সোমবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৫

কোকোর মর্মান্তিক মৃত্যু, বোমা রাজনীতি ও আন্দোলনের যৌক্তিকতা


গত শনিবার শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মালয়েশিয়ায় ইন্তিকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বিদেশের মাটিতে তার ইন্তিকালের বিষয়টি অত্যন্ত মর্মান্তিক। ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে রাজনীতিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার ও রিমান্ড নির্যাতনের যে অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল বেগম জিয়া, তার দুই ছেলেসহ অন্য আত্মীয়বর্গও এর শিকার হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে জয় এবং অন্য স্বজনরাও এসব মামলার আসামী হয়েছিলেন। বেগম জিয়ার পরিবারের ক্ষেত্রে নৃশংসতা ও নির্মমতা সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল, তার দুই ছেলেকে এত নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল যে, তাদের বাঁচার সম্ভাবনাই ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল। চিকিৎসকের সুপারিশ অনুযায়ী প্যারোলে জামিন নিয়ে তাদের বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে হয়। যাত্রার সময় তৎকালীন সরকারের নির্দেশে তারা মাসহ অন্য আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ঠিকমতো কথাবার্তা বলার সুযোগও পাননি। দুই ভাই এর এক ভাই যান লন্ডনে, অন্য ভাই ব্যাংককে। প্রায় ৫ বছর চিকিৎসা শেষে তারেক কিছুটা সুস্থ হয়ে চলাফেরা ও সীমিত আকারে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করতে সক্ষম হলেও কোকো অসুস্থই ছিলেন। তিনি ব্যাংকক থেকে বছরখানেক আগে মালয়েশিয়ায় এসে ন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অব্যাহতভাবে হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নেয়া ব্যয় সাপেক্ষ বিধায় হাসপাতাল বাসা এই করেই চিকিৎসা চলছিল এবং শুক্রবার অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কেয়ারটেকার আমলে আওয়ামী লীগ প্রধানের বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা ছিল এবং এর মধ্যে ৪টি মামলার বিচার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। তৎকালীন সরকার তাকে জাতীয় অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য এক সময়ে বিপজ্জনক বলে আখ্যায়িতও করেছিলেন। তার দলের বহু নেতা আদালতে দন্ডিত হয়েছিলেন এবং এই দন্ড সর্বনিম্ন তিন বছর থেকে ৩১ বছর পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। এই নেতারাই শুধু দন্ডিত হননি, তাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, জামাতারাও দন্ডিত হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার দলের নেতৃবৃন্দ এবং তাদের আত্মীয়-স্বজন যারা দন্ডিত হয়েছিলেন অথবা মামলায় আসামী হয়ে পলাতক কিংবা জেলে ছিলেন তাদের সকলের মামলা তুলে নেন, দন্ড মওকুফ করান এবং স্বাভাবিক জীবনে ফেরৎ আনান। কিন্তু এই সরকার বেগম জিয়া, তার পুত্রসহ আত্মীয়-স্বজন এবং বিএনপি নেতৃবৃন্দের বেলায় ভিন্ন নীতি অবলম্বন করেন। তারা তাদের মামলাসমূহ শুধু অব্যাহতই রাখেননি বরং তাদের নামে নতুন নতুন মামলাও রুজু করেন এবং বিএনপি-জামায়াতসহ প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর ওপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি করে দেন। এখানে এক যাত্রায় দুই ফল দেখা গেল এবং আওয়ামী লীগই সেটা করল। বেগম জিয়া ও তার দুই পুত্র এই প্রতিহিংসারই বলি।
আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু সংবাদ বেগম জিয়ার জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তিনি দুঃখিনী একজন মা, স্বামী ও আত্মীয়-স্বজনহারা একজন হতভাগিনী বললেও অত্যুক্তি হবে না। তিনি তার ভাই এবং বোনদের হারিয়েছেন। তার মাকে তিনি হারিয়ে ছিলেন মইন সরকারের হাতে গ্রেফতার অবস্থায় থাকাকালে। প্যারোলে তিনি এবং তার দুই সন্তান মায়ের লাশ দেখতে গিয়েছিলেন। তাদের এমনভাবে নেয়া হয়েছিল যে, এই বিপদের দিনে মা ছেলের চেহারা দেখতে পাননি আর ছেলেরা মায়ের চেহারা দেখতে পাননি। এই নির্মমতা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়।
কোকের মৃত্যু শোকে মুহ্যমান বেগম জিয়াকে গতকাল আরেকটি খবর শুনতে হলো, এই খবরটি হচ্ছে যাত্রাবাড়ীর কাঠের পুল নামক স্থানে বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের অপরাধে বেগম জিয়াকে হুকুমের আসামী করে পুলিশের মামলা। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং কয়েক দিন আগেই এ ধরনের মামলার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এর আগে বেগম জিয়া অবরোধকালে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের ব্যাপারে দায়িত্ব অস্বীকার করে জাতির কাছে তিনটি প্রশ্ন রেখেছিলেন। তার প্রশ্ন ছিল (১) বোমা মেরে মানুষ হত্যা করে লাভ কার? (২) ধ্বংসাত্মক কাজের দোষ চাপানোর জন্য যে মিডিয়া ব্যবহৃত হবে তার উপর নিয়ন্ত্রণ কার? (৩) মানুষ খুনের ঐতিহ্য কার? এই তিনটি প্রশ্নই জাতির জন্য সংবেদনশীল এবং বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী এসব প্রশ্নের জবাবে সর্বাগ্রে আওয়ামী লীগের নামই উঠে আসে। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত যতগুলো আন্দোলন হয়েছে, সবগুলোতেই আওয়ামী লীগের সক্রিয় ও ধ্বংসাত্মক অংশগ্রহণ ছিল। পেট্রোল বোমা তৈরিকালে সম্প্রতি ছাত্রদল নেতা বলে কথিত বাপ্পী নামক যে ব্যক্তি নিহত হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে সে ছিল আওযামী লীগ নেতা হাজী সেলিমের ডানহাত, আওয়ামী লীগ কর্মী, দৈনিক বিডি নিউজের এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, বাপ্পী বোমা বানানোর জন্য হাজী সেলিমের কাছ থেকে দু’লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা নিক্ষেপরত অবস্থায় এবং ভাঙচুর ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগকালে গত তিন সপ্তাহে হাতেনাতে বহু আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগকর্মী ধরা পড়েছে। মারণাস্ত্র নিয়ে তারা শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল নয়, অভ্যন্তরীণ কোন্দালে নিজেরা নিজেদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এতে প্রতিনিয়ত হতাহতের ঘটনা ঘটছে। ২০০৬ সালের নবেম্বর মাসে লগি-বৈঠা নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করার নির্দেশ কে দিয়েছিলেন? শেরাটন হোটেলের সামনে বাসে গান পাউডার ঢেলে ১৮ জন যাত্রীকে কারা, কার নির্দেশে হত্যা করেছিল তার স্বীকারোক্তি এখনও পত্রপত্রিকাসহ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার আরকাইভে পাওয়া যায়। বেগম জিয়া অথবা বিরোধী দলের অন্য কোনো নেতা কর্তৃক এ ধরনের নির্দেশ দেয়ারও কোনো নজির নেই। হুকুমের আসামী যদি কাউকে করতে হয় তাহলে অতীতে বাংলাদেশে সংঘটিত সকল ধ্বংসাত্মক কাজ (সচিবসহ কর্মচারীদের ন্যাংটা করার ঘটনাসহ) দায়িত্ব চিহ্নিত করে সবাইকে করা উচিত বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
এখানে একটা বিষয় বলে রাখা দরকার, যাত্রাবাড়ীর কাঠের পুলে বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে মানুষ পোড়ানোর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটানো হয়েছে তার নিন্দা করার ভাষা আমাদের জানা নেই। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সকলের প্রতি আমরা সহানুভূতি জানাই। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন আছে, এই স্থানটি কোথায়? অনুসন্ধানী এক রিপোর্ট অনুযায়ী এই স্থানটি আওয়ামী লীগের এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লার বাড়ির অতি সন্নিকটে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সর্বদা সশস্ত্র ক্যাডারবেষ্টিত এই এমপি সাবের বাড়ির নিকটে কে কোন সাহসে এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে? বিএনপি নেতা অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া রিমান্ডে আছেন, তিনি কি সেখানে বোমা নিক্ষেপ করতে গেছেন? না বিএনপি নেত্রী? বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার বলে আমি মনে করি। বোমা নিয়ে রাজনীতির ভবিষ্যৎ শুভ হয় না।
আমি শোকাহত বেগম জিয়াকে দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর গুলশান গমন এবং তা নিয়ে যে তর্কবিতর্ক চলছে, সে সম্পর্কে কিছু বলবো না। কিন্তু তার পরের দিন বেগম জিয়াকে হুকুমের আসামী বানানো সঠিক হয়েছে কিনা, যারা সংলাপের সহায়ক পরিবেশের কথা বলেন, তাদের কাছে এই ছোট্ট প্রশ্নটি রাখতে চাই।
বেগম খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, আরাম আয়েশ সব কিছু ত্যাগ করে স্বজনহারা অবস্থার মধ্যেও দেশের মানুষের ভোটের অধিকার, মৌলিক মানবিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় যে ভূমিকা পালন করছেন, তার জন্য জাতি তার কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে। আমরা দোয়া করি, আল্লাহ তাকে ধৈর্য, সহনশীলতা ও দুঃখ জয়ের শক্তি দান করুন।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের কিছু কিছু সদস্য এবং টক শোর অভিনেতা-অভিনেত্রী বর্তমান আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাদের উদ্দেশে কয়েকটি কথা বলা দরকার।
২০ দলীয় জোট বর্তমানে যে আন্দোলন করছে তা হচ্ছে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের দাবি আদায় এবং বর্তমান অবৈধ সরকারের বিদায়। ২০ দলীয় জোটের বিশ্বাস, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে যে নির্বাচন হয়েছে তা সংবিধানবিরোধী ছিল। এতে সংবিধানের ৬৫ ধারা লঙ্ঘিত হয়েছে। আবার বিদ্যমান পার্লামেন্ট না ভেঙে, আসন খালি না করে তারা নির্বাচনের প্রহসন করেছে। এই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারসহ অর্ধেকেরও বেশি ব্যক্তি বিনা ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। অবশিষ্ট কেন্দ্রগুলোর মধ্যে শতাধিক নির্বাচন কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। ১৪৬টি কেন্দ্রে সামগ্রিকভাবে গড়ে ভোটার উপস্থিতি ছিল ১০ শতাংশেরও কম। এর পরও ব্যালট পেপার যত্রতত্র পাওয়া গিয়েছিল এবং দলীয় ক্যাডাররা ব্যাপক হারে সিল মেরেছিল। আবার হাজার হাজার প্রিসাইডিং অফিসারের ভোটার টার্নআউট পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়েছিল এবং সরকারিভাবে ফলাফল ঘোষণায় তিন দিন সময় লাগানো হয়েছিল যা ছিল অস্বাভাবিক। এ ছাড়াও পূর্ববর্তী সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নতুন সংসদের ‘সদস্যদের’ শপথ পড়ানো হয়েছিল। গণতন্ত্রের ইতিহাসে দুনিয়ার কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল বলে জানা যায় না। এরশাদ ও জাতীয় পার্টিকে দিয়ে যে নাটক তখন মঞ্চস্থ করা হয়েছিল তা ছিল অত্যন্ত লজ্জাজনক। এর সব কিছুই তারা করেছেন ক্ষমতা ও অস্ত্রের জোরে এবং এখনও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন। দুর্নীতি তো আছেই। এই অবস্থায় বিরোধী দল বসে থাকতে পারে না।
ড. মোঃ নূরুল আমিন 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads