বৃহস্পতিবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০১৫

পুলিশের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ প্রসঙ্গে


সন্ত্রাস-নাশকতা ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড দমন করার জন্য যখন যেখানে যা করা দরকার তা-ই করার জন্য পুলিশের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গত বুধবার পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, যারা  পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মানুষকে পোড়াবে বা আঘাত করবে তাদের বিরুদ্ধে যত কঠিন ব্যবস্থা নেয়া দরকার সেটাই আপনারা নেবেন। কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলবে না। প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিতে হবে। যা কিছুই হোক তার দায়িত্ব  নিজে নেবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, সরকার প্রধান হিসেবেই তিনি এ নির্দেশ দিচ্ছেন। চলমান অবরোধ, হরতাল এবং নাশকতার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আরো কিছু কথা বললেও পুলিশের উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ নিয়েই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশি আলোচনা চলছে। সচেতন সকল মহলেও ঘটেছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। পুলিশের সাবেক আইজি ও সাবেক সচিবসহ বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, সংবিধান এবং প্রচলিত আইন-কানুন অনুযায়ী জনগণের জানমালের হেফাজত করাই আইন-শৃংখলা বাহিনী হিসেবে পুলিশের প্রধান দায়িত্ব। কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে তাও পুলিশের আইনে লিখিত রয়েছে। প্রশিক্ষণকালে এসব বিষয়ে শেখানো হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রী সে দায়িত্ব পালনের জন্য তৎপর থাকতে পুলিশকে তাগিদ বা নির্দেশ দিতে পারেন। পুলিশেরও উচিত তার আইনানুগ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হওয়া। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী যে ভাষায় ও সুরে নির্দেশ দিয়েছেন তার ফলে আইনের বরখেলাপ হতে পারে, অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্যরা এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে এবং আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নেয়ার চেষ্টা চালাতে পারেন। এটা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ বিশিষ্টজনদের এমন উদ্বেগ ও আশংকার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই বিশেষ করে বর্তমান সময়ে। কারণ, বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে সারা দেশে যখন অবরোধ চলছে তখন দাবি মেনে নেয়ার এবং সমঝোতার পথে পা বাড়ানোর পরিবর্তে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সরকার নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতন, নির্বিচার গ্রেফতার এবং কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের ভয়ংকর অভিযানে নেমেছে বলে অহরহ অভিযোগ উঠছে। র‌্যাব ও বিজিবি অংশ নিলেও এসব কাজে প্রধানত পুলিশকেই ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এমনকি গ্রেফতার বাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে। পুলিশকে মোটেও বিশ্বাস করতে পারছে না সাধারণ মানুষ। পুলিশ কখন কাকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যাবে, কখন কোথায় কোন দলের নেতা-কর্মীর লাশ পাওয়া যাবে- এ ধরনের আতংকের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে দেশবাসীকে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অত্যন্ত ভীতিকর হয়ে পড়েছে বলেই পুলিশের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ নির্দেশ নতুন করে প্রচণ্ড ভীতি ও আতংকের সৃষ্টি করেছে। তিনি শুধু ব্যবস্থা নিতে বলেননি, যখন যেখানে যা করা দরকার তা-ই করার, যত কঠিনই হোক সে ব্যবস্থা তো বটেই, প্রয়োজনে ‘সর্বোচ্চ ব্যবস্থা’ নেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। আমরা মনে করি না যে, প্রধানমন্ত্রীর কথার অর্থ বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝিয়ে বলার কোনো প্রয়োজন থাকতে পারে। বাস্তবে নির্দেশের আড়ালে তিনি যখন যেখানে যা খুশি তা-ই করার অনুমতি দিয়েছেন পুলিশ বাহিনীকে। সহজ কথায় বলা যায়, পুলিশকে ‘ওপেন লাইসেন্স’ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পুলিশ এমনকি হত্যা করারও অঘোষিত অনুমতি পেয়ে গেছে। উদ্বেগের কারণ হলো, সাম্প্রতিক সময়ে এমনিতেই প্রচণ্ড দমন-নির্যাতনের পাশাপাশি কথিত বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে একের পর এক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হত্যার মহোৎসব শুরু হয়েছে, তার ওপর ‘সর্বোচ্চ ব্যবস্থা’ নেয়ার মতো কর্মকাণ্ডের জন্য ওপেন লাইসেন্স তথা অনুমতি দেয়া হলে এবং যে কোনো কাজের দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নিজে বহন করতে সম্মত হলে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতিই ঘটতে থাকবে। আর প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এবং দল দুটির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাই যে প্রধান শিকারে পরিণত হবেন তার প্রমাণ তো এরই মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের প্রায় নিশ্চিত সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে অত্যন্ত বিপদজনক এবং সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী বলে মনে করি। আমাদের মতে সত্যিই নাশকতার অবসান ঘটাতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর উচিত বিরোধী দলের সাথে আলোচনা ও সমঝোতায় পৌঁছানোর উদ্যোগ নেয়া। কারণ, দাবি পূরণ হয়নি বলেই অবরোধের ডাক দেয়া হয়েছে আর অবরোধের সুযোগ নিয়েই ঘাতক-সন্ত্রাসীরা নাশকতা চালাচ্ছে- যারা অন্তত বিএনপি বা জামায়াতের কেউ নাও হতে পারে। আমরা তাই পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটার আগেই সমঝোতার উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানাই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads