রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫

চ্যালেঞ্জিং পৌরসভা নির্বাচন


আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন সকলের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং ঘটনা হিসাবে উপস্থিত হয়েছে। প্রথমত, নির্বাচনটি এই প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। লড়াইটিও তাই দলীয় এবং রাজনৈতিক মাত্রা পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিএনপি-জামায়াতসহ আন্দোলনরত রাজনৈতিক শক্তিসমূহ সর্বশক্তি দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। দীর্ঘদিন মাঠে-ময়দানে আন্দোলন-কর্মসূচিতে ব্যস্ত নেতাকর্মীগণ এখন নির্বাচনী তৎপরতায় ব্যস্ত। ফলে নির্বাচনী লড়াই যে জমে উঠবে এবং তীব্র হবে, তা বলাই বাহুল্য।
নির্বাচনের প্রাক্কালে দলগুলোর মধ্যে কিছু অনিয়ম দেখা যায় ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ ও অন্যান্য ইস্যুতে। কোথাও কোথাও বিদ্রোহী প্রার্থীও দাঁড়িয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এসব সমস্যাও মোকাবিলা করা হয়েছে। দেশের প্রায়-সর্বত্রই এখন সরকারি দল আর বিরোধী দল নির্বাচনী যুদ্ধে মুখোমুখি।
আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন একটি স্থানীয় পর্যায়ের ভোট হলেও রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বহীন নয়। বিশেষত, দলীয় প্রতীকে এবং দলের মনোনয়নের ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়ায় পুরো প্রক্রিয়াটিই রাজনৈতিক চরিত্র ধারণ করেছে। পাশাপাশি, এই নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের নিরিখে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্রও পাওয়া সম্ভব হবে। জানা যাবে, দলগুলোর জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তার বিষয়টিও। 
বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও নির্বাচন পদ্ধতির কার্যকারিতাও পরীক্ষা করা যাবে এই ভোটের সময়। কারণ, দেশের প্রায়-সকল বিরোধী দলেরই অভিন্ন দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পক্ষে। কারণ, তারা অভিযোগ করে আসছিলেন যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ হয় না। এই নির্বাচনে প্রমাণ হবে যে, আসলেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় কি না? দেশবাসী এবং বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র তাই এ নির্বাচনের দিকে আগ্রহভরে তাকিয়ে আছেন।
সরকার ও বিরোধীদের জনপ্রিয়তা পরিমাপেরও একটি সুযোগ আসবে এই নির্বাচনে। যদিও পৌরসভা নির্বাচন ক্ষমতার পালাবদলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে না, তথাপি সাধারণভাবে এটা জানা যাবে যে, কোন দলের জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন কতটুকু। তাই সরাসরি জাতীয় রাজনীতি ও ক্ষমতার পালাবদলে ভূমিকা না-রাখলেও এই নির্বাচন বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনীতিতে একটি পরোক্ষ প্রভাব রাখবে।
নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনে কতটুকু সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে এবং সকলকে সমান সুযোগ, নিরাপত্তা ও সুবিধা কতটুকু ন্যায়ানুগ ও সুষ্ঠুভাবে দিতে পারে, সেটাও বোঝা যাবে। নির্বাচন কমিশন যদিও দলীয় সরকারের অধীনে থেকেও নিরপেক্ষ আচরণ ও কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, তাহলে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস বাড়বে এবং ভবিষ্যতে অন্যান্য নির্বাচন সম্পন্ন করার ব্যাপারে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে।
ইতিমধ্যে বিরোধী দলের পক্ষে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সকলের জন্য সমান সুবিধার দাবি করা হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মী-প্রার্থীদের হয়রানি করার অভিযোগ আসছে। প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধাও সমভাবে বণ্টিত হচ্ছে না বলেও বলা হচ্ছে। এসব ব্যাপারে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়ে অভিযোগের সুরাহা করা আবশ্যক।
অনেকে মনে করছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর থেকে যে অচলাবস্থা ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে চলছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য বর্তমান পৌর নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই নির্বাচনকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি কাটিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। নির্বাচনের মাধ্যমে দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার দ্বার উন্মোচিত হতে পারবে এবং অসহিষ্ণুতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মাত্রা হ্রাস পেতে পারবে। তবে সব কিছুই হতে পারবে, সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা যদি থাকে, তাহলেই।
বাংলাদেশ আসলেই গণতন্ত্রমুখী একটি দেশ এবং বাংলাদেশী জনগণ পুরোপুরিভাবেই গণতান্ত্রিক মন-মানসিকতার অধিকারী। নির্বাচন বা ভোট এখানে উৎসব মুখর একটি বিষয়। মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক অধিকার ও পছন্দের ভিত্তিতে ভোট ব্যবস্থাকে সকলের জন্য  অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ করা তাই অপরিহার্য। জনগণকে আস্থায় ও বিশ্বাসের মধ্যে নিতে হলে অবশ্যই তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নচেৎ জনক্ষোভ ও বিরূপতা সঞ্চারিত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থেকেই যাবে। জনগণকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশীদার করতে হলেও তাদেরকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাত্রা বাড়াতে হবে। পৌরসভার নির্বাচনের প্রাক্কালে এসব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে সেগুলো ইতিবাচক ও আইনানুগভাবে ব্যবহার করাই সমীচিত হবে।
অতীতে নির্বাচনী ব্যবস্থার শরীরে যে নানা কালো দাগ ও কালিমা লেপ্টে গেছে, সেগুলোকে পরিশুদ্ধ করারও একটি প্রচেষ্টা নেয়ার সুযোগ এসেছে এ নির্বাচনে। ভোট ডাকাতি, সন্ত্রাস, কালো টাকা, ব্যালট পেপারবক্স ছিনতাই ইত্যাদি অতীতের কলঙ্ক বিমোচনের সুযোগও আনবে এ নির্বাচন। ক্ষমতা ও শক্তির বলে জনগণের মতামত ও ভোটাধিকারকে অগ্রাহ্য করে তথাকথিতভাবে নির্বাচিত হওয়ার অপচেষ্টাও এ নির্বাচনের মাধ্যমে বানচাল করতে হবে। তাহলেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দৃঢ় হবে এবং প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাবে।
প্রসঙ্গত বলা ভালো, দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি এ নির্বাচনকে অত্যন্ত সিরিয়াসভাবে নিয়েছে। বিভিন্ন ক্রটি-বিচ্যুতির পরেও বিএনপি সরবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বেগম জিয়া দলের নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে অনেকগুলো বৈঠক করেছেন এবং নানা পর্যায়ে নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ করেছেন। এতে প্রমাণ হয় যে, বিএনপি নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ স্বরূপই গ্রহণ করেছে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য শক্তভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এতে বিএনপি, সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থারই লাভ। আন্দোলনের উত্তপ্ত মাঠ থেকে দলটি যদি নির্বাচনী ক্ষেত্রে মনোযোগ দেয়, তবে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নানা অনিয়ম ও শক্তি প্রদর্শনের কারণে দলটি যদি আইনানুগ অংশগ্রহণের সুযোগ না পায়, তাহলের আন্দোলনের মাঠে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না বিএনপি ও অন্যান্য দলগুলোর সামনে। এতে পরিস্থিতি আবারো আগের মতো অসহনীয় পর্যায়ে চলে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
বাংলাদেশে সুশাসন, উন্নয়ন, অগ্রগতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অতি জরুরি বিষয়। এই স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে দেশে কার্যকর বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সমঝোতা ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে। হানাহানি ও আক্রমণের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা অর্জিত হয় না। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হামলা-মামলা-জেল-জুলুম-ফাঁসি দিয়ে শান্তি স্থাপন আকাশ কুসুম কল্পনার বিষয়। হিংসার রাজনীতি দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসও অবাস্তব প্রচেষ্টা মাত্র। অতএব যত দ্রত সুচিন্তা ও সুবিবেচনার উদ্ভব হবে, ততই সংকটের সমাধান ত্বরান্বিত হবে।
বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদীভাবে রাজনৈতিক সংকট ও অচলাবস্থার ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হতে পারে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ থাকতে পারে না। স্থিতিশীলতাও প্রতিনিয়ত বিপণœ হতে পারে না। কোনো একদলীয় বা স্বৈরতান্ত্রিক প্রচ্ছায়াও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সুশাসনই কাম্য। দেশ ও বিদেশে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মুখচ্ছবিই প্রত্যাশিত। নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতি এক্ষেত্রে সংকট উত্তরণের বিরাট বড় সহায়। অতীতে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধসের কারণেই বহু সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে যেন তেমন সংকট আর সৃষ্টি না হয়, সেজন্য সকলের সতর্কতা অতি প্রয়োজন। ব্যক্তি, দল ও প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে সকলের সৎ, আইনানুগ ও আন্তরিক উদ্যোগে সুষ্ঠু ও গতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথচলা মসৃণ হবে বলেই সকলে আশা করেন। সকলেই প্রত্যাশা করেন, গণতান্ত্রিক সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে উত্তপ্ত পরিস্থিতি ও সংঘাতে অবসান ঘটবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন মত ও পথের মানুষ নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা নিয়েই সমন্বয় ও সমঝোতার ভিত্তিতে এক সাথে সুশাসনের মাধ্যমে উন্নয়নের পথে চলবে। বাংলাদেশকে নিয়ে একটি আশাবাদী ও সুদূরপ্রসারী, শান্তি ও সমৃদ্ধকামী রূপরেখার উদ্ভাসনই রাজনীতিক নেতৃত্বের কাছে মানুষ প্রত্যাশা করে। যে প্রত্যাশায় ব্যক্তি ও দলের ক্ষুদ্র স্বার্থের বদলে দলের জাতির সামগ্রিক স্বার্থের প্রাধান্যই স্পষ্ট হবে।
বাংলাদেশের মানুষের এই ইতিবাচক ও জাতিস্বার্থমুখী স্বপ্নের প্রাসঙ্গিকতাও সকলের জানা। চলতি ডিসেম্বর মাসে তা আরো স্পষ্ট। জাতির বিজয়ের মাসে গণতন্ত্রের বিজয়ের প্রত্যাশাও প্রাসঙ্গিক। আসন্ন পৌরসভার নির্বাচনে গণতন্ত্রেরই বিজয় হবে, সে প্রত্যাশা তাই সকলের।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads