সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৫

দলীয় নির্বাচিতদের বৈষম্য-দৃষ্টির শিকার হবে মানুষ


তৃণমূলে সরকারের সেবা পৌঁছে দেয়ার মাধ্যম হচ্ছে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ। আমাদের দেশে রাজনীতির চর্চা অথবা রাজনীতিতে সুস্থতা বাংলাদেশে নেই। তৃণমূলের মানুষের ভাবনায়ও সেটি কাজ করে। তাই রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল সম্পর্কে এখনও মানুষের মনে যথেষ্ট ভীতি কাজ করে। যে দলের কথাই বলা হোক না কেন ক্ষমতায় গেলে সব দলই দেশের চেয়ে দলের আদর্শ, দলীয় কর্মীদের স্বার্থ, দলের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সকল আইন কানুনও সেভাবেই পাস করতে থাকে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন হয় ক্ষমতাকে সুরক্ষার আইন। আইন করতে গিয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে দল এবং দলীয় আদর্শের কর্মীরা যাতে রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক ক্ষমতা, আর্থিক সুবিধা লাভের উপায় সহজেই পেতে পারে এবং বিরোধী মতাদর্শের ব্যক্তিরা যাতে তা পেতে না পারে তা যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় বিবেচনায় হওয়ার কারণে নির্বাচিত সংসদ সদস্য যে দলের হন তার কাছে একজন নাগরিকের সুবিধা প্রাপ্তির জন্য বিরোধী মতাদর্শের খুব কম লোকই স্মরণাপন্ন হন। একান্ত প্রয়োজন হলেও তিনি এমন কারোর মাধ্যমে তার কাছে পৌঁছান যার পরিচয় ঐ সংসদ সদস্যের মতাদর্শের অনুসারী। আমি আগেই বলেছি জাতীয় সংসদ সদস্যের কাছে নাগরিকদের যাওয়ার তেমন কোন প্রয়োজন হয় না। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ তার এলাকার প্রায় সকল নাগরিককে প্রত্যক্ষভাবে চিনেন এবং জানেন। একজন মেয়র অথবা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে তার এলাকায় তৃণমূলের সকল মানুষের কর্মকা-ের নেতৃত্ব দিতে হয়। সীমানা বিরোধ, নিরাপত্তা, পারিবারিক জটিলতা নিরসন, রাস্তাঘাট মেরামতের দাবিদাওয়া, দরিদ্র মানুষের পাশে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করা, বিয়ে-শাদিতে অংশগ্রহণ, ছোটখাট ঝগড়াবিবাদ মীমাংসা, অনাকাক্সিক্ষত বা অনভিপ্রেত কোন ঘটনার অবসান ইত্যাদিতে অবশ্যই একজন মেয়র অথবা চেয়ারম্যানকে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থেকে সমাধান করতে হয়। সেক্ষেত্রে মেয়র অথবা চেয়ারম্যান উক্ত বিষয়গুলোতে নিরপেক্ষতার সাথে যেমন দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। অন্যপক্ষে ঘটনার সাথে আয়োজনের সাথে সংশ্লিষ্টরাও নির্ভরতা পাবেন না। কারণ তাদেরও জানা থাকবে নির্বাচনের সময় ঐ ব্যক্তিরা তার পক্ষে না বিপক্ষে কাজ করেছে। আর নির্বাচিত প্রতিনিধিও জানবে যে, ঐ ব্যক্তিরা নির্বাচনের সময় কোন দলের পক্ষে ছিলো। এতে করে নির্বাচনের সময় দলের পক্ষে-বিপক্ষে কাজ করা ব্যক্তিদের মনে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মনে ক্ষত রয়ে যায়। যার সুস্পষ্ট প্রভাব সেবার বিবেচনায় পড়ে থাকে। এতে করে নির্বাচিত প্রতিনিধির সেবা শুধুমাত্র যে দল থেকে তিনি নির্বাচিত হবেন তাদের কেই প্রাধান্য দেবেন। হ্যাঁ বলতে পারেন যে দলীয়ভাবে অথবা দলীয় প্রতীক ছাড়াও যখন নির্বাচিত হয় তখনও তো প্রার্থীরা গোপনীয়ভাবে (ওপেনসিক্রেট) দলের নমিনী বা প্রার্থী হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে প্রচার-প্রপাগান্ডায় বলা হয় অমূক দলের সমর্থিত। তাই বলে এরকম সমর্থিত হওয়া প্রার্থী এবং সরাসরি দল থেকে মনোনয়নপ্রাপ্ত হয়ে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের মধ্যে অবশ্যই একটা পার্থক্য আছে বা থাকে। সেটা হল প্রার্থীরা দল সমর্থিত হলেও সাধারণ মানুষের কাছে ভোট প্রার্থনার সময় তারা কিন্তু তার দলের সমর্থনের বিষয়টি প্রকাশ করে না। তিনি তখন সকল দল এবং মতের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য বেশী  ভোট পাওয়ার জন্য যেখানে যে কৌশল প্রয়োগ করলে প্রার্থীর পক্ষে বেশী ভোট পড়বে তিনি সে কৌশলই প্রয়োগ করেন। কিন্তু দলের মনোনয়ন এবং দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করলে তখন আর সে সুযোগ থাকে না। মনোনয়ন এবং তাকে আগেই ভোটারদের কাছে বা জনগণের কাছে ভাগ করেই উপস্থাপিত হবে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে তিনি যে দলের গোপন সমর্থকই হোন না কেন তিনি সকলের, সকল দল এবং মতের প্রার্থী হিসেবে কাজ করেন এবং করবেন। কিন্তু দলীয় মনোনয়ন এবং দলীয় প্রতীক থাকার কারণে নির্বাচিত মেয়র বা চেয়ারম্যান হয়েছেন। যারা যুক্তি দেখাতে চান গণতন্ত্রের চর্চা বাড়তে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় মনোনয়ন এবং দলীয় প্রতীকে হওয়া উচিত তারা একটি বিষয় ভুলে যাচ্ছেন আমাদের গণতন্ত্রের ইতিহাসে কতটুকু গণতন্ত্র পাওয়া যায় বা দেশের শতকরা কত অংশ মানুষ সরাসরি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত তাকি কখনো হিসাব করে দেখেছেন? তৃণমূলের মানুষ সকলেই যদি দলনির্ভর হয়ে ভোট দিত তাহলে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসতে পারত না। আগের ২ বারে সর্বমোট ৩ বারে ক্ষমতায় থাকা খালেদা জিয়াকে ভোট না দিয়ে ’৯৬ সালে মানুষ কেন আওয়ামী লীগকে ভোট দিল। আমি একথা দিয়ে এটাই প্রমাণ করতে চাই এদেশের মানুষ শুধুমাত্র দলবিবেচনায় ভোট দেয় না ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার অপব্যবহারে বিরক্ত হয়ে সুযোগ বুঝে তার মতের বিপক্ষের দলকেও ভোট দেয়। কারণ তারা প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। তৃণমূলের এই মানুষগুলো মনে মনে কোন দলের সমর্থন করলেও বাংলাদেশের রাজনীতিকে এখনও গ্রহণযোগ্য রাজনীতি মনে করে না। সাধারণ মানুষ বর্তমান সময় রাজনীতিকে মনে করে- ক্ষমতায় যাওয়া, অন্যের সাথে বেশী চালাকির সাথে নিজের কাজ বা স্বার্থ উদ্ধার করা, কৌশলে অন্যকে ঠকানো, নিজ দলের নেতা-কর্মীদেরকে সরকার বা রাষ্ট্রের সুবিধা ভোগ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। আমাদের দেশের রাজনীতিতে এখনও এতটুকু সহনশীলতা তৈরী হয়নি যে, একই পরিবারের ২ জন ভিন্নদলের প্রার্থী হলে অথবা একজন প্রার্থী না হয়েও তার পরিবারের সদস্যের প্রার্থীর সাথে মতের ভিন্নতা প্রকাশ করে নিজ দলের প্রার্থীর পক্ষে তৎপরতা চালালে পরিবারের সদস্য প্রার্থী তাকে ভালো চোখে দেখবে।
পাঠক এবার আপনাদেরকে ইতিহাসের পিছনের পাতার দিকে ফিরে তাকানোর জন্য অনুরোধ করে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পরিবেশ এবং তার পরবর্তী কালসহ বর্তমান পর্যন্ত কি ফলাফল দাঁড়িয়েছে? উপজেলা পরিষদ নির্বাচন তো দলের মনোনয়ন নয় দল সমর্থিত হয়েছিলো। সে নির্বাচনে প্রথম ধাপে সরকার নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ করার জন্য শতভাগ পদক্ষেপ না  নিলেও আশিভাগ পদক্ষেপ নিয়েছিল বলে জনগণের মনে হয়েছে। কিন্তু ফলাফলে যখন দেখা গেল আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানরা অনেক পিছিয়ে তখন পরবর্তী ধাপে নির্বাচনের পরিবেশ পুরোটাই পাল্টে গেল। ব্যালট ছিনতাই, কেন্দ্রদখল, ফলাফল ছিনতাই- কোন বিশৃংখলারই কমতি ছিলো না। পরবর্তী ধাপের নির্বাচনগুলো এমন পরিবেশের মধ্য দিয়েই অনুষ্ঠিত হলো। শাসক এবং শোষকদের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ এবং অপকৌশল এখানেই থেমে থাকল না। এমন নির্বাচন পরিবেশের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাড়া বিরোধী মতের আদর্শের বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র সমর্থনে নির্বাচিত চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদেরকে নানারকম কল্পিত অভিযোগে মামলা দিয়ে বরখাস্ত করা হচ্ছে। বলাবাহুল্য যে, অভিযোগগুলো প্রমাণ হওয়ার আগে তাকে তার পদ থেকে বরখাস্তের চিঠি দেয়া হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এই বরখাস্তের প্রক্রিয়া ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে যতক্ষণ বিরোধী মতের নির্বাচিত ব্যক্তিদের সংখ্যা শেষ না হচ্ছে। বিরোধী মতের নির্বাচিত মেয়রদের অবস্থা তাই হচ্ছে। এ বিষয়গুলো যে রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্ষমতাসীন দল ইচ্ছাকৃতভাবে করছেন তার অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো টাঙ্গাইল পৌরসভা। ক্ষমতার দাপট দিয়ে ভোট কারচুপি করে নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী প্রার্থী হিসেবে। সেটিও এখন জনগণের কাছে বিবেচনার বড় বিষয় নয়, বড় বিষয় হলো টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র শহিদুর রহমান খান মুক্তি, খান পরিবারের সন্তান। তার ক্ষমতার আধিপত্য ব্যাপক। তারই ধারাবাহিকতায় তারই দলের জেলা কমিটির বিশিষ্ট  নেতা, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামী। তিনি দীর্ঘ দিনযাবৎ পলাতকও আছেন। তারও পৌরসভার দপ্তরের কাগজ কলমে তিনি ছুটিতে আছেন। তার চেয়ারম্যান পদও যাচ্ছে না, গ্রেফতারও হচ্ছেন না। আমি এখানে এঘটনার অবতারণা করলাম এজন্য যে আওয়ামী লীগের সমর্থনে নির্বাচিত হওয়ার কারণে হত্যা মামালায় অভিযুক্ত আসামী হওয়া সত্ত্বেও তিনি বরখাস্তও হচ্ছে না, গ্রেফতারও হচ্ছে না। অথচ তিনি কিন্তু মনোনয়ন নয় দলের সমর্থনে প্রার্থী হয়েছিলেন। আমি এটাই বোঝাতে চাইছি যে, ‘সমর্থিত’ হয়ে নির্বাচিত হয়েই সরকারি দলের ক্ষমতার খড়গ যেভাবে চালানো হচ্ছে বিরোধী মতের প্রার্থী বা নির্বাচিত ব্যক্তিদের উপর  সে অবস্থায় বিরোধী দলের মনোনয়ন দিয়ে সিটি মেয়র, পৌরমেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানগণ নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে যেমন শংকা স্পষ্ট তেমনি নির্বাচিত হলেও চেয়ারে না থাকার শংকাই তার চেয়ে বেশী। দলীয় প্রতীক নিয়ে স্থানীয় নির্বাচনের আইন এবং আয়োজন যে উদ্দেশ্যেমূলক তা ক্ষমতাসীনদের বক্তব্যই প্রমাণ করে। মহান জাতীয় সংসদে যেদিন সিটি করপোরেশন বিল নিয়ে আলোচনা হয় সেদিন ক্ষমতাসীন দলের অধিকাংশ সদস্যই তাদের বক্তব্যে এমনই প্রতিফলন হয় যে মেয়রপদটি দলের মনোনয়ন থাকলে এবং কাউন্সিলর পদ দল মনোনয়ন না থাকলে আমাদের উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। অপর একজন মাননীয় সংসদ সদস্য মোস্তফা লুৎফুল্লাহ তার সংশোধনী উপস্থাপনা করে বলেন- মেয়র এবং কাউন্সিলর উভয়টাই রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনীত না হলে সিটি করর্পোরেশন আইনটি জগাখিচুরিতে পরিণত হবে। সব মিলিয়ে সামনের স্থানীয় সরকার নির্বাচিন নিয়ে যেমন জনগণের মাঝে একধরনের রাজনৈতিক ভীতি কাজ করছে তেমনি দলীয় প্রতীকে বা মনোনয়নের মাধ্যমে গণতন্ত্র যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি নির্বাচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে তৃণমূলের মানুষ যে সেবা থেকে বঞ্চিতি হবে তা অনেকটাই বলা যায়।
অধ্যাপক এস.এম. মনিরুজ্জামান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads