কত টপিক জমা হয়ে আছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখবো। গত বৃহস্পতিবার বিএনপি সভানেত্রী ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার দলের ৩৮ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে একটি ভাষণ দেন। ঐ ভাষণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ লোকের কাছে পৌঁছে যায়। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার অনেকগুলো কাগজের পৃষ্ঠা উল্টালাম। একমাত্র ‘দৈনিক ইনকিলাব’, ‘দৈনিক সংগ্রাম’, ‘দৈনিক নয়া দিগন্ত’ এবং ‘দৈনিক দিনকাল’ ছাড়া আর কেউ প্রথম পৃষ্ঠা তো দূরের কথা, শেষ পৃষ্ঠাতেও তার বক্তৃতা কাভার করেনি। কিছু কিছু পত্রিকা দ্বিতীয় এবং চতুর্থ পৃষ্ঠায় সংবাদটি প্রকাশ করেছে এবং সেটিও নেহায়েত দায় সারা ভাবে। দ্বিতীয় বা চতুর্থ পৃষ্ঠায় সিঙ্গেল কলামে ছোট ছোট টাইপের শিরোনাম দিয়ে ওরা সংবাদটি ছেপেছে, যেটি সহজেই পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এখনো দেশের ১৬ কোটি লোকের মধ্যে মেজরিটি অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সরকার বিরোধী। এই সরকার নিজেদের আন্ডারে ভোট না করে একটি কেয়ার টেকার সরকার বা নিরপেক্ষ সরকারের আন্ডারে ভোট করে দেখুক, কয় শতাংশ ভোট তাদের নৌকায় পড়ে। আর কয় শতাংশ ভোট ধানের শীষে পড়ে। এগুলো কোন ধরনের সাংবাদিকতা? অথচ এরাই রেডিও, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রে স্বাধীনভাবে সংবাদ ছাপানোর দাবিতে পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগ এবং বাংলাদেশ আমলে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাবস্থায় তারা তাদের জান কুরবান করে। যারা বিএনপির ৩৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণটি হেলায় ফেলায় ছাপিয়েছে তারাও ভাষণের আসল কথাটি বাদ দিয়েছে। অবাক হই তখন যখন এরা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার বুলি আওড়ায়।
গত ২/৩ দিন ধরে ওরা আরেক ধরনের নিউজ ছাপছে। সেটি হলো, আগামী বছরে নাকি আওয়ামী সরকার বাংলাদেশে ভোট করবে। তারা ফলাও করে বলেছে যে সাম্প্রতিককালে আওয়ামী লীগের পপুলারিটি, বিশেষ করে শেখ হাসিনার পপুলারিটি, নাকি অনেক বেড়ে গেছে। সেই পপুলারিটির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে এই সরকার নাকি ভোট করবে। এসব কথা বিশেষ করে ২০১৯ সালের আগে এই সরকার ভোট করবে, সেটি আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। যাই হোক, তবুও যদি তারা ভোট করে সেটি ভাল কথা। কিন্তু সেই ভোটও কোন্ সরকারের অধীনে হবে? আওয়ামী সরকার? আওয়ামী সরকার ভোট করলে কি রকম ভোট হবে সেটি তো জনগণ গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে এ বছরের বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশনের ভোট, মিউনিসিপ্যালিটির ভোট, উপজেলা পরিষদের ভোট, ইউনিয়ন পরিষদের ভোট প্রভৃতি ভোটে দেখেছে। আওয়ামী লীগই অতীতে একটি স্লোগান দিয়ে সারা দেশের আকাশ বাতাস ফাটিয়ে দিয়েছিল। সেটি হলো, “আমার ভোট আমি দেব, যাকে ইচ্ছা তাকে দেব”। কিন্তু গত এপ্রিল থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ যেসব শ্লোগান দিচ্ছে তার মর্মার্থ হলো, “আমার ভোট আমি দেব, তোমার ভোটও আমি দেব”। তো এই ধরনের ভোট করলে আওয়ামী লীগের পপুলারিটি ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত দেখানো যাবে। সেই ভোট করার আগেও মামলা মোকদ্দমার জালে জড়িয়ে তারেক রহমানকে শাস্তি দিয়ে যেরূপ অযোগ্য করা হয়েছে, সেই ভাবে বেগম জিয়াকে শাস্তি দিয়ে তাকে যদি ডিসকোয়ালিফাই করা হয় এবং তার সাথে বিএনপির আরো কয়েকজন বড় নেতা, যারা কোন দিন ইলেকশনে হারেন না, তাদেরকেও যদি ডিসকোয়ালিফাই করা হয় তাহলে তো ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যাবে। এই রকম একটি ইলেকশনের চিন্তা ভাবনা নাকি আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের মাথায় ঘোরা ফেরা করছে। এই ধরনের ইলেকশন হলে কারো কিছু বলার থাকবে না। কারণ এই ধরনের ইলেকশন বানচাল করতে গেলে ভাল ভাল কথায় হবে না। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগকে পর্যুদস্ত করে তবেই একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যাবে। সেই নির্বাচনেই জনমত যথার্থ প্রতিফলিত হবে। সেই ধরনের নির্বাচন করা শুধু বিএনপি কেন, কোন বিরোধী দলের পক্ষেই এখন সম্ভব হবে বলে আমার তো মনে হয় না।
॥দুই॥
কিভাবে সম্ভব হবে? প্রধান বিরোধী দল বলতে দুইটি। একটি হলো বিএনপি, আরেকটি হলো জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ। বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে। আরো হাজার হাজার নেতাকর্মী হুলিয়া মাথায় নিয়ে বিগত ৬/৭ বছর হলো পলাতক জীবন যাপন করছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিক বক্তৃতায় জানিয়েছেন যে, তাদের কর্মীরা পলাতক জীবন যাপন করতে করতে এমন মরিয়া হয়ে উঠেছেন যে তারা নিজের জেলা থেকে অন্য জেলায় চলে গেছেন এবং সেই জেলায় গিয়ে রিক্সাওয়ালা বা হকারের কাজ করছেন।
জামায়াতের কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল। ইতোমধ্যেই সাবেক আমীর মওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ইতোমধ্যেই ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছে। আরেকজন কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার সময়ের মধ্যেই কার্যকর হবে অথবা হয়ে গেছে। জামায়াতের নায়েবে আমীর বিশ্ব বরেণ্য মুফাস্সিরে কোরআন আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদি কারাদ- ভোগ করছেন। সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি এটিএম আজাহারুল ইসলাম এবং আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা মওলানা আবদুস সোবহান মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের কাঠগড়ায় রয়েছেন। বাংলাদেশে জামায়াতের প্রধান নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম কারাদন্ড মাথায় নিয়ে কারাগারেই শাহাদৎ বরণ করেছেন। অপর নেতা মওলানা একেএম ইউসুফ কারাগারেই শাহাদৎ বরণ করেছেন। এছাড়াও অনেকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ রয়েছে।
এখনো জামায়াতের ৩০/৪০ হাজার নেতা কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন। হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পলাতক এবং মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অসংখ্য কর্মীকে রিমান্ডে নিয়ে তাদেরকে শারীরিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। এমন অমানবিক নির্যাতন অতীতে আর কখনো কোনো সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের ওপর করেনি। এই দলটি যে টিকে আছে এটিই সবচেয়ে বড় কথা। একজন সেক্যুলার ও বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবীর নাম হলো আফসান চৌধুরী। তিনি ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা ‘নিউ এজে’ ৮ কলাম ব্যাপী বিশাল পোস্ট এডিটরিয়াল লিখে বলেই দিয়েছেন যে জামায়াতকে ক্রাশ করা হয়েছে। যারা অবশিষ্ট আছেন তাদেরও ক্রাশ করার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। এই দলের পক্ষে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। তিনি তার আলোচ্য নিবন্ধে এই কথাটিও বলেছেন যে ঢাকায় বিএনপি আওয়ামী লীগের সামনে ছিল সবচেয়ে বড় থ্রেট। এখন বিএনপির সমর্থন অনেক রয়েছে। কিন্তু সংগঠন হিসেবে তারা ছিন্ন ভিন্ন। তাই তাদের অবস্থা এখন পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির এই সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে আওয়ামী লীগের সামনে পরবর্তী থ্রেট এবং পটেনশিয়াল থ্রেট ছিল জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী এবং শিবিরকে সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্রুট ফোর্স দিয়ে শুধু ক্রাশ করা নয়, রীতিমত লিকুইডেট করা হয়েছে। জামায়াতের মাজা ভেঙ্গে গেছে। তার পক্ষে আর আওয়ামী সরকারের ক্ষমতার রাজনীতিতে থ্রেট হিসেবে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। আফসান চৌধুরীর পুরো বক্তব্য জানতে হলে পড়তে পারেন, Is JMB going to be new threat to AL, instead of BNP? (OP-ED, page- 9, New Age, August 24, 2016.)
॥তিন॥
বিগত ৭ বছর ৮ মাস হলো বিএনপি এবং জামায়াতের ওপর আওয়ামী সরকার জুলুমের যে স্টিম রোলার চালাচ্ছে তারপরেও বিএনপি ও জামায়াত তথা বিরোধী দলীয় জোট আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ইংরেজীতে যেটিকে বলা হয়, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সেই সমতল ক্ষেত্র, সেটি প্রস্তুত করতে হবে। আর সেই দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই। এত জেল জুলুম নির্যাতনের পরেও বিরোধী দল রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। কিন্তু সেক্ষেত্রে সারা বিশ্বে প্রচলিত রাজনৈতিক প্রথা মোতাবেক আওয়ামী সরকারকেও নি¤েœাক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(১) নির্বাচনের অন্তত তিন মাস পূর্বে বর্তমান জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এমনিতেই এই জাতীয় সংসদ বৈধ নয়। কারণ সংসদের ১৫৩ জন অর্থাৎ মেজরিটি সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত। এছাড়া আর যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রেও ২০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। তবুও আমরা বৈধতার প্রশ্ন না তুলে পার্লামেন্টারী প্র্যাকটিস অনুযায়ী দাবি করছি যে বর্তমান জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এটি একটি সাধারণ নিয়ম যে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হলে তার আর কোন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় না। কিন্তু জাতীয় সংসদ যদি বিলুপ্ত না হয় তাহলে নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে অধিবেশন আহ্বান করে কালা-কানুন জারি করতে পারে।
(২) নির্বাচনের পূর্বে সমস্ত রাজবন্দিকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে হবে। যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে তাদের গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করতে হবে। নির্বাচনকালে প্রতিটি দলের নেতা ও কর্মীরা যাতে অবাধে চলাচল করতে পারে এবং যাতে বিনা ভয় ভীতিতে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারে।
(৩) বর্তমান সরকারকে নির্বাচনের তিন মাস পূর্বে পদত্যাগ করতে হবে। এটাই সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশের নিয়ম। যেসব দেশে এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও দলীয় সরকারের সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় সেসব দেশেও দলীয় সরকার অন্তবর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করে। তারা শুধুমাত্র দেশের বা সরকারের দৈনন্দিন রুটিন কার্যকলাপ চালিয়ে যায়। এই ব্যবস্থাও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মেনে নিতেন যদি সরকার ভোট চুরি, কারচুপি এবং বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের কর্মীদের ওপর ফ্যাসিবাদী নির্যাতন না চালাতেন। মাগুরার একটি মাত্র এলাকায় প্রার্থীদের অভিযোগে আওয়ামী লীগ সমগ্র নির্বাচনকে অস্বীকার করেছিল এবং কেয়ারটেকার সরকারের দাবি করেছিল। এখন বিগত নির্বাচনগুলোতে একটি নয়, দুটি নয়, দেশ ও জাতির প্রতিটি স্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এই ভোট ডাকাতির আশ্রয় নিয়েছে। এবং সেই ভাট ডাকাতি করে ক্ষমতায় টিকে আছে। তাই জনগণ এই সরকারকে আর বিশ্বাস করে না। তারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করে যাচ্ছে।
(৪) আজ যে জঙ্গিবাদ নিয়ে বাংলাদেশের আকাশ বাতাস গরম করা হচ্ছে সেই জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে ঢোকা এবং মাথা চাড়ার সুযোগ পেয়েছে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অভাবে। এটি শুধু আমাদের কথা নয়। বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক শক্তির কথা। কয়েক দিন আগে বিশ্ব বিখ্যাত ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকা তার সম্পদকীয় নিবন্ধে এই কথাটিরই প্রতিধ্বনি করেছে।
গত ২/৩ দিন ধরে ওরা আরেক ধরনের নিউজ ছাপছে। সেটি হলো, আগামী বছরে নাকি আওয়ামী সরকার বাংলাদেশে ভোট করবে। তারা ফলাও করে বলেছে যে সাম্প্রতিককালে আওয়ামী লীগের পপুলারিটি, বিশেষ করে শেখ হাসিনার পপুলারিটি, নাকি অনেক বেড়ে গেছে। সেই পপুলারিটির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে এই সরকার নাকি ভোট করবে। এসব কথা বিশেষ করে ২০১৯ সালের আগে এই সরকার ভোট করবে, সেটি আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। যাই হোক, তবুও যদি তারা ভোট করে সেটি ভাল কথা। কিন্তু সেই ভোটও কোন্ সরকারের অধীনে হবে? আওয়ামী সরকার? আওয়ামী সরকার ভোট করলে কি রকম ভোট হবে সেটি তো জনগণ গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে এ বছরের বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশনের ভোট, মিউনিসিপ্যালিটির ভোট, উপজেলা পরিষদের ভোট, ইউনিয়ন পরিষদের ভোট প্রভৃতি ভোটে দেখেছে। আওয়ামী লীগই অতীতে একটি স্লোগান দিয়ে সারা দেশের আকাশ বাতাস ফাটিয়ে দিয়েছিল। সেটি হলো, “আমার ভোট আমি দেব, যাকে ইচ্ছা তাকে দেব”। কিন্তু গত এপ্রিল থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ যেসব শ্লোগান দিচ্ছে তার মর্মার্থ হলো, “আমার ভোট আমি দেব, তোমার ভোটও আমি দেব”। তো এই ধরনের ভোট করলে আওয়ামী লীগের পপুলারিটি ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত দেখানো যাবে। সেই ভোট করার আগেও মামলা মোকদ্দমার জালে জড়িয়ে তারেক রহমানকে শাস্তি দিয়ে যেরূপ অযোগ্য করা হয়েছে, সেই ভাবে বেগম জিয়াকে শাস্তি দিয়ে তাকে যদি ডিসকোয়ালিফাই করা হয় এবং তার সাথে বিএনপির আরো কয়েকজন বড় নেতা, যারা কোন দিন ইলেকশনে হারেন না, তাদেরকেও যদি ডিসকোয়ালিফাই করা হয় তাহলে তো ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যাবে। এই রকম একটি ইলেকশনের চিন্তা ভাবনা নাকি আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের মাথায় ঘোরা ফেরা করছে। এই ধরনের ইলেকশন হলে কারো কিছু বলার থাকবে না। কারণ এই ধরনের ইলেকশন বানচাল করতে গেলে ভাল ভাল কথায় হবে না। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগকে পর্যুদস্ত করে তবেই একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যাবে। সেই নির্বাচনেই জনমত যথার্থ প্রতিফলিত হবে। সেই ধরনের নির্বাচন করা শুধু বিএনপি কেন, কোন বিরোধী দলের পক্ষেই এখন সম্ভব হবে বলে আমার তো মনে হয় না।
॥দুই॥
কিভাবে সম্ভব হবে? প্রধান বিরোধী দল বলতে দুইটি। একটি হলো বিএনপি, আরেকটি হলো জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ। বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে। আরো হাজার হাজার নেতাকর্মী হুলিয়া মাথায় নিয়ে বিগত ৬/৭ বছর হলো পলাতক জীবন যাপন করছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিক বক্তৃতায় জানিয়েছেন যে, তাদের কর্মীরা পলাতক জীবন যাপন করতে করতে এমন মরিয়া হয়ে উঠেছেন যে তারা নিজের জেলা থেকে অন্য জেলায় চলে গেছেন এবং সেই জেলায় গিয়ে রিক্সাওয়ালা বা হকারের কাজ করছেন।
জামায়াতের কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল। ইতোমধ্যেই সাবেক আমীর মওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ইতোমধ্যেই ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছে। আরেকজন কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার সময়ের মধ্যেই কার্যকর হবে অথবা হয়ে গেছে। জামায়াতের নায়েবে আমীর বিশ্ব বরেণ্য মুফাস্সিরে কোরআন আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদি কারাদ- ভোগ করছেন। সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি এটিএম আজাহারুল ইসলাম এবং আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা মওলানা আবদুস সোবহান মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের কাঠগড়ায় রয়েছেন। বাংলাদেশে জামায়াতের প্রধান নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম কারাদন্ড মাথায় নিয়ে কারাগারেই শাহাদৎ বরণ করেছেন। অপর নেতা মওলানা একেএম ইউসুফ কারাগারেই শাহাদৎ বরণ করেছেন। এছাড়াও অনেকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ রয়েছে।
এখনো জামায়াতের ৩০/৪০ হাজার নেতা কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন। হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পলাতক এবং মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অসংখ্য কর্মীকে রিমান্ডে নিয়ে তাদেরকে শারীরিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। এমন অমানবিক নির্যাতন অতীতে আর কখনো কোনো সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের ওপর করেনি। এই দলটি যে টিকে আছে এটিই সবচেয়ে বড় কথা। একজন সেক্যুলার ও বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবীর নাম হলো আফসান চৌধুরী। তিনি ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা ‘নিউ এজে’ ৮ কলাম ব্যাপী বিশাল পোস্ট এডিটরিয়াল লিখে বলেই দিয়েছেন যে জামায়াতকে ক্রাশ করা হয়েছে। যারা অবশিষ্ট আছেন তাদেরও ক্রাশ করার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। এই দলের পক্ষে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। তিনি তার আলোচ্য নিবন্ধে এই কথাটিও বলেছেন যে ঢাকায় বিএনপি আওয়ামী লীগের সামনে ছিল সবচেয়ে বড় থ্রেট। এখন বিএনপির সমর্থন অনেক রয়েছে। কিন্তু সংগঠন হিসেবে তারা ছিন্ন ভিন্ন। তাই তাদের অবস্থা এখন পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির এই সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে আওয়ামী লীগের সামনে পরবর্তী থ্রেট এবং পটেনশিয়াল থ্রেট ছিল জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী এবং শিবিরকে সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্রুট ফোর্স দিয়ে শুধু ক্রাশ করা নয়, রীতিমত লিকুইডেট করা হয়েছে। জামায়াতের মাজা ভেঙ্গে গেছে। তার পক্ষে আর আওয়ামী সরকারের ক্ষমতার রাজনীতিতে থ্রেট হিসেবে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। আফসান চৌধুরীর পুরো বক্তব্য জানতে হলে পড়তে পারেন, Is JMB going to be new threat to AL, instead of BNP? (OP-ED, page- 9, New Age, August 24, 2016.)
॥তিন॥
বিগত ৭ বছর ৮ মাস হলো বিএনপি এবং জামায়াতের ওপর আওয়ামী সরকার জুলুমের যে স্টিম রোলার চালাচ্ছে তারপরেও বিএনপি ও জামায়াত তথা বিরোধী দলীয় জোট আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ইংরেজীতে যেটিকে বলা হয়, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সেই সমতল ক্ষেত্র, সেটি প্রস্তুত করতে হবে। আর সেই দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই। এত জেল জুলুম নির্যাতনের পরেও বিরোধী দল রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। কিন্তু সেক্ষেত্রে সারা বিশ্বে প্রচলিত রাজনৈতিক প্রথা মোতাবেক আওয়ামী সরকারকেও নি¤েœাক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(১) নির্বাচনের অন্তত তিন মাস পূর্বে বর্তমান জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এমনিতেই এই জাতীয় সংসদ বৈধ নয়। কারণ সংসদের ১৫৩ জন অর্থাৎ মেজরিটি সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত। এছাড়া আর যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রেও ২০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। তবুও আমরা বৈধতার প্রশ্ন না তুলে পার্লামেন্টারী প্র্যাকটিস অনুযায়ী দাবি করছি যে বর্তমান জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এটি একটি সাধারণ নিয়ম যে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হলে তার আর কোন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় না। কিন্তু জাতীয় সংসদ যদি বিলুপ্ত না হয় তাহলে নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে অধিবেশন আহ্বান করে কালা-কানুন জারি করতে পারে।
(২) নির্বাচনের পূর্বে সমস্ত রাজবন্দিকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে হবে। যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে তাদের গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করতে হবে। নির্বাচনকালে প্রতিটি দলের নেতা ও কর্মীরা যাতে অবাধে চলাচল করতে পারে এবং যাতে বিনা ভয় ভীতিতে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারে।
(৩) বর্তমান সরকারকে নির্বাচনের তিন মাস পূর্বে পদত্যাগ করতে হবে। এটাই সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশের নিয়ম। যেসব দেশে এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও দলীয় সরকারের সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় সেসব দেশেও দলীয় সরকার অন্তবর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করে। তারা শুধুমাত্র দেশের বা সরকারের দৈনন্দিন রুটিন কার্যকলাপ চালিয়ে যায়। এই ব্যবস্থাও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মেনে নিতেন যদি সরকার ভোট চুরি, কারচুপি এবং বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের কর্মীদের ওপর ফ্যাসিবাদী নির্যাতন না চালাতেন। মাগুরার একটি মাত্র এলাকায় প্রার্থীদের অভিযোগে আওয়ামী লীগ সমগ্র নির্বাচনকে অস্বীকার করেছিল এবং কেয়ারটেকার সরকারের দাবি করেছিল। এখন বিগত নির্বাচনগুলোতে একটি নয়, দুটি নয়, দেশ ও জাতির প্রতিটি স্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এই ভোট ডাকাতির আশ্রয় নিয়েছে। এবং সেই ভাট ডাকাতি করে ক্ষমতায় টিকে আছে। তাই জনগণ এই সরকারকে আর বিশ্বাস করে না। তারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করে যাচ্ছে।
(৪) আজ যে জঙ্গিবাদ নিয়ে বাংলাদেশের আকাশ বাতাস গরম করা হচ্ছে সেই জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে ঢোকা এবং মাথা চাড়ার সুযোগ পেয়েছে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অভাবে। এটি শুধু আমাদের কথা নয়। বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক শক্তির কথা। কয়েক দিন আগে বিশ্ব বিখ্যাত ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকা তার সম্পদকীয় নিবন্ধে এই কথাটিরই প্রতিধ্বনি করেছে।
আসিফ আরসালান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন