সোমবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৫

সিটি নির্বাচন: কিছু কথা


ঢাকার উত্তর, দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনকে ঘিরে চারদিকে নানা হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে বলে মনে হয়।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে যাচাই বাছাই শেষে ১২ জন প্রার্থী মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বলে জানা গেছে। ঢাকা দক্ষিণে ২৩ জন এবং উত্তরে ২৩ জন মেয়র প্রার্থীর মনোনয়ন বৈধ ঘোষিত হয়েছে। ইতঃপূর্বে অনীহা ঘোষণা করলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন সিটি নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন। এই নির্বাচনে বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু ও নাসিরুদ্দিন পিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে এবং তারা প্রার্থিতা ফিরে পাবার জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানা গেছে। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পুলিশের সার্টিফিকেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে জানা গেছে।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রধান ভিত্তি। আবার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কয়েকটি অপরিহার্য উপাদান রয়েছে। এই উপাদানগুলো হচ্ছে:
ক) একটি কার্যকর আইনগত কাঠামো। নির্বাচনী আইনে অবশ্যই নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে নির্বাচন যন্ত্র পরিচালনা, ভোটাধিকারের সংজ্ঞা, নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ ও তার সুস্পষ্ট যৌক্তিক ভিত্তি এবং নীতিমালা প্রার্থী নির্বাচন, ভোটার তালিকা চূড়ান্তকরণ, নির্বাচনী প্রচারণার নিয়ম-নীতি, ব্যালট পেপারের গোপনীয়তা, ভোট গণনা, বিরোধ নিষ্পত্তির সাংবিধানিক ব্যবস্থা এবং গণমাধ্যমের সান্নিধ্য প্রভৃতি বিষয়ে অবশ্যই পরিষ্কার থাকতে হবে। বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে একটি নির্বাচন কমিশন আছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছাড়াও এই কমিশনের আরও তিনজন সদস্য আছেন। তারা পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করার কথা এবং আইনগত কাঠামোর অধীনে তাদের পক্ষ থেকে যে কাজগুলো করার কথা তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আমি ওপরে পেশ করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে এই যে, আমাদের নির্বাচন কমিশন তাদের এ দায়িত্বগুলো পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে যেমন সমন্বয় নেই, তেমনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ক্ষমতাসীন দল ও সরকারকে সন্তুষ্ট করার জন্য অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শনের একাধিক নজির স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নির্বাচন কমিশনে পরিণত হয়েছে। এই কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও তারা তা করছেন না এবং ক্ষমতাসীন দলের সুবিধার জন্য নির্বাচনী যন্ত্রের ব্যবহার, নির্বাচনী এলাকার সীমা নির্ধারণ, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব বিশেষ করে বিরোধী দলের যোগ্য প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাতিল এবং সরকারি দলের অযোগ্য প্রার্থীদের প্রার্থিতো অনুমোদন প্রভৃতির ন্যায় অনৈতিক কাজে লিপ্ত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দ্বিধাবিভক্তি সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের এমন একটি কাজ যা জাতীয় স্বার্থ নয় বরং দলীয় স্বার্থকেই সামনে রেখে করা হয়েছে। জনমত যাচাই না করেই সরকার ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে উত্তর দক্ষিণে বিভক্ত করে ফেললেন এবং এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কোনও ভূমিকাই পালন করলেন না। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রী-উপমন্ত্রী এবং সরকারি দলের নেতা-নেত্রীরা যে সিদ্ধান্ত দেন তারা তাই বাস্তবায়ন করেন। সরকার দেখলেন, জনপ্রিয়তা তাদের শূন্যের কোঠায় তখন তারা কর্পোরেশনকে এমনভাবে ভাগ করলেন যাতে তাদের সুবিধা অনুযায়ী নির্বাচন করে সফল হওয়া যায়। বিভক্ত দুই কর্পোরেশনে নির্বাচন করার প্রশ্নটি একাধিকবার উঠেছিল। কিন্তু তা হয়নি। কমিশন থেকে বলা হয়েছিল যে, দুই কর্পোরেশনের সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি চূড়ান্ত না করা পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত থাকবে। এখন ঢাকাসহ সারা দেশে ২০ দলীয় জোটের হাজার হাজার নেতা-কর্মী যখন জেলে, তখন খালি মাঠে গোল করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সরকার বেছে নিয়েছেন এবং নির্বাচন কমিশনও সরকারের মনোরঞ্জনের মোক্ষম একটি সুযোগ পেয়েছে। ক্ষমতাসীন দল এবং নির্বাচন কমিশন উভয়ের এখানে একটি অভিন্ন ধারণা ছিল। তারা সম্ভবত মনে করেছিলেন যে, বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের কেউ কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। নির্বাচনী বাতাস এককভাবে তাদের অনুকূলেই বইবে। আবার নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান বন্দী মুক্তি, জুলুম নির্যাতন বন্ধ ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে দেশব্যাপী অবরোধ-হরতালসহ যে আন্দোলন চলছে, তা থেকে মানুষের দৃষ্টি ফেরানোর কাজেও এই নির্বাচনকে ব্যবহার করা যাবে। তাদের এই কৌশল কাজে লেগেছে কিনা এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি ছাড়া বিরোধী দলের সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তে বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতার প্রতিফলন ঘটেছে কিনা ভবিষ্যতই তা বলে দেবে। তবে আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, নাকের বদলে নরুন নিয়ে অনেকে সন্তুষ্ট।
আমি নির্বাচনের আইনগত কাঠামো এবং নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলাম, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বিভক্তির পর উত্তর ও দক্ষিণ কর্পোরেশনের সীমানা নির্ধারণ ছিল অপরিহার্য। নিয়মানুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে সীমানা নির্ধারণ করে নোটিফিকেশন জারির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর মন্তব্য বা আপত্তি আহ্বান করতে হয় এবং শুনানি শেষে চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ঢাকার সিটি কর্পোরেশন সমূহের ক্ষেত্রে এই কাজটি আদৌ হয়েছে কিনা আমার সন্দেহ রয়েছে। আর যদি সরকার/নির্বাচন কমিশন এই কাজটি করেও থাকেন তা অত্যন্ত গোপনে করেছেন যা অনভিপ্রেত। এই প্রশ্নটি এই জন্য তুলছি যে উত্তরার ১৩ নং সেক্টর উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত নয় এ কথাটি নমিনেশন পেপার সাবমিট করার আগের দিন পর্যন্ত আমি জানতাম না, জেনেছি আব্দুল আওয়াল মিন্টুর আবেদনপত্র খারিজ হবার পর। জানা গেছে যে ভোটার তার নমিনেশানের প্রস্তাবক ছিলেন তিনি ১৩ নং সেক্টিরের ভোটার। এই বিষয়টি গোপন রাখার জন্য নির্বাচন কমিশন দায়ী বলে আমি মনে করি। যে দায় নির্বাচন কমিশনের সে দায়ের কারণে কোনও প্রার্থীর আবেদন খারিজ হতে পারে না।
খ) অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দ্বিতীয় উপাদান হচ্ছে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, গণমাধ্যম এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ  আচরণ এবং সকল দলের জন্য মাঠের সমান মসৃণতা। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় নিরপেক্ষ কোনও আচরণ লক্ষ্য করা যায় না, রাজনৈতিক মামলার আসামী বিরোধীদলীয় প্রার্থী এবং কর্মীদের বাসা, কর্মস্থল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত হানা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সারা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে প্রকারান্তরে এই বার্তাটিই দিচ্ছে যে নির্বাচন তাদের জন্য নয়। আবার নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকেও প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে যে কোনও প্রার্থীকে গ্রেফতারের জন্য তার অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না। এখানে স্মরণ করা দরকার যে সিডিউল ঘোষণার দিন থেকে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলে যাওয়াই হচ্ছে নিয়ম। এই নিয়ম ভঙ্গ করে নির্বাচন কমিশন যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অধীনে থাকে তাহলে নির্বাচনী কর্তৃপক্ষের প্রতি তাদের কোনও জবাবদিহিতা থাকে না। যেখানে সরকার, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্র্যাকেটভুক্ত হয়ে যায় সেখানে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হয় না। জনগণ তাদের ইচ্ছা অুনযায়ী ভোট দিতে পারে না। এক্ষেত্রে ভয়ভীতি, সন্ত্রাস, ব্যালট পেপারে ইচ্ছামত সীল মারা, বাক্স ছিনতাই, ভোট গণনায় হস্তক্ষেপ, জাল ভোট প্রভৃতি বেআইনী তৎপরতা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই অপকর্মগুলো প্রতিহত করার জন্য সরকার রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, সশস্ত্র বাহিনী, মানবাধিকার সংগঠন, গণমাধ্যম সকলকেই এগিয়ে আসতে হয়। সিটি নির্বাচনে যে আবহ সৃষ্টি হয়েছে তাতে সরকার যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হন তাহলে নির্বাচন একটি প্রহসনে পরিণত হতে পারে।
গ) সকল রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা হচ্ছে নিরপেক্ষ নির্বাচনের তৃতীয় শর্ত। সরকার তিন মাস পর বিএনপির কেন্দ্রীয় দতফর খুলে দিয়ে একটা ভালো কাজ করেছেন বলে আমার বিশ্বাস। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ও মহানগরী দফতর গত ১২৯৩ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। পুলিশ অঘোষিতভাবে এগুলো বন্ধ করে রেখেছে। দলটির জেলা-উপজেলা দতফরগুলোর অবস্থাও প্রায় একই রকম। সরকার যদি এই দফতরগুলোও খুলে দেন অথবা খুলতে বাধা না দেন তাহলে পারস্পরিক বিদ্বেষ অনেক হ্রাস পাবে এবং তাতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুনরুদ্ধার সহজ হতে পারে।
সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ক্ষমতাসীন দল ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণের সময় তাদের ক্যাডারদের ব্যবহার করেছেন। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা এখানে ছিল শিখন্ডির ন্যায়। ফলে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির বেলায় দলীয় লোকরাই প্রাধান্য পেয়েছে। এমনকি নাবালক ছেলে-মেয়েরাও এখানে ভোটার। বিরোধী দলের গন্ধ আছে এ ধরনের ব্যক্তিরা ভোটার হবার সুযোগ পায়নি। কর্পোরেশনের বিভক্তি এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ উভয় ক্ষেত্রেই দলীয় চিন্তাধারা প্রাধান্য পেয়েছে। প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রেও দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়ে কর্পোরেশন এলাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীর এমনভাবে সমাবেশ ঘটানো হয়েছে যাতে সকল পর্যায়ে সহজে দল লাভবান হতে পারে। নির্বাচনী কর্মকর্তা বিশেষ করে প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগেও যদি দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি বহাল থাকে তাহলে এই নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। ২০ দলীয় জোট যদি এই জট ভাঙ্গতে পারেন তাহলে নির্বাচনে জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন দেখা যেতে পারে, না হলে নয়।
ড. মোঃ নূরুল আমিন 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads