বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৫

টাকা পাচার প্রতিহত করতে হবে


রাজনৈতিক হত্যা এবং বিরোধী দলকে দমন ও নিপীড়নের মতো কিছু বিষয়ে অন্য অনেক দেশকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ সম্প্রতি কালো টাকা পাচারের ক্ষেত্রেও অনেক এগিয়ে গেছে। মাত্র এক বছরের মধ্যে ৪৮তম অবস্থান থেকে উঠে এসেছে ২৬তম অবস্থানে। বাংলাদেশ থেকে বছরে পাচার হয়ে যাওয়া টাকার পরিমাণও চমকে ওঠার মতো। প্রতি বছর পাচার হয়ে যাচ্ছে গড়ে ৫৫৮ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার, দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪৪ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। গত বুধবার এসব তথ্য-পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি-জিএফআই। ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ ও অনুসন্ধান করার পর জিএফআই-এর রিপোর্টে জানানো হয়েছে, আমদানি ও রফতানির উভয় ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে প্রতি বছর ৪৯১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৩৮ হাজার আটশ কোটি টাকা পাচার করা হচ্ছে। এরই পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে লাভ নিয়ে ব্যবসা ও মূলধন গুটিয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে আরো সাড়ে ৬৭ কোটি ডলার। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে ২০১৩ সালে, যার পরিমাণ ছিল ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ৭৬ হাজার তিনশ কোটি টাকা। গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত তিন বছরে কালো টাকার পাচার বেড়েছে প্রায় ৮০ গুণ। 
টাকা পাচারের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদসহ তথ্যাভিজ্ঞরা জানিয়েছেন, বিচার ও শাস্তির শিকার হওয়ার ভয়ে অসৎ পথে অর্জিত টাকার প্রায় সম্পূর্ণই পাচার করে দেয় দুর্নীতিবাজেরা। তারা এই কালো টাকা দেশে বিনিয়োগ করা নিরাপদ মনে করে না। দেশের ভেতরে বিনিয়োগ ও ব্যবসা করার মতো পরিবেশ না থাকা টাকা পাচার হওয়ার দ্বিতীয় প্রধান কারণ। শিল্প-কারখানা স্থাপনসহ যে কোনো ব্যবসার পথেই ঘুষ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ না পাওয়ার মতো এত বেশি ধরনের সমস্যা রয়েছে যে, দেশী-বিদেশী কেউই সহজে বিনিয়োগ করার সাহস পান না। তারা তাই বিদেশে টাকা পাচার করে থাকেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত ও অনিশ্চয়তার কারণেও টাকা পাচার হয়ে যায়। এখানেও ভীতি-আতংকই কারণ হিসেবে ভূমিকা রাখে। এ প্রসঙ্গেই ২০১৩ সালের উদাহরণ উল্লেখ করেছে জিএফআই।
বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রতি বছর ৪৪ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার তথ্য উদ্বেগজনক শুধু নয়, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র ও উন্নয়নশীল একটি রাষ্ট্রের জন্য যে কোনো বিচারে অত্যন্ত ভীতিকরও। ২০১৩ সালে এক বছরেই ৭৬ হাজার তিনশ কোটি টাকা পাচারের তথ্যটিও নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই পরিমাণ ছিল পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৩৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি। শুধু তা-ই নয়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পল্লী উন্নয়ন, পরিবহন এবং শিল্প ও ভৌত অবকাঠামো খাতে উন্নয়নের জন্য বাজেটে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে এটা তার চাইতেও বেশি। এমন অবস্থায় দেশের উন্নয়ন চেষ্টা বাধাগ্রস্ত না হয়ে পারে না। বাস্তবে সর্বাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছেও এবং এখনো হচ্ছেই। উদ্বেগের সবচেয়ে বড় কারণ হলো, বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার ফলে দেশের ভেতরে কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। সৃষ্টি হচ্ছে না চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগও। এখানে তথ্যাভিজ্ঞদের বর্ণিত কারণগুলো লক্ষ্য করা দরকার। তারা বলেছেন এবং একথা সত্যও যে, মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও সংঘাতের কারণেই দেশী-বিদেশী কারো পক্ষে বিনিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। বলাবাহুল্য, সবকিছুর পেছনে রয়েছে সরকারের প্রতিহিংসামূলক নীতি ও কর্মকাণ্ড। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো জনপ্রিয় দলগুলোর বিরুদ্ধে সরকার প্রচণ্ড দমন-পীড়ন চালিয়ে এসেছে বলেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। তেমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। একই কারণে ব্যবসা ও বিনিয়োগে আগ্রহীদের মধ্যেও ভীতি-আতংক কেবল বেড়েই চলেছে। তারা তাই দেশ থেকে অবৈধ পথে পাচার করছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এভাবে চলছে বলেই শিল্প-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির প্রতিটি খাতে সংকট ক্রমাগত আরো মারাত্মক হয়ে উঠছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এবং আমরাও মনে করি, টাকার পাচার বন্ধ করার পাশাপাশি পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে হলে সরকারের উচিত অবিলম্বে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। সরকারকে একই সাথে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করার জন্যও ব্যবস্থা নিতে হবে, আগ্রহীরা যাতে সহজে শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালাতে পারেন। বিনিয়োগে উৎসাহী করার জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট কাটিয়ে ওঠারও পদক্ষেপ নিতে হবে।  সব মিলিয়ে এমন পরিস্থিতিরই সৃষ্টি করা দরকার, কাউকেই যাতে অবৈধ পথে টাকা পাচার করার কথা চিন্তা না করতে হয়। আমরা প্রসঙ্গক্রমে টাকা পাচারকারীদের চিহ্নিত করার এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনসঙ্গত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাই। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads