শনিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১৬

রাম বিলাসের স্বপ্ন বিলাস



রাম যাদবের পর এবার বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানকে নিয়ে ফেডারেশন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় আরেক মন্ত্রী রাম বিলাস পাসওয়ান। তিনি বলেছেন, এ ফেডারেশনের থাকবে অভিন্ন মুদ্রা। বাণিজ্য হবে উন্মুক্ত। তা হলে সন্ত্রাসকে বিদায় জানানো যাবে। এর একদিন আগে যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাম যাদব এ তিনটি দেশকে একীভূত করার কথা বলেন। তারপরেই এ কথা বললেন রাম বিলাস পাসওয়ান। তবে আরএসএস বলেছে, তিনটি দেশকে একীভূত করা রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। তবে রাম যাদবের কথায় জোর দিলেন ভোক্তা, খাদ্য ও বিতরণ বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাম বিলাস পাসওয়ান।
বার্তা সংস্থা পিটিআই এ খবর দিয়েছে। পিটিআইকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশ তিনটিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আমরা বলতে পারি না এ দেশগুলো একীভূত হতে পারবে নাকি পারবে না। যদি তারা একীভূত হতে পারে তাহলে তা হবে খুবই ভাল বিষয়। যদি তারা আবার এক জাতি হতে না পারে তাহলে ন্যূনতম তাদেরকে একটি ‘মহাসংগঠন’ গড়ে তুলতে হবে। আগে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এক জাতি ছিল। বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম যাদবের উক্তির বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি এসব কথা বলেন। পাসওয়ান বলেন, তিনটি দেশ মিলে একটি ফেডারেশন (মহাসংগঠন) গড়ে তুলতে পারে। এতে থাকবে অভিন্ন মুদ্রা। বাণিজ্য হবে উন্মুক্ত। জনগণের মুক্তভাবে চলাফেরার ওপর থেকে বিধিনিষেধ উঠে যাবে। এটা করা হলে সন্ত্রাস দূর হবে।
ঐদিকে ভারতের আরেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল বলেছেন, ভারতের কংগ্রেস এবং অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক পার্টি আসামকে বাংলাদেশের অংশ বানাতে ষড়যন্ত্র করছে। সর্বানন্দ ভারতের ক্রীড়া ও যুব মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। গত সপ্তাহে তাকে ক্ষমতাসীন বিজেপির আসাম প্রদেশ শাখার প্রধান নিয়োগ করা হয়েছে। শুক্রবার দিবরুগড়ে এক দলীয় সভায় তিনি বলেন, ‘শুধু ক্ষমতা দখলের স্বার্থে কংগ্রেস এবং এআইইউডিএফ আসামকে বাংলাদেশের অংশে পরিণত করার জন্য নোংরা ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।’ বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন আসামে প্রচুর বাংলাদেশী অবৈধভাবে বাস করছে বলে দাবি করে থাকে বিজেপি। তাদের আসাম থেকে বহিষ্কারেরও দাবি করে দলটি। আসামের আঞ্চলিক রাজনীতিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সর্বানন্দ দাবি করেন, বিজেপির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় কংগ্রেস উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এজন্য কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার চালাচ্ছে। সম্প্রতি সর্বানন্দকে আসামের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আগামী বছর অনুষ্ঠিত রাজ্যসভা নির্বাচনে বিজেপি জয়ী হয়ে রাজ্য সরকার গঠন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
ওপরের এই তিনটি ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, একদিকে বৃহত্তর ভারত নিয়ে ক্ষমতাসীন বিজেপির সিনিয়র নেতারা অবাস্তব বক্তব্য দিচ্ছেন, অন্যদিকে আসাম ও বাংলাদেশকে নিয়ে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এসব অভিযোগ সম্পর্কে গতানুগতিক ধারায় গালাগালি না করে আমরা ঠা-া মাথায় বাস্তব দিক বিবেচনা করে আমাদের তথা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনোভাব বা সেন্টিমেন্ট তুলে ধরব।
প্রথমে ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মিলে একটি ফেডারেশন গঠন প্রসঙ্গ। এখানে একটি কথা পরিষ্কারভাবে বলা দরকার। বিজেপির সাধারণ সম্পাদক এবং ভারত সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী রাম যাদব তিনটি দেশকে নিয়ে একটি ফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব করেছেন। লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই যে, বাবু রাম যাদব ফেডারেশন গঠনের কথা বলেছেন, কনফেডারেশন গঠনের কথা বলেন নাই। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে যাদের ক খ গ ধারণা রয়েছে তারা জানেন যে, ফেডারেশন গঠিত হয় কতগুলো প্রদেশ বা অঙ্গ রাজ্য নিয়ে। আর কনফেডারেশন গঠিত হয় একাধিক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র নিয়ে। তাই ফেডারেশন নিজেই একটি মাত্র রাষ্ট্র হয়। কনফেডারেশন গঠিত হয় একাধিক রাষ্ট্রের সম্মতিক্রমে। আবার কনফেডারেশনভুক্ত রাষ্ট্রগুলি ইচ্ছা করলে পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারে। অর্থাৎ কনফেডারেশন গঠনের আগে কনফেডারেশনভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর যে স্বাধীন ও সার্বভৌম মর্যাদা ছিল, কনফেডারেশনভুক্ত হবার পরও স্বাধীন-সার্বভৌম থাকে আর স্বাধীন ইচ্ছায় বেরিয়ে আসতে পারে। ফেডারেশনভুক্ত রাজ্য বা রাষ্ট্রগুলো বেরিয়ে আসতে পারে না।
॥দুই॥
ভারত একটি ফেডারেল রাষ্ট্র, অর্থাৎ একটি ফেডারেশন। তাদের রয়েছে ২৯টি প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্য। অনুরূপ ভাবে পাকিস্তানও একটি ফেডারেল রাষ্ট্র, অর্থাৎ একটি ফেডারেশন। তাদের রয়েছে ৪টি প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্য। পাকিস্তান বা ভারতের যে কোন প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্য ইচ্ছা করলেই ভারতীয় বা পাকিস্তানি ফেডারেশন থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে পারে না। সেটি করতে চাইলে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সামরিক বাহিনী সহ সর্বশক্তি দিয়ে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা প্রতিরোধ করবে। বেরিয়ে আসার চেষ্টাকে বলে স্বাধীনতা সংগ্রাম আর যারা সেই চেষ্টা বা সংগ্রাম করেন তাদেরকে বলা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামী বা মুক্তিযোদ্ধা। যারা বেরিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা প্রতিরোধ করেন স্বাধীনতা সংগ্রামকে বলেন বিচ্ছিন্নতাবাদ। সুতরাং বেরিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টার সঠিক কোন পরিভাষা  নেই। মুক্তিকামীদের কাছে মুক্তি সংগ্রাম অথবা মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রাম। যারা কেন্দ্রীয় সরকারে থাকেন তারা সেটিকে বলেন জাতীয় সংহতি এবং ভৌগোলিক অখ-তা বিনষ্টের ষড়যন্ত্র।
আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের দিকে তাকিয়ে দেখুন। ভারতকে বলা হয় একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরে যারা বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন করছে তাদেরকে ভারতের সুবিশাল সামরিক বাহিনী, বিএসএফ প্রভৃতি আইন শৃংখলা বাহিনী দিয়ে দমন করা হচ্ছে। ভারতের যেসব রাজ্যে বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন চলছে, সেখানে আজ যদি জনগণকে তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে দেওয়া হয়, আজ যদি ঐ সব রাষ্ট্রে গণভোট হয়; তাহলে সেই গণভোটে ৯৫ শতাংশ মানুষ ভারতীয় ফেডারেশন থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে ভোট দিতেও পারে। সাধারণভাবে ফেডারেল রাষ্ট্র এ অধিকার দেয় না।
॥তিন॥
এসব কথা এজন্যই বললাম যে, পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ এবং বাংলাদেশ যদি রাম বিলাস পাসওয়ান বা রাম যাদবের কথা মোতাবেক ভারতীয় ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলে তাদের ভাগ্য চিরদিনের জন্য সিল্ড হয়ে যাবে। যদি তারা কোন দিন আবার ভারতীয় ফেডারেশন থেকে বেরিয়ে আসতে চায় তাহলে তাদেরকে কাশ্মীর, পাঞ্জাব এবং উত্তর পূর্ব ভারতের ৭ বোনের পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ভারতের ঐ দুই নেতা বলেছেন যে, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের জনগণ নাকি স্বেচ্ছায় ভারতীয় ফেডারেশনে যোগ দেবে। আগামী ৫০ বছর বা ১০০ বছর পরে কি ঘটবে সে সম্পর্কে এখনই আমরা ভবিষ্যৎ বাণী করতে পারব না। কারণ আমরা গণক নই। কিন্তু পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পাল্টা প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, তারা যদি ভারতীয় ফেডারেশনেই যোগ দেবে তাহলে ভারত ভাগ করতে হয়েছিল কেন? ভারত বিভক্ত হয়েছিল জনগণের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে গিয়ে। বিভক্তির প্রশ্ন যদি ওঠে তাহলে বলতে হয় যে, অবিভক্ত ভারতের দুইটি রাজ্যকে বিভক্ত করা হয়েছে জনগণের ইচ্ছার মাধ্যমে। এই দুুইটি রাজ্য হলো পাঞ্জাব এবং বাংলা। জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে পাঞ্জাব দুই ভাগে বিভক্ত হয়। পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিম পাঞ্জাব। অনুরূপভাবে বাংলা বিভক্ত হয়ে হয় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা। পশ্চিম বাংলা ভারতীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয় আর পূর্ব বাংলা পাকিস্তান ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫৬ সালে পূর্ব বাংলার নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। বাংলাকে ভাগ না করা এবং বাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্র কথা উঠেছিল, কিন্তু কংগ্রেস ও হিন্দু নেতৃবৃন্দ তা হতে দেননি। সেটা হলে পূর্ববাংলা আর পূর্ব পাকিস্তান হতো না।
যদি ভারতীয় ফেডারেশনের অংশ হওয়ার জন্য বাংলাদেশের কোন ইচ্ছা থেকে থাকতো তাহলে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার জন্য সুবর্ণ সুযোগ। পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে পশ্চিমবাংলার সাথে যোগ দিলেই বাংলাদেশ ভারতীয় ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত হতো। কিন্তু বাংলাদেশ সেটি করেনি। পাকিস্তান ফেডারেশন থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ স্বাধীন সত্তা বজায় রেখেছে। পশ্চিমবঙ্গের ভাষা বাংলা। খাদ্যাভ্যাস এক ও বেশভূষাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এক। এক সময় পূর্ব বাংলায় ধুতির বেশ চল ছিল। কিন্তু এখন আর সে রকম নেই। সুতরাং ’৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গের সাথে মিশে যাওয়াটা খুব সহজ ছিল। তখন এ দেশে প্রচুর ভারতীয় সৈন্য ছিল। জাতির স্থপতি শেখ মুজিবও তখন পাকিস্তানের কারাগারে। এই অবস্থায় বাংলাদেশকে ভারতের সাথে এ্যানেক্স করা কিছুটা সুবিধাজনক ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালিদের স্বাধীনতার সুতীব্র আকাক্সক্ষাকে ভয় করেই ভারত সে পথে পা বাড়ায়নি। বাংলাদেশ আজও একটি স্বাধীন রাষ্ট্র রয়ে গেছে এবং ভবিষ্যতে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
তাই রাম যাদব বা পাসওয়ান বাবুরা যতই আশা ভরসা করেন না কেন জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের সুযোগ থাকলে বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশের অপর কোন দেশই ভারতীয় ফেডারেশনে যোগ দেবে না, বরং সে ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টোভাবে ঘটবে।
আসিফ আরসালান

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads