সোমবার, ৩০ মার্চ, ২০১৫

সেবাহীন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রসঙ্গে


যে কোন দেশের রাজধানীর চিত্র সে দেশের সভ্যতা ও উন্নতির মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়। মুখে যেমন মানুষের মনের ভাব ফুটে উঠে, তেমনি রাজধানীর চিত্র দেখে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বোঝা যায়। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের চেয়ে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা এমন অনেক দেশ রয়েছে, যেগুলোর রাজধানীর চিত্র ঢাকার চেয়ে সুশৃঙ্খল, পরিপাটি ও বাসযোগ্য। মেট্রোপলিটন সিটি বা মাদার সিটি বলতে যা বোঝায়, ঢাকায় তার সবকিছু থাকলেও, সুশৃঙ্খল ও পরিকল্পিত নয়। একটি মেট্রোপলিটন সিটির মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া।
বিশ্বের সব বড় শহর নির্বাচিত, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ ও শহরটিকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখা একজন মেয়র ও কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। সেই বিবেচনায় এক দুর্ভাগা শহরের নাম ঢাকা। সুদীর্ঘকাল ধরে ঢাকা মেগা বা মাদার সিটি হিসেবে পরিচিতি পেলেও, তা পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেনি, গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগও খুব একটা দেখা যায় নি। এখনও অপরিকল্পিতভাবে এর বিস্তৃতি ঘটছে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা কাঙ্খিত মানের নয়। প্রতিদিনই রাজধানীকে যানজটে স্থবির হয়ে পড়তে দেখা যায়।
ঢাকায় বসবাসকারী দুর্ভোগের শিকার বেশিরভাগ মানুষ। অভিযোগ করে কোন প্রতিকার পায় না তাই কারোর কাছে অভিযোগও করেন না ভুক্তভোগীরা। কষ্ট মনে চেপে রেখেই দিনাতিপাত করছেন তারা। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি বলেছেন, ঢাকা এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাই ঢাকাকে জনগণের বসবাসের উপযোগী করতে সরকার পরিকল্পনা মাফিক কাজ করছে বলে দাবি তার। তবে তার বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার মিল খুঁজে পায় না ঢাকার মানুষ। (সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম ১৯ জুলাই ২০১৪)
ঢাকার আয়তন ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার আর এখানে বর্তমানে ১ দশমিক ৫০ কোটির অধীক লোক বসবাস করছে। প্রতি বর্গ কিলোমিটার আয়তনে প্রায় ৫০ হাজার লোক বসবাস করে। তবে আয়তন না বাড়লেও ঢাকায় বাড়ছে মানুষ। পাবলিক পরিবহন, ওভারব্রিজ, আরবান ভেজিটেশন, পার্ক এন্ড রিক্রিয়েশন সেন্টার, বসবাসের জন্য নিরাপদ বাড়ি, ফুটপাত ও পথচারীদের সুবিধা বাড়েনি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ট্রাফিক জ্যামও এখন ঢাকার মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর এক প্রতিবেদনে ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে অযোগ্য শহর হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, শুধু যানজটের কারণে প্রতিবছর দেশের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। এই বিপুল ক্ষতির বোঝা সামগ্রিক অর্থনীতিকে সুদীর্ঘকাল ধরেই বয়ে চলতে হচ্ছে। বলা যায়, যানজট অর্থনীতির ক্ষত হয়ে আছে। সাধারণত আন্তর্জাতিক মানের একটি শহরে চলাচলের জন্য ২৫ ভাগ রাস্তা থাকে। ঢাকা শহরে রয়েছে মাত্র ৮ থেকে ৯ ভাগ। অর্থাৎ যানজট নিরসন, স্বচ্ছন্দ চলাফেরা এবং অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রাখার জন্য যে পরিমাণ রাস্তার প্রয়োজন ঢাকায় তা নেই। যেটুকু আছে, তাও বিভিন্নভাবে দখল হয়ে আছে।
নগরবিদরা মনে করছেন, বিদ্যমান রাস্তাগুলোকে যদি পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খলভাবে ব্যবহার করা যায়, তাতেও যানজট অনেকাংশে নিরসন করা সম্ভব। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা প্রয়োজন। নগর বিশেষজ্ঞ নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘যানজট ঢাকার প্রধান সমস্যা। অথচ একটি নগরের প্রধান দিক হলো পরিবহন ব্যবস্থা। ২০০৬ সালে একটি পরিবহন কৌশলপত্র নেয়া হয়েছিল, যেটি অনুমোদিত হয়। সেখানে মেট্রোরেল, কমিউটার ট্রেনকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল। যানজট নিরসনে এসব অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপ আগে বাস্তবায়ন করতে হবে।’ (সূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)
তবে যানজট নিরসনে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে রয়েছে, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, রাস্তার মাঝপথে বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানামা করানো, রাস্তায় বাজার বসা, ফুটপাত দখল এবং ট্রাফিক নিয়ম না মানা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটু তৎপর ও সদিচ্ছা পোষণ করলেই এসব সমস্যার সামাধান সহজেই করা যায়।
২০০২ সালের এপ্রিলে ভোটের পর ২০০৭ সালের মে মাসে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) নির্বাচনের মেয়াদ শেষ হয়। ডিসিসি নির্বাচনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও প্রায় চার বছর মেয়র হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময় দুইবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হলেও আইনি জটিলতায় সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
২০১৩ সালের ১৩ মে ডিসিসির দুই ভাগে নির্বাচন নিয়ে করা রিট আবেদন খারিজ করে ভোট আয়োজনের ওপর হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ তুলে নেয়। কিন্তু পরবর্তীতে তেজগাঁও সার্কেলভুক্ত সুলতানগঞ্জ ইউনিয়নের ১৩টি পাড়া-মহল্লা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত করায় সীমানা পুননির্ধারণের প্রয়োজন পড়ে।
‘অতিরিক্ত নাগরিক সুবিধার’ কথা বলে ২০১১ সালের নভেম্বরে ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে দক্ষিণ ও ৫৬টি ওয়ার্ড নিয়ে উত্তর নামে দুই ভাগ হয় ডিসিসি। এর পরই দুই সিটি করপোরেশনের জন্য আলাদা প্রশাসক নিয়োগ করে আওয়ামী লীগ সরকার। পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ছয় মাস পর পর প্রশাসক বদল হয়। ২০১১ সালের ৩ ডিসেম্বর প্রথম প্রশাসক নিয়োগ হয়। স্থানীয় সরকার আইন (সিটি করপোরেশন) একজন প্রশাসকের মেয়াদ ১৮০ দিন। হিসাব অনুযায়ী দুই অংশে ভাগ করার পর ইতিমধ্যে প্রতি সিটি করপোরেশনে কয়েকজন প্রশাসক বিদায় নিয়েছেন। আসছেন না সিটি মেয়র। আর অতিরিক্ত নাগরিক সুবিধার কিছুই এখনো দৃশ্যমান হয়নি।
২০১২ সালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের ইসি তফসিল ঘোষণা করলেও আইনি জটিলতায় তা স্থগিত হয়ে যায়। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ২০১২ সালের ২৪ মে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। ২০১৩ সালের মে মাসে নির্বাচনের ওপর আদালতের স্থগিতাদেশ উঠে গেলে নতুন করে তফসিল ঘোষণার উদ্যোগ নেয় নির্বাচন কমিশন। তবে ওই সময় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে একটি নতুন ওয়ার্ড যুক্ত হওয়ায় সীমানা জটিলতায় নির্বাচন আবারও ঝুলে যায়।
সরকার ডিসিসি নির্বাচন বন্ধের জন্য নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করেছিল। যাতে একটি সমস্যার সমাধান হলেও আরেকটি সমস্যা নির্বাচনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি নতুন এলাকা সংযুক্ত নিয়ে একাধিক মামলাও হওয়ার সম্ভবনা ছিল।
দুই ভাগে বিভক্ত করার কারণস্বরূপ বলা হয়েছিল, ঢাকা অনেক বড় নগরী হয়েছে, একক সিটি করপোরেশন নগরবাসীকে সেবা দিতে পারছে না, তাই দু’টি কেন্দ্র সৃষ্টি করা হোক। সেই সময় নগরবাসী তথা দেশবাসী মুচকি মুচকি হেসেছিল সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ঠুনকো যুক্তি শুনে। জনগণের মতে, আসল কারণ ছিল একক সিটি করপোরেশনের জন্য নির্বাচন হলে জনপ্রিয়তার কারণে বিএনপি কর্তৃক মনোনীত বা বিএনপিপন্থী মেয়রপ্রার্থী জিতে যাওয়ার প্রায় শতভাগ সম্ভাবনা ছিল।
আওয়ামী লীগের তথা আওয়ামী লীগপন্থী মেয়রপ্রার্থীর পরাজয় ঠেকানোর জন্য দু’টি সিটি করপোরেশন সৃষ্টি করা হলো, যেন যেকোনো একটিতে যেকোনো প্রকারে আওয়ামী লীগপন্থী প্রার্থীকে জেতানো যায়। ভাগ করে দেয়ার পর সরকার আবিষ্কার করল, দু’টি করপোরেশন করার পরও আওয়ামী লীগপন্থী প্রার্থীদের জয়ের সম্ভাবনা গৌণ। ঢাকায় যদি আওয়ামী লীগপন্থী প্রার্থীর পরাজয় হয় তাহলে সেটা আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য মারাত্মক তাৎপর্যবাহী ঘটনা হতো।
তাই পরাজিত হওয়ার থেকে একদম শূন্য ফলাফল ভালো মনে করে আওয়ামী লীগ সরকার তিন চার বছর আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচন বন্ধ করার পুরো বন্দোবস্ত করে। যেকোনো নির্বাচন বন্ধ করানোর জন্য সরকারের হাতে অনেক প্রকার অস্ত্র থাকে। তিন চার বছর আগে যদি ঢাকা মহানগরের একটি বা দু’টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো তাহলে মহানগরের অভ্যন্তরে সরকারি প্রশাসন বা সরকারি আমলাদের অপব্যবহার করতে পারত না আওয়ামী লীগ। করতে পারবে না বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই আওয়ামী লীগ নির্বাচন এড়িয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে।
সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেছেন, বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর ঢাকাকেন্দ্রিক আন্দোলনের অনুমতি নিতে হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে। যেটা সরকার এখন সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণ বিরোধী শক্তির হাতে গেলে, সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশের অনুমতি তারা সহজেই পাবে। সে ক্ষেত্রে বিরোধীদের আন্দোলন দমাতে সরকার বেকায়দায় পড়তে পারে। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি নিজেদের আওতায় রাখতে ঢাকা সিটির নেতৃত্ব কোনোভাবেই বিরোধী শক্তিকে দিতে চায় না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ৩ মে  ২০১৪)
১৬ নভেম্বর ২০১৪ তারিখের দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার নিউজের শিরোনামটি ছিল- ‘কাউন্সিলরের কাজ করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা’। সংবাদে বিস্তারিত লেখা আছে অনেক কিছু। প্রথম আলোর তথ্য মতে, ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পরিবর্তে প্রশাসক দিয়ে কাজ পরিচালনার কারণে নাগরিকদের সুবিধা তো বাড়েইনি, উল্টো ভোগান্তি বেড়েছে। সিটি করপোরেশনে নাগরিক সেবা পেতে স্থানীয় বাসিন্দাদের এখন যেতে হয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাদের কাছে। সেবার ধরন ও সেবা পাওয়ার সময়ের ওপর নির্ভর করে কোন নেতার কাছে যেতে হবে। কাজ বড় হলে চলে অর্থের লেনদেন।
ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে জনপ্রতিনিধি নেই তিন বছর। করপোরেশনের মূল, আঞ্চলিক ও ওয়ার্ড কার্যালয়গুলো চালান সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে কার্যালয়গুলোর প্রায় সব ধরনের কাজ। এলাকার সমস্যায় এসব নেতাই ওয়ার্ড বা আঞ্চলিক কার্যালয়ে হাজির হন।
জিবলু রহমান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads