বুধবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৬

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের আহ্বান


মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লুম বার্নিকাট রাজনৈতিক দলগুলোকে অবাধে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গত সোমবার বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর দেয়া এক বিবৃতিতে রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেছেন, গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার দেশটির উন্নয়নে একটি প্রয়োজনীয় ভূমিকা রেখেছে। সে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়া দরকার। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূতকে বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আয়োজিত একতরফা সংসদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের সরকার গঠন থেকে সর্বশেষ পৌর নির্বাচন এবং বিরোধী দলের ওপর চালানো দমন-নির্যাতন পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনাপ্রবাহের উল্লেখ করে বেগম খালেদা জিয়া জানিয়েছেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়নি বলে এই সরকারের কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনও অনুপস্থিত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার একটি বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটকে আরো জানানো হয়েছে, গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। ক্ষমতাসীনরা যত উন্নয়নের কথাই বলুন না কেন, গণতন্ত্রহীনতার কারণে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ বর্তমানে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দুর্বিষহ এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। রাজনৈতিক সঙ্কটও কাটিয়ে উঠতে হবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে বেগম খালেদা জিয়া যে সমাধানের পন্থা উপস্থাপন করেছেন এবং ক্ষমতাসীনরা যে তার কোনো একটিও গ্রহণ করেননি- সে বিষয়েও জানানো হয়েছে রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটকে।
আমরা মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লুম বার্নিকাটের মূলকথা এবং অন্তরালের মনোভাবকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। বলার অপেক্ষা রাখে না, তিনি অকারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘অবাধে’ মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানাননি। বস্তুত বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার প্রধান উদ্দেশ্য থেকেই তিনি এ আহ্বান জানিয়েছেন। তার বক্তব্যে সরকারের দমন-নির্যাতন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিও এসেছে পরোক্ষভাবে। না হলে ‘অবাধে’ শব্দটির প্রয়োগ করতেন না তিনি। বলা দরকার, শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, বৃটেন, জার্মানি, কানাডাসহ আরো অনেক রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়ির ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তারা হত্যাকাণ্ড ও দমন-নির্যাতন বন্ধ করার এবং পুলিশের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ারও আহ্বান জানিয়েছে। মূলত সে কারণেই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এ পরোক্ষ বক্তব্য বাংলাদেশের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক নীতি-মনোভাব ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার যথার্থ প্রকাশ ঘটেছে। আমরা মনে করি, রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ বর্তমান সরকারের প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর প্রচণ্ড দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে।
কিছুটা ঘুরিয়ে বললেও দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট প্রসঙ্গেও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট। গণতন্ত্রই যে বাংলাদেশের শান্তি-সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য; সে কথাটারই প্রকাশ ঘটেছে তার আহ্বানের মধ্য দিয়ে। স্মরণ করা দরকার, অন্য অনেক দেশের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। তাছাড়া পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি এবং নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বিরামহীন প্রচারণাসহ আরো অনেক কারণেই বর্তমান সরকারের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের আহ্বানে সাড়া দেয়ার মধ্যেই সরকারের জন্য সম্ভাবনা রয়েছে বলে আমরা মনে করি। রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘অবাধে’ মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানানোর আড়ালে তিনি আসলে সব দল ও পক্ষের অংশগ্রহণে এমন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরামর্শ দিয়েছেন, যে নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সহিংসতামুক্ত। এ লক্ষ্যে সরকার এবং সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে আস্থা গড়ে তোলারও পরামর্শ রয়েছে তার বক্তব্যে; যাতে নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ও হয় এবং সব দল যাতে সে নির্বাচনে অবাধে অংশ নিতে পারে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের বক্তব্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। তার দেশ চায়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরে আসুক এবং সব দলের অংশগ্রহণমূলক নতুন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। আমরা মনে করি, সরকারের উচিত অবিলম্বে তার নীতি ও অবস্থানে পরিবর্তন ঘটানো এবং বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে সংলাপ শুরু করা। রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটকে জানানো হয়েছে এবং একথা সত্যও যে, বেগম খালেদা জিয়া অনেক আগেই নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে সমাধানের পন্থা উপস্থাপন করে রেখেছেন। সে কারণে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে সংলাপ এবং নির্বাচনসহ কোনো ব্যাপারেই কোনো সমস্যা হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা আশা করতে চাই- ক্ষমতাসীনরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মূলকথাগুলো অনুধাবন করবেন এবং তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads