সোমবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

বিজয় দিবস : আমাদের সাফল্য ব্যর্থতা


আগামীকাল ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিনে ৯ মাসব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১১ দিনব্যাপী পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সংঘটিত ঘোষিত যুদ্ধের পরিসমাপ্তি শেষে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর নিকট পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের বিজয় সূচিত হয় এবং আমরা একটা স্বাধীন দেশের পতাকার অধিকারী হই। তখন থেকে এই দিবসটি বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে এবং আগামীকাল এই দিবসের ৪৫তম বার্ষিকী উদযাপিত হবে। বিজয় দিবসের এই উষালগ্নে আমরা দলমত নির্বিশেষে সকল দেশবাসী, সকল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার এবং আহত নিহত সকলের প্রতি শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন জানাই এবং নিহতদের রূহের মাগফিরাত কামনা করি।
বিজয় দিবসের তাৎপর্য ব্যাপক; এই দিবস প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্বাধীনতার স্বর্ণ দুয়ার উদঘাটিত করেছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট আমরা বৃটিশ শাসকদের শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে স্বাধীন পাকিস্তানের নাগরিক হয়েছিলাম। আশা ছিল আমরা আমাদের স্বাধীনসত্তা তথা মৌলিক অধিকার ফিরে পাবো। বাকস্বাধীনতা, মতামতের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, জীবিকার স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সরকার গঠন ও পরিচালনার অধিকার, ন্যায়বিচারের নীতিমালা এবং অর্থনৈতিক সুবিচারসহ আমাদের প্রাপ্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবো। সমাজে ব্যভিচার, দুর্নীতি ও কোনও প্রকার বৈষম্য থাকবে না এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী তাদের আকিদা বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করবেন। কিন্তু কার্যত তা হয়নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা তথা ১৯৫০ সালে East Bengal Estate Acquisition and Tenancy Act বাস্তবায়নের মাধ্যমে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করে কৃষক প্রজাদের ভূমি মালিকানা প্রদান করা হয়। বলাবাহুল্য, এর আগে তৎকালীন পূর্ব বাংলার (যা পরে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত হয়) জমিদারদের শতকরা ৯৫ জনই ছিল অমুসলমান, হিন্দু। অঞ্চলটি ছিল কৃষিভিত্তিক, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং মুসলমানদের শতকরা প্রায় ১০০ জনই ছিল তাদের প্রজা। জমিদারের বাড়ির সামনে দিয়ে মুসলমান প্রজাদের জুতা পায়ে, ছাতা মাথায় বা পাল্কি চড়ে যাতায়াত ছিল নিষিদ্ধ। যত শিক্ষিত বা সম্ভ্রান্তই হোক না কেন জমিদারদের সামনে তারা চেয়ারে বসতে পারতেন না; মেঝেতে বসতে হতো। তাদের সঙ্গে অচ্ছুতের মতো ব্যবহার করা হতো। কুকুর-বিড়াল ঢুকলে হিন্দু বাড়ির পবিত্রতা নষ্ট হতো না, কিন্তু মুসলমান বা তাদের ছেলেমেয়ে ঘরে ঢুকলে তা অপবিত্র হয়ে যেতো। শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বত্র সাধারণ মুসলমানরা ছিল অবাঞ্ছিত। ’৪৭ সালের স্বাধীনতা তাদের এক্ষেত্রে এবং এতদাঞ্চলের শিল্পায়নসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ক্ষেত্রে বিরাট অগ্রগতির দুয়ার খুলে দিয়েছিল। কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষার প্রতি অবজ্ঞা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস, অত্যাচার, অবিচার, সামরিক বাহিনীর বাড়াবাড়ি, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা এবং নির্মম হস্তে অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে দমনের প্রচেষ্টা ও গণহত্যা প্রভৃতি তাদের সকল অর্জনকে ম্লান করে দেয় এবং এই অঞ্চল তথা পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভারত এ ক্ষেত্রে তাদের চিরশত্রু পাকিস্তানকে শায়েস্তা করা ও এই ভূখণ্ড থেকে তাদের স্বার্থ আদায়ের দ্বৈত লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তা করে এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান পরাভূত হয়। আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিজয় সূচিত হয়। অবশ্য অনেকে বলে থাকেন এই অনুষ্ঠানে ভারতীয় স্বার্থে বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে অনুপস্থিত রাখা হয়। এই ইতিহাস, আমার আলোচ্য বিষয় নয়। বাস্তবতা হচ্ছে আগামীকাল বিজয় দিবস এবং এই বিজয়ের ফলে আমরা কী পেলাম কী পেলাম না আমাদের প্রত্যাশার আলোকে তার বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন। স্বাধীন বাংলাদেশের সাফল্যগাঁথা অনেক। আমাদের খাদ্যোৎপাদন বেড়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে, গড় আয়ু ও জীবনযাত্রার মান এবং মাথাপিছু আয় বেড়েছে। শিশুমৃত্যু ও প্রসূতি মায়েদের অবস্থারও উন্নতি হয়েছে। বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতা বেড়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। বসন্ত, কলেরা ও ম্যালেরিয়া এবং কালাজ্বর এখন নাই বললেই চলে। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রেও আমাদের সাফল্য অভূতপূর্ব। রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্টসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো আমাদের অবস্থাকে যথেষ্টভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে। গার্মেন্টস ও নীটওভেন শিল্প বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জনে আমাদের সহায়তা করেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের দক্ষ, আধা-দক্ষ ও অদক্ষ জনশক্তি সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা প্রবাস থেকে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছেন। এই সাফল্য এ দেশের মানুষের সকলের, কোনও বিশেষ পক্ষ শক্তির কৃতিত্ব নয়।
আমাদের ব্যর্থতাও আছে। রাজনৈতিক ব্যর্থতা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের উপর অত্যাচার-নিপীড়ন আমাদের অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন সবকিছুর মূল্য বেড়েছে, কিন্তু মানুষের জীবনের মূল্য সাংঘাতিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। হত্যা, গুম, ব্যভিচার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীদের নিত্যব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমনকি এলিট ফোর্সে কর্মরত সেনাবাহিনীর সিনিয়র জুনিয়র কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অর্থবিত্তের প্রলোভন দেখিয়ে অথবা অবৈধ অর্থ দিয়ে খুন-খারাবির কাজে লাগানোর অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। রাজনীতি থেকে শিষ্টাচার বিদায় নিয়েছে। ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অবৈধ ভোগ এখন রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য;
আদর্শ এখানে গৌণ। কে কত ধর্মবিদ্বেষী হতে পারলো এবং ধার্মিক, সৎ, নিষ্ঠাবান ও আদর্শবাদী দল ও নেতাকর্মীদের নিধন করতে পারলো তার উপরই এখন প্রগতিশীলতা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। রাষ্ট্রীয় ব্যাংক এবং অর্থ প্রতিষ্ঠানসমূহ এখন লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ফেরাউনী ধাঁচের স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী শাসকরা এখন মানুষের ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো বসে আছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও তার চর্চা দেশ থেকে বিদায় হয়ে গেছে। বিনা নির্বাচন, নির্বাচনী প্রহসন ও বিনাভোটে সরকারি দল ও তার জোটের নেতাকর্মীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রী পরিষদে গিয়ে দেশ শাসন করেন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের সীমাহীন অপচয় ও আত্মসাতে লিপ্ত হন। পক্ষান্তরে বিরোধী দলের বিপুল ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠানসমূহে কাজ করতে দেয়া হয় না। নানা অজুহাত তুলে তাদের জেলে পাঠিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত জননিন্দিত সরকারি দলের নেতাকর্মীদের তাদের স্থলাভিষিক্ত করা হয়। আবার অর্থনৈতিক সুবিচারও নির্বাসনে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য চরমে উঠেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য, সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের স্বৈরাচার ও সন্ত্রাস শিক্ষাব্যবস্থাকে শুধু ধ্বংসই করেনি আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদেরও ধ্বংস করে দিচ্ছে। সরকার এ ক্ষেত্রে অপরাধীদের শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কার দিচ্ছে বলে মনে হয়।
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে সরকার বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপ করে ন্যায়বিচারের পথও রুদ্ধ করে দিয়েছেন। বিচারের আদালত অভিযোগ অনুযায়ী হাসির আদালতে পরিণত হয়েছে এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সমাজে যারা সৎ, ধার্মিক, নিষ্ঠাবান ও জনদরদী হিসেবে পরিচিত এবং সর্বজন স্বীকৃত তাদের পুরস্কারের পরিবর্তে তিরস্কৃতই শুধু নয় নিষ্ঠুরভাবে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়াও হচ্ছে। প্রতিবাদের ভাষা ও পন্থা সবকিছুই সরকার বন্ধ করে দিয়েছেন। পরাধীন আমলে জনসভা, পথসভা ও বিক্ষোভ মিছিলে কোনও বাধা ছিল না। এখন ঘরোয়া বৈঠকে বসলেও সরকার নাশকতার অভিযোগে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে। নির্যাতন ও প্রতিপক্ষ ঠেঙ্গানোর মাত্রা স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির দাবিদার দল/দলগুলোর মধ্যে এতবেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, সারা দেশটি যেন এখন তাদের জমিদারীতে পরিণত হয়েছে। বৃটিশ আমলে ২৪ পরগনার নাকিলেকবাড়িয়া পরগনার জমিদার কৃষ্ণরাও দাড়ি রাখার জন্য মুসলমানদের উপর দাড়িপ্রতি পাঁচ শিকে (১.২৫) করে জরিমানা করতেন। এখন আমাদের জমিদাররা ধর্মীয় বইপুস্তককে জেহাদী বই (সন্ত্রাসী অর্থে) আখ্যা দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে লাখ লাখ টাকা আদায় করেন। গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সাম্যপ্রতিষ্ঠা, অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ, মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি লক্ষ্যে আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। কিন্তু আজকে যা ঘটছে তার সাথে এই প্রত্যাশার সামঞ্জস্য আছে কি না তা বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। মতামত প্রকাশ ও শিক্ষা-দীক্ষায় কম্পিউটার ভিত্তিক সামাজিক মাধ্যমগুলো বিশেষ করে ভাইবার, স্কাইপি ও অনেকগুলো APP বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভয়, জামায়াত। এক জামায়াতের ভয়ে তাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। অনেকে বলে থাকেন জামায়াতের মতো নিষ্ঠাবান আরো দু-একটি প্রতিষ্ঠান থাকলে সম্ভবত অত্যাচারী সরকারের অনেকে হয়তো ভয়ে আত্মহত্যা করতেন।
ড. মোঃ নূরুল আমিন

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads