো প্রতিকার প্রতিরোধ চোখে পড়ছে না। 
একটা সময় ছিল, যখন তারুণ্যের প্রতীক ছাত্রসমাজ সমাজের মধ্যে এসব অত্যাচার, অনাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতো। তারুণ্য তো রুখে দাঁড়ায়। প্রতিবাদ করে। প্রতিরোধ গড়ে তুলে। বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এখন সমাজের ভিতরে তার চিহ্নও নেই। দাঁড়ায় বা দাঁড়াতে পারে না তারুণ্যনির্ভর অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন। দাঁড়ালে ছাত্রলীগ তো আছেই। তারা যেমন অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ করে খুন-জখমে পিছপা হয় না, তেমনি তাদের সঙ্গে এসে যোগ দেয় পুলিশ বাহিনী। 
এই অবস্থা দেশের ভেতরে যে চরম ও করুণ পরিণতি ডেকে আনছে সেটি শাসক দলের গায়ে আঁচড়ও কাটছে বলে মনে হয় না। আর হৃদয় ও বিবেক এদের ভেতরে নেই। সে কারণেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে যে দাঁড়াতে চায়, তাকে নির্মূল করার দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। সমাজে যারা বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত তারাও হয় সরকারের তাঁবেদার হিসেবে নিশ্চুপ কিংবা সরকারের রুদ্র-রোষের ভয়ে, অথবা হালুয়া রুটির লোভে। কিন্তু এক দশক আগেও পরিস্থিতি এ রকম ছিল না। মইন-ফকরের সামরিক শাসনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের উপর হামলা হয়েছিল, তাতে ছাত্রসমাজ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে পরিস্থিতি প্রায় সংঘাতে রূপ নিয়েছিল। প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই নয়, কলেজ-স্কুলগুলাতেও উঠেছিল প্রতিবাদ আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত সেই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে ছাত্র সামজের জয় হয়েছিল। অনেক শিক্ষক-অভিভাবক লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। কারাভোগ করেছিলেন। কিন্তু সে আন্দোলন বৃথা যায়নি। তারুণ্য জয়ী হয়েছিল।
আমাদের প্রত্যাশা তো তরুণ সমাজের কাছেই। তারা ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়াবেন, এটাই তো কাক্সিক্ষত। কিন্তু ক্রমইে নীতি ও আদর্শের অভাবে সেই কাক্সিক্ষত আশ্রয়ের অভাবে সমাজের ভিতর ধস নামতে শুরু করেছে। এ এক বিপজ্জনক অবস্থা। বিপজ্জনক শুধু বর্তমান সময়ের জন্য নয়। ভবিষ্যৎ বংশধরের জন্যও আমরা এক নিকষ কালো অন্ধকার যেন রেখে যাচ্ছি। কারণ যে তারুণ্য নির্জীব ও নিস্তেজ, সত্য প্রকাশে কুণ্ঠিত, ন্যায়ের আন্দোলনে নিশ্চুপ, তারাই এক সময় এ দেশের কর্ণধার হবেন। যে এখন বেড়ে উঠছে অসত্য অত্যাচার ও নিপীড়নের ভেতরে, সে কেমন করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোর পথ দেখাবে? সুতরাং আমরা যে যেখানে আছি, আসুন, আলোর শিখা যতোই টিমটিমেই হোক, তাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক উজ্জ্বল পরিবেশ গড়ে তুলি।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

Ads