সোমবার, ৯ মার্চ, ২০১৫

রাজনীতি সুস্থ ধারায় ফিরে আসুক


অচলায়তনের এই রাজনীতি আর কতদিন? জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ও আর্তনাদের ভাষা যেন বুঝতে পারছেন না আমাদের শীর্ষ রাজনীতিবিদরা। আমাদের শাসকরা তো বলে থাকেন, জনগণই দেশের মালিক। তাহলে দেশের মালিকদের এমন অবজ্ঞা করার সাহস তারা কোত্থেকে পান? রাজনীতিতে সরকার থাকে, বিরোধী দলও থাকে। কারণ আমাদের দেশে রাজতন্ত্র নেই, নেই কোনো রাজাও। তারপরও কোনো কোনো রাজনীতিকের ভাষা শুনে মনে হয়, তারা যেন শুধু রাজা নন, মহারাজা। দেশে এখন রাজনীতির যে মন্দ দশা তা একদিনে হয়নি। দিনের পর দিন আদর্শহীনতা, ছলাকলা, চাতুর্য ও ক্ষমতা-লিপ্সা আমাদের রাজনীতিকে এমন হীন অবস্থায় এনে ঠেকিয়েছে। ১৬ কোটি মানুষের সম্ভাবনাময় একটি দেশে এই রাজনীতি চলতে পারে না। দায়িত্বহীনতার নানা মাত্রা আমরা লক্ষ্য করেছি। দেশের জনগণ চায় রাজনীতি আবার সুস্থ ধারায় ফিরে আসুক। তবে এর জন্য প্রয়োজন হবে সরকারের অভিভাবকসুলভ ভূমিকা এবং বিরোধীদলের যৌক্তিক আচরণ। দেশের এবং বিদেশের অনেকেই এ নিয়ে কথা বলেছেন। ৮ মার্চ রাজধানীর সেগুনবাগিচায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট বলেছেন, ভিন্নমতের প্রকাশ ও বিরোধীদের অধিকার চর্চায় পর্যাপ্ত ও নিরাপদ সুযোগ এবং রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমেই গণতন্ত্র পুরোপুরি বিকশিত হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, গণতন্ত্রের বিকাশ তো দূরের কথা বরং ক্ষমতাকেন্দ্রিক অপরাজনীতি দেশে হিংসা-বিদ্বেষ, দমন-অবদমন ও সহিংসতাকে ছড়িয়ে দিয়ে সমাজটাকে মানুষের বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে।
দেশের এমন অবস্থায় তিউনিশিয়ার আননাহদা দলের নেতা, রশিদ ঘানুশির বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। দেশের স্বার্থে এই দলটির নেতারা নিজেদের এবং দলের স্বার্থকে বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। এজন্য শুভাকাক্সক্ষীদের অনেক সমালোচনা তাদের সহ্য করতে হচ্ছে। নিজেদের ত্যাগ-তিতিক্ষা প্রসঙ্গে রশিদ ঘানুশি বলেন, ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে যারা দেশের ভিতরে ও বাইরে আমাদের বঞ্চিত ও নির্যাতনের শিকারে পরিণত করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে নিছক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগকে কাজে লাগানোর ইচ্ছেকে আমরা দমন করতে সক্ষম হয়েছি। এমন কি বিপ্লব সংরক্ষণের আওতায় আমরা রাজনৈতিক বিরোধীদের বাইরে রাখার বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমরা তাদের সমান ও পূর্ণ মর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক অংশগ্রহণ এবং স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়ায় তাদের ন্যায় বিচার পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি। সত্য প্রকাশ, ক্ষত-শুশ্রুষা এবং ক্ষমাশীলতা ও ঐক্য অর্জনের জন্য দেশকে বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করতে হয়েছে, যাতে আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অর্জিত জঞ্জাল দূর করতে পারি। উপরন্তু আমরা দায়িত্বশীলতার সাথে ক্ষমতার মোহকে অতিক্রম করে জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছি। আমরা বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনীতিকদের যৌক্তিক শৃঙ্খলার এক বিরল উদাহরণ সৃষ্টি করেছি। ক্ষমতার প্রতি অনীহার কারণে আমরা এটি করিনি। বরং পরিস্থিতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করার পর এটি করা হয়েছে। রশিদ ঘানুশি আরও বলেন, আমরা যে ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটিয়েছি তা হলো গণতান্ত্রিক উত্তরণের নতুন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ, যাতে ইসলামপন্থী ও সেকুলারপন্থী উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। মুখোমুখি সংঘর্ষের বদলে বর্তমানে তিউনিশিয়ার ট্রেন অংশীদারিত্বের লাইনে চলছে। এতে রয়েছে ৫টি দল। তারমধ্যে ২টি দল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিউনিশিয়ার গণতান্ত্রিক সাফল্য বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই অঞ্চলের অন্যরা তাতে যোগ দেয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
তিউনিশিয়ার আননাহদা পার্টি ও রশিদ ঘানুশির দৃষ্টিভঙ্গি তৃতীয় বিশ্বের সংঘাত-বিপর্যস্ত দেশগুলোর জন্য উপকারী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কারণ রশিদ ঘানুশির বক্তব্য কোনো তত্ত্বীয় গ্রন্থ কিংবা একাডেমিক আলোচনার জন্য পেশ করা হয়নি, বরং নানা মত ও পথে বিভক্ত ও বিপর্যস্ত জাতিকে ঐক্যের চেতনতায় মুক্তির রাজপথে আনার জন্য তারা যে রাজনৈতিক ত্যাগ ও গণতান্ত্রিক সহনশীলতার চর্চা করেছেন, তারই বাস্তব বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। আমরা মনে করি, আমাদের সরকার ও রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা বিশ্বের খবরাখবর রাখেন। তিউনিশিয়া যা পারে বাংলাদেশ তা পারবে না কেন? গণতান্ত্রিক অধিকারের পথ ধরেই তো বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশ তো গণতন্ত্রের পথেই ছিল। কিন্তু আজ কেন এতটা অধঃপতন? মানুষ তো আত্মসমালোচনা করে, এ কাজটি রাজনীতিবিদদের আরো বেশি করা প্রয়োজন। আত্মসমালোচনার আয়নায় নিজেদের কর্মকা- বিশ্লেষণ করলে সরকার ও বিরোধীদলের নেতা-নেত্রীদের এখন আলাপ আলোচনায় বসে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। তবে তারা কাক্সিক্ষত সেই পথে যান কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads