শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৫

পৌর নির্বাচন স্বাধীন যথেচ্ছায়ী দলের সাথে ভয়-ভীতি হামলা-মামলায় পিষ্ট দলের লড়াই


নির্দলীয়ভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে পৌরসভার রয়েছে ১০০ বছরের বেশি সময়ের ঐতিহ্য। লর্ড রিপনের শাসনামলে ১৮৮৪ সালে বেঙ্গল মিউনিসিপাল অ্যাক্ট পাস হয়। গঠিত পৌরসভায় কমিশনারদের দুই-তৃতীয়াংশ নির্বাচিত এবং এক-তৃতীয়াংশ সরকার কর্তৃক মনোনীত হতেন। কমিশনাররা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান এবং একজনকে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচন করতেন। সময়ের বিবর্তনে পৌরসভার কাঠামো ও নির্বাচিত ব্যক্তিদের পদবিতে পরিবর্তন এলেও এতদিন তাদের নির্দলীয়ভাবে নির্বাচনে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
স্থানীয় সরকার বিষয়ে এক সংজ্ঞায় বলা আছে-‘স্থানীয় সরকার সেইসব কার্যাবলী সম্পাদন করে যেগুলো বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ এবং এলাকাটি সমগ্র দেশের তুলনায় ক্ষুদ্র।’ অন্যভাবে বলা যায়, স্থানীয় কাজের জন্যই ‘স্থানীয় সরকার’ থাকে।
বর্তমানে স্থানীয় সরকার পরিবর্তিত হয়েছে সরকারের একক ইচ্ছায়। এ আইন নিয়ে সংসদে বিশদ আলোচনা যেমন হয়নি, তেমনি সংসদের বাইরে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও হয়নি। এমনকি স্থানীয় সরকার নিয়ে যাঁরা বহু বছর ধরে অধ্যাপনা এবং গবেষণা করছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা হয় নি। তার উদাহরণ মত পরিবর্তন করে শুধু মেয়র পদকে দলীয়করণ করা। শুধু মেয়র পদ হবে দলের, বাদবাকি নির্দলীয়।
দেশে সরকারবিরোধী অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি সরকারের সিদ্ধান্তকে দুরভিসন্ধি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছে, দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় নির্বাচন রাষ্ট্র ও সমাজে বিভাজন তৈরি করবে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন দুই জোটের বাইরে থাকা বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই দলীয় পরিচয় ও প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে, এতে করে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আরও সংকুচিত ও দুর্বল হবে। সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী বিশিষ্টজনদের মতে নির্দলীয় নির্বাচনে প্রার্থী, দল-মত নির্বিশেষে ভোট পাওয়ার আশায় নিজেকে সৎ, সভ্য ও সজ্জন হিসেবে তুলে ধরতে সচেষ্ট থাকত। দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে তা তিরোহিত হবে। রাজনীতির বাইরেও সৎ ও যোগ্য লোক সমাজে আছে। দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে এসব সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি তৃণমূল পর্যায়ে সমাজকে নেতৃত্ব প্রদানের সুযোগ পাবেন না। সমাজের ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব হবে না। তাছাড়া, দলীয়ভাবে নির্বাচনে বড় বড় রাজনৈতিক দলে মনোনয়ন বাণিজ্য হবে।
এই আইন ও ব্যবস্থাপনার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক বাদ দিলেও বড় প্রশ্ন হয়েছে, পৌরসভা নামের পরিষদটি কীভাবে পরিচালিত হবে। এখানে যেসব কাউন্সিলর মেয়রের দলের বাইরের হবেন, তাঁদের অবস্থান কী হবে? এ প্রশ্ন আমাদের মতো রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশের জন্য প্রযোজ্য। এখানে স্থানীয় সরকার পরিষদ চলে মেয়রের কৃপায়, সংসদীয় পদ্ধতিতে নয়। আরও বড় ধরনের কারিগরি প্রশ্ন হচ্ছে, দলীয় মেয়রের পরিবর্তে প্যানেল মেয়র কে হবেন? কারণ, দৃশ্যত মেয়রকে দলীয় হতেই হবে। যেভাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কলমের এক খোঁচায় জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি বিভিন্ন অভিযোগে আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত এবং দণ্ডপ্রাপ্ত না হওয়ার আগেই বরখাস্ত হচ্ছেন, তাতে প্যানেল মেয়রের ভূমিকা অপরিহার্য। সে ক্ষেত্রে নির্দলীয় একজন কাউন্সিলর, তিনি যে দলের সমর্থক হোন না কেন, তাঁর আইনি অবস্থান কী হবে? নাকি মেয়রের জায়গায় পুনঃনির্বাচন পর্যন্ত প্রশাসক নিয়োগ হবে, তা অন্তত তথ্যমতে পরিষ্কার নয়।
সমস্যার এখানেই শেষ নয়। পৌরসভার মেয়র নির্বাচন সংসদ সদস্য নির্বাচনের আদলে হলেও নির্বাচনের পরে দলত্যাগের মতো ঘটনা ঘটলে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তার কোনো বিধান নেই। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই দুটি বিষয় বিশ্লেষণ করলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতীয়মান হয়, তা হলো নির্বাচনের পর মেয়র কেনাবেচা অথবা দলত্যাগ করাতে বেগ পেতে হবে না। এমনকি প্যানেল মেয়রের ক্ষেত্রেও তেমন হতে পারে।
শুধু আইনই নয়, নির্বাচনী বিধিমালাতে রয়েছে কমপক্ষে পাঁচটি দৃশ্যমান জটিলতা। প্রথমটি হলো বিধি ১২-এর উপবিধি (৩) দফা (গ) এর নতুন সংযোজন (BBB)। সেখানে মনোনয়নে দলের একজন প্রার্থীর বাধ্যবাধকতা করা হয়েছে, যেখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একাধিক প্রার্থীর মনোনয়নের বিষয়টি ব্যাপক আলোচনা ও গবেষণা করে করা হয়েছিল, যাতে কোনো দল নির্বাচন থেকে বাদ না পড়ে। পৌরসভার এ বিধিতে কোনো দলের একক প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হলে তার পরিবর্তে আর কোনো প্রার্থীর মনোনয়ন সম্ভব নয়। যেকোনো কারণে প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। শুধু হলফনামার বিবরণ বিশ্লেষণেই বহু প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে। এ ধরনের বিধি অত্যন্ত মারাত্মক এবং অগণতান্ত্রিক বলে বিবেচিত। অপর বিধিটি হলো, স্থানীয় পর্যায়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে ১০০ জনের স্বাক্ষর গ্রহণ। মনে রাখতে হবে, জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকা খুব বড় এলাকা ও নি¤েœ লক্ষাধিক ভোটারের আবাস। অপরদিকে বেশির ভাগই গ্রাম্য পৌরসভা, যার ভোটার সংখ্যাও ১০ হাজারের নিচে, সে ক্ষেত্রে গ্রামেগঞ্জে বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ১০০ জন ভোটার কাউকে সমর্থন করে চিহ্নিত হতে চাইবেন কি না, তা অনুধাবন করা প্রয়োজন ছি।
বিধি অনুযায়ী প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্যদের প্রচার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যা অতীতে হয়নি। কারণ, সব সংসদ সদস্যই সংবিধানের আওতায় লাভজনক পদাধিকারকারী নন। এই নির্বাচনের এই বিধি নির্বাচন কমিশন প্রয়োগ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিধি ২০ও একধরনের সমস্যার সমাধান করবে। কারণ, এর আগে স্থানীয় নির্বাচনে কোনো বৈধ প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে সম্পূর্ণ বা কোনো অংশের নির্বাচন প্রক্রিয়া বাতিল হতো না। এ ধারা সংযোজন দুইধারি তলোয়ারের মতো কাজ করবে। আল্লাহ না করুন, মেয়র পদ বাদ দিলেও কোনো ওয়ার্ডের একজন প্রার্থীর যেকোনো কারণে মৃত্যু ঘটলে হয়তো ওই ওয়ার্ডের কারণে মেয়র নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বর্তমানের আংশিক দলীয় নির্বাচনে কী ধরনের জটিলতা ঘটতে পারে, তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। এই নির্বাচন গ্রামাঞ্চলের নির্বাচন, আরবান নির্বাচন নয়। তা ছাড়া, আচরণবিধির বহু বিধিই প্রয়োগ করা কতখানি সম্ভব হবে, তা নির্বাচন কমিশনের সামর্থ্যের প্রমাণ অবশ্য দেবে। (সূত্রঃ নির্বাচনী শাসন বা পরিচালনা ব্যবস্থা, এম সাখাওয়াত হোসেন, দৈনিক প্রথম আলো ৯ ডিসেম্বর ২০১৫)
বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল পৌরসভার ভোট পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল জাতীয় পার্টি দাবি করেছিল, সংসদ সদস্যরা যেন ভোটের প্রচারে নামার সুযোগ পান। কিন্তু  কোনো আবদারেই শেষ পর্যন্ত সাড়া দেয়নি নির্বাচন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের উপস্থিতিতে ৩০ নভেম্বর কমিশনারদের বৈঠকে আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে পৌরসভায় ভোট ৩০ ডিসেম্বর থেকে না পেছানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয় ত্যাগ করার সময় অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পৌরসভা নির্বাচন একদিনও পেছানো সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, দলগুলো পেছানোর দাবি করায় আমরা আলোচনায় বসেছিলাম। চেষ্টা করেছিলাম একদিনও যদি পেছানো যায়, কিন্তু আমাদের হাতে সময় নেই। আর সংসদ সদস্যরাও (এমপি) নির্বাচনে প্রচারণায় যেতে পারবেন না।
কাজী রকিবউদ্দীন বলেন, ২০ ডিসেম্বরও যদি ভোটের সময় রেখে তফসিল করা যেত, পেছানোর সুযোগ থাকত। কিন্তু শেষ সময়ে এসে তফসিল ঘোষণা করতে গিয়ে ৩০ ডিসেম্বরে ভোটের তারিখ রাখা হয়েছে। এতে পর্যাপ্ত সময় রাখা হয়েছে। এরপরও একদিন পেছানো যায় কি না যাচাই করে দেখেছি, কিন্তু সে সুযোগ নেই আমাদের।
তিনি বলেন, যেহেতু আইন সংশোধনের গেজেট আমরা দেরিতে পেয়েছি তাই নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা এবং বিধিমালা আমাদের দ্রুততার সঙ্গে করতে হয়েছে। আমাদের হাতে সময় ছিল না। অন্যদিকে, মন্ত্রী-এমপিদের প্রচারণার সুযোগ না দেয়ার যে বিধান সেটিও পরিবর্তন করা এ পর্যায়ে ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেন সিইসি। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে? অন্য নির্বাচনগুলোতে এ বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বর্তমান সংশোধিত আচরণবিধিতে দলীয় প্রধানের প্রচারণায় যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী দলীয় প্রধান হেলিকপ্টারে প্রচারণায় যেতে পারবেন বলেও উল্লেখ রয়েছে। তবে সরকারি সুবিধাভোগী হিসেবে অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নির্বাচনী প্রচরণায় যেতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সরকারি সুবিধাভোগী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেমন-প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, উপনেতা, মন্ত্রী, এমপি, সিটি মেয়রের কথা বলা রয়েছে।
এক দলের শীর্ষ নেতা প্রচারণায় যেতে পারবেন, অন্য দলের নেতারা যেতে পারবেন না, এমন ভুল কেমন করে হল-জানতে চাইলে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেন, এটি তো ভুল নয়। এটি একটা বিষয় পরিমাপ করা। আর এটিই তো শেষ নির্বাচন নয়। আমরা অভিজ্ঞতা নেব। যদি দেখি কোনোটা সঠিক হচ্ছে না, তবে অন্য নির্বাচন রয়েছে। তখন এগুলো ঠিক করে নেব। (সূত্রঃ দৈনিক সকালের খবর ১ ডিসেম্বর ২০১৫)
আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি-না তা আল্লাহ জানেন। তবে নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয় তাহলে মানুষ আওয়ামী লীগের অতীত সব অপকর্ম ভুলে যাবে।
ক্ষমতাসীনদের এমন আচরণ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, দেশের অনেক স্থানে সরকার দলীয় লোকজন অন্যদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে দেয়নি। যেখানে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা সেখানে সরকার নানাভাবে জুলুম নির্যাতন এবং গ্রেফতার চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেন, এই নির্বাচনে কারচুপি হবে জেনেও আমরা অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু আমরা জেনে শুনে বিষ পান করতে চাই না। বিগত ঢাকা সিটির মত আরেকটি নির্বাচন দেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তারা সবকিছু ঠিক করে রেখেছে। নির্বাচন কমিশন প্রশাসনের সহায়তায় সরকারের এই এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে। (সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম ৬ ডিসেম্বর ২০১৫)
৩ ডিসেম্বর ২০১৫ মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক স্থানেই বিএনপির প্রার্থীরা বাধার মুখে পড়েছেন। আবার মামলা ও গ্রেফতার আতংকে আত্মগোপনে থাকায় অনেক প্রার্থীই মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। অনেকের পক্ষে দলীয় কর্মী, সমর্থক ও স্বজন মনোনয়নপত্র জমা দেন।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে জেল-জরিমানা ও প্রার্থিতা বাতিলের বিধান রয়েছে। (সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর ৪ ডিসেম্বর ২০১৫)
মূলত নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে থাকেন সহকারী রিটার্নিং ও রিটার্নিং অফিসার। নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার ক্ষেত্রে আইনে এ দু’জন কর্মকর্তাকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা ও এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। তাই নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে এ দুটি পদের গুরুত্ব অনেক। তবে নির্বাচন কমিশনের হাতে এক সময় অনেক বেশি আসনে একসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য সহকারী রিটার্নিং ও রিটার্নিং অফিসার দেয়ার মতো জনবল ছিল না। আর থাকলেও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দিয়েই করানো হতো। কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার প্রশ্নে জরুরী অবস্থাকালীন সরকারের সময় ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন এ বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। সে অনুযায়ী পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে একযোগে সারা দেশে নির্বাচন পরিচালনা করার মতো নির্বাচন কমিশনের জনবল রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও রিটার্নিং অফিসার পদে ২৩৪টি পৌরসভার মধ্যে ১৭৬টিতে মাঠ প্রশাসন থেকে ইউএনও এবং এডিসি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাকি ৫৮টিতে ইসির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হয়েছে।
ইসির এমন ভূমিকা প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, তাদের সময়ে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের ৫-৭ বছর ধরে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তারা ছোট-বড় অনেক নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বও পালন করেছেন। কিন্তু নির্বাচনে ইসির লোকবল কম নিয়োগ দিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বেশিরভাগ পৌরসভায় রিটার্নিং কর্মকর্তা করায় নির্বাচনে কমিশনের নিয়ন্ত্রণ থাকবে কী না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অতীতের নির্বাচনে এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টি কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এ সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। কমিশন যাকে ভালো মনে করবে তাকে নিয়োগ দেবে। প্রশ্ন হচ্ছে-কমিশন যদি মনে করে, সরকারি দলের লোকজন দিয়ে নির্বাচন ভালো হবে, তার বিচার বিশ্লেষণ জনগণ করবে। তবে সরকারি লোক নিয়োগ দেয়ার ফলে নির্বাচন খারাপ হলে এর দায়িত্ব কমিশনকেই নিতে হবে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেছেন, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তারা যেভাবে কমিশনের কথা শুনবে, সরকারি কর্মকর্তারা সেভাবে শুনবে না। এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া তিনি মনে করেন, ইসির পর্যাপ্ত জনবল থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আধিক্য বেশি হওয়ায় নির্বাচন নিয়ে জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এ সন্দেহ নির্বাচন কমিশনকেই দূর করতে হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সঙ্গতকারণে এডিসি এবং ইউএনও দিয়ে কী হবে তা সহজে অনুমান করা যায়। তবে এ কথাও সত্য যে, নির্বাচন কমিশনের হাতে যে জনবল আছে তাদের রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করার মতো সক্ষমতা আছে। কারণ মধু ও মধুর মতো মিষ্টি এক জিনিস নয়। তিনি বলেন, আসলে প্রধান সমস্যা এখানে না। সমস্যা হল-নির্বাচনের সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মানুষ এখন ভোট দিতে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এর কারণ আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। এর মধ্যেই সব প্রশ্নের উত্তর আছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেঃ জেনারেল (অবঃ) মাহবুবুর রহমান বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে অনেক অনেক কথা রয়েছে। এই কমিশন সরকারের একটা ক্যাডার বাহিনী। বলা যায়, তাদের একটা অঙ্গসংগঠন। তবে এই নির্বাচন কীভাবে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে, এটা নির্বাচন কমিশনের জন্য একটা অগ্নিপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় তাকে পাস করতে হবে। এই নির্বাচনের ওপরই নির্ভর করবে ভবিষ্যতের সংসদ নির্বাচন ও অন্যান্য নির্বাচন। তিনি বলেন, বিএনপির অনেক প্রার্থী মনোনয়ন পত্র জমা দিতে পারেননি। নানা অজুহাতে রিটার্নিং অফিসাররা তাদের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করেননি। এ ছাড়া যারা নির্বাচন করবেন, তারা প্রকাশ্যে বের হতে পারছেন না। নির্বাচনে নিয়োজিত কর্মীরা বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমার শিকার হচ্ছেন। এখানে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করেনি নির্বাচন কমিশন। (সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর ৬ ডিসেম্বর ২০১৫)।
জিবলু রহমান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads