বৃহস্পতিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৫

সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও নীতিহীনতার পরিণতি


২৮শে এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৩টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোন সমীকরণই যেন মিলানো যাচ্ছে না। সরকার পক্ষের সকল প্রার্থীর মামলা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রত্যাহার করা হচ্ছে- উপরন্তু ২০ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাসমূহের প্রত্যাহার তো দূরের কথা, পুলিশী হয়রানি আর গ্রেফতার আতঙ্কে প্রার্থীরা সঠিকভাবে ভোটারদের কাছে যেতে পারছেন না। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির মুখরোচক কথা যতই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন না কেন- মামলা আক্রান্ত প্রার্থীদের গ্রেফতার করতে পুলিশকে রীতিমত উস্কানি দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মোবারক আলী। গত ১৭ এপ্রিল ‘আ: লীগের ১৬ প্রার্থীকে মামলা থেকে রেহাই’ শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলো’র সংবাদ শিরোনামে উল্লেখ করা হয় যে, ‘ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ১৬ জন প্রার্থীকে ২২টি হত্যা মামলা ও হত্যা প্রচেষ্টা মামলা থেকে বিভিন্ন উপায়ে রেহাই দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে নয়জনের পাঁচটি হত্যা ও সাতটি হত্যা চেষ্টার মামলা আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার প্রত্যাহার করা হয়।’ একদলকে মামলা প্রত্যাহারের মাধ্যমে সোনার ছেলে বানানো আর বিরোধীদলকে মামলায় হয়রানি করার কূটকৌশল দৃশ্যমান হলেও ইসি’র না দেখার ভান জনমনে হাস্য কৌতুকের জন্ম দিয়েছে। ‘প্রার্থীরা অসমহায়, নির্বিকার ইসি’ শিরোনামে ঐ একই দিনে দৈনিক নয়া দিগন্তে ১ম পৃষ্ঠায় উদ্বেগজনক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়, ‘ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ১২নং ওয়ার্ডের প্রার্থী হিমাংশু কিশোর দত্তকে নির্বাচন থেকে সরে দাড়ানোর জন্য মীরপুর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পুত্র ফয়সাল হুমকি দিয়েছে অন্যথায় গুলী করে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে টেলিফোনে জানানোর পরও কোন প্রতিকার দৃশ্যমান হয়নি। ঢাকা দক্ষিণের এক ওয়ার্ড কাউন্সিলার প্রার্থীকে পল্টন থানা পুলিশ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে সরকার সমর্থিত এক প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য। ঢাকা সিটি উত্তরের ১৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলার প্রার্থী এডভোকেট এনায়েত হোসেনের নির্বাচনী প্রচার কর্মীদের ৩ দফা হামলা চালিয়েছে নাজমুল আলম জুয়েলের সরকার সমর্থিত লোকজন। এইভাবে অসংখ্য অভিযোগ আছে যার প্রতিকার ক্ষমতাবান নির্বাচন কমিশন করছে না বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। কাজী রকিবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন তাদের একচোখা নীতিমালার জন্য দেশ-বিদেশে বহুভাবেই নিন্দিত হয়েছে। এ ব্যাপারে ‘কানে দিয়েছি তুলো’ নীতিতে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেয়াতে ২০১৪ সনের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিশ্বব্যাপী ধীকৃত হয়েছিল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো : জাতিসংঘ সহকারী মহাসচিব তারাঙ্কো কর্তৃক চলমান জাতীয় সংলাপের মাঝখানে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা ধ্বংস করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কর্তৃক হঠাৎ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা। সংলাপের একটা চমৎকার পরিণতির ব্যাপারে দেশ-বিদেশে যখন আশাবাদ উচ্চকিত হচ্ছিল, তখন তিনি ওয়াদা ভঙ্গ করে কার ইঙ্গিতে সংবিধানের দোহাই তুলে ‘সিডিউল’ ঘোষণা করলেন- জাতি তা আজও জানতে পারেনি। জাতিসংঘ ও বিদেশী সকল নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল এ নির্বাচন বয়কট করলেও একদলীয় এ নির্বাচনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার গাল ফুলিয়ে ও তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ‘অত্যন্ত সফল’ নির্বাচনের সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। তাই আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন কতটুকু সফলতার মুখ দেখবে- মহান আলাহ্পাকই তা জানেন। ‘আদর্শ ঢাকা আন্দোলন’-এর আহ্বায়ক প্রফেসর এমাজুদ্দিন গত ১৭ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ইসি’র ভূমিকাকে ভয়ঙ্কর বৈষম্যমূলক বলে অভিহিত করেছেন। তিনি সরকার সমর্থিত ঢাকা দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকনের ‘জানে বাঁচতে চাইলে ইলিশ মাছ মার্কায় ভোট দিন’ মন্তব্যে ইসি’র নির্বিকারত্বে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের বিএনপি’র সমন্বয় কমিটির সভাশেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেন, প্রায় ১৬ জন আওয়ামী সমর্থক কাউন্সিলর প্রার্থীর মামলা প্রত্যাহার এবং ঢাকা উত্তরের বিএনপি’র কাউন্সিলর প্রার্থী কাউসার আহমেদকে গ্রেফতারের মাধ্যমে সরকার ও ইসি’র মনোবৃত্তির পরিচয় পাওয়া গেছে। তবুও বিএনপি মাঠে থাকবে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ চলমান গণআন্দোলনের অংশ মাত্র। তিনি বলেন, আমরা লিখিত অভিযোগ করছি, তবে নির্বাচন কমিশনের কি চোখ-কান নেই? অপর সমন্বয়ক ব্রিগেডিয়ার (অব:) হান্নান শাহ বলেন, ইসি’র নিয়োগপ্রাপ্ত ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিস্ট্রেটকে চোখে দেখা যায় না। কোথায় কি করেন, বোঝা যায় না। তিনি নির্বাচনের ৭ দিন পূর্ব থেকে সেনাবাহিনী নিয়োগের দাবি জানান।  ঢাকা ও চট্টগ্রামের শান্তিপ্রিয় বাসিন্দারা যতই নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে ততই এক অজানা আশঙ্কায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন। কিছুতেই তারা যেন এক শান্তিপূর্ণ আশঙ্কায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন। কিছুতেই তারা যেন এক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে মেয়র নির্বাচনের কল্পনা করতে পারছে না। কেননা এই নির্বাচন কমিশনের আওতায় ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও দেশব্যাপী মহাবিতর্কিত উপজেলা নির্বাচন জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। সরকারের প্রতি শতভাগ আনুগত্যের ফলে ইসি আজ হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তবে তা থেকে বেরিয়ে আসার মোক্ষম উপায় হলো আসন্ন ৩টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার যারপরনাই আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করা। কিন্তু সে আশা আমরা করতে পারিÑ ‘কিন্তু ইসি জাতির সামনে উদাহরণ সৃষ্টিকারী ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসবে কি? নীতি, নীতিমালা ও নীতিবোধ এখন যেন পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু। সমাজ, প্রশাসনসহ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে যেন তা তিরোহিত হতে চলেছে ক্রমাগতভাবে। জনগণকে প্রতারণা করতে কতই না মায়াকান্না আর ছেলে ভুলানো কথা শোনা হচ্ছে, জনগণকে ভুলানো হচ্ছে প্রকৃত ইতিহাসের কথকতা। সেখানেও গোয়েবলসের নীতিমালা ক্রীয়াশিল! ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে কত চতুরতা। কখনও বা ‘ভিশন টুয়েন্টি ওয়ান,’ কখনও বা ২০৪১ সালে মধ্যম আয়ের দেশের কল্পনা বিলাসিতার কল্পকথা! গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে চলছে গণতন্ত্রের নামাবলী মার্কা ‘বাকশালী’ শাসনÑ সেখানে জনগণকে ‘হাওয়াই মিঠাই’ খাওয়ানোর কৌতুক শোনানো হচ্ছে বার বার। বেয়াড়া জনগণ, মানবাধিকার সংস্থা আর বিদেশী রাষ্ট্রসমূহ বিংশ শতাব্দির মদিনা সনদ(?) মার্কা এই শাসনকে কেন ‘আহলান সাহলান’ বলে অভিনন্দিত করছে না- সেজন্য শীর্ষ নেতৃত্বের কতই না আহাজারী! দলীয়করণকৃত প্রশাসন, পুলিশ-র‌্যাব, বিজিবি দিয়ে নির্বিচার দমনেও খুশী নন তিনি। কিছুদিন পূর্বে তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, ‘পুলিশ কি অস্ত্র পকেটে পুরে রাখবে?’ অদ্ভুত, এতো আস্কারা পেয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের এখন ‘তাধিন তাধিন’ অবস্থা। জনগণকে রক্ষার বদলে শাসকগোষ্ঠীকে রক্ষার নীতিহীন ক্রিয়াকা-ে তারা এখন লিপ্ত। যার প্রমাণ মিলল গত ১লা বৈশাখের (১৪২২ বঙ্গাব্দ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৭-৩০ মিনিট পর্যন্ত বর্ষবরণ উৎসবে। রাজু ভাষ্কর্যের সামনে দেড় ঘণ্টাব্যাপী সুসজ্জিত বঙ্গললনাদের ওপর যেভাবে সোনার ছেলেরা নারকীয় উন্মাদনায় বিবস্ত্রসহ যৌনাচার চালালো, পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে আনতিদূরে এসব আচরণে পুলিশ কোনো পদক্ষেপই নিতে পারলো নাÑ ভাবতেই বিস্মিত হতে হয়। ‘শিবির-জামায়াত-বিএনপি’ নির্মূলে এতো পারঙ্গম পুলিশ বাহিনী হাজার হাজার জনগণের সামনে মা-বোনদের রক্ষার্থে কিছুই করতে পারলো না, ভাবলেও বিস্মিত হতে হয়। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা যেসব ধর্ষকামীদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করলোÑ তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে ধর্ষকদের সহায়তাকারী হিসেবে প্রমাণ করে বিশ্বের কাছে তারা আমাদেরকে অপমাণিত করেছে। মহামান্য হাইকোর্টের সুয়োমুটো রুল জারি না হলে ওসব বহিরাগত কাজ বলে দায়সারা মন্তব্য করে পার পাওয়ার চক্রান্ত চলছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত, তিনি নিজেও মহিলা। আশা করি উপযুক্ত তদন্ত শেষে দোষী ব্যক্তি ও দায়িত্ব অবহেলাকারীদের উপযুক্ত শাস্তির বিধান তিনি করবেন। পবিত্র কুরআনে জুলুমবাজ জালিমদের সম্পর্কে ও তাদের সহায়তাকারীদের সম্পর্কে কতভাবেই না হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। সূরা ইব্রাহিমে আল্লাহ পাক বলেন, ‘জালিমদের কর্মকা- স¤পর্কে আল্লাহকে কখনো উদাসীন ভেবো না। তবে তিনি তাদেরকে শুধু একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত অবকাশ দেন।’ ক্ষমতামদমত্ত জালিমরা নিজেদের পতনের কথা চিন্তাও করে না। তোষামোদকারী ও চাটুকারদের পরিবেষ্টিত অবস্থায় ক্ষমতাসীনেরা সাময়িকভাবে হলেও ‘ক্ষমতাহীন’ হওয়ার কথা কল্পনায় আনতে নারাজ কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা হলো : ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে শোষকেরা যতো চক্রান্তই করুক না কেন, নির্মম পরাজয় ও পরাভব ততদ্রুতই তাদের নিকট অমোঘ নিয়তী হয়ে আবির্ভূত হয়। কিন্তু জালিমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। ইতিহাসের এটাও একটি শিক্ষা! পবিত্র আল কুরআনে মহান আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা কি এর আগে কসম খেয়ে বলতে না যে তোমাদের পতন নেই! যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছে, তোমরা তো তাদের বাসস্থানেই বাস করছো এবং সেসব জালিমের সাথে আমি কেমন আচরণ করেছি- তা তোমাদের স্পষ্ট হয়ে গেছে। উপরন্তু আমি তোমাদের জন্য বহু উদাহরণ দিয়েছি (সূরা ইবরাহিম)।’ মহাগ্রন্থ আল কুরআন থেকে আল্লাহপাক আমাদের সকলকেই শিক্ষাগ্রহণের তৌফিক দিন আমিন!!
পাদটীকা : দুঃস্বপ্ন দেখলেও যেখানে জামায়াত-শিবিরের উপর দোষ চাপানো ক্ষমতাসীনদের দুরারোগ্য ব্যধিতে রূপ নিয়েছে- সেখানে সরকার নিয়ন্ত্রণ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মুখপাত্রদের কথার ধরনে গত ১লা বৈশাখের যৌন হয়রানির দোষারোপ তাদের ওপর বা মৌলবাদীদের ওপর না চাপালে কেমন দেখায়? পুলিশ বাহিনীর পাহাড়সম ব্যর্থতাকে পাশ কাটাতে ডিএমপি’র যুগ্ম কমিশনার ও মুখপাত্র গত ১৭ এপ্রিল বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে পয়লা বৈশাখের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হচ্ছিল। একটি মহল পয়লা বৈশাখের সংস্কৃতিতে ‘শিরক’ বলে প্রচার চালাচ্ছিল। তিনি সন্দেহ করছেন, যারা এই প্রচারণা চালিয়েছে তারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ৪র্থ পৃষ্ঠা, ১৮ এপ্রিল, ২০১৫)। জনৈক বেরসিক পাঠকের মন্তব্য : জামায়াত শিবির কিম্বা হেফাজত-খেলাফতের কর্মীরা দাড়ি-চুল কামিয়ে, প্যান্ট শার্ট পড়ে এরকম ঘটনা তো ঘটাতেও পারে? অতএব, মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads