বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৫

পান্তা রাইস উইথ ইলশা ফিস


ইলিশের সাথে পান্তার সম্পর্ক যে কেমন সে বিষয়ে একটি অভিসন্দর্ভ তৈরি করে ফেলতে পারেন কেউ। কত বিষয়েই না গবেষণাপত্র রচনা হচ্ছে ইদানীং। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘পান্তা ইলিশ’ এ বিষয়টির ব্যাপারে চিন্তা করতে পারেন সহসা। একদিকে যেমন বিষয়টি অত্যন্ত জনপ্রিয় অন্যদিকে জননন্দিতও। মহার্ঘ্যতো বটেই। মহার্ঘ্য কারণ অনেক অর্থ ব্যয়ের পর এমন একটি ‘মুখরোচক’ খাবারের নাগাল পাওয়া যায়। মিডিয়াগুলো এরকম সংবাদই জানায় ফি বছর। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। গরুর মূল্যে ইলিশ কিনেছে কেউ কেউ। তাই পহেলা বৈশাখের আনন্দটাই আলাদা, অন্য ধরনের। বৈশাখ আগমনের মাসখানেক আগ থেকেই ইলিশ বধের ধুম পড়ে। তবে ধুম পড়লেও ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। বাজারে আসতে দেয়া হয় না। কোন কোন সময় খবর চাউর হয় নদী থেকে ইলিশ গায়েব। এ সময় ইলিশ তার স্বগৃহে পালিয়ে যায় কিনা কে জানে। বৈশাখী ভয়ে ইলিশের এমন আচরণ হয়তো বা। পান্তার থালায় পর্যাপ্ত পানি থাকে তাই ইলিশের এমন আচরণ শোভন কিনা গবেষকরা এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারবেন। জনৈক বন্ধু গবেষণাপত্রটির একটি চমৎকার শিরোনাম উপস্থিত করেছেন। শিরোনামটি হলো ‘পান্তা রাইস উইথ ইলশা ফিস’। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটি বিবেচনায় আনতে পারেন। কারণ এই শিরোনামটিতে একটা আন্তর্জাতিক আন্তর্জাতিক গন্ধ আছে। নব্য গবেষকদের জন্য সুখবর, গন্ধটা মন্দনা। বাংলা সনের প্রতি ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে আগামী বৈশাখের প্রথম দিবসের এমন একটি ঘোষণা দিলে দেশবাসী কৃতজ্ঞ থাকবে। ‘পান্তা রাইস উইথ ইলশা ফিস’ শিরোনামের অভিসন্দর্ভটি প্রকাশিত হলে ১লা বৈশাখ কোন মাসের কয় তারিখ এমন বেআক্কেল প্রশ্নের অবসান হলেও হতে পারে।
বালকবয়সে একটি কবিতা পাঠ করে ছিলাম ‘বাল্যশিক্ষা’ বা আদর্শলিপিতে হয়তোবা। সে কবিতায় ক’টি লাইন ছিল এরকম ‘পান্তা খেয়ে শান্ত হয়ে কাপড় দিয়ে গায়/ গরু লয়ে রাখাল ছেলে গাঁয়ের পথে যায়।’ সে পান্তার সাথে ইলিশের উপস্থিতি ছিল না। পহেলা বৈশাখ না শ্রাবণ-ভাদ্র তারও উল্লেখ নেই। কবি তার কবিতায় গ্রামীণ সমাজের প্রতিদিনকার দৃশ্য এঁকেছেন। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের দৃশ্যটা এরকম এখনো। তেমনটা বদলায়নি এতকাল পরও। হাজার টাকা ব্যয় করে পান্তা ইলিশ খাওয়ার রেওয়াজ শহুরে সাহেবদের বৈশাখ উদযাপন হলেও গ্রামের বৈশাখ অন্য ধরনের। যা কৃত্রিমতায় আকাণ্ঠ নয়। পান্তার সাথে প্রধান অনুষঙ্গ হলো কাঁচামরিচ, পোড়া মরিচ আর পেঁয়াজ। এই পান্তার স্বাদই আলাদা। প্রায় প্রতিদিনই গ্রামের বাঙালরা ভক্ষণ করেন এই সুস্বাদু খাবারটি। যারা একদিনের বাঙালী বনে যান তারাই ইলিশ-পান্তার বেঢপ আয়োজনে মত্ত হন। জন্তু-জানোয়ার সেজে অশোভন উন্মত্ততায় রাস্তায় নামেন। রাক্ষস খোক্ষস সাপ ব্যাঙ পেঁচার ছুরতে পথে আসে মনুষ্যকুল। উৎসব চলে নারীর বস্ত্রহরণের। শ্রীকৃষ্ণ তার বান্ধবী রাধাসহ সখীদের বস্ত্রহরণ করেছিলেন। সেই হরণ দৃশ্যটি তুলে আনা হয় ফি বছর। অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে। এবারও যার বিরতি ছিল না। বস্ত্রহরণের নাট্যোৎসব হয়েছে রমনার খোলা ময়দানে। তাই পহেলা বৈশাখের খুশিটাই ভিন্ন ধরনের। সারা রাতের ঝুটঝামেলার পর প্রভাতে পান্তা ইলিশের মজাই আলাদা। ঐ যে কবি বলেছেন, পান্তা খেয়ে শান্ত হয়ে কাপড় দিয়ে গায়। কাপড় থাকুক বা না থাকুক শান্ত হবার ব্যাপারটি তো আছে। পান্তার সাথে ইলিশ রসনা তৃপ্তি করুক বা না করুক পেট-দেহ তো ঠাণ্ডা করে। তাই পান্তা ইলিশকে বলতেই হয় পান্তা-ইলিশ জিন্দাবাদ। তাছাড়া যারা এমন মহতি আয়োজনের কারিগর তাদেরকেও জিন্দাবাদ না জানালে ব্যাপারটা শোভন হয় না।
মঙ্গল ঘট মঙ্গল প্রদীপ পেঁচা নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় সাম্প্রদায়িক গন্ধটা বেশ উৎকট। ব্যাপারটা সর্বংসহা কিনা ভাববার অবকাশ আছে। পহেলা বৈশাখে মঙ্গল কামনা করাতে অপরাধের কিছু নেই। তবে প্রণতি জানানোর পদ্ধতিটা নিয়েই প্রশ্নের উৎপত্তি। যারা প্যাঁচাকে মঙ্গলের প্রতীক ভাবেন ভাবতে পারেন। তাই বলে সব বঙ্গবাসীকে প্যাঁচক স্বভাবে চিহ্নিত করার মধ্যে বোধের অভাবটাই উঠে আসে। পান্তা-ইলিশের আড়ালে এটি কোন সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ষড়যন্ত্র কিনা সে কাহিনী উদ্ধারের ভার গবেষকদের। আগামীতে যারা পান্তা ইলিশ নিয়ে গবেষণা করবেন।
বাংলা সনের উৎপত্তি হয়েছিল সম্রাট আকবরের দরবারে পণ্ডিত ফতেহ্উল্লাহ সিরাজী’র চিন্তা-চেতনায়। হিজরী সনের সাথে মিল রেখে খাজনা আদায়ের স্বার্থে। বিশেষ করে মোগল সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের জন্যে। ফসল ওঠার সময়কে লক্ষ্য রেখে মাস দিন সন গণনাকে ধার্য করা হয়। তাই এই সনের আর এক নাম ফসলী সন। সম্রাট আকবর যদি জানতেন তার এই উদ্ভাবিত সন প্যাঁচার পিঠে চড়ে উড়বে, মঙ্গল ঘটে জট পাকাবে তাহলে হয়তো ভিন্ন চিন্তা করতেন। পহেলা বৈশাখের কথিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় ফসলের কোন গন্ধ থাকে না। থাকে না কৃষকের উপস্থিতি, বাংলাদেশকে তুলে আনা হয় এক উদ্ভট চেহারায়। মঙ্গলের পরিবর্তে অমঙ্গলের চীৎকার। অসভ্যতার বিভীষিকা। যদিও অসভ্যতা শব্দটি এমতাবস্থায় বেমানান। কারণ এখান থেকে উৎক্ষীপ্ত হয় ‘মাঙ্গোলিক ধ্বনি’। বস্ত্রহরণের মতো সম্প্রদায়গত অনুষঙ্গ লক্ষ্মীপ্যাঁচার পক্ষীসুলভ আচরণ। তাছাড়া পান্তাইলিশের মহার্ঘ্য আয়োজন তো থাকছেই। যদিও এর পরদিন থেকেই আলবিদা বৈশাখ।
পহেলা বৈশাখে শোভাযাত্রা হবে না কেন? হতেই পারে, হওয়াটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে অবারিত ফসলের মাঠ। ফসল বোনা আর ফসল তোলার সাথেই যুক্ত গ্রামবাংলার মানুষ। তাই বাংলা সনের শরীর থেকে বেরিয়ে আসে ধানের গন্ধ, রবিশষ্যের সুবাস। তাই পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় থাকবে কৃষকের জীবন বাস্তবতা। ফসল সম্পৃক্ত আয়োজন। যারা শোভাযাত্রায় অংশ নেবেন তাদের পরনে থাকবে লুঙ্গি-গেঞ্জি, মাথায় মাথাল, কোমরে গামছা আর কাঁধে থাকবে লাঙ্গল-জোয়াল। শোভাযাত্রার শুরুর কাতারে থাকতে পারে দু’চারটি গরু। সেখান থেকে উঠে আসবে সমগ্র বাংলাদেশ, বাংলা সনের গন্ধ। পান্তা থাকবে মরিচপোড়া আর পেঁয়াজ সংযোগে। গত কয়বছর থেকে যে শোভাযাত্রা, সে মঙ্গলেরই হোক বা অমঙ্গলেরই হোক ঢাকার সড়ক দাপিয়ে বেড়ায়, সেখান থেকে বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতাকে উদ্ধার করা খুবই দুষ্কর। বৃহত্তর সমাজের চিন্তাচেতনার অনুপস্থিতি পহেলা বৈশাখকে করে ম্রিয়মান।
যে হারে মরছে নদী বাংলাদেশের, আগামী পহেলা বৈশাখগুলোতে পান্তা-ইলিশ জুটবে কিনা সন্দেহের দোলাচলে হৃদয়। গত ক’বছর থেকেই ইলিশের কাহাত। পানি বিহনে ভেসে উঠছে নদীর তলা। পানির অভাবে ইলিশ কেন, কোন মাছই পাওয়া যাচ্ছে না। বদলে যাচ্ছে মাছেভাতে বাঙালীর সংজ্ঞা। কেন এককালের নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ বদলে ইদানীং হয়ে যাচ্ছে নদীহীন, সে সংবাদ কারোরই অজানা নয়। বাংলাদেশের একজন শিশুও বলতে পারে উজানে আমাদের সব নদীর হলকুমে রেখেছে হাত কোন বেগানা দেশ, কোন বেগানা সমাজ। নদী না থাকলে ইলিশ কোত্থেকে আসবে। পানি যেমন মানুষের জীবন ঠিক তেমনি পানি মাছের প্রাণ। সেই প্রাণেরই অভাব প্রচণ্ড বাংলাদেশে। তাই মাছের আকাল, আকাল ইলিশের। পান্তা ইলিশের জন্য আফসোসের অন্ত থাকবে না একদিন। ভবিষ্যতের পহেলা বৈশাখে হয়তো পান্তা-ইলিশের পরিবর্তে অনুষঙ্গ হবে রুটি আলু ভর্তা। শুঁটকি ভর্তা হবে না কারণ তখনতো আর মাছ পাওয়া যাবে না। নদীর মতো খাল-বিলও থাকবে তপ্ত বালুময়। হয়তো সেই বৈশাখী শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের কণ্ঠে থাকবে আব্বাসউদ্দিনের বিখ্যাত গান ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে ছায়া দেরে তুই’। পান্তার জন্যে যেমন পানি প্রয়োজন ইলিশের জন্যেও দরকার টলটলে। পানিবিহীন বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের দৃশ্যটা নজরে আনলে আঁতকে উঠতে হয়।
সাজজাদ হোসাইন খান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads