মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৬

মাসতুতো ভাইদের গল্প


চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’ এই প্রবাদ আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে বহুদিন, প্রায় অনাদিকাল থেকে। এ প্রবাদ হাজার হাজার বছর ধরে অমোঘ সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত আছে। বর্তমান সরকারের আমলে এ আরও সর্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত হয়েছে। এই মাসতুতো ভাইদের একসূত্রে গ্রথিত করার জন্য রিমডেলিং করা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন নামক প্রতিষ্ঠানটিকে। শুরুতে বিএনপির শাসনামলে এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণই করা হয়েছিল স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন হিসেবে। তাতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল সমাজের সম্মানিত সর্বজনশ্রদ্ধেয় নাগরিকদের। কিন্তু ব্যক্তিত্বের সংঘাতের কারণে তা স্থিতিশীল হবার আগেই বিএনপি সরকারকে বিদায় নিতে হয়। ভাটা পড়ে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজে। বেশ কিছুকাল দুর্নীতি দমন কমিশন প্রায় নিশ্চুপ হয়ে থাকে। তারপর আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রে এদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে ক্ষমতায় আসীন হয় স্বঘোষিত জেনারেল সেনাপ্রধান মইন উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ছদ্মবেশি সামরিক সরকার।
দেশি-বিদেশি চক্রান্তের মধ্য দিয়ে এই বিশ্বাসঘাতক রাষ্ট্রঘাতী ভিনদেশি পদলেহি জে. মইন-ফখরুদ্দিন আহমদ ভিনদেশি নাগরিককে ছদ্মবেশে সামনে রেখে সংবিধান লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। আর সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এই গণতন্ত্রঘাতককে আঁচল বিছিয়ে স্বাগত জানালেন। বললেন, বিএনপিকে একেবারে পিটিয়ে তুষ বানিয়ে দাও। এর জন্য সংবিধানের তোয়াক্কা করার কোনো দরকার নেই। কারণ এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে যদি তারা ক্ষমতায় বসায়, তবে  জে. মইন সরকার যতো সংবিধানবিরোধী কাজই করুক না কেনো, আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে তার বৈধতা দেবে। অর্থাৎ, তাদের সকল অপকর্মের জন্য দেওয়া হবে দায়মুক্তি। যে দায়মুক্তি নিয়ে কতো কথা বলেছেন শেখ হাসিনা, সেই শেখ হাসিনাই ঘোষণা দিলেন অবৈধতার দায়মুক্তির এবং সে দায়মুক্তি তিনি এই অপরাধীদের দিয়েছেন। আর তাদের নিরাপদে দেশ থেকে পালিয়ে বিদেশে গিয়ে আশ্রয় নেবার সুযোগ করে দিয়েছেন।
একইভাবে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হঠিয়ে ১৯৮২ তে যখন সেনাপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখনও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আই অ্যাম নট আনহ্যাপি। তারপর এরশাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি সব কিছুই করেছেন। এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাবার সর্বদলীয় ঘোষণা সত্ত্বেও এরশাদ ঘোষিত নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাকে সাংবিধানিক বৈধতাও দিয়েছেন। সে কথা শেখ হাসিনাকে এরশাদ মাঝেমধ্যেই স্মরণ করিয়ে দিতে ভুল করেন না। এরশাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার সেই গাঁটছড়া এখনও অব্যাহত আছে। এরশাদের ক্ষয়িষ্ণু দল জাতীয় পার্টি এখনও আওয়ামী লীগের মহাজোট সরকারের একটি প্রধান শরিক দল। এ ক্ষেত্রে মেনন-ইনু এমনই মাইক্রোস্কোপিক দল যে, তাদের কথা মুখে না আনলেও চলে। তারাও এক সময় তুমুল এরশাদ ও জাতীয় পার্টি বিরোধী ছিলেন। এখন শুধু পাশাপাশি নয়, গলায় গলায় আছেন এরশাদের। এর সবই মাসতুতো ভাইদের গল্প।
এখন আমাদের সমাজে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় পুলিশের ধারাবাহিক অনৈতিক আচরণ। পুলিশ ডাকাতি করছে। পুলিশ জিম্মি করছে। পুলিশ মুক্তিপণ আদায় করছে। রাত হলেই এরা দল বেঁধে হিং¯্র হায়েনার মতো শিকারের সন্ধানে রাজপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে রকম অবস্থার শিকার হয়েছেন সম্প্রতি দু’জন সরকারি কর্মকর্তা। এদের একজন বাংলাদেশ ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বি। অপরজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা বিকাশ দাস। বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি নেবার আগে গোলাম রাব্বি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপকের কাজ করেছেন। সংবাদপত্রে ফিচার লিখেছেন। সমাজে মোটামুটি পরিচিত মুখ গোলাম রাব্বি। গত ৯ জানুয়ারি রাতে একটি এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে বের হওয়া মাত্রই মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদের নেতৃত্বে একটি পুলিশ ভ্যানে কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে তাকে জোর করে তুলে নেওয়া হয়। রাব্বিকে বলা হয়, তার কাছে ইয়াবা আছে। রাব্বি যতো অস্বীকার করেন, ততো তাকে পিটায় পুলিশ। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোনো জায়গাই বাদ রাখে না। আর তার কাছে পাঁচ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করতে থাকে এসআই মাসুদ। টাকা না পেলে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে তাকে ক্রস ফায়ারে দিয়ে হত্যা করে ভেরি বাঁধে ফেলে দেয়ারও হুমকি দিতে থাকে। ঘণ্টা পাঁচেক তারা মাসুদকে আটকে রাখে। কিন্তু থানায় নিয়ে যায় না। এই সময়ে রাব্বি যা দেখতে পান, তা আরও ভয়ঙ্কর। এই পুলিশের দল রাস্তা থেকে যাকে-তাকে ধরছে। গাড়িতে তুলছে। টাকা আদায় করছে। টাকা দিতে না পারলে নির্যাতন করছে। লকআপে ভরছে। আবার শিকারের সন্ধানে বের হচ্ছে।
রাব্বি সরকারি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ, ঐ ঘরানার বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তা, সরকারি কর্মকর্তা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরকেও ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। তাকে নির্যাতনের সময় তিনি এসব ব্যক্তিকে ফোন করার সুযোগ চান। বার বার নিজের পরিচয়পত্রও দেখান। কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হচ্ছিল না। এসআই মাসুদের এক দাবি, টাকা দাও চলে যাও। নইলে ইয়াবা রাখার ‘দায়ে’ ক্রসফায়ারে মরো। তার  এতোসব পরিচয় ব্যবহার করে রাব্বি যেন বিপদ আরও বাড়িয়ে তুলছিলেন। আরও অশ্রাব্য গালিগালাজ তাকে শুনতে হচ্ছিল। গোলাম রাব্বির কাছে ছিল এ এক দুঃস্বপ্ন। হাসপাতালের বেডেও তাই তিনি অবিরাম প্রলাপ বকছেন নির্ঘুম রাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমানও পুলিশ প্রধানের কাছে এর বিচার দাবি করেছেন। এ সম্পর্কে মোহাম্মদপুর থানার ওসি সেই মাসতুতো ভাইয়ের মতোই আচরণ করেছেন। বলেছেন, পুলিশ তাকে সার্চ করতে চেয়েছিল। তিনি সহযোগিতা করেননি। উল্টো রিঅ্যাক্ট করেছেন। পুলিশ কোনো দোষ করে থাকলে তদন্ত করে দেখা হবে। ব্যস, ওসির দায়িত্ব শেষ। এদিকে দু’দিন আগে গভীর রাতে রাব্বির কেবিনে গিয়ে অজ্ঞাত পরিচয় দু’জন লোক তাকে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেবার হুমকি দিয়ে এসেছে। অন্যথায় তাকে প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হয়। পুলিশ মাসতুতো ভাইদের এভাবেই রক্ষা করার চেষ্টা চালায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বিকে নিয়ে এই তুলকালাম কাণ্ডের পর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে পুলিশ ঘটিয়েছে আর এক ঘটনা। গত ১৫ জানুয়ারি রাজধানীর হাজারিবাগ খালপাড় এলাকায় ভোর পাঁচটার দিকে সাদা পোশাকের একদল পুলিশ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের পরিদর্শক বিকাশ কুমার দাশকে নির্মমভাবে পিটিয়ে একেবারে অজ্ঞান করে রাস্তায় ফেলে রাখে। বিকাশ ভোরে মোটর সাইকেলে করে তার কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। ঐ পুলিশ দল তার পথ আটকালে তিনি তাদের ছিনতাইকারী ভেবে মোটর সাইকেল জোরে টান দিয়ে এলাকা পার হয়ে যাবার চেষ্টা করছিলেন। তখন পুলিশেরা রাইফেলের বাঁট দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করলে তিনি রাস্তায় পড়ে যান। তিনিও তার পরিচয় দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। এরপরও পুলিশ তাকে বেধড়ক পেটাতে থাকে। তখন পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা এগিয়ে এসে তার পরিচয় নিশ্চিত করেন। কিন্তু তাতেও পুলিশ নিবৃত্ত হয়নি। পিটাতেই থাকে। তখন পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা তাদের পায়ে ধরে অনুরোধ করতে থাকেন। তবুও শোনেনি পুলিশ কারও কথা। পুলিশ বরং বলেছে, ‘মাছের রাজা ইলিশ আর দেশের রাজা পুলিশ’। পুলিশ দেশের রাজা হয়ে গেছে। অতএব সাবধান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হয়ে বিকাশ এখন ল্যাবএইড-এর ইনটেনসিভ কেয়ারে চিকিৎসাধীন। রাব্বি ও বিকাশ উভয় ক্ষেত্রেই পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত রাব্বির মামলা গ্রহণ করতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্ট বলেছেন, এসআই মাসুদ একজন ক্রিমিনাল, তাকে বহিষ্কার করুন। সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন যে, পুলিশ আর সাদা পোশাকে ডিউটি করতে পারবে না। অন্তত কোটি গায়ে দিতে হবে। এর আগেও আমরা দেখেছি, পুলিশ-র‌্যাবের কোটি গায়ে দিয়ে অপহরণ ডাকাতির ঘটনা অহরহ ঘটেছে। তবে ব্যবস্থা হিসেবে প্রথমে রাব্বি ও বিকাশের হামলাকারীকে ‘ক্লোজড’ করা হয়। কিন্তু তার অন্য সহযোগীরা আছে বহাল তবিয়তে। আর  ক্লোজড করা কোনো শাস্তি নয়। তাকে কোনো কাজ না দেওয়া। এভাবে ক্লোজড করার নামে হামেশাই অপরাধী পুলিশদের নিষ্কৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা চালু আছে পুলিশ বিভাগে। ডামাডোল কিছুটা কমে এলে তাদের আবার স্বপদে বহাল করা হয়। কিংবা দূরে কোথাও বদলি করে দেওয়া হয়। মাসতুতো ভাইদের কাহিনী এ রকমই। কিন্তু গত সোমবার ঢাকার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বিশাল মিছিল ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। তাদের দাবি, বিকাশ দাশের ওপর হামলাকারীদের বিচার না হলে তারা রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা বন্ধ করে দেবেন।
এর মধ্যে ঘটেছে আর এক ঘটনা। গত ১৬ জানুয়ারি বরিশালের আগৈলঝাড়ায় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও কাঠ ব্যবসায়ী আবু সেরনিয়াবাতের ছেলে বাবু সেরনিয়াবাত রাস্তার পাশে কাঠ রেখে পাশের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন। তখন ঐ পথ দিয়ে একটি পিকআপে যাচ্ছিলেন থানার ওসি মনিরুল ইসলাম। পিকআপের সঙ্গে কাঠের ধাক্কা লাগায় ‘দেশের রাজা’ ওসি গাড়ি থেকে নেমে বাদলকে বেধড়ক পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করেন। বাদলকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা এমপি আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর বাসার সামনে নিয়ে যান। ওদের সেখানে দেখে ওসির নির্দেশে তার গাড়ি চালক বাদলকে আর এক দফা পেটায়। তখন  তাকে স্থানীয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান। বিষয়টি পুলিশ সুপার আখতারুজ্জামানকে জানালে তিনি গাড়ির চালককে যথারীতি ক্লোজড করেন। ওসি আছেন বহাল তবিয়তে। পুলিশ বলেছে, বাদল ‘সামান্য’ আহত হয়েছে মাত্র।
আজকের মতো মাসতুতো ভাইদের শেষ গল্প ঘুষের টাকা ফেরত দেয়া নিয়ে। নাটোরের গুরুদাসপুরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার নামে চাঁদা নিয়েছিলেন যুবলীগ নেতা ইউনুস আলী বাবু। সেই টাকা ফেরত দিয়ে এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস। প্রত্যেককে খামে করে টাকা ফেরত দেয়ার সময় তিনি বলেছেন, ‘সরকারের উন্নয়নমূলক কোনো কাজে গুরুদাসপুরে কোনো নেতাকে টাকা দিতে হবে না।’ বিনামূল্যে গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার নিয়ম থাকলেও ঐ যুবলীগ নেতা গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। এ নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়ে। ঐ যুবলীগ নেতা ৪০ জন গ্রাহকের প্রত্যেকের কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকা করে মোট এক লাখ টাকা আদায় করে। এর আগেও এক সরকার সমর্থক নেতা টাকা আদায় করেছিল। তাও ফেরত দেয়া হয়। এবার টাকা ফেরত দিতে ছয় মাস গড়িমসি করেন ঐ যুবলীগ নেতা। ফলে সবকিছু ঠিক থাকলেও গ্রাহকদের বিদ্যুৎ  পেতে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হয়। এলাকায় এমপির নামে ধন্য ধন্য পড়লেও এর মধ্যে কোনো যোগসাজশ নেই, সেকথা কেউ বিশ্বাস করছে না।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads