শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫

স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন বিশ্বরাজনীতি


বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দু’ভাগে বিভক্ত বিশ্বরাজনীতিতে এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যকার সম্পর্কে পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। এই পরিবর্তন ঘটেছিল ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতার পরিপ্রেক্ষিতে। সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দেশগুলো পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। অন্যদিকে অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা বর্তমান রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ভারতের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল। সে সমর্থন শেষ পর্যন্ত পেয়েছিল বাংলাদেশ। উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম পরাশক্তি ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গণচীনের ভূমিকা ছিল প্রশ্নসাপেক্ষ। সাধারণভাবে পাকিস্তানের পক্ষ নিলেও গণচীন সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতার পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনাকালে পাঁচ প্রধান রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক ছিল এ রকম : (এক) গণচীনের সঙ্গে ১৯৬২ সালে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৬৫ সালে ভারতের যুদ্ধ হয়েছিল। এরপর চীন-সোভিয়েত যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। ফলে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে গভীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; (দুই) যুদ্ধ ও সীমান্ত সমস্যার কারণে গণচীন ও পাকিস্তান ভারতকে সাধারণ শত্রু মনে করতো। ফলে গণচীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ; এবং (তিন) ১৯৫০-এর দশক থেকে পাকিস্তান বিভিন্ন সামরিক জোটে যুক্ত থাকায় এবং সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার সোভিয়েতবিরোধী নতুন শক্তি গণচীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দূতিয়ালি করায় যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের প্রকাশ্য সম্পর্ক ছিল উষ্ণ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল ভারত। জন্মকালীন শত্রু রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত পাকিস্তানের ভাঙন ঘটানো ছিল ভারতের প্রধান সাফল্য। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা বাংলাদেশের জনগণকে ভারতের দ্বারস্থ করেছিল, ভারত সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল পরিপূর্ণরূপে। তাই বলে ভারতের সব রাজনৈতিক দল প্রথম থেকে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ায়নি। উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও ডানপন্থী দলগুলো তো বটেই, ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল কংগ্রেসের ডানপন্থীরাও বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মাধ্যমে ‘দ্বিতীয় পাকিস্তান’ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসে তৎপর বামপন্থীদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সাফল্যের সঙ্গে শরণার্থী সমস্যাকে প্রাধান্যে এনে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ইন্দিরা গান্ধীর অন্য একটি কৌশল ও উদ্দেশ্যও ছিল উল্লেখযোগ্য : স্বাধীনতাযুদ্ধে সমর্থন দেয়ার আড়ালে নকশালসহ বিভিন্ন রাজ্যে চলমান সশস্ত্র সংগ্রামকে ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত করার মধ্য দিয়ে তিনি ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে নিজের এবং কংগ্রেসের নেতৃত্ব সংহত করেছিলেন। কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রামকেও ইন্দিরা গান্ধী নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপর, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদকে দিয়ে তিনি এমন একটি সরকার গঠন করিয়েছিলেন, যে সরকার শুধু ভারতের মুখাপেক্ষীই থাকেনি, সকল প্রশ্নে কংগ্রেস সরকারের ইচ্ছা ও নির্দেশনাও মেনে নিয়েেেছ। বাংলাদেশের ওপর ভারতের এখনও যে প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ, তার শুরু হয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনাকালে। ইন্দিরা সরকারের নির্দেশ থাকায় বামপন্থীদের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি, তারা এমনকি ভারতেই থাকতে পারেননি। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকেও যুদ্ধ ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এবং প্রহরাধীন রেখেছিল ভারত। ভারতের চূড়ান্ত সাফল্য অর্জিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করার সম্মানজনক পথ খোলা থাকলেও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের লজ্জাকর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল (যদিও কাগজেপত্রে তা ছিল ‘বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনী’)। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে সব দিক থেকে এভাবেই লাভবান হয়েছিল ভারত।
দ্বিতীয় লাভবান রাষ্ট্র ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থক ও গণচীনের বন্ধুরাষ্ট্র হওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নও পাকিস্তানের ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতি চেয়েছে, কিন্তু প্রথমেই বাংলাদেশের পক্ষ নেয়নি। ভারতকে একটি সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ করার কৌশল হিসেবে দেশটি বরং ভারতের সঙ্গে দরকষাকষি শুরু করেছিল। ১৯৬৯ সালে সংঘটিত চীন-সোভিয়েত যুদ্ধের পর থেকেই এ জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু ভারত সম্মত হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত জড়িয়ে পড়ার পর ওই সামরিক চুক্তিকে সমর্থনের পূর্বশর্ত বানিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভারতেরও তখন পাশ কাটানোর সুযোগ ছিল না। ফলে ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২৫ বছর মেয়াদী ভারত-সোভিয়েত ‘মৈত্রী চুক্তি’। এই চুক্তি ছিল ভারতের ওপর সোভিয়েত কূটনীতির বিরাট বিজয়। এটা স্বাক্ষর করায় ভারতের এতদিনকার স্বাধীন নীতি ও অবস্থান বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। ভারত অনেকাংশে নির্ভরশীল রাষ্ট্রেও পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধই ছিল অন্তরালের প্রধান নির্ধারক। উল্লেখ্য, ‘মৈত্রী চুক্তি’র আগে পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বলেছে, স্বাধীনতাযুদ্ধকে ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং ভারতের পক্ষে দাঁড়ালেও ‘শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের’ জন্য তাগিদ দিয়েছে। ‘মৈত্রী চুক্তি’র পর বাংলাদেশের পক্ষে দেশটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল জাতিসংঘে। ডিসেম্বরে চূড়ান্ত যুদ্ধের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র যখন স্বাধীনতা যুদ্ধকে ‘ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন নিরাপত্তা পরিষদে ভেটোর পর ভেটো প্রয়োগ করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের বিজয় ও স্বাধীনতা অর্জন করা অনেক সহজ হয়েছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য ভূমিকা ছিল বিভিন্ন সামরিক জোটের সদস্য হিসেবে দীর্ঘদিনের অনুসারী পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্তু পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত নীতি ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে মার্কিন সরকারেরই গোপন দলিলপত্র। দীর্ঘদিন গোপন রাখার পর ১৯৯৯ সালে মার্কিন সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কিত গোপন দলিলপত্র প্রকাশ করতে শুরু করে। এরকম বিভিন্ন দলিলপত্রের প্রথম সংকলন ‘দি অ্যামেরিকান পেপারস : ইন্ডিয়া-পাকিস্তান-বাংলাদেশ ডকুমেন্টস ১৯৬৫-১৯৭৩’ নামের গ্রন্থে মুদ্রিত দলিলপত্রগুলো পড়লে যে কারো মনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত নীতি ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হবে। অনেকে এমনকি সংশয়েও আচ্ছন্ন হতে পারেন। দলিলগুলো একটি বিষয়কে নিশ্চিত করেছে যে, স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই মার্কিন সরকার ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থেকেছে, সম্ভাব্য পরিণতির ব্যাপারেও প্রস্তুতি নিয়েছে। যেমন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ থেকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করতে পারেন, সেকথা মার্কিন সরকার আগেই জেনে গিয়েছিল। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে ২৫ ফেব্রুয়ারি পাঠানো গোপন রিপোর্টে মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোসেফ ফারল্যান্ড জানিয়েছিলেন, সেদিনই তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠককালে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এবং সংবিধান প্রশ্নে মুজিব-ভুট্টোর মধ্যে সৃষ্ট অচলাবস্থায় তাকে হতাশ ও উদ্বিগ্ন মনে হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরো লিখেছেন, ইয়াহিয়া জানিয়েছিলেন, যদি ৩ মার্চের আগে ভুট্টো-মুজিবের মধ্যে সৃষ্ট অচলাবস্থার অবসান না হয়, তাহলে  তিনি এক বা দুই সপ্তাহের জন্য কিংবা প্রয়োজন দেখা দিলে আরো বেশি সময়ের জন্য ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার কথা বিবেচনা করছেন। অচলাবস্থার অবসান না হলে কি ঘটবে বলে তিনি ভাবছেন এমন প্রশ্নের জবাবে নৈরাশ্যের সুরে ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলার’ শুরু হতে পারে। অর্থাৎ, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ঘটনাপ্রবাহের সম্ভাব্য গতিধারা এমনকি রক্তক্ষয়ের ব্যাপারেও জানতো। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ার পরদিন, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানাতে গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোসেফ ফারল্যান্ড লিখেছিলেন, ‘আমাদের ঢাকাস্থ কনস্যুলেট জেনারেলের মূল্যায়নে পাকিস্তানের অব্যাহত ঐক্যের সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি এসে গেছে।’ ৪ মার্চের চিঠিতে রাষ্ট্রদূত লিখেছেন, ‘যতো ক্ষীণভাবেই হোক, (শেখ) মুজিবুর রহমান এখনো পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি ও মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ৫ মার্চের এক সংক্ষিপ্ত স্মারকে। এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে বলা হয়েছিল, বিচ্ছিন্নতা প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী মরিয়া হয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে, তা যতই সহিংস ও নিষ্ফল হোক না কেন। আমাদের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙালীদের স্বাধীনতাকে দমন করার উদ্দেশ্যে সামরিক শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সহিংসতা ও রক্তক্ষয় ঠেকানোর জন্য আমাদেরকে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে। আমরা শত্রুতার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে ব্রিটেন ও জাপানসহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে একযোগে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানানোর ইচ্ছা বিবেচনা করতে চাই। একই ধরনের বক্তব্য এসেছিল পররাষ্ট্র দফতরের একটি কন্টিনজেন্সি স্টাডিতেও। ৫ মার্চের এই রিপোর্টে অন্য কয়েকটি বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল। পাকিস্তান যদি বল প্রয়োগের পথে অগ্রসর হয় তাহলে ‘প্রস্তাবিত মার্কিন ব্যবস্থা’ উপশিরোনামে বলা হয়েছিল : ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথম সারির দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের থাকা উচিত। ভারত এক্ষেত্রে সবার আগে এগিয়ে আসতে পারে। ভারতের সঙ্গে সমন্বয় রাখার দরকার নেই। যদিও আমরা স্বীকৃতি দেয়ার আগে ভারতকে সেটা জানাতে পারি।’
স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও চিন্তাধারায়ও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল। যেমন, ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এমন এক রিপোর্টকে মার্কিন সরকার যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছিল, যার মধ্যে বাংলাদেশের সমর্থনে বলিষ্ঠ বক্তব্য ছিল। ১৩ এপ্রিলের ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিল : ‘সংঘাত ও শত্রুতার অবসানের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নিহিত রয়েছে।’ রাষ্ট্রদূতের সুপারিশে বলা হয়েছিল, ‘পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিতে পারে, মার্কিন সমরাস্ত্র ও সরঞ্জাম ব্যবহারের জন্য অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারে, শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের ভাগ্যের ব্যাপারে উদ্বেগ জানাতে পারে এবং আশু রাজনৈতিক সমঝোতার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহ ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দিতে পারে।’ নয়াদিল্লিস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই রিপোর্টে ‘কয়েকটি সত্য’ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়- ‘একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সম্ভবত শেষ হয়ে গেছে; বিশ্বের এই অঞ্চলে ভারত এখন সুস্পষ্টভাবে প্রধান, প্রকৃত এবং সম্ভাবনাময় শক্তি; সীমাবদ্ধ সম্ভাবনা এবং ব্যাপক সমস্যাসহ বাংলাদেশ সম্ভবত জন্ম নিতে যাচ্ছে।’ মার্কিন সরকারের ‘করণীয়’ হিসেবে রাষ্ট্রদূতের সুপারিশে বলা হয়েছিল, একই কারণে আমাদের উচিত ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’, ‘বাইরের শক্তির জড়িত থাকা’ প্রভৃতি ধরনের বিবৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকা; পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক নির্যাতনের অবৈধ নীতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ও অকপট অবস্থান বজায় রাখা এবং সাধারণভাবে পাকিস্তান সরকারকে নীতি পরিবর্তনে প্রভাবিত করা। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নে নয়াদিল্লিস্থ রাষ্ট্রদূতের রিপোর্টে বলা হয়, ‘আমি আশা করি, পশ্চিম পাকিস্তানকে ক্ষুব্ধ না করার স্বাভাবিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শক্তি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার স্বার্থে যথাসময়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সুযোগ গ্রহণ করা হবে।’
যুক্তরাষ্ট্র আরো অনেকভাবেই বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিল বলে বিভিন্ন মার্কিন দলিলপত্রে লক্ষ্য করা গেছে। এসবের মধ্যে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার ও মুক্তির ব্যাপারে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি। ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরের টেলিগ্রামে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোসেফ ফারল্যান্ড ‘মুজিবের বিচার ও শাস্তি’ উপশিরোনামে লিখেছিলেন- ‘মে থেকে অনুষ্ঠিত প্রায় প্রতিটি বৈঠকেই আমি ইয়াহিয়ার কাছে প্রশ্ন তুলেছি এবং এটা কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে একটি, যে ব্যাপারে আমরা পাকিস্তান সরকারের ওপর জনমতের চাপ ব্যবহার করেছি। ফলাফল ঠিক ততোটাই হয়েছে, যতোটা বাস্তবতার আলোকে সম্ভব ছিল। ...(শেখ) মুজিবকে একজন আইনজীবী দেয়া হয়েছে এবং আমরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে আশ্বাস পেয়েছি যে, মুজিবকে হত্যা করা হবে না।’
ভারতের প্রতি গৃহীত তোষণমূলক নীতির দিকটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ প্রসঙ্গে জানা গেছে নয়াদিল্লিস্থ রাষ্ট্রদূতের কাছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের পাঠানো এক টেলিগ্রামে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার নির্দেশ দিয়ে ২২ নভেম্বরের এই টেলিগ্রামে বলা হয়, ‘আপনি উল্লেখ করবেন যে, মিসেস গান্ধী শান্তির পক্ষে ইচ্ছা ব্যক্ত করায় এবং ভারত আগে যুদ্ধ শুরু করবে না বলে আশ্বাস দেয়ায় প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন বিশেষভাবে সন্তুষ্ট হয়েছেন। তাছাড়া আপনি প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন, এখানে তার সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এবং পরিস্থিতিকে প্রশমিত করার লক্ষ্যে আমরা নিম্নবর্ণিত সুনির্র্দিষ্ট পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলাম : ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে অস্বস্তিকর হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় আমরা পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহ স্থগিত করেছি এবং রাজনৈতিক সমঝোতা প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্দেশ্যে কয়েকটি পন্থা নিয়ে আমরা আলোচনা চালাচ্ছি।
একথা সত্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহ যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যায়নি, কিন্তু একথাও সমান গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষণীয় যে, মার্কিন দলিলপত্র অন্যরকম কিছু তথ্যকে সামনে নিয়ে এসেছে। ওপরে সংক্ষেপে উল্লেখিত চিন্তা, বক্তব্য ও সুপারিশসহ দলিলপত্রগুলো পড়ার পর মনে হতে পারে যেন পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ঠিক তেমন গভীর ও প্রশ্নাতীত ছিল না, যেমনটি এতদিন প্রচারিত হয়ে এসেছে। পাইপলাইন থেকে সমরাস্ত্র প্রত্যাহার, রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য ক্রমাগত চাপ, স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার তাগিদ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বরং এমন ধারণাই শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যে, প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করলেও যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়নি। পাকিস্তানী স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে এ অবস্থানকেই ‘প্রতারণাপূর্ণ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে একে আবার সম্পূর্ণরূপে ভারতের পক্ষাবলম্বন বলারও উপায় নেই। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ সমঝোতা এবং যুদ্ধ এড়ানোর জন্য ভারতের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছিল, সময়ে সময়ে ভারতকে প্রচ্ছন্নভাবে হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও একথাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানের পক্ষে ভূমিকা পালনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করা থেকে সযতেœ ও সুকৌশলে বিরত থেকেছে এবং ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি।
একই যুক্তরাষ্ট্র আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন যোগাড় করেছে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১০৪-১১ ভোটে পাকিস্তানকে জিতিয়েছে এবং শেষ দিনগুলোতে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর ঘোষণা দিয়ে চমক ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের ভাঙন ও পরাজয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বরং প্রতারণাপূর্ণ কৌশল অবলম্বনের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বলা হয়েছে, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সে সময় গণচীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গণচীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মধ্যস্থতা করায় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ার অভিনয় করেছিল। অভিনয় বলার কারণ, এই সমর্থন সর্বাত্মক ও আন্তরিক হলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পাকিস্তানকে কার্যকরভাবে সাহায্য করতো। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র শুধু কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। বাংলাদেশের বিরোধিতা করার জন্য এটুকুই অবশ্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু নিজের স্বার্থে সুকৌশলে পদক্ষেপ নিলেও যুদ্ধকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল।
ওদিকে সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল গণচীনের ভূমিকা। সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি চীনের সমর্থন স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু দুই প্রতিবেশী ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় এবং দেশ দুটি বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোয় চীন দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানের পক্ষে। সমাজতন্ত্রসহ বিভিন্ন প্রশ্নে চীন-সোভিয়েত শত্রুতার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন সে সময় চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মধ্যস্থতা করায় চীনের পক্ষে বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন সম্ভব ছিল না। এটাই অবশ্য শেষ কথা নয়। কারণ, পরবর্তীকালে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্যে জানা গেছে, ভারত ও বাংলাদেশ বিরোধী কূটনৈতিক তৎপরতার ক্ষেত্রে গণচীন পাকিস্তানের জন্য ‘বেশি দূর অগ্রসর হতে চায়নি’ এবং উপমহাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে নিবৃত্ত রাখার ব্যাপারে দেশটি বিশেষভাবে উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের স্বাধীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে স্বীকার করতেই হবে যে, চীনের ভূমিকা ছিল নিন্দনীয়Ñ যা সহজেই প্রশংসনীয় হতে পারতো এবং পাকিস্তানীদের গণহত্যাকে প্রতিহত করতে পারতো।  
এভাবে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটেছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী শিবির দুটির নেতৃত্বে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন। ঘটনাপ্রবাহে সবচেয়ে লাভবান হয়েছিল ভারত, অন্যদিকে সম্পূর্ণ বিপরীত ও ধ্বংসাত্মক পরিণতি বরণ করেছিল পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে প্রকাশ্য কূটনৈতিক সমর্থন বেশি পেলেও পাকিস্তান তার ভাঙন ও পরাজয় এড়াতে পারেনি। সবকিছুর পেছনে নির্ধারকের ভূমিকা রেখেছিল বাংলাদেশের জনগণ। স্বাধীনতার জন্য তাদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কাছে পাকিস্তান ও তার সমর্থকরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। বিশ্লেষণের এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণই আসলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মেরুকরণ ঘটিয়েছিল।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads