শনিবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০১৫

বেগম জিয়াকে গালাগালি করার ক্ষেত্রে আওয়ামী নেতৃবৃন্দের অশালীন প্রতিযোগিতা


বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা দুজনেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুই রাজনৈতিক নেত্রী। সুতরাং তাদের সম্পর্কে কথা বলতে গেলে প্রত্যেকের উচিত শিষ্টাচার রক্ষা করে কথা বলা। এই দুই নেত্রীর রাজনীতির আদর্শ এক নয়। সেটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। সে জন্যই তো তারা দুজনে দুই দলের নেত্রী। রাজনৈতিক আদর্শ যদি দুটি দলের এক হতো তাহলে তো তারা এক দলই করতেন। রাজনৈতিক আদর্শের মতভিন্নতা থাকলেও তারা দুজনেই দেশের শ্রেষ্ঠ দুই নেত্রী। বেগম জিয়া ৩ বার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। শেখ হাসিনাও এবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয় মেয়াদ পার করছেন। এসব কারণে তারা শ্রদ্ধা এবং সন্মানিত ব্যক্তি। বাংলাদেশের আরো অনেক নেতা আছেন, তারাও অনেক উঁচু মানের এবং তারা মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। এরা হলেন, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমান। এদের স্থান ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। এসব নেতার মধ্যেও রাজনৈতিক মত পার্থক্য ছিল। কিন্তু এসব কালজয়ী নেতা কেউই একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেননি অথবা এমন কোনো কথা বলেননি যেটি চরিত্র হননের শামিল হয়। অথচ অত্যন্ত গুরুতর মৌলিক এবং পররাষ্ট্র বিষয় নিয়ে সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর মধ্যে মতবিরোধ হয়। মতবিরোধ এমন চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছে যে, শেষ পরিণতিতে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয় এবং মওলানা ভাসানী একটি অংশ নিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠন করেন। শেখ মুজিব মারা যাওয়ার পর জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করেন। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগতভাবে শেখ মুজিবের প্রতি সবসময়ই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং অত্যন্ত সমীহ করে শেখ মুজিব সম্পর্কে কথা বলতেন। অথচ জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, গণতন্ত্র ইত্যাদি প্রতিটি ব্যাপারেই এই দুই নেতার চিন্তা ধারায় মৌলিক পার্থক্য ছিল।
দুঃখের বিষয়, নেতা-নেত্রীদের প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধ এখন রাজনীতি থেকে বলতে গেলে উঠেই যাচ্ছে। আরো দুঃখের বিষয় হলো এই যে, পলিটিশিয়ানদের ব্যক্তিগত আক্রমণ তথা তাদের চরিত্র হননের নিন্দনীয় কাজটি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। বেগম খালেদা জিয়া ৩২ বছর হলো রাজনীতি করছেন। এই ৩২ বছরে তিনি ৩২ বার তো দূরের কথা, ৩ বারও শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেননি। অথবা তার চরিত্র হননের কোনো প্রয়াস পাননি। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয় এই যে, শেখ হাসিনা অসংখ্য বার বেগম জিয়াকে ব্যক্তিগত এবং পরিবারিকভাবে আক্রমণ করেছেন। এমন অশ্রদ্ধার সাথে তিনি বেগম জিয়ার এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান সম্পর্কে উক্তি করেছেন যে, তার এসব অসংলগ্ন উক্তির কারণে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যেমন জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন তেমনি তার দলও জনপ্রিয়তা অনেক হারিয়েছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনপূর্ব রেডিও ও টেলিভিশন ভাষণে শেখ হাসিনা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ‘এক অখ্যাত মেজর’ হিসেবে তাচ্ছিল্য করেছিলেন। শুধুমাত্র এই কারণে তিনি অন্তত ৩ শতাংশ ভোট ১৯৯১ এর নির্বাচনে হারিয়েছেন বলে অভিজ্ঞ মহল ধারণা করেন।
বহুবার শেখ হাসিনা এ কাজটি করেছেন। সর্বশেষ করেছেন গত ১২ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জনসভায়। ঐ জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভা নেত্রী শেখ হাসিনা। তার ভাষণটি বিস্তারিতভাবে ছাপা হয়েছে দৈনিক ‘জনকণ্ঠে’, ১৩ জানুয়ারি।
খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানের সমালোচনা করে ঐ জনসভায় ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উনি অফিসে কী করেন? উনাকে তো অবরুদ্ধ করে রাখা হয়নি। উনি বাড়িতে চলে যাক। উনি নাকি সরকার উৎখাত না করে ঘরে ফিরবেন না। সন্ত্রাস ও জঙ্গি রানীর কথায় জনগণ আসবে না। শেখ হাসিনা খালেদাকে কটাক্ষ করে বলেন, ঘর থুইয়া অফিসে কেন? পুরনো অভ্যাস। ঘর ছেড়ে পালানো উনার পুরনো অভ্যাস। এ সময় খালেদা জিয়ার ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন উদাহরণ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, স্কুলে পড়া অবস্থায় উনি সিনেমায় অভিনয় করার জন্য বাড়ি ছাড়া হয়েছিলেন, কিন্তু ভারতের বিহারের কাতিহারা স্টেশন থেকে জনগণ তাকে উদ্ধার করে মা-বাবার কাছে ফেরত দেন। এরপর জিয়ার সঙ্গে দিনাজপুর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন ময়মনসিংহ।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়ার পরিবারসহ সকল অফিসারের পরিবারকে ফিরিয়ে নিতে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলারা ঢাকায় এসেছিলেন। খালেদা জিয়াকে আনতে গেলে উনি জানান, পরদিন যাবেন। কিন্তু পরদিনই উনি পালিয়ে গেলেন, পাকিস্তানী আর্মি অফিসার আসলাম বেগের আতিথেয়তা নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে চলে গেলেন। তখন আসলাম বেগ ছিলেন কর্নেল। পরবর্তীতে তিনি জেনারেল হন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান হন। যাওয়ার সময় জিয়াকে মেসেজ দিয়ে যান, যুদ্ধ করে কিছু হবে না। তুমি পাকিস্তানে চলে যাও, আমিও যাব। এখানেই শেষ নয়। দেশে কিছু অঘটন ঘটার আগেই উনি পালিয়ে যান, আত্মগোপনে থাকেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ও হঠাৎ করেই উনি তিন দিন লাপাত্তা হয়ে গেলেন। পরে এরশাদ সাহেব পূর্বাণী হোটেলের দরজা ভেঙে তাঁকে উদ্ধার করলেন। ’৮৬ সালেও সিপাহী-জনতার বিপ্লবের কথা বলে তিন দিন আত্মগোপনে ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বিডিআর বিদ্রোহের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের দুই ঘণ্টা আগে উনি (খালেদা জিয়া) ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপনে গিয়েছিলেন। বিদ্রোহ ঘটার দু’ঘণ্টা আগে উনি পালালেন কেন? আসলে উনি যখনই ষড়যন্ত্র করেন, তার আগে আত্মগোপনে চলে যান। এর ধারাবাহিকতায় এবার উনি খাট, সোফা, গদি নিয়ে উঠলেন গুলশান কার্যালয়ে। পত্রিকায় বেরিয়েছে কয়েকদফা উনি খাট পরিবর্তনও করেছেন। নিজে পালাবেন আর বলবেন অবরুদ্ধ।
দুই
ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে। সেটি হলো, Trend Setter. দেখা যায় যে দলনেত্রী ট্রেন্ড সেট করে দেন, আর তার অনুসারীরা শতকরা ১০০ ভাগ আনুগত্য সহকারে সেটি অনুসরণ করেন। বেগম খালেদা জিয়ার সমালোচনা সম্পর্কেও তার অনুসারীরা সেই একই মহাজনী পথ অনুসরণ করছেন। সাম্প্রতিক অবরোধকালে শেখ হাসিনার মন্ত্রী মিনিস্টাররা যার মুখে যা আসছে তাই বলছেন। গত ২৩ জানুয়ারি ‘আমাদের সময় ডটকমে’ এ সম্পর্কে একটি তথ্যবহুল সংবাদ ছাপা হয়েছে।
ওই সংবাদে বলা হয়েছে, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এ মন্তব্য করা থেকে বাদ পড়েননি খোদ প্রধানমন্ত্রীও। খালেদা জিয়াকে ‘ডাইনি বুড়ি’, ‘কুইন অব টেরর অ্যান্ড হরর’, ‘সন্ত্রাসের রানী’, ‘গোলাপি রে গোলাপি’, ‘জামায়াতের আমীর’, ‘বোমানেত্রী’, ‘পেট্রোল বোমানেত্রী’ ও ‘পাকিস্তানীদের দোসর’ বলে মন্তব্য করেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
গত বছরের ২৩ জানুয়ারি যশোরের অভয়নগরের শংকর পাশা মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত  সমাবেশে খালেদাকে ‘গোলাপী রানী’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘গোলাপি রে গোলাপি, ট্রেন তো মিস করলি।’ তিনি বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন বর্জন করে ট্রেন মিস করলেন। এখন যদি আমি বলি, ‘গোলাপি রে গোলাপি ট্রেন তো মিস করলি। গোলাপি এখন আর ট্রেনে নাই।’ ওই সভায় জামায়াতের সমলোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা ইসলামের নামে রাজনীতি করে। কিন্তু ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে না। বিএনপির নেত্রী তাদের সমর্থন দিচ্ছেন। বিএনপির নেত্রী জামায়াতের নেত্রী হয়ে গেছেন। খালেদা জিয়া এখন জামায়াতের আমীর হয়ে গেছেন।
রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু একাডেমির উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভায় খালেদা জিয়াকে সন্ত্রাসের রানী বলে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, খালেদা জিয়া জাতীয়তাবাদী নেত্রী থেকে ‘সন্ত্রাসের রানী’তে পরিণত হয়েছেন।
সুরঞ্জিত বলেন, বিএনপির দলীয় বৈশিষ্ট্য পাল্টে গেছে। খালেদা জিয়া এখন আর জাতীয়তাবাদী নেত্রী নন। তার সঙ্গে এখন আর তার নেতারা নেই। তিনি তার দলকে সন্ত্রাসী দলে পরিণত করেছেন। তিনি এখন মোল্লা ওমরের ভূমিকায়। তিনি এখন সন্ত্রাসের রানী, কুইন অব টেররিজম। ধানম-ির আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির যৌথ সমাবেশ শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, পাকিস্তানীদের দোসর বেগম খালেদা বাংলাদেশের জনগণ শান্তিতে থাকুক, তা চান না। তিনি দেশকে পাকিস্তান বানাতে চান। শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত মানববন্ধনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘কুইন অব টেরর অ্যান্ড হরর’ মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, রাজনীতি মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু খালেদা রাজনীতির নামে সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে সারাদেশে সাধারণ মানুষের ওপর পেট্রল বোমা নিক্ষেপ করে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছেন, যা সারাবিশ্বে নজিরবিহীন ঘটনা। খালেদা আজ বাংলার মানুষের কাছে ‘কুইন অব টেরর অ্যান্ড হরর’ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছেন। শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রোকেয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে শীতার্ত ও দুস্থ মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র ও কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠানে মানুষ হত্যা করে খালেদা জিয়া ‘ডাইনি বুড়িতে’ পরিণত হয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তিনি বলেন, মানুষ হত্যাকারী খালেদা জিয়া ‘ডাইনি বুড়িতে’ পরিণত হয়েছেন। তিনি অহেতুক হরতাল-অবরোধ ডেকেছেন। একদিকে তিনি মানুষ হত্যা করছেন, অন্যদিকে উল্লাস করছেন। এটি ‘ডাইনি বুড়ি’র কাজ বৈধ কিছুই নয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জঙ্গিরানী হিসেবে মন্তব্য করে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, দেশ ও দেশের মানুষ আজ জঙ্গিরানীর কাছে জিম্মি। এ থেকে পরিত্রাণ চায় দেশবাসী।
তিন
হাতে কোনোরকম প্রমাণ না রেখে শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে তার পারিষদ দল বলে চলেছেন যে, বেগম জিয়া নাকি ‘জঙ্গিরানী’ এবং জামায়াতের আমীর হয়ে গেছেন। বিএনপি এখন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ধারা ধৈর্য সহকারে অনুসরণ করছেন। অনেক মার খেয়েছে বিএনপি, কিন্তু কোনো সময় অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পাল্টা আঘাত করে দেশে কোনো বিশৃঙ্খলা করেনি। বাংলাদেশকে তিনি যদি পাকিস্তান বানাতে চেয়ে থাকেন তাহলে তিনি তিন তিন বার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তখন কি তিনি এ কাজটি করার উদ্যোগ নিতে পারতেন না? তার সাথে তার দলের লোক নেই- এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য কেবলমাত্র আওয়ামী লীগের উর্বর মস্তিষ্ক থেকেই বেরুতে পারে। চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ নামের একটি সিনেমা বানিয়েছেন। সেখানে গোলাপীর চরিত্র কি ছিল, সেটি মানুষ ভুলে যায়নি। এখন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বেগম জিয়াকে যখন গোলাপী বলেন তখন তাদের রুচি কোন পর্যায়ে গেছে সেটি বুঝতে অসুবিধা হয় না।
আসিফ আরসালান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads