বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৫

মুক্ত মতামত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে


সংবাদ মাধ্যমের সত্যিকারের কিছু স্বাধীনতা প্রথম আসে যুক্তরাষ্ট্রে। তাও ক্ষণস্থায়ী হয়। কারণ শিগগিরই সংবাদ মাধ্যমগুলো বিভিন্ন গোষ্ঠীর মুখপাত্র হবার কারণে, তাদের স্বাধীনতার স্বরূপ বিভিন্নœভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। তবুও মার্কিন সংবাদমাধ্যম তাদের অভ্যন্তরীণ তথ্য প্রবাহে নির্মোহতা আনতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তথ্য প্রবাহের সংকট তাতে কখনোই যায়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয় অনেকগুলো কালজয়ী ছবি, যেখানে শৃঙ্খলিত মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ও নিয়ন্ত্রিত সংবাদ প্রবাহের অপূর্ব প্রকাশ ঘটেছে। বিশ্বযুদ্ধ এবং এর পরে মার্কিনীদের পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন শক্তিতে তাদের সংবাদ মাধ্যমগুলোর অবস্থান চিহ্নিত করা হয়। এখানে তারা তাদের স্বদেশের ব্যাপারে নিরপেক্ষ, নির্মোহ হবার চেষ্টা করেছে। কিšুÍ সারা বহির্বিশ্বের জন্য তারা ব্যবহৃত হয় বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের তথ্য হাতিয়ার হিসেবে।
সংবাদপত্র চলে তথ্য বিক্রি করে। পাঠক যিনি, তিনি তার প্রয়োজনীয় তথ্য সংবাদপত্রে খোঁজেন। সেই তথ্য পাওয়ার জন্য পয়সা দিয়ে তারা সংবাদপত্র কিনেন। এভাবে একটা বিনিময় মূল্যের পরিবর্তে পাঠককে যে তথ্য দেয়া হচ্ছে, সেই তথ্য সঠিক হতে হবে। না হলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। অর্ধসত্যের জায়গা সংবাদপত্রে নেই। কারণ, অর্ধসত্য পাঠককে মিথ্যা ও বিভ্রান্তির দিকে ধাবিত করে। দেশ ও সমাজের কাজে লাগবে সে রকম তথ্য অগ্রাধিকার দিয়ে সংবাদপত্রে পরিবেশন করা উচিত। দেশ ও সমাজের কাছে সাংবাদিকরা এভাবেই দায়বদ্ধ।
তথ্য সঞ্চালক হিসেবে সংবাদপত্রের ভূমিকা অসামান্য। এটা পাঠকদের জ্ঞানদান ও সূক্ষ্ম সমালোচনা করতে সাহায্য করে। সংবাদপত্রের তথ্য সঞ্চালকের ভূমিকা কেবলমাত্র স্পেশালাইজড রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, সমকালীন বিশ্বের কোথায় কি হচ্ছে সংবাদপত্রের মাধ্যমে পাঠক তা জানতে পারছে। এছাড়াও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পাঠকের সামনে এমন সব দ্বার উন্মোচন করে যা হয়তো সংবাদপত্র না থাকলে তাদের কাছে চিরদিনই অজানা ও অচেনা থেকে যেত।
তৃতীয় বিশ্বের সাংবাদিকগণ নিবর্তনমূলক আইনের আওতায় নির্যাতিত হন; আর প্রথম বিশ্বের সাংবাদিকরা (সম্মানজনক ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে) লজ্জিত হচ্ছেন, অন্যায়কে হজম করছেন অথবা আত্মসমর্পণ করছেন আইন ছাড়াই।
মিডিয়াপ্রেমী হওয়া অতটা সহজ নয়। উল্টাপাল্টা রিপোর্ট লিখে সংবাদপত্র যে কাউকে হয়রানি করতে ও যন্ত্রণা দিতে পারে। আবার ব্যক্তিগত জীবনের পর্দা সরানোর মাধ্যমে কারও জীবনকে একেবারে শেষও করে দিতে পারে। আসলে অল্প-বিস্তর ক্ষতি ছাড়া মহৎ কল্যাণকর কোন কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়- এই শাশ্বত সত্যটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিষয়টির সঙ্গেও প্রচ্ছন্নভাবে জড়িত। সংবাদপত্র ক্ষমতার অপব্যবহার করবে না। এই বোধ তার অবশ্যই থাকতে হবে। সেই সঙ্গে আসবে সুস্থ প্রতিযোগিতার বিষয়টিও।
পাঠকদেরও পরিস্কার ধারণা থাকা উচিত সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে। তাদেরকেও বুঝতে হবে কেন ও কিভাবে সংবাদপত্র মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করছে, জনসচেতনতা তৈরি করছে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রভূত অবদান রাখছে। বহুবিধ কারণেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা জরুরি।
দুর্যোগকালে সংবাদপত্রে প্রতিফলিত জনগণের মতামত জোরালো রাজনৈতিক ইস্যু তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ প্রভাব মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে আরও যা করে তা হচ্ছে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে অবহেলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য এটা এক ধরনের প্রতিরক্ষাব্যুহ সৃষ্টি করে যা মানুষের নিরাপত্তা প্রদানে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশার কারণে শাসকগোষ্ঠীকে অবমাননাকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। সংবাদপত্রে জনগণ কর্তৃক সরকারের সমালোচনা এবং স্বাধীনতা সংবাদপত্রের সঙ্গে অঘোষিত দ্বন্দ্ব সরকারকে বরং সাহায্য করে যথাসময়ে সিদ্ধান্তÍ ও পদক্ষেপ নিতে। এটা তাই কোন অবাক ব্যাপার নয়, যখন স্বাধীন সংবাদপত্র ও সরকারের মধ্যে সুন্দর সমঝোতার কারণে দেশের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ এড়ানো যায়।
আমাদের দেশে গণমাধ্যম যে ভূমিকা পালন করছে তা জনগণের ভরসার জায়গা। কারণ, আমাদের দেশে যখন যে দলের সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন তারা তাদের ইচ্ছামতো অনেক কাজ করে। রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক ক্ষেত্রে সরকারের জবাবদিহি পরিলক্ষিত হয় না। গণমাধ্যম সরকারের বিভিন্ন কর্মকা- তুলে ধরে জবাবদিহির একটি ক্ষেত্র তৈরি করে।
তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির যুগেও সংবাদপত্র শিল্পসহ সব গণমাধ্যমকে নানা পন্থায় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রবীণ সাংবাদিকদের মতে, একসময় সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেয়া কঠিন ছিল। ঢাকা শহরে সাংবাদিকদের বাড়িওয়ালারা বাসা ভাড়া দিতে চাইতেন না। সে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটেছে।
বাংলাদেশে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের ওপর আঘাত নতুন নয়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর আঘাত এসেছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে হরিষ চন্দ্র জেল খেটেছেন।
অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের দায়িত্ব। এখন সংবাদপত্রের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে সাংবাদিকদের দায়বদ্ধতা। কারণ, আগে সংবাদপত্রের ওপর আঘাত এলে সবাই মিলে প্রতিহত করতো। সেই জায়গা এখন নেই। সাংবাদিক ইউনিয়ন এখন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং ব্যক্তিস্বার্থ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো আন্দোলন করতে পারছে না। এটা খুবই দুঃখজনক।
একজন সাংবাদিক আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘......তারপরও কেন বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে; সাংবাদিকতার প্রত্যাশিত মান বাড়ছে না? সাংবাদিক সমাজের আত্মসম্মান রক্ষা এবং পেশার উৎকর্ষ সাধনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ যথাযথভাবে নিতে পেরেছে? সম্পাদকদের সংগঠন, সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সংগঠনগুলো কি এ নিয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে? নাকি নিজেদের মধ্যে বিভেদ, দলাদলি, সাংবাদিকতার নামে নিজের পছন্দের রাজনৈতিক দলের অনুগত বাহিনীতে আমরা পরিণত হয়েছি? প্রবাদে রয়েছে কাক কাকের গোশত খায় না। কিন্তু রাজনৈতিক সুবিধা, দলাদলি এবং ব্যক্তিস্বার্থে সাংবাদিকরা নিজ কমিউনিটির গোশত গোগ্রাসে গিলতে দ্বিধা করেন না। রাজনৈতিক বিশ্বাস আর কিছু বৈধ-অবৈধ সুবিধা পাওয়ার আশায় নিজেরা যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছি; তেমনি দলকে খুশি করার মানসিকতা নিয়ে কলম ধরছি। এতে করে মিডিয়া রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের ভূমিকা পালন থেকে বিচ্যুত হচ্ছে তেমনি আমরা সাংবাদিকরাও জাতির বিবেকের দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছি। এ অবস্থায় ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’য়ের মতো মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে সৃষ্টি হয়েছে কর্পোরেট সাংবাদিকতা। এ সাংবাদিকতার নামে গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের বদলে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বৈধ-অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থ রক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিছু মিডিয়া।  (সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব ৩ জুলাই ২০১৪)
বাংলাদেশে সংবাদপত্রকে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়। প্রথমত, সরাসরি সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, এটাকে প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। বাকি দুটো পরোক্ষ অথচ অধিকতর কার্যকরী ব্যবস্থা। প্রথমত: বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণাদেশ আরোপ এবং দ্বিতীয়ত: সরকারি বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ দ্বারা সংবাদপত্রের আর্থিক ক্ষমতায় আঘাত হানা।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের বিকাশের ইতিহাসটা সংগ্রামী ইতিহাস। বিশেষ করে ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের সিভিল শাসনেই এই সংগ্রাম তীব্রতর হয়েছে। প্রথম দফায় এই সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৭২-১৯৭৫ পূর্ব বাংলাদেশে। সে সময়ে সংবাদপত্রের সংখ্যা সীমিত করা হয় এবং মাত্র ৪টি দৈনিককে প্রকাশনার অধিকার দেয়া হয়। তাও পরিচালনার দায়িত্ব নেয় সরকার। এটা ছিল সোস্যালিস্ট বা কমিউনিস্ট বা একনায়কত্বের দেশের নীতি-আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাকশাল প্রতিষ্ঠার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার ১৯৭৩ সালে অধ্যাদেশ জারি করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় আঘাত হেনেছিলেন। ১৯৭৩ সালের করা আইনের পর থেকে নানা অজুহাতে অনেক পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে প্রকাশনা বন্ধ রাখছেন দেশের জেলা প্রশাসকরা। কোনো কোনো পত্রিকা আদালতের রায়ে আবার প্রকাশের সুযোগ পেলেও অনেক পত্রিকা পুনঃপ্রকাশ হচ্ছে না। এতে ১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যম শিল্প যাত্রা শুরুর পর যে শক্তিশালী অবস্থানে এসে পৌঁছায়, সে অবস্থা এখন ধ্বংসের মুখে।
বাংলাদেশে প্রেস মিডিয়ার সাংবাদিকরা এবং ফ্রি ল্যান্সার সাংবাদিকরা অনেকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিয়মিত সাংবাদিকদের অনেক ক্ষেত্রে ওয়েজ বোর্ড অনুসারে পাওনা দেয়া হচ্ছে। ফ্রি ল্যান্সার সাংবাদিকদের লেখা প্রকাশিত হবার পর তাদের লেখার সম্মানী প্রাপ্তিও মালিকদের ইচ্ছাধীন হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি স্বচ্ছ সাংবাদিকতা তথা সংবাদপত্র বিকাশের এক বিরাট অন্তরায় হয়ে উঠেছে। সাংবাদিক নিয়মিতই হোক বা ফ্রি ল্যান্সারই হোক এদের দর কষাকষির ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সংকট বিদ্যমান। সাংবাদিকদের ঐক্যের মধ্যেও ফাটল ধরানো হয়েছে। ইদানীংকালে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমাজ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এ বিভক্তির দ্বারা একে অপরের সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত। অথচ পেশাগত দিক থেকে তারা এক পেশায় আছে। এটা সত্যিই দুঃখজনক দৃষ্টান্ত। সাংবাদিকদের বিভাজনে কাজ করছে সরকারি ও বিরোধী দলীয় দর্শন। সরকারদলীয়  দর্শনের সাংবাদিকরা পাচ্ছে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা, পক্ষান্তরে তারাও এই পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিদান দিচ্ছে।
বর্তমানে সর্বাধিক কার্যকর অস্ত্র হলো নিউজপ্রিন্ট। দেশে উন্নতমানের নিউজপ্রিন্ট উৎপাদিত হয় না বলে সংবাদপত্র শিল্পের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে নিউজপ্রিন্ট আমদানি করতে হয়। রাষ্ট্র মালিকানাধীন খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল ছিল। সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যক্তি মালিকানায় কয়েকটি নিউজপ্রিন্ট মিল চালু হলেও তা সংবাদপত্র শিল্পের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। কাগজের মানও সন্তোষজনক নয়। দু’একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান একচেটিয়া ব্যবসা করছে। দফায় দফায় নিউজপ্রিন্টের দাম বাড়াচ্ছে।
গণতন্ত্রের বিকাশ, স্থিতিশীলতা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য স্বাধীন, বহুমাত্রিক এবং মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারের। প্রত্যেক দল ক্ষমতায় যাওয়ার আগে বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন দেয়ার অঙ্গীকার করলেও আজ পর্যন্ত কোন সরকার তা কার্যকর করেনি। এগুলো এখন সরকারের দলীয় প্রচারের মুখপত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে দিন দিন বেতার ও টিভির জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে এবং বিশ্বাসযোগ্যতা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে।
আশি দশক থেকে প্রতিটি সরকার ‘সেলফ সেন্সরশীপ’ নামক একটি দানবের প্রচলন শুরু করেছে। বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার যে সেল সেন্সরশীপের প্রয়োজন বোধ করেছে এবং করছে সেটা হচ্ছে সরকারকে বাঁচিয়ে কথা বলা। অর্থাৎ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় এমন কোনো খবর দেয়া থেকে বিরত থাকা বা তেমন কোনো বিষয়ে রিপোর্টিংকালে ভাষার হেরফের করা। এটা একটা সংবাদপত্রের জন্য স্বাধীনতা খর্ব করার পদ্ধতি মাত্র। অধিকাংশ সংবাদপত্রের নিজস্ব আর্থিক সঙ্গতি কম থাকায় তারা সেলফ সেন্সরশীপের আওতায় রয়েছে। বহু সংবাদপত্রের ওপর বিদেশী প্রভাব রয়েছে। বিদেশী পৃষ্ঠপোষকতার কারণে এমনটি হয়ে থাকে। আবার কোনো কোনো পত্রিকা দলীয়ভাবে চালানো হয় এক ধরনের সেন্সরশীপের অধীনে। এমন পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা থাকে না। অনেক সময় সাংবাদিকরা হয় ক্ষতিগ্রস্ত। জীবিকার তাগিদে এবং সার্বিক দারিদ্র্যের কারণে বহু ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে না।
ইদানীং আবার সংবাদপত্রের জগতে আর একটি নতুন উপসর্গ সৃষ্টি হয়েছে। স্বাধীন সংবাদপত্র কতটুকু তথাকথিত মৌলবাদ সমর্থক, কতটুকু খোদাদ্রোহী এসব ব্যাপারে মূল্যায়ন হচ্ছে। খোদাদ্রোহী কথাটিকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ‘প্রগ্রেসিভ’ বা ‘প্রগতিশীল’ নামে অভিহিত করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ান একটি দেশে আবার মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক, অমুক্তিযোদ্ধা সমর্থক তথাকথিত স্বাধীনতার সমর্থক বা অন্য আদর্শের সমর্থক ইত্যাদি নাম ও আদর্শের নিরিখে সংবাদপত্রের আদর্শ মূল্যায়ন করা হয়। এসবই আসলে রাজনীতির নিরিখে করা হয়। আগে গত গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা বা তথাকথিত প্রতিক্রিয়াশীলতার নিরিখে। সেটাই বর্তমানে তথাকথিত মৌলবাদে রূপান্তরিত। স্বাধীন সংবাদপত্র বলতে তৃতীয় বিশ্বে বর্তমানে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সংবাদপত্রের মালিক পক্ষ যে আদর্শে বিশ্বাসী পত্রিকার সম্পাদনা পরিষদকেও সে আদর্শে বিশ্বাসী হতে হয়। মালিক পক্ষের আদর্শ বিরোধী কিছু হলে আর রক্ষা নেই।
এ দেশে একশ্রেণীর সংবাদপত্র ইসলামী আদর্শের প্রতি কমিটেড সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে এবং ইসলামী আন্দোলনে দায়বদ্ধ দল বা আদর্শ অঙ্গীকারাবদ্ধ দল বা নেতা-নেত্রীবৃন্দকে জনসমক্ষে হেয় করার মানসে অনেক অসৎ ও কল্পিত মিথ্যাচার শুরু করে। এসব মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে প্রকাশিত মন্তব্য ও রিপোর্টের উত্তর দেয়ার পরও ভদ্রতার খাতিরে এসব প্রতিবক্তব্য ও প্রতিবাদপত্র ইসলামবিরোধী সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় ছাপানো হয় না। এসব মিথ্যাচারকেই সংবাদপত্রের পাঠক ও পৃষ্ঠপোষকবৃন্দ সত্য বলে গ্রহণ করে। যেহেতু নীতি-নৈতিকতা বলতে কিছুরই অস্তিত্বে এসব সংবাদপত্র বিশ্বাস করে না। তাই মিথ্যাচার ও আদর্শহীনতাই এসব সংবাদপত্রের মূল আদর্শ। অর্থাৎ মিথ্যাচার, অনৈতিকতাই এসব সংবাদপত্রের মূলধন।
মুক্ত বাজার নীতির আওতায় পত্রিকার প্রকাশনা বাধাগ্রস্ত না হলেও ডিএফপির নিয়ন্ত্রণ ও সেন্সরশীপ আওতায় পত্রিকার প্রকাশনা অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বাংলাদেশে ইদানীংকালে আর এক ধরনের সেন্সরশীপ রয়েছে যা কোনো সিভিল সরকারের জন্য প্রত্যাশিত নয়। এ প্রসঙ্গে আমরা বলতে পারি সাংবাদিক দলন ও নিপীড়ন নীতি। সম্প্রতি সাংবাদিকরা পেশাগত কাজ করতে বাধাগ্রস্তই শুধু হচ্ছে না, লাঞ্ছিতও হচ্ছে। আর এটা হচ্ছে সরকারের পক্ষ হতে। সরকার কোনো কোনো তথ্য সংবাদপত্র কর্মীদেরকে সরবরাহ করছে না। বা তেমন তথ্য সংগ্রহ করতে দিচ্ছে না। কিন্তু সরকার তার প্রয়োজনের খবরটুকু স্বউদ্যোগে সরবরাহ করছে। কিন্তু যখন সরকারি পুলিশ বা সন্ত্রাসী বাহিনী সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়, মারপিট করে, তখন সেটিও পড়ে যায় সেন্সরশীপের আওতায়। ইদানীং ফটো সাংবাদিকদের এবং রিপোর্টারদের ওপর এমন বহু ঘটনা ঘটানো হয়েছে যা প্রেস ফ্রিডম বিরোধী। সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বাংলাদেশে প্রেস ফ্রিডম বজায় নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য অনেক মন্ত্রী এমন পরিস্থিতিকেও বর্ণনা দিচ্ছেন এবং দাবি করছেন সংবাদপত্রের অর্থাৎ প্রেসের ব্যাপক স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। এমনো বলা হয় যে  ইতঃপূর্বে কখনোই প্রেস স্বাধীনতা ছিল না। সরকারের মতে, এখন প্রেস ফ্রিডমের ব্যবহার হচ্ছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। তথ্য পরিবেশনে তারা অনেকে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কোনো রকম জবাবদিহিতা না থাকাই এর কারণ বলে প্রধানমন্ত্রীরও ধারণা জন্মেছে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের প্রকাশিত নির্বাচনী ইশতেহারে ‘সব ধরনের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্য প্রবাহের অবাধ চলাচল সুনিশ্চিত’ করার কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে প্রতিশ্রুতির উল্টো। একদিকে সরকার পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করছে, অন্যদিকে আর্থিক সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক পত্রিকা। আর্থিক সঙ্কটে পতিত হয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকাকে সহায়তা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকার একের পর এক পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি দিচ্ছে।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠনের কয়েক মাস পর অনিয়মিত প্রকাশিত হওয়ার অভিযোগে প্রায় ১শ’ পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করে দেয় সরকার। পরে ওই বছর বন্ধ হয় আরও কয়েকটি পত্রিকার প্রকাশনা। ২০১১ সালে পাঁচটি ও ২০১২ সালে প্রায় পনেরটি পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়। সরকারের বিজ্ঞাপন বৈষম্য ও রোষানলের শিকার হয়ে বন্ধ আছে সারা দেশের অর্ধশত পত্রিকা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর আবারো ক্ষমতাসীন হয়ে পূর্বের ধারা অব্যাহত রেখেছে সরকার।
প্রতিনিয়তই অপরিশীলিত, অমার্জিত এবং অনাকাক্সিক্ষত ও ঔদ্ধ্যত আচরণের এই কার্যকলাপ প্রায়ই এমনভাবে প্রতিভাত হচ্ছে যে, একে দুঃশাসনেরই নামান্তর বলা যায়। সংবিধান অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো ‘সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচারের নিশ্চয়তা।’ (দ্রষ্টব্য: সংবিধানের প্রস্তাবনা, পৃষ্ঠা ৯)।
সংবিধান মানলে, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ একই অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারায় আছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচণা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে ক. নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং খ. সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
যেকোনো অভিযোগেই হোক, দৈনিক আমার দেশের প্রকাশনা এই সরকারের আমলে বন্ধ করা হয়েছে এবং সেটির সম্পাদককে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ইসলামী টিভি, দিগন্ত  টিভি ও চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে প্রথম চ্যানেল দুটির লাইসেন্স বাতিল করা হয়নি। এ দেশের সম্প্রচার মাধ্যমের পক্ষে কোনো আইনী সুরক্ষা নেই, টিভি চ্যানেলগুলো চলছে সরকারের মর্জিমাফিক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্বাহী আদেশের বলে। কিছুদিন আগে সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য একটি সম্প্রচার নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছে, যেটি কার্যকর হলে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর যেটুকু স্বাধীনতা আছে, তা-ও বিলুপ্ত হবে। কিন্তু সম্প্রচার মাধ্যমের সাংবাদিকরা এর যথেষ্ট প্রতিবাদ জানানোরও সাহস পাননি, প্রতিবাদ-সমালোচনা করে যেটুকু লেখালেখি হয়েছে, তার অধিকাংশই হয়েছে সংবাদপত্রগুলোতে। বলা বাহুল্য, সম্প্রচার মাধ্যমের ওপর সরকারের চাপ অপেক্ষাকৃত বেশি, যেহেতু সরকার ইচ্ছা করলেই যেকোনো টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দিতে পারে। যারা সরকারের সমালোচনা করেন, টিভি টক শোগুলোতে তাদের আমন্ত্রণ না জানানোর ব্যাপারে সরকারের দিক থেকে চাপ দেয়া হয় এমন অভিযোগ রয়েছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়ও এ বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে। 
জিবলু রহমান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads