মঙ্গলবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৫

পুলিশ কি তবে শিক্ষকের সঙ্গে দুষ্টমি করছিল?


গত ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষে ঢাকা বিশ্বকিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে ধারাবাহিকভাবে নারীদের শ্লীলতাহানি করেছে ছাত্রলীগের একদল সন্ত্রাসী। প্রতিবাদী ছাত্ররা এদের মধ্য থেকে পাঁচজনকে হাতেনাতে ধরে ফেলে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করেছিল। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাদের চা-নাস্তা খাইয়ে সসম্মানে বিদায় দিয়েছিল পুলিশ। এ নিয়ে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। পত্রিকাগুলো সে ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। টিভি চ্যানেলগুলা প্রচার করেছিল ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ। তাতে হামলাকারীদের চেহারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু পুলিশের তরফ থেকে এই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার নানান কোশেশ চালানো হয়। আর ঘটনাস্থলের আশেপাশে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য মোতায়েন ছিল ডজন ডজন পুলিশ। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টাই করেনি। আক্রান্ত নারীদের রক্ষা করতে যারা চেষ্টা করছিলেন, তারা পুলিশের সাহায্য চাইলে পুলিশ বলেছে, এখানে দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া আছে। সংশ্লিষ্ট এলাকা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।
ঘটনা সম্পর্কে প্রথমে পুলিশ একেবারেই অস্বীকার করে বসে যে, ঐ দিন টিএসসি চত্বরে এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তারপর বলল, পত্রিকায় যে ছবি ছাপা হয়েছে, তা অন্য কোনো এলাকার। তারা আরও বলল যে, যখন ঘটনা ঘটেছে, তখন অন্ধকার হয়ে আসছিল, তাই কিছু ঘটে থাকলেও পুলিশ দেখতে পায়নি। আবার বলা হলো, পুলিশ ভেবেছিল, ওখানে ছেলেপেলেরা সামান্য জটলা করছিল। তারপর এলো সেখানে স্থাপিত সিসি ক্যামেরা প্রসঙ্গ। পুলিশ বলল, সে ফুটেজ দেখে কারও চেহারা শনাক্ত করা যাচ্ছে না। পুলিশ যখন এইসব আবোল তাবোল বলছিল, তখন পত্রিকাগুলো ভিডিও ফুটেজ থেকে হামলাকারীদের ছবি প্রকাশ করে দিল। তাতে তাদের স্পষ্ট চেনা যাচ্ছিল। তারপরও পুলিশ বাহিনীর প্রধান শহীদুল হক যা বলে বসলেন, তা স্তম্ভিত হওয়ার মতো কথা। তিনি বললেন, টিএসসি চত্বরে নারীদের শ্লীলতাহানির মতো কোনো ঘটনাই ঘটেনি। সেখানে কিছু ছেলে দুষ্টামি করছিল। যেখানে হাজার হাজার মানুষের সামনে নারীদের জামাকাপড় ছিঁড়ে বিবস্ত্র করে ফেলা হলো, একের পর এক মেয়েকে-মাকে-বান্ধবীদেরকে কামড়ে-খামচে পিষে দেয়া হলো, আর সেই ঘটনাকে পুলিশ প্রধান ‘দুষ্টামি’ বলে অভিহিত করে বসলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুলিশের, পুলিশ প্রধানের এসসব সাফাই কোনো কাজে আসেনি। পুলিশকে মেনে নিতেই হয়েছে যে, সেদিন ওখানে নারীরা লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। আর পুলিশই লাঞ্ছনাকারীদের শনাক্তও করতে পারল। তারাও স্পষ্ট ছবি বের করতে পারল এবং পত্রিকায় সেসব ছবি দিয়ে প্রচারও করতে পারল যে, এরা লাঞ্ছনাকারীদের কয়েকজন। তাদের ধরিয়ে দিতে পারলে মাথাপিছু এক লক্ষ টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হবে। এখন আইজিপি সাহেবের দুষ্টুমি তত্ত্বের কী গতি হবে, কে জানে।
পুলিশের এমন আর এক দুষ্টামি দেখলাম মাদারিপুরে। গত ১৩ আগস্ট মাদারিপুরের মোস্তফাপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর দুই ছাত্রীকে নির্যাতনের পর হত্যা করে ছাত্রলীগের সন্তাসীরা। এ নিয়েও সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। যদিও প্রতিদিনই দেশে ঘটছে শিশু নির্যাতন-ধর্ষণের মতো লোমহর্ষক ঘটনা। প্রতিকার কোথায়ও পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার কিংবা পুলিশ বাহিনী সম্ভবত আশা করে যে, তাদের দায়িত্বহীনতা ও নিষ্ক্রিয়তায় দেশে এই যে বীভৎস অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, কোথায়ও যেন তার কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিকারের দাবি না ওঠে। কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, এই অনাচারের সঙ্গে যুক্ত আছে সরকার দলের সমর্থনপুষ্টরা। তাদের রাখতে হবে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। পুলিশ এখন ধর্ষণের মামলাও নিতে চায় না। এ থানা বলে, ও থানায় যান, ও থানা বলে সে থানায় যান। মামলা-মোকদ্দমা ঝামেলার কাজ। তার চেয়ে অনেক সহজ থানায় বসে মুক্তিপণ আদায় করে রাতারাতি বিত্তবান হয়ে ওঠা। আর মামলা নিলে হাসপাতালে দৌড়াও, আদালতে যাও। সাক্ষী দাও। আর এসব ভারী ঝক্কি-ঝামেলার কাজ। আর সে কারণেই সম্প্রতি নিহত ব্লগার নিলয় তার জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে একাধিক থানায় দৌড়াদৌড়ি করেও একটি জিডি পর্যন্ত করতে পারেননি।
মাদারিপুরে ঐ দুই ছাত্রী ও সারা দেশে শিশু হত্যার প্রতিবাদে হত্যার বিচারের দাবিতে জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। দেশে এখন রাজনীতি নেই। সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল নেই। জনসভা নেই। রাজনৈতিক বক্তব্য দেবার জন্য বিবৃতির রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে। ফলে যে-কোনো বিষয়ে সরকারকে জানান দিতে বা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সকলেই মানববন্ধনের মতো নিরীহ কর্মসূচির আয়োজন করে। তাতে সংক্ষুব্ধরা একটি ব্যানার ও কিছু প্লাকার্ড হাতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়। এই মানববন্ধনের ওপর ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে সরকার। পিটিয়ে তেমন মানববন্ধনকে তুষ বানিয়ে দিচ্ছে।
গত ১৬ আগস্ট মাদারিপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি শুরু করেছিলেন শহরের এএইচ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক শিক্ষার্থী আর অভিভাবকেরা। সে মানববন্ধনে ছিল দেড় থেকে দুই শতাধিক কোমলমতি শিশুও। কিন্তু এরা মানববন্ধনে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের ওপর একবারে হামলে পড়ে। ব্যানার-ফেস্টুন ছিঁড়ে ফেলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নেয়ার চেষ্টা করে। যেন কম্যান্ডো স্টাইলে ধরছে কোনো ভয়ঙ্কর অপরাধীকে। দুটি স্কুলগামী মেয়ে শিশুকে নির্যাতন করে যারা হত্যা করল, তাদের ধরার যাদের মুরাদ নেই যে পুলিশের, সেই পুলিশের কী সাংঘাতিক মুরাদ দেখলাম মানববন্ধন পণ্ড করে দিতে। দৃশ্য দেখে বলিহারি যাই।
বর্তমান সরকারের আমলে পুলিশদের শিক্ষক পেটানোর ঘটনা নতুন নয়। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা যখন তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে ঢাকার রাজপথে আন্দোলন করছিলেন, তখনকার অবস্থা স্মরণ করলে গা শিউরে ওঠে। প্রবীণ শিক্ষকদের ওপর দু’ হাতে লাঠি বাগিয়ে কিংবা রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে রাস্তার ওপর রক্তাক্ত করেছে পুলিশ। রাস্তার ওপর ফেলে তাদের বুট দিয়ে পিষে দিয়েছে। শিক্ষকদের আর্তনাদে ঢাকার বাতাস ভারী হয়েছে। সরকার নির্বিকার থেকেছে। সরকারের কোনো মন্ত্রী-এমপিকে এ ব্যাপারে মুখ খুলতে দেখিনি। আফসোস হয়েছে। এদের প্রায় সবাই প্রাইমারি, মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। তাদের কারও কি একবারও তাদের নির্মাণের কারিগরদের কথা মনে হয়নি? কোনো প্রিয় শিক্ষকের মুখ কি চোখের সামনে ভেসে ওঠেনি? উঠলে দেখতাম, সংশ্লিষ্ট পুলিশদের এই বাহিনী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারে কুটোটিও নড়েনি। তবে কি পুলিশ শিক্ষকদের সঙ্গে একটু দুষ্টামি করছিল মাত্র?
তেমনি দৃশ্যই মাদারিপুরে দেখলাম। ঐ নিরীহ নির্বাক মানববন্ধন থেকে পুলিশ আটক করছে একজন শিক্ষককে। সামনে একজন পুলিশ কর্মকর্তা ঐ শিক্ষককে শক্ত করে ধরে সম্ভবত হ্যান্ডকাফ পরাচ্ছে। পেছনে একজন পুলিশ কনস্টেবল ঐ শিক্ষকের ঘাড় চেপে ধরে সামনের দিকে ঠেলছে। ফের বেদনায় বুক ভারী হয়ে এলো। এই শিক্ষকদের কাছে আমার বাপ-দাদারা লেখাপড়া করেছেন। আমি লেখাপড়া করেছি। আমার সন্তানেরা লেখাপড়া করেছে। তাদের সন্তানেরাও পড়বে। তারা সমাজে আমাদের কাছে এতটুকু মর্যাদাও কি আশা করতে পারেন না? শিক্ষকদের কেউ অপরাধ করতে পারেন না, তা আমি বলছি না। কিন্তু যে শিক্ষকদের ঢাকার রাস্তায় পিটিয়ে পুলিশ বুটের তলায় পিষে দিচ্ছিল, তারা কোনো অপরাধ করেননি। যে শিক্ষককে পুলিশ ঘাড় ধরে গ্রেফতার করার চেষ্টা করছিল, তিনিও কোনো অপরাধ করেননি। যেসব পুলিশ শিক্ষকদের ওপর এমন বর্বর আচরণ করল, তারাও নিশ্চয়ই কোনো শিক্ষকের কাছে কোনো বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছে। তা না হলে পুলিশের চাকরিও তার কপালে জুটত না। পুলিশ বলতে পারে, বিদ্যা দিয়ে চাকরি নেইনি, টাকা দিয়ে চাকরি নিয়েছি। শিক্ষকের ইজ্জত গেল কি রইল, তাতে আমার কি আসে যায়? তবু বলতে হবে, তাকেও স্কুলে যেতে হয়েছে।
মানববন্ধনটি হতে যাচ্ছিল ডিসি অফিসের পাশে। ডিসি সাহেব কি অফিসে ছিলেন? তিনি কি ঘর থেকে বরিয়ে দেখেছেন, শিক্ষকদের সঙ্গে, শিশুদের সঙ্গে কী আচরণ করছে পুলিশ? দেখলে বাধা দেননি কেন? তিনি তো আর ফাল দিয়ে এসে ডিসি হয়ে যাননি। স্কুল-কলেজে তাকেও পড়তে হয়েছে। তিনি তার স্কুল-পড়ুয়া সন্তানদের কাছে কী জবাব দেবেন? নাকি পুলিশ-প্রশাসন সবাই ঐ ঘাতকদের সহযোগী? ঘাতকদের বিরুদ্ধে কাউকে তারা কোনো উচ্চবাচ্যই করতে দেবেন না? কিন্তু এসপি-ডিসি-ওসি সাহেব, ঘাতকদের সহযোগী হওয়ার পরিণাম কখনও সম্মানজনক হয় না।
এর প্রমাণ মিলল কক্সবাজারে। উখিয়া টেকনাফের এমপি আবদুর রহমান বদি গত ১২ আগস্ট চড় মেরে মেরে গাল লাল করে দিয়েছিলেন উপজেলা প্রকৌশলী মোস্তফা মিনহাজকে। ধারণা করা হয়েছিল, এবার বোধকরি প্রধানমন্ত্রী বদিকে কঠোরভাবে শাসন করবেন। কিন্তু না, ফল হয়েছে একেবারেই বিপরীত। গত রোববার (১৬ আগস্ট) সরকার মিনহাজকে স্ট্যান্ডরিলিজ (তৎক্ষণাৎ বদলি) করে দিয়েছে। এতে প্রশাসনের সম্মান বাড়েনি। বরং তারা সরকারের বুটের তলায় পিষ্টই হয়েছেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads