সোমবার, ১০ আগস্ট, ২০১৫

অন্ধের দৃষ্টিশক্তি সাম্প্রতিক বন্যা ও আমাদের দায়-দায়িত্ব


অন্ধরা দেখতে পায় এ কথাটি কি কেউ বিশ্বাস করবেন? আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার সাথে সাথে অন্ধদের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা-প্রশিক্ষণ পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা ব্রেইলি ও অন্যান্য পদ্ধতির সুবিধা গ্রহণ করে হাত দিয়ে পড়ালেখা করতে পারেন। এদের অনেকে এই পদ্ধতিতে কুরআনে হাফেজ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারীও হয়েছেন। এটি আল্লাহর করুণা এবং তাদের ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং নিষ্ঠার ফল। কিন্তু যারা কোনও রকম শিক্ষা-প্রশিক্ষণের সুযোগ পাননি তারা তাদের দৈনন্দিন জীবন তথা পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন মানুষের ন্যায় স্বাভাবিক আচরণ করতে পারেন, কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারেন এ কথাটি হয়ত কেউ বিশ্বাস নাও করতে পারেন। তবে বাস্তবে তা ঘটছে। খুলনা জেলার কয়রা উপজেলা সংলগ্ন একটি গ্রামের মসজিদে সম্প্রতি আমি একজন অন্ধ ব্যক্তির সাক্ষাৎ পেয়েছি। তিনি একটি মসজিদের মুয়াজ্জীন, মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেন। ফযরের নামায থেকে এশা পর্যন্ত প্রতি ওয়াক্ত নামাযের ন্যূনতম ১৫ মিনিট আগে তার মোবাইলের এলার্ম বেজে ওঠে। এলার্ম শুনে তিনি অজু করে শাদা ছড়ি নিয়ে সোজা মসজিদে এসে আযান দেন এবং নামায শেষে আবার বাড়িতে চলে যান। ভদ্রলোককে আমি কয়েকবার বায়তুন নূর মসজিদে দেখেছি, আলাপ করেছি এবং স্বাভাবিক মানুষের মতো কারুর সাহায্য ছাড়াই বাড়ি চলে যেতে দেখেছি। আরেকজন অন্ধ, তাকে দেখিনি, তবে এলাকার লোকের মুখে শুনেছি- তিনি রোজ মাঠে যান কাচি দিয়ে ঘাস কেটে তা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। কোন কোন সময় রাতের বেলার নির্জন পরিবেশেও তিনি মাঠে গিয়ে ঘাস কেটে বাড়ি ফেরেন। রাতের অন্ধকারে ঘাস কাটতে অসুবিধা হয় কিনা জিজ্ঞাস করা হলে উত্তরে তিনি নাকি বলেছিলেন, আমার জন্য তো রাত আর দিন নেই-সব সময়ই অন্ধকার।
তার দু’টি চোখই উপড়ানো। কোটরে চোখ থাকলে হয়তো কেউ বলতে পারতেন যে তিনি হয়ত ঝাপসা ঝাপসা দেখতে পারেন কিন্তু সেই উপায় নেই, কোটর খালি, গর্ত। তা হলে প্রশ্ন, তিনি এবং তারা কিভাবে রাস্তা চেনেন, জমি চেনেন, খানা-খন্দক নির্ণয় করেন, নিজ বাড়ি ও ঘর থেকে বেরিয়ে আবার সেখানেই ফিরে আসেন। আমার মনে হয় এ সবই আল্লাহর কুদরত। আল্লাহ তাদের এক অসাধারণ ধীশক্তি দিয়েছেন যা ব্যবহার করে তারা চোখ দিয়ে নয়, অনুভূতি ও ঘ্রাণ শক্তি এবং অপরাপর অংগ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে দেখেন এবং কাজ করেন। এরা যদি সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা পান তাহলে জাতির জন্য এক বিরাট সম্পদে পরিণত হতে পারেন। তাদের ভালমন্দ চিন্তা করার জন্য রাষ্ট্র ও সরকারের হয়ত সময় খুবই কম। বেসরকারি খাতের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো এই অবহেলিত মানুষগুলোর কল্যাণের জন্য যদি কিছু করতে চান তাহলে তারা অনেক কিছুই করতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস।
(দুই)
এই মাসের প্রথম সপ্তাহে বৃহত্তর খুলনার তিনটি জেলা যথাক্রমে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট এবং পিরোজপুর জেলার জিয়ানগর উপজেলায় আমার সফর করার সুযোগ হয়েছে। সফরকালে গ্রাম বাংলার এক করুণ অবস্থা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। সফরকালে দেশের রাস্তাঘাটের যে বেহাল অবস্থা আমি দেখেছি ইতঃপূর্বে তা আর কখনো দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি। বিশেষ করে, খুলনা থেকে সাতক্ষীরা জেলায় যাবার যে মহাসড়কটি তার অবস্থা অত্যন্ত করুণ এবং ভাষায় বর্ণনা করার মত নয়। যে রাস্তা অতিক্রম করতে আগে দেড় ঘণ্টা লাগত তা এখন অতিক্রম করতে কমপক্ষে চার ঘণ্টা লাগে। রাস্তা নয় যেন খানা-খন্দক এবং সাম্প্রতিক বন্যা রাস্তার অবস্থা আরও করুণ করে তুলেছে। আশপাশের বাড়িগুলোর অবস্থা এত করুণ যে, তা বর্ণনা করার উপযুক্ত ভাষা আমার জানা নেই। অনেক বাড়ির উঠানে বুক সমান পানি। রান্নাঘরের চুলা পানির নিচে। যে সমস্ত বাড়ি-ঘর ফ্লাড লেভেলের উপরে সেগুলোকেও জোয়ারের পানি এসে দু’বেলা প্লাবিত করে। লোনা পানির প্রভাবে অনেক বাড়িঘরের ইট খসে পড়তে দেখেছি। নদীর পাড় ভাঙা। সাতক্ষীরা জেলার অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট বিশেষ করে জেলা থেকে উপজেলা এবং উপজেলা থেকে ইউনিয়ন এবং গ্রামের রাস্তাগুলোর অবস্থা পঞ্চাশ-ষাট বছর পেছনে চলে গেছে। যাবার সময় একটি মাইক্রোবাস নিয়ে গিয়েছিলাম। গাড়ির লাফালাফিতে কখনো মনে হচ্ছিল যেন, শরীরের হাড্ডি থেকে গোশতগুলো আলাদা হয়ে যাচ্ছে এবং হাড্ডির সন্ধিগুলো আর অবশিষ্ট নেই। একই অবস্থা খুলনা-কয়রা মহাসড়কের। এ সড়কগুলোর মেরামত-সংরক্ষণের কোন কার্যকর ব্যবস্থা সড়ক বিভাগ কখনো নিয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। স্থানীয় লোকদের প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী মাঝে মাঝে এই বিভাগ রাস্তার বিভিন্ন স্থানে বিটুমিনের প্রলেপ দিয়েছিলেন কিন্তু বৃষ্টি, বন্যা ও জোয়ারের পানিতে এ প্রলেপের আর কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। খুলনা ও সাতক্ষীরাবাসীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেশা হিসেবে ধান চাষের পরিবর্তে চিংড়ি চাষকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। চিংড়ি ঘের তাদের জীবন-জীবিকার সাথে মিশে গিয়েছিল। কিন্তু, বন্যা ও জোয়ারের পানিতে এই ঘেরগুলো শুধু তলিয়েই যায়নি তাদের জীবন-জীবিকাকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। মানুষ অত্যন্ত দুর্বিষহ দিনাতিপাত করছে। তাদের খাবার পানি নেই, আশ্রয়ের জায়গা নেই, গবাদিপশু রাখার স্থান নেই, রান্নার চুলা নেই, ছেলে-মেয়ে, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল ও সাপ-বিচ্ছু সাথে নিয়ে ঘরে হাঁটু সমান পানির ওপর মাচা বেঁধে তাদের থাকতে হচ্ছে। এ এক করুণ অবস্থা। এর মধ্যে কয়রায় বাঁধ ভাঙার খবর শুনলাম। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। স্বাধীন বাংলাদেশে বৃহত্তর পরিসরে বন্যা নিয়ন্ত্রণে আমরা ব্যর্থ হয়েছি; কিন্তু ক্ষুদ্রতর পরিসরে জেলা, উপজেলা এবং গ্রামগুলোকেও আমরা বন্যা এবং জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করতে পারছি না। এ ব্যর্থতার দায় সরকারকেই বহন করতে হবে।
[ তিন ]
আমার গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার দাগনভুঞা উপজেলার তিন নম্বর ইউনিয়নে। এবার আমার এলাকার মানুষ স্মরণাতীতকালের বৃহত্তর বন্যার শিকার। আমাদের এবং আমাদের আশপাশের এমন কোন বাড়ি নেই, যে বাড়ি বন্যায় প্লাবিত হয়নি। গত ৬১ বছরে আমার গ্রামের কোন বাড়িতে পানি ওঠার দৃষ্টান্ত নেই। ১৯৫৩ সালে আমার যতদূর মনে পড়ে, একবার বন্যা হয়েছিল এবং সে বন্যার পানি আমাদের কাচারি ঘরের উঠান পর্যন্ত গিয়েছিল কিন্তু মূল বাড়ির বসতভিটা পর্যন্ত যায়নি। এবারের বন্যার পানি বসতভিটার সিঁড়ি স্পর্শ করেছে। অর্থাৎ, আমরা অবস্থার দিক থেকে ছয় দশকেরও পেছনে চলে গেছি। কোনও বাড়ির পুকুরে মাছ বলতে আর কিছু নেই। সব মাঠে চলে গেছে। গতকাল পর্যন্ত বাড়ির সামনের রাস্তায় হাঁটু সমান পানি ছিল। অপেক্ষাকৃত নিচু বাড়িঘরগুলো এখনো পানির নিচে। মানুষ রান্নাঘরে রান্না-বান্না করতে পারেন না। দৈনিক এক ইঞ্চি-আধা ইঞ্চি করে পানি কমছে বলে খবর পাওয়া গেছে। পানি হ্রাসের এই গতিবিধি অব্যাহত থাকলে মানুষের দুর্গতি চলতি মাস পর্যন্ত চলতে থাকবে। এ অবস্থা শুধু দাগনভুঞা নয় দেশের সতেরোটি জেলায়। এসব জেলায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকল মানুষ এর শিকার। কিন্তু সরকারি ত্রাণ এখানে নেই বললেই চলে। যৎসামান্য যা কিছু আসে মারামারি ও সরকারি দলের লুটপাটেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো কেন এই অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে? কেন আমরা ষাট বছর পিছিয়ে গেলাম? পাকিস্তান আমলে আমরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলাম। আমরা অভিযোগ করেছিলাম যে, পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোন দপক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এখন তো পাকিস্তানীরা নেই। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং স্বাধীনতার  অনুঘটক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এই অবস্থায় বন্যায় কেন মানুষ মরবে এবং কেন তারা তাদের সহায়-সম্পত্তি হারাবে? পাকিস্তান আমলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন ও সেচের জন্য ওয়াপদার (Water And Power Development Authority) উদ্যোগে ফেনীতে মুহুরী প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছিল। এ প্রকল্পের আওতায় সোনাগাজীতে স্লুইস গেট স্থাপন করা হয়েছিল। বর্ষাকালে বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের পানি এই স্লুইস গেট দিয়ে সমুদ্রে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল। তখন গেট খুলে দেয়া হতো। আবার বর্ষা শেষে যাতে জোয়ারের লোনা পানি ঢুকতে না পারে সে জন্য গেট বন্ধ রাখা হতো। এখন দীর্ঘকাল ধরে এই প্রকল্প এবং তার অধীনে স্থাপিত স্লুইস গেটসমূহের মেরামত এবং সংরক্ষণ কাজ হয় না। প্রকল্প সন্নিহিত এলাকা পলি পড়ে (Siltation) উঁচু হয়ে গিয়েছে। ফলে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানি সমুদ্রের দিকে না গিয়ে জনবসতির দিকে ফিরে আসছে। এছাড়া নদী ও খালসমূহের নাব্যতাও আর নেই। আবার জোয়ারে পানি ঢোকার পথেও কোন বাধা নেই। ফেনীর বন্যার এটি হচ্ছে প্রাথমিক কথা। খুলনা, সাতক্ষীরা ও ফেনীসহ বাংলদেশের সর্বত্র বন্যার যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে তার কারণ অসুন্ধান করতে গিয়ে আমার কাছে সবচেয়ে বিস্ময়কর যেটি মনে হয়েছে সেটি হচ্ছে আমাদের অযোগ্যতা ও ব্যর্থতা। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশনের জন্য আমরা নতুন কোন কাঠামো তৈরি করতে পারিনি। পাকিস্তান আমলে তৈরি কাঠামোগুলো সংরক্ষণেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি। ফলে কোটি কোটি মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। আমাদের সরকার সংখ্যালঘু শহরবাসীদের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গাড়ি-ঘোড়ার চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। তারা কি সংখ্যাগুরু গ্রামবাসীদের ঘর-বাড়ি, সম্পত্তি ও জীবন-জীবিকা রক্ষার জন্য লক্ষ বা কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নও করতে পারেন না? এ সামর্থ্য ও যোগ্যতা যদি তাদের না থাকে তাহলে তাদের বিদায় নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আমি অন্ধদের দৃষ্টিশক্তির কথা দিয়ে নিবন্ধটি শুরু করেছিলাম এবং বলেছিলাম যে, অন্ধরাও দেখতে পায়। আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অন্ধ নন। তাদের চোখ-কান আছে, অনুভূতি আছে। কাজেই সরকার যদি তাদের অন্ধ মনে করেন তাহলে ভুল করবেন। আবার নিজেই যদি অন্ধ হন তাহলে প্রলয় বন্ধ হবে না।
ড. মোঃ নূরুল আমিন

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads