মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট, ২০১৫

কঠিন নোংরা ও বিপদসঙ্কুল কাজ


১৯৭২ সাল থেকে দৈনিক বাংলায় আমার সহকর্মী ছিলেন মরহুম মোজাম্মেল হক। বয়সে ছিলেন আমার চেয়ে বছর চারেকের বড়। তার তাৎক্ষণিক রসবোধের কারণে তিনি সবার কাছে প্রিয়ভাজন ব্যক্তি ছিলেন। সকল মতপথের সাংবাদিকদের সঙ্গে তার ছিল সমান সৌহার্দমূলক সম্পর্ক। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন দু’ দু’বার করে। ১৯৯১-৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি ছিলেন তার সফল প্রেসসচিব। সে সময় আমাকেও দৈনিক বাংলা থেকে প্রেষণে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতালেখক হিসেবে (উপপ্রেসসচিব) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
যাই হোক, এই মোজাম্মেল ভাই একদিন বললেন, আর বাংলাদেশে থাকবেন না। লন্ডন চলে যাবেন। কী করবেন সেখানে গিয়ে? জবাবে তিনি বললেন, বেশি বেশি টাকা কামাবো। এত কম বেতনের চাকরিতে আর পুষছে না। সেখানে গিয়ে কী কাজ করবেন, না করবেন, সে বিষয়ে তাকে আর কোনো প্রশ্ন করিনি। তারপর একদিন মোজাম্মেল ভাই সত্যি সত্যি লন্ডন চলে গেলেন। কিন্তু বছর খানেক না যেতেই আবার ফিরে এলেন মোজাম্মেল ভাই এবং ফের দৈনিক বাংলায় যোগ দিলেন। এর কিছুকাল পরে আমি আর একটি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় প্রায় দেড় গুণ বেতনে সহকারী সম্পাদকের চাকরির অফার পেলাম। বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতে গেলাম মোজাম্মেল ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি একেবারে  রা রা করে উঠলেন। বললেন, দৈনিক বাংলার চাকরি কিছুতেই ছেড়ো না।
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। দেড়গুণ বেতন। বছরে ছয়টা বোনাস। আরও কত সুবিধা। মোজাম্মেল ভাই একবারে আমার হাত ধরে রাখলেন। বললেন, শোনো আমি তো এরই মধ্যে একাধিক পত্রিকায় চাকরি করে এলাম। চাকরি বদলালাম। বিদেশে গিয়েও কাজ করে এলাম। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, চাকরি করার জন্য বাংলাদেশ হলো একেবারে বেহেশ্ত। আর দৈনিক বাংলা হলো জান্নাতুল ফেরদৌস। এই চাকরি ছেড়ো না। পরে আফসোস করবে। নইলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করে ফেলো। বিশ্বদ্যিালয়ের চাকরিও জান্নাতুল ফেরদৌসের কাছাকাছি।
এরপর মোজাম্মেল ভাই আমাকে তার লন্ডনের চাকরির গল্প শোনালেন একবার আড্ডা দিতে দিতে। বললেন, লন্ডনেও তিনি সংবাদপত্রেই চাকরি করেছেন। সকালে রিপোর্ট সংগ্রহ করতে বের হতেন। ফিরে আসতেন বিকালে। এসে টাইপ করতে বসতেন। টাইপ করে সম্পাদনা, মেকআপ, এরপর কাগজ ছাপা হয়ে গেলে গাড়িতে করে সে কাগজ স্টেশনে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে ফিরতে হতো ঘরে, রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বারোটায়। বেতন ভালো। চাকরি এই। তাহলে তুমি দৈনিক বাংলার চাকরিকে কেন জান্নাতুল ফেরদৌস বলবে না? আমি থমকে গেলাম। চাকরি পরিবর্তনের কথা আর ভাবিনি।
মালয়েশিয়ার চাকরি নিয়ে এখন সারা দেশে তুমুল আলোচনা চলছে। মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আহমেদ জাহিদ হামিদ বলেছেন যে, কঠিন, নোংরা ও বিপদসঙ্কুল কাজের জন্য মালয়েশিয়া সরকার বিদেশ থেকে ১৫ লাখ শ্রমিক নেবে, যার বেশির ভাগই তারা নিতে চান বাংলাদেশ থেকে। গত ০৮ আগস্ট সে দেশের সংবাদপত্র স্ট্রেইট টাইমস এ খবর দিয়েছে। আর এই চাকরির জন্য এক একজন শ্রমিককে খরচ করতে হবে মাত্র ৬০ হাজার টাকা। যেদেশে একটা পিয়নের চাকরির জন্য এক দেড় লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়, সেদেশ থেকে মাত্র ৬০ হাজার টাকায় বিদেশে চাকরি! এ তো কল্পনারও অতীত। কিন্তু আমাদের অদক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে বিদেশে চাকরির একটা দুর্দান্ত মোহ আছে। তাতে দোষের কিছু নেই। এর মাধ্যমে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা যেমন নিজেদের ভাগ্য বদল করতে পারেছে, তেমনি দেশের ভেতরে রেমিট্যান্স প্রবাহেও অবদান রাখছে। বর্তমানে আমাদের ২৫ বিলিয়ন ডলারের যে রিজার্ভ, তার অর্ধেকেরও বেশি রেমিট্যান্স। এটা কোনো দেশের অর্থনীতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়।
আমাদের দেশের ৮৬ লাখ মানুষ বিদেশে চাকরি করেন। কিন্তু তাদের প্রায় ৯০ ভাগই অদক্ষ শ্রমিক। ফলে আয়ও তাদের কম। এদিকে আবার এই ৮৬ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৩৭ শতাংশই কাজ করেন সৌদি আরবে, ২৬ শতাংশ সংযুক্ত আরব আমীরাতে, ১০ শতাংশ মালয়েশিয়ায়, ওমানে চাকরি করেন ০৬ শতাংশ। কিন্তু দেশে বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করায় সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ায় প্রবাসী কর্মীরা বিনিয়োগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। কেউ দেশে বিনিযোগ করতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গে সরকারি দলের স্থানীয় মাস্তানরা চাঁদা দাবি করে বসে। শুধু কি প্রবাসী শ্রমিকদের কাছে? যে কেউ এখন যে-কোনো শহরে ঘর-বাড়ি দোকানপাট করতে গেলে আওয়ামী মাস্তানদেন চাঁদা দিতে হচ্ছে। এটা ঘটছে সরকারের চোখের সামনে। আজ পর্যন্ত সরকার কারও বিরুদ্ধে এ জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থান নিয়েছে, এমর খবর জানা যায় না। উপরন্তু কিছুদিন আগে বাড়ি নির্মাণ করতে চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী মাস্তানরা একজনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। ফলে অর্জিত টাকায় তারা বিলাস সামগ্রী কেনে, ঘরবাড়ি বানায়। তাতে খরচ হয়ে যায় তাদের উপার্জিত টাকার ৮০ ভাগেরও বেশি।
ফলে রেমিট্যান্স দেশের সামগ্রিক অর্থনৈকিত কল্যাণে তেমন কোনো অবদান রাখতে পাছে না। ইপরন্তু সরকারের ভুল কূটনীতির কারণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানি প্রতিদিনই কমছে। এদিকে আবার সরকারি পরিসংখ্যানমতেই দেশে প্রতিবছর তিন লক্ষের বেশি তরুণ বেকারের কাতারে যোগ দিচ্ছে। কাজের জন্য তারা রানা প্লাজার মতো কোনো মৃত্যুকূপে ঢুকছে অথবা বিপদসঙ্কুল মৃত্যুযাত্রায় সমুদ্র দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে অজানা গন্তব্যে। তারপর শিকার হচ্ছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ আর নির্যাতনের।
এই প্রেক্ষাপটেই আসছে মালয়েশিয়ায় চাকরির অফার। মালয়েশিয়া সরকার এ বিষয়ে কোনো রাখঢাক করেনি। তারা বলেছে, বাংলাদেশ থেকে যে জনশক্তি আমদানি করা হবে এবং তাদের যে কাজ দেওয়া হবে, তা হবে কঠিন, নোংরা ও বিপদসঙ্কুল। জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে সরকার যে একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠান, তা প্রমাণের জন্য কাগজ কলম নিয়ে বসার দরকার নেই। তা না হলে বিগত তিন বছরে মালয়েশিয়ায় সরকারিভাবে যেখানে তিন লক্ষ লোক রফতানির কথা, সেখানে রফতানি হয়েছে মাত্র সাত হাজার লোক। ফলে সরকার টু সরকার ব্যবস্থা (জি২জি) ভেস্তে গেছে এবং মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি অগ্রসর হতে পারেনি। তিন বছর পর আবারও বেসরকারিভাবে জনশক্তি রফতানির সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এখানে বেসরকারি রফতানিকারকদের প্রতারণার আশংকা আমরা উড়িয়ে দেই না। কার্যত মালয়েশিয়ার বন্দী শিবিরে আটকে রেখে বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাদের দিয়ে যে ধরনের কাজ করানো হয়েছে, কঠিন, নোংরা ও বিপদসঙ্কুল কাজ বলতে সে ধরনের কাজকেই বোঝানো হয়েছে। বন্দী শিবির থেকে এক্ষেত্রে  যা পার্থক্য, তা হলো, বন্দী অবস্থায় উপযুক্ত বা প্রতিশ্রুত বেতন পাওয়া যায়নি। কিন্তু আশা করা যায় যে, বর্তমান ব্যবস্থায় তারা প্রতিশ্রুত বেতন পাবেন। তবে কাজ একই থাকবে। অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য এসব কাজ রাবার বাগান বা পাম বাগানেই হবে। সেখানে সাপ-খোপ, হিংস্র বন্যপ্রণীর সঙ্গে লড়াই করেই তাদের চাকরি করতে হবে। বসবাস করতে হবে জনবিরল দুর্গম এলাকাতেই। আর এটাও ধারণা করি যে, তারা যাতে কাজ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে, তার জন্যও বাগানমালিকরা পাহারারও ব্যবস্থা রাখবে।
এক্ষেত্রে যা দরকার, তা হলো রিক্রুটিং এজেন্ট বা সরকারের তরফ থেকে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা, যাতে সেখানে কোনো মানবেতর পরিবেশের সৃষ্টি না হয়। আর যেসব অদক্ষ শ্রমিক সেখানে যাবেন, তাদেরও ভালো করে তাদের কাজের ধরন বুঝিয়ে দিতে হবে। যাতে তারা গিয়েই কষ্টের অভিযোগ তুলতে না পারেন। এছাড়া সেখানে আধাদক্ষ আর এক শ্রেণীর কর্মীও নিয়োগ করা হবে। যারা ওয়েলডিং, রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রী, স্যানিটারি মিস্ত্রীর কাজ জানেন। তাদের কাজ হয়তো নোংরা নয়, কিন্তু কঠিন ও বিপদসঙ্কুল। আমরা মনে করি মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রফতানির ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে শ্রমিকদের আগাম সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। যাতে তারা ঐ চাকরিকে বেহেশততুল্য মনে না করেন।
ইউরোপের বহু দেশের অভিযোগ আছে, তারা বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিয়োগ করে তাদের ওপর নির্ভর করে কোনো প্রকল্প চালাতে পারেন না। কারণ বাংলাদেশের শ্রমিকরা সুযোগ পেলেই তাদের কাজ ছেড়ে দিয়ে ভিন্ন কোনো দেশে পাড়ি জমান। এতে তাদের প্রকল্প মার খায়। সেক্ষেত্রে ইউরোপীয় নিয়োগকর্তাদের বক্তব্য হচ্ছে, যেতে চাইলে তারা যাক, কিন্তু যত দিনের চুক্তিতে তারা কাজ নিয়েছে ততোদিন করে দিয়ে যাক। তাতে তারা ফের নতুন শ্রমিক নিয়োগের সুযোগ পাবেন। এই অনিয়মের ফলে ইউরোপের অনেক দেশেই বাংলাদেশের শ্রমিক নিয়োগে ব্যাপক ধস নেমেছে। আশা করি সরকার ও রিক্রুটিং এজেন্টরা এ বিষয়ে মনোযোগী হবেন।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads