বিশ্ব রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে এমন সব ঘটনা ঘটছে, যেগুলো দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি কোন দিকে গড়াচ্ছে। এটাও বোঝা যাচ্ছে না যে বিশ্বশক্তি এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো নতুন করে কোনো মেরুকরণ করছে কিনা। এ ব্যাপারে সঠিকভাবে কোনো কিছু বলা যাচ্ছে না এজন্য বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে যারা প্রধান অভিনেতা তারা পৃথিবীর একটি ট্রাবল স্পটে একটি বিশ্ব শক্তির সাথে মিলে ঝুলে কাজ করছে। আবার অন্য ট্রাবল স্পটে অন্য একটি বিশ্ব শক্তির সাথে মিলে ঝুলে কাজ করছে। সবচেয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে ভারতের ভূমিকা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে গিয়ে। পৃথিবীর এই এলাকায় অর্থাৎ এশিয়ার রঙ্গমঞ্চে ভারতকে আমেরিকার পার্টনার হিসেবে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যে তাকে বলতে গেলে কোনো ভূমিকাতেই দেখা যাচ্ছে না। জঙ্গিবাদ নিয়ে ভারত তার নিজ দেশের অভ্যন্তরে যতখানি কঠোর বিশ্বের অন্যত্র একই প্রশ্নে তাদের ভূমিকা সোচ্চার নয়। ভারতের ভূমিকা দেখে এক সময় মনে হয় সে আমেরিকার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আবার অন্য সময় মনে হয় যে রাশিয়ার সাথে (প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের উত্তরাধিকারী) তার সেই ৬ দশকের সম্পর্ক তারা অটুট রাখতে চায়। বিশ্লেষকরা বলেন, এশিয়া মহাদেশে নেতৃত্ব নিয়ে চীন ও ভারতের দ্বন্দ্ব রয়েছে। কিন্তু দৈনন্দিন কার্যকলাপে দেখা যাচ্ছে ভারতের সাথে কথা বলার সময় চীন যেমন শান্তির ললিত বাণী উচ্চারণ করছে তেমনি ভারতও যখন চীনের সাথে কথা বলছে তখন ভারতও শান্তির ললিত বাণী উচ্চারণ করছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ভারত বর্তমানে এমন একটি দেশ যে অপর তিনটি বৃহৎ শক্তি অর্থাৎ আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীনের সাথেও সম দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। তবে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে মনে হচ্ছে যে ভারত ঠিক সম দূরত্ব বজায় রাখতে পারছে না। ভারত যেটা করার চেষ্টা করছে সেটিকে ইংরেজীতে বলা যায় Tight Rope Walking, অর্থাৎ টান টান দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া।
॥দুই॥
তবে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলী দেখে মনে হচ্ছে যে সেখানে সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে একটি নতুন মেরুকরণ অথবা জোট বাঁধার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই উদীয়মান জোটটি সিরিয় সংকট সমাধানের একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সিরিয়া নিয়ে একাধিক বিশ্ব শক্তি তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে কাজ করে যাচ্ছে। কার পথটি সঠিক আর কার পথটি বেঠিক সেটি এখনো নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। কারণ সমগ্র সিরিয়া এখন একটি রক্তাক্ত রণাঙ্গন। তবে একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়।
সিরিয়ায় অবস্থিত আইএসের ঘাঁটিগুলোতে বিমান হামলা করার জন্য রাশিয়া এখন ইরানের হামেদান বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করছে। এটি এখন আর কোন অনুমান নয়। বরং এটি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। রাশিয়া কর্তৃক ইরানের বিমান ঘাঁটি ব্যবহার এ কথা প্রমাণ করে যে রাশিয়ার সাথে ইরানের সম্পর্ক ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। একই সাথে দেখা যাচ্ছে যে রাশিয়ার সাথে তুরস্কও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করছে। ইরানের সাথেও তুরস্ক সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যেই এই দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের পারদ উর্ধ্বমূখী। এখন দেখা যাচ্ছে, শুধু রাশিয়াই ইরান এবং তুরস্কের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ছে না। বরং এই তিনটি দেশের মধ্যে এক ধরণের সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলছে। আমরা জানি না, শেষ পর্যন্ত এই তিনটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। তবে দুই এক দশক আগেও এই তিনটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন যতটুকু ঘনিষ্ঠ ততটুকুও কল্পনা করা যেত না। এমন একটি সময় ছিল যখন রাশিয়া, তুরস্ক এবং ইরানকে এক কাতারে কল্পনা করা তো দূরের কথা, বরং তুরস্ক এবং ইরান পশ্চিমা ক্যাম্পের সক্রিয় সদস্য ছিল। সেই সময় মধ্যপ্রাচ্য বা পশ্চিম এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি সামরিক জোট গঠিত হয়। এটির নাম ছিল বাগদাদ চুক্তি বা সেন্টো (CENTO) চুক্তি। এই চুক্তির সদস্য ছিল বৃটেন, ইরান, ইরাক, তুরস্ক ও পাকিস্তান। সেই সময় আরেকটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট গঠিত হয়। সেই জোটের নাম ছিল আরসিডি, অর্থাৎ আঞ্চলিক উন্নয়ন সহযোগিতা। আরসিডির সদস্য রাষ্ট্র ছিল তিনটি। এসব দেশ হল তুরস্ক, ইরান এবং পাকিস্তান। সেই তুরস্ক এবং ইরান এখন রাশিয়ার সাথে মিলে ঝুলে কাজ করছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপে এরদোগান ইতোমধ্যেই রাশিয়া সফর করেছেন। এর মধ্যে তিনি ঘোষণা করেছেন যে অত্যন্ত নিকট ভবিষ্যতে তিনি ইরান সফরে যাবেন।
তেহরানে তুর্কি প্রেসিডেন্টের আসন্ন সফরকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বলা হয়েছে যে ইরান সফরকালে তুর্কি প্রেসিডেন্ট ইরানের নেতাদের সাথে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন তার মধ্যে একটি রয়েছে সিরিয় যুদ্ধের অবসান। দুটি দেশ ভাবছে যে তাদের সাথে রাশিয়াকে জড়িয়ে কিভাবে সিরিয়ার রক্তক্ষয় বন্ধ করা যায়। সংবাদ সংস্থা ফার্স জানাচ্ছে যে সিরিয়া সম্পর্কে রাশিয়া, ইরান ও তুরস্কের মধ্যে একটি জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। তিন দেশের নেতৃবৃন্দের বৈঠক ঐ জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করবে বলে ফার্স নিউজ এজেন্সী জানাচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ইরান, তুরস্ক এবং রাশিয়ার এই উদীয়মান জোটকে আমেরিকার পাল্টা জোট হিসেবে দেখছে। সকলেই অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছেন যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মধ্য প্রাচ্যের রাজনীতিতে সশব্দে এবং দ্রুত গতিতে প্রবেশ করছেন। ইরানী ঘাঁটি থেকে রুশ বিমানের সিরিয়ায় আইএস জঙ্গিদের ওপর বোম বর্ষণ একটি নতুন ইঙ্গিত দেয়। সেই ইঙ্গিতটি হলো এই যে ইরান এবং রাশিয়া এখন সিরিয়াতে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। পর্যবেক্ষকরা আরো অবাক হয়েছেন এটা দেখে যে রাশিয়া সিরিয় রণাঙ্গনে প্রবেশের পর আমেরিকার প্রভাব সিরিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে অনেক কমে গেছে। রাশিয়া আমেরিকাকে এই বার্তাও দিয়েছে যে তারা এবার মধ্যপ্রাচ্যে এসেছে খেলা করতে নয়, তারা এখানে থাকতে এসেছে।
আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ‘দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে রুশ ইরান সহযোগিতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে যে সিরিয় রণাঙ্গনে সামরিক অভিযান চালানোর সময় আমেরিকা একটি বড় ভুল করেছে। তারা তাদের সামরিক অভিযানের সময় কোন নিরাপদ অঞ্চল (Safe zone) সৃষ্টি করেনি বা আলাদাভাবে চিহ্নিত করেনি। যদি সেটা করত তাহলে রাশিয়া এখানে ঢোকার কোনো সুযোগ পেত না। গবেষকরা বলছেন যে ইরান কর্তৃক রাশিয়াকে তার সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে দেওয়ার অনুমতি প্রদানকে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এটি শুধু রুশ জঙ্গি বিমানের উড্ডয়ন এবং অবতরণের বিষয়ই নয়, বরং সিরিয় সংকট মীমাংসার জন্য একটি বৃহত্তর রুশ, ইরান, তুর্কি পরিকল্পনারই অংশ। নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতে এখন মার্কিন প্রশাসনের জেগে ওঠার সময় হয়েছে। কারণ এটি আমেরিকার বিরুদ্ধে তুরস্ক এবং ইরানের যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে রাশিয়ার সহযোগিতায় সেটিই একটি সামরিক অক্ষ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
॥তিন॥
আরেকটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ মন্তব্য করেছে যে ইরান-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর রাশিয়া আর সময় নষ্ট করেনি। তারা ইরানের কাছে বিমান বিধ্বংসী এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রয় করার ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফরাসি ‘দৈনিক লাফিগারও’ বলেছে যে রাশিয়া এবং ইরানের মধ্যে একটি সামরিক আঁতাত করার বাসনা অনেক দিন ধরেই সুপ্ত ছিল। মার্কিন ইরান পারমাণবিক চুক্তির পর তাদের পথের কাঁটা দূর হয়ে যায় এবং সামরিকভাবে রুশ ইরান অক্ষ শক্তি গড়ে ওঠে। আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে যে দুর্বল ভূমিকা গ্রহণ করেছিল রাশিয়া সেটির সুযোগ গ্রহণ করেছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সরকারকে আমেরিকা হটাতে চেয়েছিল। কিন্তু এজন্য বাশারের বিরুদ্ধে যত শক্তিশালী সামরিক অভিযানের প্রয়োজন ছিল এবং বাশার বিরোধীদেরকে যে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের প্রয়োজন ছিল ততখানি তারা করেনি।
ইরান এবং রাশিয়া উভয়েই বাশারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য কয়েক বছর আগে থেকেই চিন্তা ভাবনা করছিল। কিন্তু সিরিয় সংকটে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ তারা পাচ্ছিল না। যে মুহূর্তে সুযোগ পেয়ে গেল সেই মুহূর্তে তারা সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার করল। এবং এখন সিরিয় সংকটে রাশিয়াকেই প্রধান খেলোয়াড় বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি এমনভাবে ডেভেলপ করছে যে রাশিয়াকে বাদ দিয়ে সিরিয় সংকট সমাধানে কোন চিন্তা এখন আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
এখন এই সংকটে সিরিয়ার প্রতিবেশী তুরস্ক কতদূর যাবে সেটি দেখার বিষয়। তুরস্ক আমেরিকার সাথে সদ্ভাব বজায় রেখেই চলছিল। কিন্তু আমেরিকার মাথা ব্যথা হলো, কেন এরদোগান এবং তার দল এ কে পার্টি ইসলামের কথা বলে। এজন্য তারা ভেতরে ভেতরে অনেকদিন থেকেই এরদোগান সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছিল। কিন্তু এরদোগানের পেছনে রয়েছে জনসমর্থন। তাই তাকে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই সেদিন আমেরিকা তুরস্কের সেনাবাহিনী দিয়ে এরদোগানকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। জনগণের প্রতিরোধে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর এরদোগান আর কতখানি আমেরিকার দিকে থাকবে আর কতখানি রাশিয়ার দিকে ঝুঁকবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে যেসব আলামত পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো দেখে মনে হচ্ছে যে তুরস্কও সম্ভবত ইরানের পথেই হাঁটবে। হয়তো সেটিতে সময় নেবে। কারণ তুরস্কের এক অংশ ইউরোপে এবং অপর অংশ এশিয়ায়। তাই পরিবর্তন সেখানে সময় নেবে।
॥দুই॥
তবে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলী দেখে মনে হচ্ছে যে সেখানে সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে একটি নতুন মেরুকরণ অথবা জোট বাঁধার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই উদীয়মান জোটটি সিরিয় সংকট সমাধানের একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সিরিয়া নিয়ে একাধিক বিশ্ব শক্তি তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে কাজ করে যাচ্ছে। কার পথটি সঠিক আর কার পথটি বেঠিক সেটি এখনো নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। কারণ সমগ্র সিরিয়া এখন একটি রক্তাক্ত রণাঙ্গন। তবে একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়।
সিরিয়ায় অবস্থিত আইএসের ঘাঁটিগুলোতে বিমান হামলা করার জন্য রাশিয়া এখন ইরানের হামেদান বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করছে। এটি এখন আর কোন অনুমান নয়। বরং এটি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। রাশিয়া কর্তৃক ইরানের বিমান ঘাঁটি ব্যবহার এ কথা প্রমাণ করে যে রাশিয়ার সাথে ইরানের সম্পর্ক ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। একই সাথে দেখা যাচ্ছে যে রাশিয়ার সাথে তুরস্কও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করছে। ইরানের সাথেও তুরস্ক সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যেই এই দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের পারদ উর্ধ্বমূখী। এখন দেখা যাচ্ছে, শুধু রাশিয়াই ইরান এবং তুরস্কের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ছে না। বরং এই তিনটি দেশের মধ্যে এক ধরণের সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলছে। আমরা জানি না, শেষ পর্যন্ত এই তিনটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। তবে দুই এক দশক আগেও এই তিনটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন যতটুকু ঘনিষ্ঠ ততটুকুও কল্পনা করা যেত না। এমন একটি সময় ছিল যখন রাশিয়া, তুরস্ক এবং ইরানকে এক কাতারে কল্পনা করা তো দূরের কথা, বরং তুরস্ক এবং ইরান পশ্চিমা ক্যাম্পের সক্রিয় সদস্য ছিল। সেই সময় মধ্যপ্রাচ্য বা পশ্চিম এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি সামরিক জোট গঠিত হয়। এটির নাম ছিল বাগদাদ চুক্তি বা সেন্টো (CENTO) চুক্তি। এই চুক্তির সদস্য ছিল বৃটেন, ইরান, ইরাক, তুরস্ক ও পাকিস্তান। সেই সময় আরেকটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট গঠিত হয়। সেই জোটের নাম ছিল আরসিডি, অর্থাৎ আঞ্চলিক উন্নয়ন সহযোগিতা। আরসিডির সদস্য রাষ্ট্র ছিল তিনটি। এসব দেশ হল তুরস্ক, ইরান এবং পাকিস্তান। সেই তুরস্ক এবং ইরান এখন রাশিয়ার সাথে মিলে ঝুলে কাজ করছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপে এরদোগান ইতোমধ্যেই রাশিয়া সফর করেছেন। এর মধ্যে তিনি ঘোষণা করেছেন যে অত্যন্ত নিকট ভবিষ্যতে তিনি ইরান সফরে যাবেন।
তেহরানে তুর্কি প্রেসিডেন্টের আসন্ন সফরকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বলা হয়েছে যে ইরান সফরকালে তুর্কি প্রেসিডেন্ট ইরানের নেতাদের সাথে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন তার মধ্যে একটি রয়েছে সিরিয় যুদ্ধের অবসান। দুটি দেশ ভাবছে যে তাদের সাথে রাশিয়াকে জড়িয়ে কিভাবে সিরিয়ার রক্তক্ষয় বন্ধ করা যায়। সংবাদ সংস্থা ফার্স জানাচ্ছে যে সিরিয়া সম্পর্কে রাশিয়া, ইরান ও তুরস্কের মধ্যে একটি জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। তিন দেশের নেতৃবৃন্দের বৈঠক ঐ জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করবে বলে ফার্স নিউজ এজেন্সী জানাচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ইরান, তুরস্ক এবং রাশিয়ার এই উদীয়মান জোটকে আমেরিকার পাল্টা জোট হিসেবে দেখছে। সকলেই অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছেন যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মধ্য প্রাচ্যের রাজনীতিতে সশব্দে এবং দ্রুত গতিতে প্রবেশ করছেন। ইরানী ঘাঁটি থেকে রুশ বিমানের সিরিয়ায় আইএস জঙ্গিদের ওপর বোম বর্ষণ একটি নতুন ইঙ্গিত দেয়। সেই ইঙ্গিতটি হলো এই যে ইরান এবং রাশিয়া এখন সিরিয়াতে আরো ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। পর্যবেক্ষকরা আরো অবাক হয়েছেন এটা দেখে যে রাশিয়া সিরিয় রণাঙ্গনে প্রবেশের পর আমেরিকার প্রভাব সিরিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে অনেক কমে গেছে। রাশিয়া আমেরিকাকে এই বার্তাও দিয়েছে যে তারা এবার মধ্যপ্রাচ্যে এসেছে খেলা করতে নয়, তারা এখানে থাকতে এসেছে।
আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ‘দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস’ বলছে যে রুশ ইরান সহযোগিতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে যে সিরিয় রণাঙ্গনে সামরিক অভিযান চালানোর সময় আমেরিকা একটি বড় ভুল করেছে। তারা তাদের সামরিক অভিযানের সময় কোন নিরাপদ অঞ্চল (Safe zone) সৃষ্টি করেনি বা আলাদাভাবে চিহ্নিত করেনি। যদি সেটা করত তাহলে রাশিয়া এখানে ঢোকার কোনো সুযোগ পেত না। গবেষকরা বলছেন যে ইরান কর্তৃক রাশিয়াকে তার সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতে দেওয়ার অনুমতি প্রদানকে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এটি শুধু রুশ জঙ্গি বিমানের উড্ডয়ন এবং অবতরণের বিষয়ই নয়, বরং সিরিয় সংকট মীমাংসার জন্য একটি বৃহত্তর রুশ, ইরান, তুর্কি পরিকল্পনারই অংশ। নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতে এখন মার্কিন প্রশাসনের জেগে ওঠার সময় হয়েছে। কারণ এটি আমেরিকার বিরুদ্ধে তুরস্ক এবং ইরানের যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে রাশিয়ার সহযোগিতায় সেটিই একটি সামরিক অক্ষ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
॥তিন॥
আরেকটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ মন্তব্য করেছে যে ইরান-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর রাশিয়া আর সময় নষ্ট করেনি। তারা ইরানের কাছে বিমান বিধ্বংসী এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রয় করার ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফরাসি ‘দৈনিক লাফিগারও’ বলেছে যে রাশিয়া এবং ইরানের মধ্যে একটি সামরিক আঁতাত করার বাসনা অনেক দিন ধরেই সুপ্ত ছিল। মার্কিন ইরান পারমাণবিক চুক্তির পর তাদের পথের কাঁটা দূর হয়ে যায় এবং সামরিকভাবে রুশ ইরান অক্ষ শক্তি গড়ে ওঠে। আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে যে দুর্বল ভূমিকা গ্রহণ করেছিল রাশিয়া সেটির সুযোগ গ্রহণ করেছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সরকারকে আমেরিকা হটাতে চেয়েছিল। কিন্তু এজন্য বাশারের বিরুদ্ধে যত শক্তিশালী সামরিক অভিযানের প্রয়োজন ছিল এবং বাশার বিরোধীদেরকে যে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের প্রয়োজন ছিল ততখানি তারা করেনি।
ইরান এবং রাশিয়া উভয়েই বাশারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য কয়েক বছর আগে থেকেই চিন্তা ভাবনা করছিল। কিন্তু সিরিয় সংকটে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ তারা পাচ্ছিল না। যে মুহূর্তে সুযোগ পেয়ে গেল সেই মুহূর্তে তারা সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার করল। এবং এখন সিরিয় সংকটে রাশিয়াকেই প্রধান খেলোয়াড় বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি এমনভাবে ডেভেলপ করছে যে রাশিয়াকে বাদ দিয়ে সিরিয় সংকট সমাধানে কোন চিন্তা এখন আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
এখন এই সংকটে সিরিয়ার প্রতিবেশী তুরস্ক কতদূর যাবে সেটি দেখার বিষয়। তুরস্ক আমেরিকার সাথে সদ্ভাব বজায় রেখেই চলছিল। কিন্তু আমেরিকার মাথা ব্যথা হলো, কেন এরদোগান এবং তার দল এ কে পার্টি ইসলামের কথা বলে। এজন্য তারা ভেতরে ভেতরে অনেকদিন থেকেই এরদোগান সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছিল। কিন্তু এরদোগানের পেছনে রয়েছে জনসমর্থন। তাই তাকে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই সেদিন আমেরিকা তুরস্কের সেনাবাহিনী দিয়ে এরদোগানকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। জনগণের প্রতিরোধে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর এরদোগান আর কতখানি আমেরিকার দিকে থাকবে আর কতখানি রাশিয়ার দিকে ঝুঁকবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে যেসব আলামত পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো দেখে মনে হচ্ছে যে তুরস্কও সম্ভবত ইরানের পথেই হাঁটবে। হয়তো সেটিতে সময় নেবে। কারণ তুরস্কের এক অংশ ইউরোপে এবং অপর অংশ এশিয়ায়। তাই পরিবর্তন সেখানে সময় নেবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন