রবিবার, ২২ মার্চ, ২০১৫

আন্দোলন ও নির্বাচন


বাংলাদেশ অভূতপূর্ব আন্দোলন-সংগ্রামের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে চলছে। এমতাবস্থায় সিটি কর্পোরেশনের মতো অরাজনৈতিক নির্বাচনের তোড়জোড় চালানো হচ্ছে। পুরো আন্দোলনই যখন রাজনৈতিক দাবিতে ঠাঁসা এবং সংগ্রামও চলছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাঠে, তখন সংলাপ নয়, সমঝোতা নয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠা নয়; নাযিল হলো সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। বিরোধী দল বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যা দাবি করেছে বা পরামর্শ দিয়েছেন, সেটা কানেও তোলা হলো না। অন্য রকম আরেক ইস্যুকে সামনে আনা হলো, যার নাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। কে করবে এই নির্বাচন? বিরোধী দল তো তাদের দাবির ব্যাপারে কোনো কথা বা প্রত্যাশাই শুনতে পায় নি। তাদের কথা শোনে বা দাবি মেনে তাদেরকে নির্বাচনে আনার পরিবেশও তো সৃষ্টি করা হয় নি। তাহলে একদলীয় বিগত নির্বাচনের পরিণতিই কি অপেক্ষা করছে এহেন নির্বাচনের ভাগ্যে? এমনই শত প্রশ্নের মধ্যে চলছে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি এবং সুদীর্ঘতম বিরোধী আন্দোলন আর নির্বাচনের ভেল্কিবাজি।
স্মরণ করলে দেখা যায়, ২০ দলীয় জোটের ডাকে গত ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবসের কর্মসূচি পালন করতে না দেয়াসহ বিভিন্ন দাবিতে গত ৬ জানুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। ৫ জানুয়ারির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সরকার একদিন আগে থেকেই সারা দেশেই সড়ক ও নৌপথে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। সভা সমাবেশ বন্ধ করে। বেগম জিয়াকে তার ২ দিন আগে থেকেই তার গুলশানস্থ অফিসে অবরুদ্ধ করে রাখে। আজ অবরোধের ৭৭তম দিন। সরকার এই গণআন্দোলনের বিরুদ্ধে হত্যা গুম হামলা মামলা আর গণগ্রেফতার করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা চালায়। প্রতিদিনই সারা দেশে শ’শ’ নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করছে। হাজার হাজার নেতা কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। এতে করে নেতাকর্মীরা দৃশ্যত রাজপথে নেমে তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারছে না। তারপরেও জনগণ এই কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানিয়ে স্বঃতস্ফূর্তভাবে অবরোধ পালন করছে। সরকার মালিকদের উপর চাপ সৃষ্টি করে বাস লঞ্চ চালানোর চেষ্টা করেও কোনো ফল পায়নি। পরিবহন মালিকরা চালাতে বাধ্য হলেও কোনো লাভ নেই। কেননা মূলত তারা যাত্রী সংকটের কারণেই বাস চালাতে পারছে না। খালি বাস চালাতে গিয়ে অনেক সময় তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। তারপরেও তারা অনেক সময় ঢাকা থেকে খালি বাস চালাচ্ছেন। টানা অবরোধের মধ্যেও রাজধানী ঢাকায় যান চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও এখানে বসবাসরত নাগরিকদের মধ্যে আতংক এখনও কাটেনি। দৃশ্যত অবরোধের কার্যক্রম না থাকলেও মানুষের মধ্যে আতংক কাটছে না। আর এ কারণেই এখানের মানুষ অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের হচ্ছে না। এতো দীর্ঘ সরকার পতনের আন্দোলন আগে কখনও এ দেশে হয়নি। এতো দিন ধরে আন্দোলন চলাও এক সাফল্য। ফলে আন্দোলন হচ্ছে না বলে সরকার মহলের ফাঁকা আওয়াজ অর্থহীন। আন্দোলন না হলে ‘হচ্ছে না’ বলা হচ্ছে কেন? জোরপূর্বক গাড়ি চালানো ও বলপ্রয়োগ করা হচ্ছে কেন? অতএব কি হচ্ছে আর কি হচ্ছে না, সেটা দেশ ও বিদেশের সকলেই সচক্ষে দেখছেন।
সন্দেহ নেই, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মহাদুর্যোগের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ক্ষমতালিপ্সার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংঘাত। প্রতিনিয়ত বাড়ছে রাজনৈতিক সংকট ও রক্তপাত। জাতির মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদ আর বিভক্তি স্পষ্ট। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্র হচ্ছে আধুনিক যুগে একটি দেশের জন্য সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা। বাংলাদেশ অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে ১৯৯১ সালে সংসদীয় ব্যবস্থার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু নানা কারণে সেই সংসদীয় গণতন্ত্র আজ দিকভ্রান্ত। বিশেষ করে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি যখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিবর্জিত হয় তখন সংসদীয় গণতন্ত্র রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। সুতরাং বলা যায় সংসদীয় গণতন্ত্র ভয়াবহ এক দুর্যোগের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যে দুর্যোগের হাত ধরে আর্থ-সামাজিক নানা অঙ্গনেও আসছে বহুবিধ সমস্যা। বিগত কয়েক মাসের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা যায়, বাংলাদেশের চলমান অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা এখন বহুমুখী সংকটে রূপ পরিগ্রহ করেছে। এক সংকট থেকে আরেক সংকটে পড়েছি আমরা। রাজনৈতিক সংকট দিয়ে শুরু হলেও এ সংকট এখন সর্বগ্রাসী হয়েছে। এই রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির পেছনে মূলত দায়ী কারা, সেটা সবাই জানেন। ক্ষমতালিপ্সা ও ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রবণতার কারণে সঙ্কটে পড়েছে সাধারণ মানুষ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক হানাহানি যেন থামবেই না। রাজনীতির কারণে অর্থনীতিতে ধস নেমে এসেছে, যা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। চলমান বিভেদ ও সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি জাতির জন্য সর্বনাশ ডেকে আনছে। এর সর্বগ্রাসী প্রভাব সমাজের সর্বক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থায় স্বার্থান্বেষী মহল ফায়দা লুটার চেষ্টা চালাচ্ছে। মনে রাখা ভালো, ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালি একটি জাতিগোষ্ঠী হিসেবে অসহনশীল জাতি। এই জাতির ইতিহাসে নিজেরা বেশিরভাগ সময়ই শাসিত হয়েছে। যদিও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আমরা মুক্ত তারপরও শোষণ বঞ্চনার সেই হীনম্মন্যতা এখনো আমাদের মননে বিরাজ করছে। ভিন্ন মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার প্রবণতা অর্জন করার যে মানসিকতা তা এখনো সৃষ্টি হয়নি। আর ক্ষমতার সব কাঠামোতে কিছু রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতা প্রতিষ্ঠা হওয়ায় ভিন্নমত সহজে সংঘাতের দিকে চলে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় আধুনিক যুগের গণতান্ত্রিক সময়ে এসেও  ভিন্নমতের প্রতি যদি আমরা শ্রদ্ধাশীল না হই, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে লালন না করি, তাহলে দুঃসহ পরিণতি অপেক্ষমাণ। এরই মাঝে টের পাওয়া যাচ্ছে যে, চলমান অস্থিতিশীলতার পরিণতি ভয়াবহ হচ্ছে। সবাই জিরো টলারেন্সে। একইসঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত নিরসনের কোনো চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। ভায়োলেন্স আরও বেশি ভায়োলেন্স জন্ম দেয়। এরপর সৃষ্টি হয় নৈরাজ্য। সহিংসতা, নৈরাজ্য ও অর্থনৈতিক মন্দা একটি দেশকে ভয়ংকর পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। এই সংকটের মাধ্যমে আবার গণতন্ত্র বিপদে নিপতিত হয়। স্বৈরশাসন জেঁকে বসে। স্থায়ী সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কারণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নষ্ট হলে দেশে অস্থিতিশীলতা বেড়েই চলবে। তাই চলমান অস্থিতিশীলতা বন্ধে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বহাল রাখার বিকল্প যেমন নেই; তেমনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সঙ্কট মোচনেরও কোনো বিকল্প নেই। সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সব রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় বসে উপর্যুক্ত করণীয় ঠিক করতে হবে। সরকার ও বিরোধী দলগুলোকে সংঘাতের পথ পরিহার করতে হবে। জনমানুষের আকাক্সক্ষার প্রতি সরকারকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নির্যাতন-নিপীড়নসহ হত্যা-গুম-খুন বন্ধ করে একটি সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এই মুহূর্তে প্রধান ও মৌলিক কর্তব্য।
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার মাস মার্চে আমরা স্মরণ করতে পারি, বাংলাদেশ যে উদ্দেশে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়েছিল সে আশা-আকাক্সক্ষা সম্পূর্ণভাবে পূরণ হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম একটি সমৃদ্ধ ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে। যেখানে স্বৈরশাসন থাকবে না, থাকবে না নিপীড়ন-নির্যাতন, শোষণ ও বঞ্চনা কিংবা হানাহানি। আজ ৪৪ বছরে যদি আমরা হিসাব-নিকাশে বসি তাহলে দেখতে পাব অনেক কিছুই অপূর্ণ রয়ে গেছে। ঐক্যের যে লৌহকঠিন শক্তি জাতি অর্জন করেছিল, সেটাও ¤্রয়িমাণ। তবুও আশাবাদী মানুষ আশা করেন, স্বাধীনতার স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে। সেই দিনটি আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরেই বাস্তবের মাটিতে নেমে আসবে। কিন্তু চাপিয়ে দেওয়া কোনো কিছুর মাধ্যমে সঠিক অর্জন সম্ভব হবে কি? এই যেমন আন্দোলনের তোপের মুখে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন দেওয়ার পর পরেই নানা পক্ষ থেকে বিরূপ ও বিশাল প্রতিক্রিয়া শোনা যাচ্ছে। সুজন বলেছে, বর্তমানে সারা দেশে পেট্রোল বোমা হামলা ও বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ নানা ধরনের সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া অনেক সম্ভাব্য প্রার্থী মামলার কারণে কারারুদ্ধ বা পলাতক রয়েছেন। তাই অনেকেই মনে করেন আরো কিছু দিন অপেক্ষা করলে চলমান অস্থিরতা অনেকটা প্রশমিত হতো। অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ বিরাজ করত। কিন্তু কমিশন সেটা না করে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করায় জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে যারা কারাগারে রয়েছেন, তাদের জামিনে মুক্তি দিয়ে এবং যারা পলাতক রয়েছেন তাদের ভয়ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থেকে সরকার নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করবে বলেও সুজন আশা প্রকাশ করে। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম বলেছেন, “আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার ‘ললিপপ’ খাওয়ানোর মতো সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ঘোষণা করলেও জনগণের ভোটে সরকারি দলের প্রার্থীর জেতার কোন সম্ভাবনা নেই্ ।’ তিনি আরো বলেন,‘ নির্বাচনে বিরোধী দল অংশগ্রহণ করলে সরকার নির্বাচন স্থগিত করার পথ খুঁজবে।’ শনিবার বিকেলে অবস্থান কর্মসূচির ৫৩তম দিনে মতিঝিলের দলীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি একথা বলেন। মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত রণাঙ্গনের বঙ্গবীরকেও এখন আন্দোলন করতে হচ্ছে। বঙ্গবীর বলেন, “গণতন্ত্রের মা-খালা-ফুপুরা গত ২৫ বছরে কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন না দিয়ে ছাত্ররাজনীতি টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজদের হাতে তুলে দিয়ে জাতীয় নেতা সৃষ্টি হওয়ার পথকে রুদ্ধ করেছে। সেজন্যেই আগে নেতার ইচ্ছায় গু-ারা চলতে বাধ্য হতো আর এখন গুন্ডাদের ইশারায় নেতারা চলে।” অতএব আন্দোলনের বিষয়ে কোনো সাড়া না দিয়ে, আন্দোলনকারী নেতাদের জেলে রেখে এবং কর্মীদের অকাতরে হত্যা-নির্যাতন করে যে বিভীষিকাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রশাসনসহ সর্বত্র দলীয় আধিপত্য বিস্তার করে যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করা হয়েছে, তেমন বিরূপতার মধ্যে  বিরোধী দল নির্বাচন সম্পর্কে গভীরভাবে না ভেবে পা বাড়াতে পারে কি? যাকে মানা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে অবৈধ, তার অধীনে নির্বাচন কবে বৈধতা দেবে? এসব প্রশ্নও ভাবতে হবে। সরকার যদি নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতেও আলোচনার আহ্বান করতেন, তবে কিছু কথা বলা যেতো, কিছু দাবি আদায় করা সম্ভব হতো। সব কিছুই যদি চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় হয় তখন নির্বাচনের ফলাফলও যে চাপিয়ে দেওয়া হবে না, তার গ্যারান্টি কি? অতএব নির্বাচন বা যে কোনো বিষয়েই বিরোধীদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে হবে সর্বাগ্রে। আর সেটা সরকারকেই করতে হবে। মনে হচ্ছে আন্দোলনের তোড়ে সরকার কিঞ্চিৎ দিশেহারা। নইলে হঠাৎ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সামনে এনে হাজির করানো হলো কেন? আন্দোলনের পটভূমিতে অবশ্যই নির্বাচন হবে। কিন্তু সেটা জনইচ্ছায় ও জনঅংশগ্রহণমূলক এবং স্বচ্ছ হতে হবে। তেমন পরিস্থিতি কি আসলেই হয়েছে?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads