সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৫

পেশীশক্তি এখন নির্বাচনের নিয়ন্ত্রণে


দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে সবাই উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় দিনাতিপাত করছে। প্রতিটি মহুুর্ত কাটছে ভয় আর শংকায়। কখন জানি কার প্রিয়জন চলে যায় না ফেরার দেশে অথবা হয়ে যায় গুমের শিকার। এই যখন দেশের অবস্থা তখন সরকার তড়িঘড়ি করে ১৯ মার্চ ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে চলমান আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। দেশের জনগণ নির্বাচনমুখী হওয়ায় সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আনন্দের সুবাতাস বইতেছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের হাজারো ভোটারদের মনে। সাধারণ জনগণের মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল এই সরকারের আমলে আর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। অবশেষে প্রায় এক যুগ পর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনরে নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচন একেবারে দোড়গোড়ায় হলেও ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ’এর নমুনা দেখতে হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার ওপর বর্বরোচিত হামলার মধ্যদিয়ে।
আওয়ামী সরকার এক ঢিলে দুই পাখি মারার ফন্দি করেছে বলে অনেকে মনে করেন। তবে আশার কথা হচ্ছে, এই ফাঁদে বিরোধীদল পা না দিয়ে উল্টো আওয়ামী-লীগকে ফাঁদে ফেলেছে সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে। বিএনপির নেত্রীর ওপর বার বার হামলা হওয়ার পিছনের রহস্য হচ্ছে বিএনপি যেন নির্বাচন বয়কট করার ঘোষণা দেয়। আশা করি বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জনগণের ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে পিছপা হবেন না। সরকার যদি মনে করে ৫ জানুয়ারির মতো একটি নির্বাচন করে নিজেদের প্রার্থীদেরকে জয়ী করবেন তাও করতে পারবেন, কারণ সরকারের হাতে পেশীশক্তির পাশাপাশি আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর দলবাজরা রয়েছেন। কিন্তু জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে, ভুলুন্ঠিত করে পৃথিবীর কোনো শাসকই ক্ষমতায় বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অগ্রণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে ধ্বংস হয়েছে জার্মানীর গণতন্ত্র ও অর্থনীতি। ইতিহাসের কী নিষ্ঠুর রায়! যে চসেস্কুর একটিমাত্র অংঙ্গুলির নির্দেশে প্রাণ দেয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তো লক্ষ সৈনিক তারাই আজ চসেস্কুর প্রাণ নেয়ার জন্য এগিয়ে আসছিল সংগীন উঁচিয়ে। কত সুন্দর কথাই না বলে গেছেন ভলতেয়ার, পীড়ন করলে সে পীড়ন এসে একদা পীড়া দিবে তোমাকেই।
বাংলাদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক আদর্শে বরাবর সচেতন বলেই প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তারাই অগ্রপথিক। গণতন্ত্রের জন্য তারা লড়তে যেমন প্রস্তুত থাকে তেমনিভাবে নিজের প্রিয় জীবনটাও বিলিয়ে দিতেও পিছপা হন না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, গণতন্ত্র  সাধারণ মানুষের দ্বারা বিনষ্ট হয়নি হয়েছে ক্ষমতার মসনদে আজীবন টিকে থাকার স্বৈরাচারী আচরণ থেকে।
তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রচার মোটামোটিভাবে শান্তিপূণভাবেই চলছিল। যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তাদের মধ্যে সৌহার্দ্যরে তেমন ঘাটতি ছিল বলে মনে হয়নি। এরকম একটি সুন্দর পরিবেশের প্রত্যাশা করছিল তিন সিটির হাজারো ভোটারেরা। সকলে আশা করছিল অতীতে যা হবার তাই হয়েছে। এই নির্বাচনে নির্ভয়ে নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাবে। কিন্তু হঠাৎ করেই গত সোমবারে নির্বাচনের ছন্দপতন ঘটলো। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালাতে গিয়ে সরকারদলীয় ছাত্রলীগ যুবলীগ কর্মীদের দ্বারা হামলার শিকার হয়েছেন তিন তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ২০ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পক্ষে প্রচার চালানোর সময় জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মীরা বেগম জিয়ার গাড়িবহরে বেপরোয়া হামলা চালায়। আশপাশের বিভিন্ন ভবনের ওপর থেকে বৃষ্টির মতো ইট ছোড়া হয় খালেদা জিয়ার গাড়ি ও নিরাপত্তা কর্মীদের (সিএসএফ) এর গাড়ি লক্ষ্যে। ভাংচুর করা হয় বহরের অধিকাংশ গাড়ি। আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে এ তা-ব চলে। এতে কিছু সময়ের জন্য কারওয়ান বাজার এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। হামলাকারীদের হাতে ছিল কালো পতাকা। খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা সমন্বয়কারী মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর জানান, হামলার সময় খালেদা জিয়ার গাড়ি লক্ষ্য করে খুব কাছ থেকে গুলী করা হয়েছে।
এই নারকীয় হামলার পরের দিন ঢাকা দক্ষিণের বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মিজা আব্বাসের পক্ষে প্রচার চালানোর সময় আওয়ামী লীগের কর্মী বাহিনী বেগম জিয়ার গাড়ি বহরে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে হামলা চালায়। তৃতীয় দিনের মতো বুধবার বিকেলে রাজধানীর বাংলামোটরে ছাত্রলীগ নেতা কর্মীরা খালেদা জিয়ার বহনকারী গাড়িতে হামলা করেছে। এ হামলায় খালেদা জিয়ার গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে যায়। এ সময় তিনি গাড়িতেই ছিলেন। এ ছাড়া তার নিরাপত্তাকর্মীদের (সিএসএফ) কয়েকটি গাড়িও ভাংচুর করা হয়। এ হামলায় খালেদা জিয়ার একজন উপদেষ্টা, তার পাঁচজন নিরাপত্তাকর্মী এবং একজন গাড়িচালক আহত হন। ছাত্রলীগের কর্মীরা একজন সিএসএফ সদস্যকে পিচঢালা রাজপথে  প্রকাশ্যে পুলিশের সামনে পিটিয়েছে। অথচ পুলিশ বাহিনী ছিল নিরব দর্শকের ভুমিকায়।
সরকারের উচিত ছিল দেশনেত্রীর নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা। কিন্তু  তা না করে এই বর্বর হামলা চালানোর আগেই তারা বিএনপিনেত্রীর পুলিশ প্রহরা প্রত্যাহার করে নিয়েছে । আল্লাহ না করুক সেদিন যদি ঘাতকের বুলেটের আঘাতে বেগম জিয়া নিহত হতেন, তাহলে দেশের স্বাভাবিক অবস্থা কতটুকু বলবৎ থাকতো তা আল্লাহপাকই ভালো জানেন। দেশের সাধারণ নাগরিকরা এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডব্লিউ গিবসন নিন্দা জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে সকল পক্ষকে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। সেই সাথে বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে বলেও জানানো হয়েছে। যে কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণায় হামলা হলে সংগত কারণেই জনমনে ভীতি সৃষ্টি হতে পারে, যার প্রভাব পড়বে ভোট গ্রহণে। কাজেই এ ধরনের নারকীয় ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেজন্যে নির্বাচন কমিশনকে এক চোখে নুন আর এক চোখে তেল বিক্রি করলে চলবে না। অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে যারা হামলা করেছে সরকার প্রধান তাদেরকে শাস্তি দেয়ার কথা বলা তো দূরের কথা উল্টো বললেন, বেগম জিয়া নির্বাচনী প্রচারণার নামে নাটক করছেন, মানুষকে কষ্ট দিচ্ছেন। বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যদি নাটক করে থাকেন তাহলে এই নাটকের ভিলেনের ভূমিকায় যারা গাড়ি ভাংচুর করছে, তাদেরকে শাস্তি দিতে এতো নাটকীয়তা কেন? বেগম জিয়ার প্রচার অভিযানে হামলার ঘটনার কয়েকদিনে পুলিশ কি আক্রমণকারী কাউকে গ্রেফতার করেছে? করেনি কেন? তাদের গায়ে হাত দেয়া যাবে না বলেই কি?
প্রধান নির্বাচন কমিশনার মহোদয়কে বিনয়ের সাথে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসরে বাংলাদেশ-ভারতের ক্রিকেট খেলায় আম্পায়ারদের পক্ষপাতিত্বের কারণে বাংলাদেশ পরাজিত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তবে একশত ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারবে না কেউ এ পক্ষপাতিত্ব না হলে বাংলাদেশই জয়ী হতো। আমার মনে হয় না ক্রিকেটপ্রেমিকেরা সেটা বলতে চান, আবার তারা এটাও দাবি করেন না যে পক্ষপাতিত্বটা বাংলাদেশের পক্ষে হলো না কেন? শুধু বাংলাদেশ বললে ভুল হবে সারা দুনিয়ার ক্রিকেটপ্রেমিরা বলতে বাধ্য হয়েছেন খেলাটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে হয়নি। কমিশনার সাহেব, দয়া করে কারও সামনে নয়, যখন একাকী থাকেন তখন কিছুক্ষণের জন্যে চোখ বন্ধ রেখে একটু ভাবুন তো, নিরপেক্ষ আম্পায়ার না থাকলে কী হয়? ক্রিকেট খেলার আম্পায়ারের পক্ষপাতিত্বের কারণে একটি দল হেরে যেতে পারে। কিন্তু আপনি যদি পক্ষপাতিত্ব করে বিবেকের কাছে হেরে যান তাহলে হেরে যাবে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ১৬ কোটি মানুষ। আপনার জীবনে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের যে কলংক লেগে আছে তা থেকে রেহাই পেতে একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দিয়ে প্রমাণ করে দিন আপনি জনগণের খাদেম কারও আজ্ঞাবহ নন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads