শনিবার, ২৮ মার্চ, ২০১৫

অথঃ বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার এবং পুলিশ রিমান্ড প্রসঙ্গ


বর্তমানে বাংলাদেশের প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভীতিকর দু’টি পরিভাষার নাম হলো ‘বিনা পরোয়ানায় মধ্যরাতে গ্রেফতার’ এবং ‘পুলিশ রিমান্ড’। অনেকের ক্ষেত্রে কোনরূপ পরোয়ানা ছাড়াই রাতে বাসা থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়। যাদের কপাল ভালো তাদেরকে বিনা পরোয়ানায় উঠিয়ে নেয়ার কথা বিলম্বে হলেও স্বীকার করা হয়। আর যাদের কপাল খারাপ তাদেরকে উঠিয়ে নেয়া হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তাদেরকে উঠিয়ে নেয়ার কথা স্বীকারও করা হয় না। আইন সুস্পষ্ট ভাষায় বলে যে, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের কোনো প্রশ্নই উঠে না। এটি সম্পূর্ণ বেআইনী এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আর যদি পরোয়ানা বলে গ্রেফতার করা হয় তাহলে গ্রেফতার করার সময় হতে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আটক ব্যক্তিতে আদালতে হাজির করতে হবে। এই বিষয়গুলো যেন ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই’ এর মতো। সাম্প্রতিককালে এ ধরনের ঘটনার জ্বলন্ত উদাহরণ হলো বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি ও প্রতিমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন আহমেদ এবং প্রখ্যাত সাবেক ছাত্রনেতা, আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক জনাব মাহমুদুর রহমান মান্না। জনাব মান্নাকে তার আত্মীয়ের বাসা থেকে (বনানী) গ্রেফতার করা হয় রাত সাড়ে তিনটায়। সমস্ত টেলিভিশনে এই গ্রেফতারের খবর সম্প্রচারিত হয়। কিন্তু পরদিন সকালে ডিবি পুলিশ এবং র‌্যাব এই গ্রেফতারের খবর সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। কিন্তু সন্ধ্যার পর টেলিভিশনে পুনরায় খবর প্রচারিত হয় যে, মান্নাকে ‘ধানমন্ডির’ ‘স্টার কাবাব’ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ঐ রাতেই তাকে ডিবি পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়। পরদিন তাকে কোর্টে প্রোডিউস করা হয় এবং ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়।
কিন্তু জনাব সালাহ উদ্দিনের গ্রেফতার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো বিভাগই স্বীকার করেনি। তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদের কোনো জিডি কোনো থানা গ্রহণ করেনি। আজ ১৭ দিন হলো তিনি নিখোঁজ আছেন। তিনি কি বেঁচে আছেন কি নাই তাও কেউ জানে না। বেগম হাসিনা আহমেদ জোর দিয়ে বলছেন যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে, তার সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে। ২০ দলীয় জোটপ্রধান বেগম খালেদা জিয়াও বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই যে সালাহ উদ্দিনকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে তার প্রমাণ তাদের কাছে রয়েছে। একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ১৭ দিন হলো নিখোঁজ আছেন। অথচ সরকার সম্পূর্ণ নির্বিকার। কোথায় বাস করছি আমরা?
॥ দুই ॥
আরেকটি হলো রিমান্ড। ইংরেজি রিমান্ড শব্দটি বাংলায় নির্যাতনের সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে গ্রেফতারকে রাজনৈতিক কর্মীরা তেমন একটা ভয় করতেন না। তখন বলা হতো, রাজনীতি করবো, আর গ্রেফতার হবো না, এটা কোনো কথা হয়? কিন্তু এখন গ্রেফতারের আশঙ্কা আছে, জানতে পারলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। কারণ এখন গ্রেফতার মানেই রিমান্ড। রিমান্ড মানেই নির্যাতন। এমন নির্বিচার রিমান্ড অতীতে আর দেখা যায়নি। আর সেই রিমান্ডও একটানা ২/৪ দিন নয়, একেবারে একটানা ১০/১৫ দিন। তাও আবার দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়া হয়। এমন পাইকারি হারে রিমান্ডে নেয়া আইনে নেই এবং রিমান্ড মঞ্জুর হলেও নির্যাতনের কোনো অধিকার আইন পুলিশকে দেয়নি। ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইটে যা পাওয়া যায়, তা নিম্নরূপ:
What is a Police Remand? Does it mean permission to torture accused?
After arresting a person police officer cannot keep arrested person with him for more than 24 hours.
Within 24 hours police officer has to produce this man physically before a judge. the arrested man can also complain to the judge if police has beaten him.
The Judge then takes this man in his `judicial custody- judges custody and then he sends arrested man to Jail authority to keep him on judges behalf untill further order.
Here two more things can happen
(1) A lawyer can move an application that his client is innocent. He may be given bail.
(2) Here police can oppose grant of bail.
Then if the judge thinks that it is necessary to give the accused to police custody he may do it but shall give safety direction that the arrested person should not be beaten.
This is called remand.
বাংলা অনুবাদ :
পুলিশ রিমান্ড কি? এর অর্থ কি
আসামীর ওপর নির্যাতন চালানো?
কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করলে পুলিশ অফিসার সেই ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার ওপর তার হেফাজতে রাখতে পারবেন না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামীকে শারীরিকভাবে বিচারকের সামনে হাজির করতে হবে। পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে পুলিশ তাকে নির্যাতন করেছে কিনা সেটাও আসামী বিচারককে বলতে পারবেন।
তখন বিচারক তাকে পুলিশ হেফাজতের বদলে বিচারিক হেফাজতে সোপর্দ করবেন। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তিনি বিচারকের তত্ত্বাবধানে কারাগারে থাকবেন।
এখানে দু’টি ঘটনা ঘটতে পারে।
১। আসামীর আইনজীবী এই মর্মে দরখাস্ত করতে পারেন যে, তার মক্কেল নির্দোষ। সুতরাং তাকে জামিন দেয়া হোক।
২। পুলিশ সেই জামিনের বিরোধিতা করতে পারে। যদি বিচারক মনে করেন যে, তাকে পুলিশ হেফাজতে দেয়া দরকার, তাহলে তিনি সেই মর্মে নির্দেশ দেবেন। কিন্তু একই সাথে এ নির্দেশও দেবেন যে, তার আর কোনো শারীরিক নির্যাতন করা যাবে না। এটাকেই বলা হয় রিমান্ড।
কিন্তু কে কার কথা শোনে? শুধু বিদেশের উদাহরণ কেন, দেশের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টেরও একই রকম নীতি নির্ধারণী নীতিমালা আছে।
॥ তিন ॥
১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড ট্রাস্টসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা রিমান্ড প্রশ্নে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করে। এটি করা হয় সন্দেহজনক গ্রেফতার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা এবং রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারার অপব্যবহার চ্যালেঞ্জ করে। ২০০৩ সালের ২৭শে এপ্রিল হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ঐ দু’টি ইস্যুতে প্রচলিত আইন সংশোধনের নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশনা আপিল বিভাগ স্থগিত করেনি। হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়,
১। আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না।
২। কাউকে গ্রেফতার দেখানোর সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে।
৩। গ্রেফতারের কারণ একটি পৃথক নথিতে পুলিশকে লিখতে হবে।
৪। গ্রেফতারকৃতদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার কারণ লিখে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ডাক্তারি সনদ আনবে পুলিশ।
৫। গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে পুলিশকে।
৬। বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো স্থান থেকে যদি কাউকে আটক করা হয় তাহলে আটক ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে।
৭। আটক ব্যক্তিকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে।
৮। জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের কাঁচনির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন।
৯। কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া না গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিনদিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে।
১০। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ঐ ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করতে হবে।
১১। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে, ঐ ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে দ-বিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে।
১২। পুলিশ হেফাজতে বা কারাগারে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে।
১৩। পুলিশ বা কারা হেফাজতে কেউ মারা গেলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে তা তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত করা হবে। ময়নাতদন্তে বা তদন্তে যদি মনে হয়, ঐ ব্যক্তি কারা বা পুলিশ হেফাজতে মারা গেছে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট মৃত ব্যক্তির আত্মীয়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তা তদন্তের নির্দেশ দিবেন।
॥ চার ॥
এই ১৩ দফাই হলো রিমান্ডের ব্যাপারে হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা। এসব নির্দেশনা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে চ্যালেঞ্জ হয়নি, অথবা আপিল বিভাগ এসব নির্দেশনা বাতিল বা সংশোধন করেনি। সুতরাং সন্দেহাতীতভাবে এই ১৩ দফাই হলো আজ পর্যন্ত বহাল রিমান্ডের নির্দেশনা। চরম পরিতাপের বিষয় হলো এই যে, এসব নির্দেশনা এখন কাজীর গরুতেই পরিণত হয়েছে। এগুলো এখন শুধু কেতাবেই আছে, গোয়ালে নেই। এ ব্যাপারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র এডভোকেট এবং মানবাধিকার কর্মী ড. শাহদীন মালিকের উক্তি প্রণিধানযোগ্য। একটি জাতীয় দৈনিকের সাথে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশের সব জায়গায় নাগরিক অধিকার সংকুচিত হচ্ছে। এখন পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, অভিযুক্তদের কোনো সাংবিধানিক বা আইনগত অধিকার নেই বললেই চলে। ড. মালিক বলেন, রিমান্ড মঞ্জুরের ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের বিচারকরা হাইকোর্টের নির্দেশনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করছেন না।”
ড. শাহদীন মালিকের এই দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না।
আসিফ আরসালান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads