বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৫

জাতীয় কবির সম্মান এবং ছবি বিষয়ক ভাবনা


অবাক করা বিষয়ই বটে। রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুল বা নজরুলের সাথে রবীন্দ্রনাথ কি দণ্ডায়মান কি উপবিষ্ট এমন কোনো যুগল ছবি অদ্যাবধি অনাবিষ্কৃত। কোনো সভা-সমিতিতেও এদেরকে একত্রে বা কাছাকাছি দেখা যায় না। যদিও বাংলা সাহিত্যের দুই বিস্ময় রবীন্দ্র-নজরুল। বয়সের ব্যবধান যথেষ্ট থাকলেও মেধা ও ধীশক্তির ফারাকটা ক্রমেই নিকটতর হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনকালেই। পরবর্তী সময় নজরুলের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ-ঔৎসুক্য এবং মমতা, বিপরীতে নজরুলের অনুরাগ এবং শ্রদ্ধা রবীন্দ্রনাথের অর্থাৎ রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রতি বিভিন্নজনের লেখায় এবং উক্তিতে বিষয়টি উঠে এসেছে। যদিও নজরুল-রবীন্দ্রের ব্যক্তিগত দেখা-সাক্ষাৎ খুবই সীমিত হলেও হয়েছে বার কয়েক। যে সময়গুলোতে এই সাক্ষাৎকার ঘটেছে, নজরুল খ্যাতির বিস্ময়কর উত্থান তখন। রবীন্দ্রনাথও বেশ সমীহ করতেন নজরুলকে। নজরুলের কাব্যপ্রতিভার প্রতি রবীন্দ্রনাথের আস্থার প্রকাশ ঘটতে শুরু করেছে লেখা এবং বাক্যে। এতকিছুর পরও এই দুই মহারথীকে কেউ ক্যামেরাবন্দি করেনি এমনটা বিশ্বাসের সীমায় আসছে না। এখানে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিচু মানসিকতার প্রকাশ কিনা কে জানে। যদিও একথা সত্য, এক সময় দুই কবির একটা মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তাছাড়া সাহিত্য চিন্তার ব্যবধান তো ছিলই। যদিও এমনটা ভাবতে মন চায় না যে, রবীন্দ্রনাথ নিজেই একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে চেষ্টা করতেন, নজরুলকে এড়িয়ে চলতেন। যে কারণে নজরুলের সাথে রবীন্দ্রনাথের কোন ছবি পাওয়া যায় না। নজরুল শান্তিনিকেতনে গেছেন এক কি দুবার। তখন রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। আদর-আপ্যায়নও করেছেন কবি। যেখানে রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি মুহূর্তকেই ধরে রাখার চেষ্টা করেছে তার ভক্তরা। এমন সময়গুলোতে এরা শীতল ছিলেন, তা ভাবতে কষ্ট হয়। তাছাড়া কবি হিসাবে তো বটেই, গানের রাজ্যে তো নজরুল নামের জয়জয়কার। তার নাম আধুনিক বাংলার শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে তখন। রবীন্দ্রনাথের তা অজানা ছিল না। এরপরও এমন আচরণ (!) সত্যিই অভিনব। এখানে যে একটা ষড়যন্ত্র ক্রিয়াশীল ছিল তা সহজেই অনুমেয়। কত যদু-মধুর সাথেই তো রবীন্দ্রনাথকে দেখা যায়, ব্যতিক্রম কেবল নজরুল। তার নাম নজরুল এ জন্যেই নিরাপদ দূরত্ব? সে সময়কালের চিত্রটা ছিল সে রকমেরই। যে কারণে নজরুলকে লিখতে হয়েছিল জাত-জালিয়াত খেলছ জুয়া।
আসলে রবীন্দ্রনাথের সাথে ছবি থাকা না-থাকাটা কোনো ব্যাপার নয়। নজরুল তো নজরুলই। কারো সাথে তিনি একাকার নন। আপন ঔজ্জ্বল্য এবং মহিমায় দীপ্যমান। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথও প্রতিভা খ্যাতি এবং নিজস্বতায় ভাস্বর। তাই এই দুই ব্যক্তিত্বের হাস্যোজ্জ্বল ছবি তার ভক্তরা প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু আফসোসের খবর হলো, তেমনটা ঘটেনি এবং ঘটার সুযোগ দেয়া হয়নি হয়তোবা। এই না ঘটার পশ্চাতে কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি কাজ করে থাকলে থাকতেও পারে। কারণ তৎকালীন রবীন্দ্রবলয়ের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন সমাজ যে ওয়াকিবহাল নন এমনটা তো নয়। প্রতি সপ্তাহে ‘শনিবারের চিঠি’র ঘেউ ঘেউ নজরুলকে শুনতে হয়েছে। যে জন্যে তাকে লিখতে হয়েছিল ‘আমি বলি প্রিয়ে হাটে ভাঙ্গি হাঁড়ি/ অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি’। এক ধরনের ঈর্ষার নজর পড়েছিল নজরুলের উপর। সুভাষ বসুর নেতৃত্বে নজরুলকে সংবর্ধিত করা হয়েছিল জাতির পক্ষ থেকে। সে সভা জাতীয় কবি হিসাবে ঘোষণা করে তাকে। তখন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবিত। যদিও দুই কবির বয়সের ব্যবধান অনেক। এরপরও রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে কবি হিসাবে মান্য করতেন, স্নেহ করতেন। বই উৎসর্গ, অনশন ভাঙ্গার জন্যে চিঠি এবং ধূমকেতু পত্রিকার জন্য আশীর্বাদ বাণী পাঠানোর মধ্য দিয়েই তিনি তার স্নেহ-ভালবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। বিপরীতে নজরুলও রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছিলেন সশ্রদ্ধ। কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। রবীন্দ্র প্রয়াণের পর নজরুল যে গান রচনা করেছিলেন তা এখনও তুলনারহিত। নজরুল সে গানটিতে ইলা মিত্রের সাথে নিজেও কণ্ঠ দিয়েছিলেন। যা গীত হয়েছিল আকাশবাণীতে। একটি কবিতাও রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর। সেটিও স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করেছিলেন আকাশবাণীতে। যা ছিল একজন অগ্রজকবির প্রতি আর একজন অনুজের ভালবাসা এবং শ্রদ্ধার প্রকাশ। এত ঘটনা-অঘটনার পরও নজরুলের সাথে রবীন্দ্রনাথের ছবি পাওয়া যায় না। এক প্রকার দুষ্করই বলতে হবে। থাকলে তো কোথাও না কোথাও তা প্রদর্শিত হতো। একবার নাকি নজরুলের সব ইসলামী গান ধ্বংস করে ফেলার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। দুই কবিকে তফাতে রাখার এমনি কোন ষড়যন্ত্র হয়েছিল কিনা কে জানে।
কবি নজরুল এখন একটি স্বাধীন দেশ এবং জাতির জাতীয় কবি। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথও ভিন্ন একটি দেশের জাতীয় কবি। আশ্চর্যের বিষয় হলো উভয়ই বাংলাভাষার কবি। একজন বাংলাদেশের অন্যজন ভারতের। এটি বঙ্গবাসীদের জন্য গরিমার বিষয়। এই গরিমার ভূমিতে বিভেদ রেখা টেনে দিতে ব্যস্ত কেউ কেউ। রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রিয় কবি এবং ভালবাসার কবি। ভিন্নদিকে নজরুল কেবল প্রিয়ই নন আমাদের জাতীয় কবিও বটে। তাই দেশ ও জাতির কাছে জাতীয় কবির সম্মানটা আলাদা থাকাটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক শব্দটির উপরই শ্যেন নজর পড়ছে কারো কারো। যে কারণে নজরুলকে আড়ালে ফেলে দেয়ার প্রয়াস দেখা যায় মাঝে মধ্যে। নজরুল জন্ম-মৃত্যুতে আগের মতো তেমন ধুমধাম নেই। এ ব্যাপারে আগ্রহের অভাবটাই যেন প্রকট হচ্ছে দিন দিন। উৎসব-উৎসবভাবে ভাটার টান। জীবৎকালে যেমন নজরুল রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন মৃত্যুর পরও নিচু মানসিকতার রাজনীতি তার পিছু ছাড়েনি। রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনা সঙ্গীত প্রচারে কোন বাধা না থাকলেও নজরুলের ইসলামী বা জাগরণমূলক সঙ্গীতে যেন অলিখিত একটি নিষেধের খড়গ ঝুলছে। যে কারণে প্রচারমাধ্যমগুলোতে স্বাভাবিক নিয়মে তেমন সঙ্গীত প্রচারিত একপ্রকার হয় না বললেই চলে। সে গানগুলো এখন মৌসুমী হয়ে গেছে। ঈদ বা এ জাতীয় কোন পার্বণে সিলেক্টেড কিছু গান গীত হয়ে থাকে। জাগরণী গান বিশেষ করে ইসলাম-মুসলমান বিষয়ক, সেগুলোতো অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় একেবারেই নিষেধের তালিকায়। পরিবেশটাই বর্তমানে এমন করে রাখা হয়েছে। ইচ্ছা থাকলেও অনেক নজরুল সঙ্গীতশিল্পী দ্বিধান্বিত কেবল পরিবেশের কারণে। সঙ্গীতে নজরুল তুলনা রহিত। নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত কীর্তনতো এক অনন্য উচ্চতায়। তাই নজরুল সঙ্গীত উপমহাদেশের উভয় সম্প্রদায়কেই তৃপ্ত করে। অন্যদিকে রবীন্দ্র সঙ্গীতে সেই সুযোগটি নেই। সেখানে একদেশদর্শিতাই বিষয় ভাবনা। তাই নজরুলের ঔদার্য পরিমাপহীন।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল। এখানে জাতীয় শব্দটি একটি ব্যাপক অর্থ বহন করে। যে কবির লেখালেখি জাতির আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে, হৃদয়ের স্পন্দনকে জাগ্রত করে, দৃষ্টিকে করে প্রসারিত, তাকেই জাতি বরিত করে জাতীয় কবির আসনে। সেদিক থেকে নজরুলের গ্রহণযোগ্যতা সবার ঊর্ধ্বে। সাহিত্যে যেমন গ্রহণ বর্জনের একটা রীতি চালু আছে, সামাজিক আচার বিচারেও এই গ্রহণ বর্জন সুমনোভঙ্গিরই পরিচায়ক। রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রিয় কবি ভালবাসার কবি। বাংলা সাহিত্যের বড় কবি তা দ্বিধাহীনভাবেই উচ্চারণ করা যায়। অন্যদিকে নজরুল প্রিয় এবং ভালবাসার কবি তো বটেই উপরন্তু বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তাছাড়া বড় কবি তো অবশ্যই। তাই জাতির কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা এবং সম্মান অন্য কবির চেয়ে একটু আলাদা তো হবেই। এই হওয়াটা স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতায় যারা অন্য কিছুর সন্ধান করে তারা হয় ষড়যন্ত্রকারী, না হয় আহম্মক। এখানে বড়-ছোট অবান্তর। এই যেমন ধানমণ্ডি লেকের পাশে একটি চত্বরের নামকরণ করা হয়েছে রবীন্দ্র সরোবর। এমন হতেই পারে। কারণ রবীন্দ্রনাথ আমাদের অনাত্মীয় নন। বিপরীতে অন্য একটি চত্বরকে নজরুল সরোবর নামে ঘোষণা দেওয়া উচিত ছিল। যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নামকরণের দাবি রাখে। কিন্তু অদ্যাবধি এর কোন ফায়সালা করেনি কর্তৃপক্ষ। শোনা গেছে বিষয়টি নিয়ে নাকি ফাইল চালাচালি হয়েছে, এক সময় ফাইলও নাকি চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। নজরুল সরোবরের বিষয়টি এখন শব্দহীন। নজরুল নামের প্রতিষ্ঠানগুলো এ ব্যাপারে কতটা সোচ্চার কে জানে। এদের শীতলতা বিষয়টিকে আরো পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে হয়। শোনা যাচ্ছে এলাকাবাসীর আপত্তির কারণে নাকি উদ্যোগটি পথ হারিয়েছে। ধানমন্ডি লেকের চারধার জুড়েই তো আবাসিক এলাকা। আবাসিক এলাকায় (?) রবীন্দ্র সরোবর স্থাপিত হতে কোন আপত্তি উত্থিত না হলে নজরুল সরোবরের বেলায় আপত্তি উঠছে কেন? এখানে এলাকাবাসীর আপত্তি না অন্য কোন ষড়যন্ত্রের কালোথাবা, বিষয়টি খোলাসা করা প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপটি নিতে অগণন নজরুল ভক্ত এবং নজরুল নামের প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসতে পারে। পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। জাতীয় কবির প্রতি এ ধরনের ধৃষ্টতা কোন অবস্থায়ই বরদাস্ত করা উচিত নয়, সমীচীন নয়।
নজরুল-রবীন্দ্রনাথকে ক্যামেরাবন্দী করতে তৎকালীন সমাজের কারো কারো আপত্তি বা যড়যন্ত্র থাকলেও বর্তমানকালের সমাজ রবীন্দ্র-নজরুল সরোবর পাশাপাশি রাখতে আপত্তি যে করবে না তা বলাই বাহুল্য। তাই কর্তৃপক্ষ এই জন ইচ্ছার দিকটির প্রতি সুনজর দেবেন হয়তো সহসা। কারণ জাতীয় কবির সম্মান এর সাথে জড়িত।
সাজজাদ হোসাইন খান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads