বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৬

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট


আওয়ামী লীগ সরকার সম্পর্কে ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে ওঠার তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। গত বুধবার প্রকাশিত বার্ষিক রিপোর্টে ‘বাংলাদেশ : গভর্নমেন্ট শাটস ডাউন ক্রিটিকস’ শিরোনামের অধ্যায়ে নিউইয়র্কভিত্তিক সংস্থাটি বলেছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার ক্রমেই ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশের বিষয়টি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। দেশটিতে বিরোধী রাজনীতিকদের গ্রেফতার করে বিভিন্ন মামলা দায়ের করেছে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্যাতন, হত্যা ও গুম হওয়ার মতো গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত বছর বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ অত্যন্ত কঠিন সময় পার করেছে। সরকারের সমালোচনা করার কারণে গণমাধ্যমগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। সাংবাদিক ও সম্পাদকদের অভিযুক্ত ও গ্রেফতার করা হচ্ছে। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দু’জন রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকেও বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। রাজনৈতিক সংকট প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশটির সংসদে কার্যত কোনো বিরোধী দল নেই। কারণ, বড় দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। মনে হচ্ছে, সংসদের বাইরেও কোনো বিরোধী দলকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিতে চায় না শেখ হাসিনার সরকার। বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বিধিবহির্ভূত গ্রেফতার ও বিচারবহির্ভূত হত্যার আতংকে রয়েছে। গত বছর বিরোধী দলের আন্দোলনের আগে সহিংসতা ঠেকানোর নামে রাজপথে বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করে সরকার। এ সময় হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে আটক করার পাশাপাশি বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ রাখা হয়। এভাবে সব মিলিয়েই দমনমূলক ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে সরকার ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে উঠেছে। 
ব্লগার হত্যা এবং ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের ন্যায্য সমালোচনার পক্ষ নেয়ার কারণে ৪৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করার মতো আরো অনেক তথ্যও রয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই বার্ষিক রিপোর্টে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রিপোর্টে কোনো বিষয়েই সামান্য বাড়িয়ে বলা হয়নি। বস্তুত সরকার ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে ওঠার কারণে বিশেষ করে বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করতে পারছে না। তাদের এবং আক্রান্ত অন্য সকলের জন্যও ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। রিপোর্টে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য সঠিকভাবেই আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী তথা নিরাপত্তাবাহিনীগুলোকে দায়ী করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর রিম্যান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন, প্রতিহিংসামূলক গ্রেফতার, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলা দায়ের, গ্রেফতারের জন্য বাসা বাড়িতে তল্লাশি এবং গুম ও খুনের মতো বিভিন্ন তথ্য স্মরণ করলে স্বীকার করতেই হবে, রিপোর্টে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে সত্য ও সঠিক চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে উপর্যুপরি আহবান জানানো ও তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও গত বছর গুম ও গুপ্তহত্যাসহ মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ক্রমাগত বেড়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের ব্যাপারেও সরকার তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। হত্যার পাশাপাশি নিরাপত্তা হেফাজতে নিষ্ঠুর নির্যাতন, ঢালাও গ্রেফতার অব্যাহত থেকেছে। 
গণমাধ্যম প্রসঙ্গেও রিপোর্টে বাড়িয়ে বলা হয়নি। কারণ, সরকার সব দিক থেকেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে ফেলেছে। দৈনিক আমার দেশ এখনো প্রকাশিত হতে পারছে না, এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদকে মিথ্যা মামলায় আটকে রেখেছে সরকার। ওদিকে দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি এখনো বন্ধ রয়েছে। সরকারের গণমাধ্যম বিরোধী নীতি ও কর্মকা-ের সর্বশেষ একটি উদাহরণ হিসেবে এসেছে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে বন্ধ করার পদক্ষেপ, যা আধুনিক বিশ্বে কল্পনা করা যায় না। অন্যদিকে নিজেরা ডিজিটাল যুগের ঘোষণা দিলেও সরকার দীর্ঘদিন পর্যন্ত ফেসবুক এবং অন্য কিছু মাধ্যমকে নিষিদ্ধ রেখেছে। এখনো কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রয়েছে। এসব কারণেই বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে রচিত হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টের কোনো একটি বিষয়ের সঙ্গেই ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। বলা বাহুল্য, রিপোর্টটি সরকারের জন্য নিঃসন্দেহে সুখবর হয়ে আসেনি। তা সত্ত্বেও অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করাটাই যথেষ্ট হতে পারে না। কারণ, সবই ঘটে চলেছে জনগণের চোখের সামনে, আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্তও তারাই হচ্ছে। তাছাড়া সব দিক থেকেই রিপোর্টটিতে সত্যের প্রকাশ ঘটেছে। সুতরাং কেবলই ঘাড় বাঁকিয়ে প্রত্যাখ্যান করার মধ্যে সরকারের জন্য রেহাই পাওয়ার সুযোগ থাকতে পারে না। তেমন চেষ্টা করার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের বরং রিপোর্টের মূলকথা ও সুর অনুধাবন করা এবং সে অনুযায়ী নিজেদের সংশোধন করা দরকার। কারণ, প্রতিটি বিষয়েই তারা গণতন্ত্রের সীমা ছাড়িয়ে গেছেন, তাদের বাড়াবাড়ির ফলে দেশে মানবাধিকারের লেশমাত্রও আর অবশিষ্ট নেই। রাজনীতিক থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত প্রত্যেককেই এখন নির্যাতনের কবলে পড়ার- এমনকি বেঘোরে প্রাণ হারানোর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় থাকতে হয়। 
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যখন অভিযোগ উত্থাপন করে তখন বোঝা দরকার, এমন অবস্থা কোনো সরকারের ভবিষ্যতের জন্য শুভ হওয়ার নয়Ñ দেশের ভাবমর্যাদার কথা না হয় বাদই দেয়া গেলো। সুতরাং গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং মামলা ও গ্রেফতারসহ বিরোধী দলের ওপর দমন-নির্যাতন বন্ধ করার পাশাপাশি সরকারের উচিত জাতীয় নির্বাচন নিয়েও এখনই উদ্যোগী হওয়া। কারণ, আলোচ্য রিপোর্টে সত্যের প্রকাশ ঘটিয়ে বলা হয়েছে, দেশটির সংসদে কার্যত কোনো বিরোধী দল নেই এবং বড় দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সব দলের অংশগ্রহণে যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে সে লক্ষ্যে উদ্যোগ নেয়ার মধ্যেই সরকারের জন্য মঙ্গল নিহিত রয়েছে বলে আমরা মনে করি। ক্ষমতাসীনদের অনুধাবন করা উচিত, ‘সংসদের বাইরেও কোনো বিরোধী দলকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিতে চায় না শেখ হাসিনার সরকার’- রিপোর্টের এই কথাটুকু তাদের জন্য অশুভ পরিণতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads