বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৫

সন্ত্রাসবাদের ড্রামা এখন মেলোড্রামার রূপ নিয়েছে


বর্তমান পৃথিবীতে শক্তিমান দেশ বলতে তো আমরা বুঝি আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, বৃটেন ও ফ্রান্সকে। এই দেশগুলোতো পৃথিবীকে শাসন করছে। এদের ইচ্ছের বাইরে তো পৃথিবী চলতে পারছে না। কিন্তু আইএস-এর বিরুদ্ধে এদের এত দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে কেন? আইএস নিয়ন্ত্রণে তারা ব্যর্থ হচ্ছে কেন? আইএস কি তাদের নাগালের বাইরে? আইএসতো কোনো রাষ্ট্রের বাহিনী নয়। তাহলে আইএস এত অস্ত্র, ভারী অস্ত্র ও অর্থ পাচ্ছে কোথা থেকে? গরীব দেশগুলোর এমন সামর্থ্য নেই। বড় অস্ত্র, বড় অর্থ, বড় দেশই দিতে পারে। তাই প্রশ্ন জাগে, আইএস-এর পেছনে কি কোনো বড় শক্তির মদদ রয়েছে? আইএসতো ভিন্ন কোনো গ্রহ থেকে আসেনি। আইএস-এর উৎপত্তি ও বিকাশ পৃথিবী নামক এই গ্রহেই। পৃথিবীর হর্তাকর্তাদের অনুমোদন ছাড়া আইএস বিকশিত হতে পারে না। আর এই বিষয়টি এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আইএস-এর কারণে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমান। আইএসকে নিয়ে যে ড্রামা শুরু হয়েছিল তা এখন মেলোড্রামার রূপ নিয়েছে সিরিয়ায়।
৩ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে বন্দুকধারীদের হামলায় ১৪ জন নিহত হয়েছেন। উল্লেখ্য যে, শুধু চলতি বছরেই আমেরিকায় প্রতিদিন গড়ে একটির বেশি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৬২ জন, আর আহতদের সংখ্যা এক হাজার ৩১৪ জন। নিউইয়র্ক টাইমস এই খবর পরিবেশন করেছে। অবাক ব্যাপারে হলো, বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই সন্ত্রাসমুক্ত নয়। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতেই প্রতিনিয়ত ঘটছে নির্বিচারে গুলি করে হত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা। ২০১৫ সালে সংঘটিত এসব ঘটনার বেশির ভাগই ঘটেছে শহরের ব্যস্ত সড়ক কিংবা জনবহুল স্থানে।
যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী ঘটনার ব্যাপকতা উপলব্ধি করা যায় খোদ দেশটির প্রেসিডেন্টের বক্তব্য থেকেও। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন শহরে ২০১৫ সালের ১ অক্টোবরে কমিউনিটি কলেজে হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে বলেন, সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের চেয়ে সাধারণ অস্ত্রবাজির ঘটনায় বেশি আমেরিকান নিহত হন। এক জরিপে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ অস্ত্রবাজিতে নিহতদের সংখ্যা সন্ত্রাসী বা জঙ্গীদের হামলায় নিহতদের চাইতে ১১২ গুণ বেশি। এই প্রসঙ্গে ওবামা বলেন, ‘আমরা ব্যাপারটিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বলতে হয়, অবশ্যই সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের চেয়ে সাধারণের হাতের অস্ত্রে বেশি আমেরিকান নিহত হন।’ খবরটি পরিবেশন করে বিবিসি ও সিএনএন। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাসমূলক ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সন্ত্রাসী ও জঙ্গী হামলার কিছু ঘটনা নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় তোলপাড় করা হলেও আসলে ওইসব দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসমূলক ঘটনার মাত্রা অনেক বেশি। এই প্রসঙ্গে ফ্রান্সের খ্যাতিমান সাংবাদিক, লেখক ও চিত্রশিল্পী বেননর্টন-এর বিশ্লেষণ উল্লেখ করা যায়। প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর পরই এক লেখায় তিনি উল্লেখ করেন, নাইন-ইলেভেনের পর যখনই বেসামরিক কোনো হামলা হয়েছে, নেতারা সাথে সাথে এর জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছেন মুসলমানদের। তাদের হাতে তেমন কোনো প্রমাণ থাকে না, কিন্তু মুসলিম বিদ্বেষী গোঁড়ামির স্থূল বুদ্ধিকেই তারা ব্যবহার করেন তাদের অভিযোগকে জোরদার করতে। অথচ প্রকৃত প্রমাণ অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোতে যে সব সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে, তার দুই শতাংশেরও কম ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ২০১৩ সালে ১৫২টি সন্ত্রাসী হামলার মাত্র ১ শতাংশ ছিল ধর্মীয় প্রকৃতির। আর ২০১২ সালে ২১৯টি সন্ত্রাসী হামলার ৩ শতাংশেরও কম ছিল ধর্মীয়ভাবে উদ্দীপ্ত। বর্তমান সময়ে সন্ত্রাসী হামলাগুলোর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো জাতিগত-জাতীয়তাবাদী কিংবা বিছিন্নতাবাদী। পাশ্চাত্যের সত্যনিষ্ঠ বিশ্লেষকদের তথ্য-উপাত্ত বিবেচনায় আনলে বিশ্বব্যাপী পরিচালিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ এবং তাদের মুসলিমবিরোধী নেতিবাচক প্রপাগান্ডার গোমর ফাঁস হয়ে যায়।
দুঃখের বিষয় হলো, উদ্দেশ্যমূলক প্রপাগান্ডার কারণে বর্তমান সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুসলমানরা জুলুম-নিপীড়ন ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। বৃটেনের একটি স্কুলে মুসলিম শিক্ষার্থীদেরকে স্কুলের হলরুমে নামায পড়তে দিচ্ছে না। ফলে এই বরফজমা শীতের দিনে বৃষ্টির মধ্যে খেলার মাঠে নামায পড়তে হচ্ছে। তাদের ভেজা জামাকাপড় গায়েই শুকাতে বাধ্য করা হচ্ছে। এ কারণে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা স্কুলটির বিরুদ্ধে (ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার মারফিল্ড স্কুল) আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তা-ভাবনা করছে। খবরটি পরিবেশন করেছে ডেইলি মেইল। এদিকে আল-জাজিরার খবরে বলা হয়, ফ্রান্সে চলমান জরুরি অবস্থার অধীনে দেশটির ১৬০টি মসজিদ বন্ধ করে দিচ্ছে সরকার। এসব বিষয় সন্ত্রাস নির্মূলে কতটা অবদান রাখবে জানি না। তবে এ কথা বলা যায় যে, এইসব উদাহরণ বিশ্বের শান্তিকামী মানুষদের জন্য ভুলবার্তা বহন করছে। আসলে প্রকৃত সত্যকে অস্বীকার করে শুধু শক্তি ও কৌশলের প্রহসনে সন্ত্রাসকে দমন করা যাবে না। সন্ত্রাসের গডফাদাররা কি কখনো সন্ত্রাসের নির্মূল চাইবে? সন্ত্রাস প্রসঙ্গে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ বলেছেন, কেবল যুদ্ধবিমান থেকে বোমা ফেললেই ইরাক-সিরিয়া সংকটের সমাধান হবে না। আইএস কেন এভাবে শিকড় ছড়িয়েছে, কেন তারা এমন ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভূত হয়েছে, তার কারণ খুঁজতে হবে। আসলে আইএস-এর উৎপত্তি ও বিকাশের ধারা বিশ্লেষণ করলে সন্ত্রাসের কারিগরদের মুখোশ উন্মোচিত হতে পারে। বেরিয়ে আসতে পারে আরো অনেক সত্য।
বৃটেনে বসবাসকারী মুসলমানদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রতিবাদে লন্ডনের ফিনসবুরি পার্ক মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, মুসলমানদের উপর হামলা চালিয়ে বর্ণবাদীরা কমিউনিটিকে বিভক্ত করতে পারবে না। উল্লেখ্য যে, গত সপ্তাহে একজন হামলাকারী ফিনসবুরি পার্ক মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। ওই হামলার প্রেক্ষিতেই জেরেমি করবিন উপরোক্ত বক্তব্য পেশ করেন। খবরটি পরিবেশন করেছে ডেইলি মিরর।
সমাবেশে জেরেমি করবিন আরো কিছু বক্তব্য রেখেছেন, যা আমাদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তিনি বলেছেন, এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের কমিউনিটিকে বিভক্ত করা। এক জাতিগোষ্ঠীকে আরেক জাতিগোষ্ঠীর শত্রু বানানো। এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, এটা ব্যর্থ হবে, এটা সব সময় ব্যর্থ হবে, কেননা ফিনসবুরি পার্কে আমাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি নিয়ে আমরা গর্বিত। করবিন বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি নিয়ে গর্বের যে অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন তা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা ও বিশ্বসভ্যতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত এই উপলব্ধির বিকাশের উপরই নির্ভর করছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। আমরা এ কথা জানি যে, এই পৃথিবীতে বহুধর্ম ও বহুমতের মানুষের বসবাস। পৃথিবী কখনোই এক ধর্ম কিংবা এক মতের মানুষের আবাসস্থল হবে না। কেউ জোর-জবরদস্তি করে তা করতে চাইলে পৃথিবী হিংসা-বিদ্বেষের রণভূমিতে পরিণত হবে।
এই বিষয়টি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ও তার সময়ে উপলব্ধি করেছিলেন। তাইতো তিনি বলে গেছেন, ‘এখন জগৎজুড়িয়া সমস্যা এই নহে যে, কি করিয়া ভেদ ঘুচাইয়া মিলন হইবে, কিন্তু কি করিয়া ভেদ রক্ষা করিয়া মিলন হইবে সেইটাই আসল কথা। কারণ সেইখানে কোনো ফাঁকি চলে না, প্রত্যেকের জন্য প্রত্যেকের জায়গা ছাড়িয়া দিতে হয়।’ এখানে Unity in diversity বা বৈচিত্র্যের ঐক্যের আকাক্সক্ষাই ব্যক্ত হয়েছে। এতদিন পরে লন্ডনের ফিনসবুরি পার্ক মসজিদ প্রাঙ্গণে সেই একই কথা উচ্চারণ করলেন জেরেমি করবিনও। আসলে সত্য সব সময় একই রকম থাকে। সময় বা প্রযুক্তির কারণে সত্য কখনো পরিবর্তিত হয় না। এই পৃথিবীকে মানুষের বসবাসযোগ্য রাখতে হলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে সত্যকে ধারণ করেই এগিয়ে যেতে হবে।
‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ বিষয়টি কোনো নতুন কিংবা আধুনিক বিষয় নয়। এটি শাশ্বত বিষয়। সৃষ্টির শুরুতে যেমন বৈচিত্র্যের ঐক্য লক্ষ্য করা গেছে, তেমনি ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে তা লক্ষ্য করা গেছে শুদ্ধ সমাজে। বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ মোস্তফা (সাঃ)-এর সময়ে মদীনা সনদে ও মদীনার সমাজে আমরা বৈচিত্র্যের ঐক্য লক্ষ্য করেছি। ওই সমাজে সবাই যার যার বিশ্বাস ও প্রথা নিয়ে বসবাস করার সুযোগ পেয়েছে। ইসলাম ব্যক্তি বা সমাজের ওপর জোর-জবরদস্তি বা চাপিয়ে দেয়ার দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে না। ফলে দমন-পীড়ন ও সন্ত্রাস ইসলামে পরিত্যাজ্য বিষয়। এই সত্যকে বিভ্রান্ত মুসলমানদের যেমন বুঝতে হবে, তেমনি উপলব্ধি করতে হবে পাশ্চাত্যকেও। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্যারিসে যারা হামলা চালিয়েছে তারা যেমন ভুল পথের পথিক, তেমনি এখন যারা ইউরোপ-আমেরিকায় মুসলমানদের উপর হামলার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে তারাও ভুল পথের পথিক। উভয় গোষ্ঠীকে উপলব্ধি করতে হবে বৈচিত্র্যের ঐক্যের মর্মকথা। এটাই সময়ের দাবি। এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে আমাদের মত ছোট ছোট দেশগুলোর সরকার ও রাজনীতিবিদদেরও।
বৈচিত্র্যের ঐক্যকে গুরুত্ব না দিয়ে আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে অন্যকে নির্মূল করতে চাইলে আখেরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিপর্যয়ের মাত্রাই বাড়ে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাই তার বড় প্রমাণ। আসলে ভুল ফর্মুলা যেমন বিশ্বের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি তা ক্ষতিকর দেশের জন্যও। এ কারণেই নানা মত ও পথের লোকদের নিয়ে সহাবস্থানের চেতনায় আমাদের এগিয়ে যেতে হবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায়। বিষয়টি আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা উপলব্ধি করেন কি-না সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads