মঙ্গলবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৫

জনগণকে এত ভয়!


গত ৩ জানুয়ারি থেকে সাধারণ মানুষ ও সুশীল সমাজের মধ্যে দারুণ কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল যে, সরকার বোধ করি এ যুদ্ধ বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছে। কিন্তু তারপর ক্রমেই স্পষ্ট হলো, এ যুদ্ধ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নয়, বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষের বিরুদ্ধে। এর কোনো উপসর্গ ছিল না। গত বছর ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে একটি নির্বাচনী প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে নির্বাচন হয়েছিল একেবারেই বানোয়াট ও পাতানো। এক পদলেহী নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে হাসিনা সরকারের অধীনে অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্টভাবে সে নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও তার উচ্ছিষ্টলোভী ইনু-মেননসহ কয়েকটি নাম-গোত্রহীন তথাকথিত রাজনৈতিক দল সে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিল। আর আশ্চর্য ঘটনা এই যে, এরা সবাই ছিল আওয়ামী লীগের ১৪ দলের অন্তর্ভুক্ত।
এই ১৪ দলের মধ্যে আঞ্চলিক দল হিসেবে এরশাদের জাতীয় পার্টির সামান্য নাম-পরিচয় ছিল। দীর্ঘকাল ধরে এরশাদ ও আওয়ামী লীগ একই বৃন্তে দুটি ফুল। ১৯৮২ সালে লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন বিচারপতি সাত্তারের বিএনপি সরকারকে হটিয়ে সামরিক শাসন জারি করেন, তখন ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম নট আনহ্যাপী।’ অর্থাৎ এরশাদ গণতন্ত্রের যে কবর রচনা করলেন, তিনি তাতে সায় দিলেন। শেখ হাসিনার ইতিহাস হলো, যতবার এদেশে সামরিক শাসন জারি হয়েছে, ততবারই তিনি তার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়েছেন। গণতন্ত্র বিষয়টা, মনে হয়েছে, তার কাছে বড় অসহনীয় ব্যাপার।
তার গণতন্ত্রের প্রতি এই অসহিষ্ণুতার ফলস্বরূপ তিনি ২০০৭ সালে ইন্দো-মার্কিন ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশে ডেকে আনলেন এক সামরিক সরকার। আর একটি রাজনৈতিক দল হয়েও তিনি ঘোষণা করলেন যে, এই গণতন্ত্রঘাতী সামরিক সরকার যেসব পদক্ষেপ নেবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে তার সবকিছুকে বৈধতা দেবেন। কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল কী করে এমন ঘোষণা দিতে পারে যে, গণতন্ত্র ঘাতকদের সকল নিবর্তনমূলক আচরণকে তারা বৈধতা দেবে? এই আঁতাত যখন ঘটে, তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবদুল জলিল, আওয়ামী লীগের পাঁচ দশকের পরীক্ষিত নেতা। শেখ হাসিনার আঁচল বিছিয়ে ডেকে আনা সামরিক সরকারের সঙ্গে ইন্দো-মার্কিন সহযোগিতায় বা ষড়যন্ত্রে এই সমঝোতা হলো যে, তারা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করবে।
এর মধ্যে ঐ সামরিক সরকার প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের ও নির্বাচন কমিশনারদের চায়ের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। সে দাওয়াতের মর্মার্থ ছিল, হয় মইন-ফখরের জগাখিঁচুড়ির সরকারের প্রতিটি আদেশ মেনে নিন অথবা অপমানজনক বিদায়ের জন্য প্রস্তুত হন। আমাদের ট্র্যাজেডি হলো সম্মানিত বিচারকরা, যা দেখেছি, সম্ভবত চায়ের দাওয়াতের সেসব শর্ত মেনে নিয়েছিলেন।
কিন্তু আমরা ভিন্ন চিত্র দেখেছিলাম নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে। তাদেরও চায়ের দাওয়াত দেয়া হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, তাতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি এমএ আজিজ। আওয়ামী লীগ বলল, এমএ আজিজসহ কোনো নির্বাচন কমিশনারকেই তারা মানেন না। নির্বাচন কমিশনের সব সদস্যকেই পদত্যাগ করতে হবে। আওয়ামী লীগের এ দাবির সঙ্গে জোরোশোরে যোগ দিল ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো গ্রুপ। একজন সাংবাদিক হিসেবে এখনও এই লজ্জায় অধোবদন হই। প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার হঠাৎ করেই নিজেদের সুশীল সমাজের নেতা বলে দাবি করে বসল এবং নানাভাবে তারা ছড়ি ঘোরাতে শুরু করল। সেটা মইন-ফখরের সামরিক সরকারের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো।
এই নগ্ন সামরিক শাসন সমর্থনের ঘটনা বাংলাদেশে ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর ‘বাংলার বাণী’ ছাড়া আর কারো মাধ্যমে কখনও ঘটেনি। বাংলার বাণীর সম্পাদকের যোগ্যতা আর প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার সম্পাদকের যোগ্যতার মধ্যে দুস্তর ফারাক। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য হলো এই যে, তারা একই কাতারে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দাঁড়াতেই পারেন। কিন্তু মনে হলো, যাদের সুশিক্ষিত ভেবেছিলাম, প্রকৃত বিচারে তারা নিকৃষ্টতম মতলববাজ। কার্যত এরাই এদেশের গণতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সামরিক শাসন জারির প্রতিভূ হিসেবে কাজ করলেন।
এই দুটি পত্রিকা বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে কা-জ্ঞানহীন, যুক্তিহীন এমন সব দুর্নীতির গপ্পো তাদের পত্রিকায় ছাপাতে শুরু করলেন যে, জনগণ যেন কিছুতেই আর কোনো বিএনপি প্রার্থীকে ভোট না দেয়। একটি সামান্য উদাহরণ দেই। প্রথম আলো পত্রিকা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল সাইফুর রহমান সম্পর্কে। তাতে বলা হয়েছিল, সাইফুর রহমান বন বিভাগের গাছ নিজের বাগান বাড়িতে লাগিয়ে বি-রা-ট দুর্নীতি করেছেন। বৃক্ষরোপণ মওসুমে বন বিভাগ রোপণের জন্য কোটি কোটি চারাগাছ বিনামূল্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করে। এসব চারা গাছ তারাই নেয়, যারা প্রকৃতই বৃক্ষরোপণ করতে চায়। এসব চারাগাছ চিবিয়েও খাওয়া যায় না। অন্যদের কাছে বিক্রিও করা যায় না। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা হয়, উৎসাহী লোকরা চারাগাছ নিয়ে যান, রাস্তার পাশে রোপণ করেন। প্রথম কয়েকদিন পানি, টানি দেন। তার পর আর খবরও রাখেন না। ফলে এর অধিকাংশই মরে যায়। সাইফুর রহমান যদি তার বাগান বাড়িতে দু-চার হাজার চারাগাছ লাগিয়ে থাকেন, তবে সেগুলোর পরিণতি নিশ্চয় হালটের পাশের চারাগাছগুলোর মতো মৃত্যুমুখী হয়নি। তার লোক ছিল। যারা এদের পরিচর্যা করেছে। অর্থাৎ উনি যেসব চারাগাছ নিয়েছিলেন, তা অধিকাংশই সযত্নে বেড়ে উঠেছে। বন বিভাগের বৃক্ষরোপণ অভিযান ততে সফল হয়েছে। সেটাকে দুর্নীতি বলে চালানোতে চেয়েছে ঐ পত্রিকা।
ডেইলি স্টার সম্পাদক সামরিক সরকারের উপদেষ্টা তৎকালে মইনুল হোসেনকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরাই আপনাদের ক্ষমতায় এনেছি।’ অর্থাৎ আমরাই বিদেশীদের সঙ্গে লবি করেছি। সামরিক শাসনের আদ্যোপান্ত আলোচনা করেছি। বিএনপির সুবিধাভোগী ফখরুদ্দিন নামক এক লোককে নিয়োজিত করেছি। ফখরুদ্দিনকে ক্ষমতা দখলে অনুপ্রাণিত করেছি এবং ক্ষমতা দখল করিয়েছি। অতএব মিস্টার মইনুল, তত্ত্বাবধায়ক উপদেষ্টা, আপনি আমাদের বিরুদ্ধে বলার কে?
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একটা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ততক্ষণে চায়ের দাওয়াতে বিচারপতিরা নিষ্ক্রিয়। নির্বাচন কমিশন ছত্রখান। কতগুলো সরকারের তল্পিবাহক দিয়ে গঠিত হলো নির্বাচন কমিশন। তার প্রধান হলেন এটিএম শামসুল হুদা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ রকম ব্যক্তিত্বহীন লোক আর কোনোদিন নির্বাচন কমিশনের প্রধান হননি। এবার যারা নির্বাচন কমিশনে আসীন, তারা আরও নিকৃষ্ট।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করেছিল। যদিও ফলাফল ছিল পূর্বনির্ধারিত। সেরকম একটি আঁতাতের নির্বাচনের পরবর্তী পাঁচ বছর আওয়ামী লীগ তার দোসরদের নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। লক্ষ্য ছিল কীভাবে দেশ থেকে বিএনপি তথা বিরোধী দলকে সম্পূর্ণ নির্মূল করে ফেলা যায়। হামলা-মামলা, খুন-গুম এসব পথ অনুসরণ করে তারা বিরোধী দলকে বেশ নাস্তানাবুদ করেই ছাড়ে। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, এই সরকার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। বিরোধী দল যাতে নির্বাচনে না আসে, তেমন একটা পরিবেশ সরকার সৃষ্টি করে। আর তার ভেতর দিয়েই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়।
বিরোধী দলের দাবি ছিল- এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। নির্বাচন কমিশনে পরিবর্তন আনতে হবে। সেদিকে মোটেও কর্ণপাত করেনি সরকার। ফলে আওয়ামী লীগ ও তাদের কিছু নামসর্বস্ব সহযোগীদের নিয়ে কার্যত একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গোটা পৃথিবী আগে থেকেই ঘোষণা করেছিল, এভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচন কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে তারা এই নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষকও পাঠায়নি। সরকারের তরফ থেকে তখন বলা হয়েছিল, এটি হলো নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। আশা করা গিয়েছিল, নিয়ম রক্ষার পর সরকার সব দলের অংশগ্রহণমূলক আর একটি নির্বাচন দেবে। কিন্তু এখন সরকার বলছে, নির্বাচন হয়েছে। বিরোধী দল অংশ নেয়নি। সে দায়িত্ব তাদের নয়। তারা ট্রেন মিস করেছে। ২০১৯ সালের আগে আর কোনো নির্বাচন নয়।
সেরকম একটা একদলীয় একতরফা নির্বাচনের প্রথম বার্ষিকী ছিল ৫ জানুয়ারি ২০১৫। আওয়ামী লীগ দিনটাকে গণতন্ত্রের বিজয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিল এবং ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছিল। অপরদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট দিনটিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে অভিহিত করে নয়াপল্টনে তাদের কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ আহ্বান করেছিল। আওয়ামী লীগ জানত তাদের জনসমর্থন একেবারে তলানিতে পৌঁছে গেছে। ফলে ঐ জনসমাবেশে তেমন কোনো লোক সমাগম সম্ভব হবে না। আর তাই কায়দা করে পুলিশকে দিয়ে ঢাকায় সভা-সমাবেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করায়। আর ৪ তারিখ থেকেই সরকার ঢাকামুখী সবরকম যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। তাদের আশঙ্কা ছিল যদি মানুষ ঢাকা আসতে পারে তাহলে বিএনপির সমাবেশেই লাখ লাখ লোক হবে এবং তারা যদি রুখে দাঁড়ায় তাহলে সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠবে।
শুধু ঢাকামুখী সব যানবাহন চলাচলই তারা বন্ধ করে দেয়নি, ৩ তারিখ রাত থেকেই বেগম খালেদা জিয়াকে তার অফিসে অবরুদ্ধ করে ফেলে। তার বাড়ির রাস্তায় ইট-বালুর ট্রাক দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। শুধু তাই নয়, যে ভবনে তিনি অবরুদ্ধ, তার গেটে গেটে তালা লাগিয়ে দেয় পুলিশ। ৫ জানুয়ারি যখন তিনি তার কার্যালয় থেকে বেরিয়ে নয়াপল্টনের কার্যালয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তখনও তালাবদ্ধ ছিল তার বেরোবার পথের সব দরজা। তিনি অফিস প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়েই যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন পুলিশ তার ওপর নিক্ষেপ করে আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত বিষাক্ত পিপার স্প্রে, যা কোথাও কোথাও ব্যবহৃত হয় পাগলা কুকুর বা হিংস্র বন্যজন্তু নিধনে।
এ অবস্থায় সাংবাদিকরা বেগম খালেদা জিয়ার কাছে জানতে চান- এখন তার কর্মসূচি কী হবে? খালেদা জিয়া উত্তরে বলেন, সরকার যে অবরোধ দিয়েছে, দাবি না মানা পর্যন্ত সারা দেশে সে অবরোধ চলতে থাকবে। গত ১০ দিন ধরে বেগম খালেদা জিয়া তার নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ আছেন। আর আট দিন ধরে সারা দেশে অবরোধ চলছে। আর সারা দেশে বাস, ট্রাক, ট্রেন সব কিছু বন্ধ করে দিয়েছে সাধারণ মানুষ। সরকার জনআতঙ্কে প্রতিদিন না ধরনের হম্বিতম্বি করেই চলেছে। কিন্তু জনগণ সেসব হম্বিতম্বির কোনো মূল্যই দিচ্ছে না। ভয়কে তারা জয় করেছে। এই স্বৈরসরকারের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জনই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ধারণা করি সে বিজয় খুব দূরে নয়।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads