মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৫

‘ধরো অস্ত্র করো রণ’


আমাদের কৈশোরে শীতকালে ‘মহাসমারোহে’ অনুষ্ঠিত হতো যাত্রাগান। এক এক বছর এক এক জায়গা থেকে প্রখ্যাত যাত্রাদল হায়ার করে আনা হতো। তারা নানা লটবহর, যন্ত্রপাতি, তাঁবু-খাট-বাঁশ এইসব নিয়ে এসে গ্রামে হাজির হতো। বড়রা ছোটরা মিলে ভিড় করে তাদের দেখতে যেতাম। তারা ডাল-ভাত-মাছ-মাংসই খেতো। তার মধ্যে কয়েকজন থাকতো, যারা পুরুষ, কিন্তু যাত্রায় নারী সেজে অভিনয় করত। তাদের লম্বা চুল ছিল। পুরুষ মানুষের লম্বা চুল দেখে আমরা মুখ টিপে হাসতাম। রাত এগারোটা-সাড়ে এগারোটা থেকে যাত্রার ঢাক-ঢোল আর বাঁশি বাজতে শুরু করত। তার একটা মাদকতা ছিল। ওটা হলো আহ্বান : দলে দলে যোগদান করুন। যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে। আর সত্যি সত্যি খাল-পুকুরের পাড় ধরে, বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে মড়মড় শব্দ তুলে কেউ বা সাপের ভয়ে করতালি দিতে দিতে যাত্রার প্যান্ডেলের দিকে যাত্রা করত। আমাদের মতো বয়সের ছেলেদের যাত্রা দেখা নিষেধ ছিল। মুরুব্বিরা বলতেন, খবরদার, যাত্রা দেখে ফাৎরা লোকে। আর ব্যাপারটা এমন নয় যে, যাত্রা দেখার জন্য গোঁ ধরা যাবে। তাহলে অভিভাবকরা পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দেবেন। তারপরও নানা সঙ্কেতে বন্ধু-বান্ধবেরা একত্র হয়ে আমরা যাত্রা দেখেছি। মারও খেয়েছি।
সে সময় সবচেয়ে জনপ্রিয় যাত্রা ছিল ‘রূপভান যাত্রা’। মানিকগঞ্জের লাথুরার বিখ্যাত এক যাত্রাদল রূপভান যাত্রা করত সবচেয়ে ভাল। তারা সারা দেশে খুব নামও করেছিল। কাহিনীর মধ্যে ছিল, রাজার একটি পুত্র সন্তান হলো। গণক রাশি-কুষ্ঠি গুণে বলে দিলেন যে, এই ছেলের বয়স যেদিন ১২ বছর পূর্ণ হবে, সেদিন তাকে বারো বছরের কোনো কন্যার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বারো বছরের জন্য বনবাসে পাঠাতে হবে। তা না হলে  রাজার উত্তরাধিকারী বাঁচবে না। চারদিকে খোঁজ পাঠানো হলো, বারো বছরের কনে চাই। শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল রূপভানকে। আর শুরু হলো রূপভানের কষ্টকর বনবাস। সে যুবরাজ রহিম বাদশাহকে পেলেলেলে ধীরে অতি যত্নে বড় করে তোলে। এভাবেই একদিন বারো বছর শেষ হয়ে আসে। তখন সেই বনে শিকারে আসেন কন্যা তাজেলসহ সায়েদ বাদশাহ। তাজেলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় রহিম বাদশাহর। আর রহিম তাজেলের প্রেমে পড়ে যায়। সায়েদ বাদশাহ তো বনে-জঙ্গলে বেড়ে ওঠা কারও কাছে তার কন্যা সম্প্রদান করবেন না। কিন্তু রহিম বাদশাহও ছাড়ার পাত্র নন। তিনি খাপ খুলে তরবারি বের করেন। সায়েদ বাদশাহও বের করেন তার তরবারি। তারপর পুচকে যুবরাজকে যুদ্ধে আহ্বান জানিয়ে সায়েদ বাদশাহ বলেন,‘তবে ধরো অস্ত্র করো রণ।’ এরপর যা হবার তাই হলো। সায়েদ বাদশাহ রহিম বাদশাহর প্রচণ্ড যুদ্ধ হলো। হেরে গেলেন সায়েদ বাদশাহ এবং কন্যা তাজেলকে তার হাতে সম্প্রদান করলেন। তখন রহিম বাদশাহ দু’ স্ত্রী নিয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন এবং সুখে-শান্তিতে জীবন যাপন করতে থাকলেন।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের অনির্বাচিত সরকারের এখন সায়েদ বাদশাহর দশা। তারা যেন তরবারি শানিয়েই রেখেছে। যাকে সামনে পায় তাকেই যুদ্ধে আহ্বান করে বসে ‘ধরো অস্ত্র করো রণ’। এই প্রক্রিয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের একবারে কুপোকাত করে ফেলেছেন। তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য হামলা-মামলা-ক্রসফায়ার-গুম-খুন এখন নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আর এসব অপকর্মে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হচ্ছে র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবিকে। বিরোধী রাজনীতিকদের দমনে এভাবে তাদের ব্যবহারের ফলে এসব বাহিনী তাদের পেশাদারিত্ব সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলেছে। এখন তারা নিজেরাই গুম-খুন-গ্রেফতার বাণিজ্য ও মুক্তিপণ আদায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এসব বাহিনীকে সরকারের তরফ থেকে ক্রসফায়ারের নামে নরহত্যার যেন লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। ফলে প্রতিদিন নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের বিচার চাইবার কোনো জায়গা নেই। সরকারের কাছে প্রতিকার চাওয়া এখন অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হয়েছে। জনপ্রতিনিধিত্বহীন এই সরকার যেন গোটা দেশবাসীকেই একেবারে ডাণ্ডা মের ঠাণ্ডা করে দিতে চাইছে।
সরকারের এই ফ্যাসিবাদী নীতির প্রতিবাদ জানিয়েছে সারা বিশ্ব। গোটা বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। বহু বিশ্ব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশ দায়বদ্ধ। দায়বদ্ধ জাতিসংঘের সঙ্গেও। কিন্তু দেশে ফ্যাসিবাদী কায়দায় সীমাহীন হামলা চালিয়ে সরকারের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, একই কায়দায় তারা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও শাসন করতে পারে। তারা যেন বাংলাদেশের অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ মানতে বাধ্য। তা না হলে তাদের পরিণতিও যেন বাংলাদেশের বিরোধী দলের মতো করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন শেখ হাসিনা। ফলে তিনি জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ কাউকে কোনোরূপ তোয়াক্কাই করছেন না। আর এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি এমন ভাষা প্রয়োগ করছেন যে, তা সকল শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘন করেছে। অথচ এসব দেশ ও প্রতিষ্ঠানের ওপর বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
এটা শুরু হয়েছিল বিশ্বব্যাংক দিয়ে। দুর্নীতিতে এই সরকারের বিশ্বরেকর্ড সর্বজনবিদিত। দেশের ভেতরে-বাইরে এমন কোনো খাত নেই, যা আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত নয়। আর এই সর্বগ্রাসী দুর্নীতির জন্য সারা বিশ্বের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রতি তিনমাসের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, বিদেশি বিনিয়োগ কেবলই কমছে। সরকার না পারছে দুর্নীতির রাশ টেনে ধরতে, না পারছে স্থানীয় আওয়ামী মাস্তানদের দুর্নীতি-চাঁদাবাজি রোধ করতে, না পারছে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে অবকাঠামোগত সুবিধা চালু করতে। ফলে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বিদেশিরা অলস বসে আছেন। কবে গ্যাসের লাইন পাওয়া যাবে, কবে পাওয়া যাবে বিদ্যুৎ সংযোগ, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এদিকে আবার পদ্মাসেতু প্রকল্পে মাত্র ০.৭৫ শতাংশ সুদে ২০০ কোটি ডলার ঋণ দিতে চেয়েছিল বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও এডিবি। কিন্তু কাজ শুরুর আগেই সরকারের তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ঘুষের কারবারে জড়িয়ে পড়ায় ঐ তিন প্রতিষ্ঠান পদ্মাসেতুতে ঋণদান পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়। ফলে এখন প্রায় চার শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে সে কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এসব সংস্থার অর্থ সাহায্যে পরিচালিত অন্যান্য প্রকল্পের পরিস্থিতিও প্রায় একই রকম। ঘুষ, দুর্নীতি আর প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতার কারণে দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বহু প্রকল্পে তাদের অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে এই সরকারের নেতৃত্বে ভূতের মতো পেছনে চলতে শুরু করেছে দেশ। একদিকে এসব প্রতিষ্ঠানকে কষে যেমন গাল দিচ্ছে সরকার, অপর দিকে তেমনি ভিক্ষাপাত্র হাতে তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে অর্থ সাহায্যের জন্য। প্রধানমন্ত্রী অবিরাম বিশ্বব্যাংককে গাল দিয়ে যাচ্ছেন, বিশ্বব্যাংক শুধু টাকা বোঝে, উন্নয়ন বোঝে না। আর অর্থমন্ত্রী অবিরাম বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের দরবারে ধরণা দিচ্ছেন। ফায়দা কিছুই হচ্ছে না।
এদিকে জনগণের ওপর নির্যাতনের স্টীমরোলার চালানোর ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই দেশে চরমপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মানুষের পিঠ যখন দেওয়ালে ঠেকে যায়, তখন প্রতিরোধ করা ছাড়া তার সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকে না। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই তখন তারা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। সংঘবদ্ধ হয়। এই সংঘশক্তি কখনও কখনও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশে এখন হচ্ছেও তাই। আর সে কারণেই নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশে তাদের ক্রিকেট দলকে নিরাপত্তা হুমকির কারণে পাঠাতে অস্বীকার করে। গোলযোগের সূত্রপাত ঘটে সেখান থেকেই। সরকার অস্ট্রেলিয়ার ওপর একেবারে হামলে পড়ে। তাদের এই সিদ্ধান্তকে বাড়াবাড়ি বলে অভিহিত করতে থাকে। এর দুদিনের মধ্যেই ঢাকায় খুন হন ইটালির নাগরিক তাভেলা সিজার আর তার মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যেই রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোসি কুনিও। এতে অস্ট্রেলিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে তাদের নাগরিকদের জন্য রেড এলার্ট ও ভ্রমণ সতর্কতা জারি করে। যা এখনও বহাল আছে। সরকার তারও কঠোর সমালোচনা করতে থাকে এবং নানা রকম আইড়া যুক্তি খাড়া করতে শুরু করে।
ঐ দুই বিদেশি হত্যাকা-, শিয়া মিছিলে, মসজিদে হামলা ও হত্যা, আশুলিয়া ও গাবতলিতে পুলিশ হত্যা প্রভৃতি ঘটনার দায় স্বীকার করে আইএস (ইসলামিক স্টেট)। বাংলাদেশের তরফ থেকে ধারাবাহিকভাবে বলা হতে থাকে যে, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিশ্বাস করে যে, এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে আইএস-ই। সরকার অন্যদের তো টিটকারি দিলই, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেন একবারে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসল। সরকারের মন্ত্রীরা তো বললেনই, সেই সঙ্গে পুলিশ প্রধানও বিনা প্রমাণে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে বসলেন বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে।
এর মধ্যে ঘটল আর এক ঘটনা। গত ২২ নবেম্বর সরকার যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। এ বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন ও মহাসচিব বান কি মুন প্রতিবাদ জানান। তারা বলেন, যুদ্ধাপরাধের এই বিচার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হয়নি। তারা বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড বন্ধ রাখারও আহ্বান জানান। তারা বারবার বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক করেছিলেন। ন্যাযবিচার সংক্রান্ত ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অ্যান্ড সিভিল পলিটিক্যাল রাইটসের শর্ত অনুযায়ীও এই বিচার করা হয়নি। ঐ চুক্তিতে বাংলাদেশও স্বাক্ষর করেছে। আর তাই সকল মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা স্থগিত রাখা হোক। এরও তীব্র প্রতিবাদ জানায় সরকার। এতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের বত্তব্য চরম বিরক্তিকর। এও জাতিসংঘের বিরুদ্ধে এক ধরনের  ‘ধরো অস্ত্র করো রণ’ ধরনের অবস্থা।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একযোগে কঠোর মন্তব্য করেছেন সরকারের তিন মন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন বলেছেন, বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে আইএস-এর নামে ষড়যন্ত্র করছে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের বাংলাদেশি দোসররা। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, জঙ্গি বানিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, জিএসপি সুবিধা না দিয়ে অন্যায় করছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এর আগে বহুবার এই তোফায়েলই বলেছিলেন যে, জিএসপির কোনো প্রয়োজন নেই। আর কোনোদিন বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জিএসপি চাইবে না। কিন্তু তার ‘ভিখ মাগা’ চলছেই। তাহলে কি এবার বাংলাদেশ সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে তলোয়ার ঘুরিয়ে বলবে, আসো দেখি ‘ধরো অস্ত্র করো রণ’?
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads