শনিবার, ১ আগস্ট, ২০১৫

আওয়ামী লীগই মধ্যবর্তী নির্বাচনের গুজব ছড়াচ্ছে : নেপথ্য মতলব কী?


হঠাৎ করে গত কয়েকদিন হলো আওয়ামীপন্থী পত্রপত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। এখানেও যেন উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, বেগম খালেদা জিয়া এখন মধ্যবর্তী নির্বাচন চাচ্ছেন এবং সেটি চাচ্ছেন যে কোনো মূল্যে। এর জন্য প্রয়োজন হলে তিনি শেখ হাসিনার অধীনেও নির্বাচন করতে রাজি আছেন। আওয়ামী ঘরানা এসব কথা কোথা থেকে পাচ্ছে এবং কিভাবে পাচ্ছে সেটা তারাই ভাল জানে। তবে যদি বিএনপি বা বেগম খালেদা জিয়ার কথা বলা হয় অথবা ২০ দলীয় জোটের কথা বলা হয় তাহলে তাদের কথাবার্তা তো অত্যন্ত পরিষ্কার। তারা মধ্যবর্তী নির্বাচন চান। অবশ্যই চান। এটি তো তাদের নতুন কোনো কথা নয়। তারা তো সেই ২০১৩ সাল থেকেই নির্বাচনের কথা বলে আসছেন এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন চাচ্ছেন। তারা তো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মানেননি। শুধু তারা কেন, বিএনপি এবং জামায়াতসহ দেশের ৪২টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩০টি রাজনৈতিক দলই সেই নির্বাচন মানেনি এবং সেটি বর্জন করেছে। আওয়ামী লীগ হাতেগোনা কয়েকটি সিকি, আধুলি, আনি, দু’আনি মার্কা তাঁবেদার দল নিয়ে তথাকথিত ইলেকশন করেছে। সেই ইলেকশনে ১০ শতাংশ ভোটও পড়েনি। ৪৩টি কেন্দ্রে ১টি ভোটও পড়েনি। একাধিক কেন্দ্রে কোনো মানুষজন ছিল না এবং কুত্তারা শুয়ে শুয়ে ঐসব কেন্দ্রে বিশ্রাম নিয়েছে। এসব কথা সকলেরই জানা। তারপরেও আওয়ামী লীগ যখন তাদের মতলব মোতাবেক মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলছে তখন এসব কথা তো উঠে আসবেই।
যেই ইলেকশনে ভোটের দিন অর্থাৎ ৫ জানুয়ারির আগেই সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য, অর্থাৎ ১৫৩ জন সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে যায় সেটি যে কেমন ইলেকশন সেটা কি দেশী এবং বিদেশী লোকজনদের বুঝতে আর বাকি আছে? ইলেকশন হলো মাত্র ১৪৭টি আসনে। তাও আবার সেখানে ৫/৭ শতাংশের বেশি ভোটার নাই। এসব দেখে শুনেই বিদেশীরাও সরকারের কাছে প্রশ্ন তোলেন যে, এটা কোন টাইপের ইলেকশন হলো? সরকারও বড় লজ্জায় পড়ে যায়। তাই ইলেকশনের আগে ও পরে একাধিকবার একাধিক স্থানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রী মিনিস্টার এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা দেশবাসী এবং বিদেশীদেরকে সান্ত¡নার বাণী শোনান। তারা বলেন যে, এটি স্রেফ নিয়ম রক্ষার নির্বাচন এবং সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন। নির্বাচন যদি অনুষ্ঠিত না হয় তাহলে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে এবং সংবিধান বহির্ভূত শক্তি ক্ষমতা দখল করবে। এসব কারো মনগড়া কথা নয়। নিচে কয়েকটি প্রমাণ দিচ্ছি।
॥ দুই ॥
১০ম সংসদ নির্বাচনের ৪ দিন আগে গত ১ জানুয়ারি বুধবার ধানমন্ডিস্থ দলের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক জরুরি সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র কাঠামো রক্ষার অত্যাবশ্যকীয় তাগিদে ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া বাস্তবসম্মত ও সংবিধানসম্মত কোনো বিকল্প নেই।’ নির্বাচনের পর সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে প্রধান বিরোধী দলসহ সকল নিবন্ধিত দল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা আশা করি, “বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেবেন। নির্বাচনের ১ দিন আগে ৩ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখ শুক্রবার সিলেটে গণমাধ্যমের কর্মীদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, “নতুন সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে বলে মনে করি না। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠিত হলে যে কোনো সময় নতুনভাবে নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।” দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সরকারের ওপর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, “সরকার এই দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর। দশম জাতীয় সংসদ পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, “নতুন সরকার পাঁচ বছর থাকবে বলে মনে করি না। নতুন সরকার গঠনের পর বিরোধী দলের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হলে যে কোনো সময় নতুনভাবে নির্বাচন করা যেতে পারে।”
নির্বাচনের পরের দিন ৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন চত্বরে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “আগামী নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা করেই সমাধান করা হবে। সেজন্য সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে, সহনশীল হতে হবে এবং সব ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ করতে হবে।” একই দিন ৬ জানুয়ারি সোমবার দুপুরে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দলীয় কার্যালয়ের সামনে ২২টি সংগঠনের সমন্বয়ে সম্মিলিত আওয়ামী সমর্থক জোটের ব্যানারে আয়োজিত হরতাল ও অবরোধবিরোধী এক মানববন্ধনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেও বিরোধী দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমঝোতায় যেতে রাজি আছে। তবে এজন্যে বিরোধী দলকে অবশ্যই সন্ত্রাস, নাশকতা বন্ধ করতে হবে বলেও জানান তিনি।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার বিকেলে ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ঢাকার আশপাশের কয়েকটি জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং সংসদ সদস্যদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন “নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি এটা বলা যাবে না। তবে নির্বাচন সর্বজনগ্রাহ্য হয়নি। বিরোধী দল এ নির্বাচনকে সীমাবদ্ধতা এনে দিয়েছে।” মন্ত্রিত্বের শপথ নেয়ার পর এই ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ৫ বছর ক্ষমতায় থাকবো এমনটি অন্যদের মত বলবো না।
॥ তিন ॥
৫ জানুয়ারির নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্য ছিল না সেটা প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে এসব মন্ত্রী মিনিস্টারের বক্তব্য থেকেই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এসব কথা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং আওয়ামী ঘরানার পত্রপত্রিকা, রেডিও টেলিভিশন এবং তাদের টকশোর টকাররা ভুলে গেছেন। আওয়ামী সরকারের আমলে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না সেটা শুধুমাত্র দেশের মানুষ কেন বিদেশীরাও বলেছে। এমনকি খোদ জাতিসংঘও সেটা বিশ্বাস করেছে। বাংলাদেশে যাতে একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয় তার জন্য তারা নিজস্ব ফর্মুলাও দিয়েছে। দেশবাসীর হয় তো মনে আছে যে, ২০১৩ সালে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে যখন দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন হচ্ছিল তখন জাতিসংঘসহ আমেরিকা ও ইউরোপ বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য চিন্তাভাবনা শুরু করে। সকলের সম্মিলিত চিন্তাভাবনার পর জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশে তার প্রতিনিধি পাঠান। এই প্রতিনিধির নাম অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। তিনি জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব।
তিনি বিবদমান সব পক্ষের সাথে আলোচনা করে ফিরে যান এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে ৪ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। এই ৪ দফাই সংকট সমাধানের রূপরেখা হিসেবে গ্রহণ করে এগুতে চায় সংস্থাটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও বৃটেন এ ধরনের মধ্যবর্তী নির্বাচনেরই পক্ষপাতী।
জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত ও সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো তার বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রধান দুই দলের মধ্যকার সমঝোতা প্রচেষ্টা নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনে সঙ্কট সমাধানে চারটি মৌলিক প্রস্তাব পেশ করেন।
জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব প্রতিবেদনের প্রথম দফায় উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান সঙ্কট সমাধান করতে হলে অবিলম্বে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মুক্তি প্রদান, তাদের অফিস খুলে দেয়াসহ স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম চালু রাখা, সভা-সমাবেশে বাধা না দেয়ার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয় দফায় তিনি উল্লেখ করেন, নির্বাচনকালীন সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ছুটি দেয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিপরিষদে দুই পক্ষের লোক থাকবেন। তবে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে দু’জন নিরপেক্ষ ব্যক্তি দায়িত্ব পালন করবেন।
তারানকো তার প্রস্তাবের তৃতীয় দফায় উল্লেখ করেন, প্রথম ২ দফা প্রস্তাবে দুইপক্ষ সম্মত না হলে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন দেশে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার যে পদ্ধতি রয়েছে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
চতুর্থ দফায় তিনি উল্লেখ করেন, সে ক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকারে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রতিনিধিরা থাকবেন। জাতিসংঘের একটি কমিটি সার্বিক বিষয় তদারকি করবেন। এরপরও সমাধান না হলে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে। তাতেও কাজ না হলে জাতিসংঘের চ্যাপ্টার ৭ অনুযায়ী সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের সুপারিশ করেছেন তিনি।
॥ চার ॥
তারানকোর এই চার দফা শুধুমাত্র জাতিসংঘেরই দাবি ছিল না, এটি ছিল ১৬ কোটি দেশবাসীর দাবি। কিন্তু এই দাবির প্রতি ভ্রƒক্ষেপ না করে শুধুমাত্র বন্দুকের জোরে সরকার নির্বাচন করে। নির্বাচনের পর তারা কথা দেয় যে, অতি শীঘ্রই তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপে বসবে এবং আলোচনার ভিত্তিতে সকলের অংশগ্রহণমূলক অতি দ্রুত আরেকটি নির্বাচন করবে।
কিন্তু ক্ষমতায় বসার পর সরকার তার সেই ওয়াদা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। এখন তারা বলছে যে, তারা ৫ বছরের জন্য ক্ষমতায় এসেছে এবং ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন হবে না। যেহেতু ৫ বছর আগে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না, তাই এই সময়ে তারা রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে কোনো সংলাপেও বসবে না।
এখন সেই আওয়ামী ঘরানাই আবার মধ্যবর্তী নির্বাচনের আওয়াজ বাজারে ছড়াচ্ছে। যারা সোজা-সরল, তারা আওয়ামী মতলব বুঝতে পারবেন না। কিন্তু যারা চালাক তারা আওয়ামী লীগের প্ল্যান ধরে ফেলেছেন।
আওয়ামী লীগের সেই প্ল্যান হলো (১) যত দ্রুত গতিতে সম্ভব খালেদা জিয়াকে এক বা একাধিক মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে কারাগারে প্রেরণ করা। ফলে তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হয়ে যাবেন।  (২) এক বা একাধিক মামলায় তারেক রহমানকে দোষী সাব্যস্ত করে কারাগারে প্রেরণ করা। ফলে তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হয়ে যাবেন। (৩) বিএনপির সিনিয়র নেতাদেরকে এক বা একাধিক মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে কারাগারে প্রেরণ করা। ফলে তারা নির্বাচনের অযোগ্য হয়ে যাবেন। (৪) জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে নেতৃত্ব শূন্য। ইতোমধ্যেই তাদের হাজার হাজার কর্মী কারাগারে আটক রয়েছেন। এর ফলে জামায়াতও নির্বাচনে অকার্যকর হয়ে যাবে।
এভাবে মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে তারা ফাঁকা মাঠে গোল দেবে। তাই তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথাবার্তা বাজারে ছাড়ছে।
আসিফ আরসালান

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads