বুধবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৫

আসলেই কি বন্দুকযুদ্ধের নাটক?


কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যাকাণ্ড কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমাদের রাজনীতিবিদরা সোচ্চার। সরকারি কিংবা বিরোধী ঘরানার নেতৃবৃন্দ এ ক্ষেত্রে যেন একই কাতারে সামিল। তারপরও দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে। ফলে জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানী ঢাকায় ও মাগুরায় ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক দুই নেতা পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। দু’জনেরই আপনজনরা বলছেন, তাদের ধরে নিয়ে হত্যা করে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নাটক সাজানো হয়েছে। এরপর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা বলছেন, তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মেনে নেবেন না। আর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন- সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে, অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে।
উল্লেখ্য যে, রাজধানীর হাজারীবাগে গত ১৮ আগস্ট ভোর সাড়ে চারটার দিকে র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান হাজারীবাগ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি আরজু মিয়া (২৮)। রাজা মিয়া (১৬) নামে এক কিশোরকে চুরির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যার প্রধান আসামী ছিলেন আরজু মিয়া। আরজুর মাথার ডানে-বাঁয়ে তিনটি ও বুকের বাঁ থেকে ডান পর্যন্ত সারি ধরে আরও তিনটি গুলীর ছিদ্র পাওয়া গেছে। স্বজনদের দাবি, সন্ধ্যায় তাকে ধরে নিয়ে ভোরে হত্যা করেছে র‌্যাব। এদিকে মাগুরায় ছাত্রলীগের গোলাগুলীতে মায়ের জঠরে শিশু গুলীবিদ্ধ ও একজন বৃদ্ধ নিহত হওয়ার মামলায় তিন নম্বর আসামী মেহেদী হাসন ওরফে আজিবর শেখ (৩৪) ১৭ আগস্ট সোমবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে মাগুরার পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। আজিবর মাগুরা পৌর ছাত্রলীগের আগের কমিটির নেতা ছিলেন। নিহতের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, সোমবার বিকেলে আজিবরকে শালিখা থানা এলাকা থেকে ধরে এনে সদর থানা এলাকায় হত্যা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের  আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় একাধিক খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। বাড্ডায় ঝুট ব্যবসা নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের তিন নেতা হত্যা, জাতীয় শোক দিবসের দিন কুষ্টিয়ায় এক যুবলীগ নেতা হত্যা এবং চাঁদপুরের কচুয়ায় চাঁদার দাবিতে স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রীদের ওপর যুবলীগের হামলার ঘটনা ঘটে। দলীয় নেতা-কর্মীদের এ ধরনের অপরাধপ্রবণতায় ইমেজ সংকটে পড়েছে সরকারি দল ও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। এমন পরিস্থিতিতে কঠোর অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে এক অনির্ধারিত আলোচনায়ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অপরাধী দলের হলেও ন্যূনতম কোনো সহানুভূতি দেখানো হবে না বলে জানিয়ে দেন। এরপরই দু’টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটলো। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই সরকারের আমলে অনেকগুলো বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটলেও দলের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু এবার সরকারি দলের দুই নেতা-কর্মী বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনায় আওয়ামী লীগে ও ছাত্রলীগে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তারা প্রকাশ্যে এর বিরুদ্ধে  বক্তব্য দিয়েছেন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা বলছেন, তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মেনে নেবেন না। অপরদিকে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন- সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে, অ্যাকশান শুরু হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আবার আলোচনায় চলে এসেছে। অনেকেই বলছেন, আইনের শাসন না থাকায় এবং অনুরাগ ও বিরাগের সংস্কৃতি অব্যাহত থাকায় সরকারি দলের লোকজন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং তারা হত্যা, নির্যাতন ও নানা অপরাধমূলক ঘটনার সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে। তারা মনে করেন, অপরাধ কিংবা সন্ত্রাসমূলক ঘটনা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আচরণ হতে পারে না। বরং সুশাসন তথা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই অপরাধ, সন্ত্রাস ও বেপরোয়া মনোভাবের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টাই হবে সরকারের জন্য যৌক্তিক।
বর্তমান সময়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের চালচিত্র নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। রাজনীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল দেশ ও জনগণের কল্যাণ এবং উন্নত সমাজ বিনির্মাণ। এমন কাজতো আদর্শিক ভাবনা ও নৈতিক মেরুদ- ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে যে কোনো প্রকারে ক্ষমতা দখলের বিষয়টি রাজনীতিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠায়, আদর্শ ও নৈতিকতা রাজনৈতিক অঙ্গনে গৌণ বিষয় হয়ে উঠেছে। ফলে রাজনীতিতে পেশীশক্তি ও দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নের এই দায় আর কাউকে নয়, রাজনীতিবিদদেরই বহন করতে হবে। এর জবাব একদিন তাদের জনগণের আদালতে দিতে হবে, পরকালে দিতে হবে মহান প্রভুর আদালতে।
সরকারি দল ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের অপতৎপরতা এখন এতটাই বেড়ে গেছে যে, স্বয়ং মন্ত্রীরাও এখন এর বিরুদ্ধে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছেন। গত ১৮ আগস্ট মঙ্গলবার জাতীয় শোকদিবস উপলক্ষে রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মোহসিন আলী বলেছেন, লম্পট ছেলেরা এখন ছাত্রলীগ ও যুবলীগ করছে। পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছুলে মন্ত্রীরাও নিজ দলের কিংবা অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ব্যাপারে এমন মন্তব্য করতে পারেন। আমরা জানি, অযথা কাউকে ছোট কিংবা বড় করা সাংবাদিকদের কাজ নয়। কখনো কখনো পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরতে কিছু চিত্র বা তথ্য তুলে ধরতে হয়। আর আমরা একথাও জানি যে, ব্লেমগেমের মাধ্যমে কোনো সমস্যার সমাধান করা যায় না। আর ব্লেমগেম কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের সংস্কৃতি হতে পারে না। তবে রাজনৈতিক সমস্যা বা সংকটের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা প্রয়োজন। সংকটের কারণ ও সমাধান বিশ্লেষণ করতে গেলে কখনো কখনো ব্যক্তি কিংবা সংগঠনের নামও এসে পড়ে। তবে এমন বিশ্লেষণে অনুরাগ ও বিরাগের প্রবণতা পরিত্যাগ করা প্রয়োজন। কারণ দলকানা মনোভাব নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ করা হলে তা অর্থবহ কোনো অবদান রাখতে পারে না। বিভিন্ন সময়ে আমরা পত্র-পত্রিকা ও টকশোতে দলকানা আলোচনার নানা মাত্রা লক্ষ্য করেছি। বকাবকি, গালাগালি এবং হাতাহাতির অগণতান্ত্রিক প্রবণতাও লক্ষ্য করেছি। এমন অসহিষ্ণুতা ও দলকানা মনোভাবের কারণে অনেক লেখক ও আলোচকরা জনমনে তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। আসলে দলকানা মনোভাব নিয়ে দল কিংবা দেশের কল্যাণ করা যায় না। কল্যাণের জন্য প্রয়োজন আদর্শের রাজনীতি। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পেরেছে। কিন্তু তাঁর আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি। ভবিষ্যতেও আর পারবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চিরজাগ্রত। বাঙালি জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। যত বাধা ও বন্ধুর পথই আসুক না কেন, বাঙালি জাতি এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাবে। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে গত ১৩ আগস্ট জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ‘চিত্রগাঁথায় শোকগাথা’ শীর্ষক ছবি প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি উপরোক্ত বক্তব্য পেশ করেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, মানুষকে হত্যা করা গেলেও আদর্শকে কখনো হত্যা করা যায় না। আদর্শ তার আপন মহিমায় প্রোজ্জ্বল থাকে। তবে আদর্শকে ধারণ করতে হয়, চর্চা করতে হয়। আদর্শের চর্চা হলে মানুষ সমৃদ্ধ হয় এবং তার প্রভাব পড়ে সমাজে ও রাষ্ট্রে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ও ব্যক্তিগত আচরণে যে সব উত্তম উদাহরণ রেখে গেছেন, তার অনুসরণ বর্তমান সময়েও খুবই প্রাসঙ্গিক। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা। তাঁরা কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালনে সক্ষম হলে, তাতে শুধু আওয়ামী লীগই সমৃদ্ধ হবে না- উপকৃত হবে দেশ ও জনগণ।
দুঃখের বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের আদর্শকে ধারণ করতে সক্ষম হচ্ছে না। ফলে দল ও সরকারকে পড়তে হচ্ছে বিব্রতকর অবস্থায়। এমনকি ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার সময়ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে গোলাগুলীর ঘটনা ঘটে যায়। গত ১৩ আগস্ট রাজধানীর বাড্ডায় গোলাগুলীর এমন ঘটনায় ৩ জন নিহত হয়েছে। এমন ঘটনা রাজধানীর বাইরেও লক্ষ্য করা গেছে। কুষ্টিয়ায়ও নিহত হয়েছে ১ জন। বাড্ডার ঘটনা প্রসঙ্গে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, গরুর হাটের ইজারা নিয়ে দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন কারণে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। ১৪ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। ভাবতে অবাক লাগে, বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছেন, দল করেছেন দেশ ও জনগণের স্বার্থে; আর এখন তার অনুসারী বলে দাবিদার অনেকেই দল করছেন প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থ-সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য তথা আত্মস্বার্থে। এমন নেতা-কর্মী দিয়ে আদর্শের রাজনীতি সম্ভব নয়। তাই ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চিরজাগ্রত’ রাখতে হলে আওয়ামী লীগের এখন ক্ষমতার রাজনীতির চাইতেও আদর্শের রাজনীতির প্রতি অধিকতর মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। আর এই বিষয়টি শুধু আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য দলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে সংশ্লিষ্ট মহল এ বিষয়ে কতটা সাড়া দেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads