শুক্রবার, ১৩ মার্চ, ২০১৫

অনড় খালেদা জিয়ার সাংবাদিক সম্মেলন


আমাদের দেশে ‘বাপের ব্যাটা’ বলে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে। কঠিন বিপদের মুখেও যিনি বা যারা ভীত হওয়ার বদলে দুর্দান্ত সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হন, তাকে বা তাদেরকেই ‘বাপের ব্যাটা’ বলা হয়। এদেশেরই কোনো কোনো বিশেষজনাকে আবার ‘বাপের বেটি’ হিসেবেও পরিচিতি দেয়ার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তাই বলে ওই বিশেষজনা এখনো থেমে পড়ার নামটি পর্যন্ত করছেন না। এটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ, যদিও ‘আকেলমন্দ’ যারা তাদের জন্য ইশারাই ‘কাফি’ হওয়ার কথা। এভাবে শুরু করার কারণ তৈরি করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। প্রচারণায় ‘বাপের বেটি’ হতে না চাইলেও গতকাল ১৩ মার্চ যথেষ্টই দেখিয়েছেন তিনি। আগেরদিন থেকে রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন তিনি। এটা এমন এক সময় ক্ষমতাসীনরা যখন গণতন্ত্রসম্মত রীতি, সৌজন্য ও কর্মকান্ডের সকল সীমা অতিক্রম করে তার বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগে রয়েছেন। তাকে গ্রেফতার করার এবং মিথ্যা ও সাজানো মামলায় দন্ড দেয়ার লক্ষ্যে উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন তারা। খুনী এবং জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের রানী ধরনের আখ্যা দেয়া থেকে শুরু করে পেট্রোল বোমায় পুড়িয়ে মানুষ হত্যার অভিযোগে অসংখ্য মামলায় হুকুমের আসামী বানিয়েই তারা থেমে যাচ্ছেন না, বেগম জিয়াকে গ্রেফতারের দাবিতে হাস্যকর আন্দোলনেও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। গত ৫ জানুয়ারি অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই নানা বাহারী নামের সংগঠনের ব্যানারে খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসের অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করা হচ্ছে। একযোগে চলছে অফিস ঘেরাওয়ের চেষ্টা। নৌমন্ত্রী শাজাহান খানসহ জনা কয়েক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকেও মহাব্যস্ত দেখা যাচ্ছে। তারা এসব হাস্যকর ও নাটকীয় কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দিয়ে বেড়াচ্ছেন। ভাড়া করা কিছু লোকজন নিয়ে গুলশান এলাকায় তারা বিক্ষোভ মিছিল করছেন। কোনো কোনো মিছিলে আবার বোমারও বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। কিন্তু মন্ত্রীকে তো বটেই, পুলিশকেও বোমাবাজদের ধাওয়া দেয়ার বা পাকড়াও করার জন্য তৎপরতা চালাতে দেখা যায়নি। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা বরং শ’ দেড়-দুই মানুষের সমাবেশে হরতাল-অবরোধ বন্ধ করার জন্য খালেদা জিয়ার উদ্দেশে কঠোর ভাষায় হুমকি দিয়েছেন। কোনো এক বিশেষ মন্ত্রী ‘তুই-তুকারি’ করে খালেদা জিয়াকে কারাগারে ঢোকানোর সিদ্ধান্তধর্মী ঘোষণাও শুনিয়েছেন। সর্বশেষ উপলক্ষে এ ব্যাপারে জানান দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও। প্রথম থেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলে এলেও গত ১১ মার্চ জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি শুধু দিন-তারিখ সম্পর্কে বলতে বাকি রেখেছেন। এভাবে সব মিলিয়েই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, ভেতরে ভেতরে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছেন ক্ষমতাসীনরা। আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার করা এখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিছুটা দীর্ঘ হলেও ভ’মিকাটুকু দিতেই হলো। কারণ, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের হুংকার এবং র‌্যাব-পুলিশ ও আওয়ামী গুন্ডা-সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে প্রচন্ড দমন-নির্যাতন এবং গুম ও হত্যার পাশাপাশি সারা দেশে এমন এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে, যখন শুধু বাপের ব্যাটা বা বেটির পক্ষেই প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করা এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া সম্ভব। ১৩ মার্চ সে সৎ সাহসই দেখিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। এমন মন্তব্য অকারণে করা হচ্ছে না। সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই আওয়ামী পন্ডিতদের মুখ থেকে নানা ধরনের মন্তব্য ও বিশ্লেষণ শুনতে হচ্ছিল। ‘গুরু’ নামে কুখ্যাত একজনসহ আওয়ামী লীগের কোনো কোনো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং নেতা এমনকি একথা পর্যন্ত বলেছিলেন যে, সংবাদ সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়া নাকি ‘নাকে খৎ’ দিয়ে আন্দোলন থেকে সরে আসার ঘোষণা দেবেন! জনগণের কাছেও নাকি ক্ষমা চাইবেন তিনি! অন্যদিকে ২০ দলীয় জোটের নেত্রী কিন্তু সে সবের ধারেকাছেও যাননি। তিনি বরং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত এবং তার ভাষায় বর্তমান ‘অবৈধ’ সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ গত বছরের ডিসেম্বরে উপস্থাপিত সাত দফা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, অবিলম্বে পদত্যাগের মাধ্যমে সরে যেতে এবং অনির্বাচিত হলেও সংসদের অধিবেশন যেহেতু এখনো চলছে সেহেতু ওই সংসদের এই অধিবেশনেই পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদক্ষেপ নিতে। হত্যা-সন্ত্রাসসহ ক্ষমতাসীনদের কলংকিত ইতিহাসেরও উল্লেখ করেছেন তিনি। পেট্রোল বোমার প্রাণবিনাশী হামলা ও যানবাহনে গান পাউডার দিয়ে আগুনে নিরীহ মানুষ হত্যাসহ দেশব্যাপী চলমান ভয়াবহ নাশকতা, নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতন, গ্রেফতার ও হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, সবকিছুর পেছনে রয়েছে সরকারের নীল নকশা। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, বিএনপি-জাামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের ওপর দোষ চাপানোর সুচিন্তিত চেষ্টা চালানো হলেও জনগণ ঠিকই জানে, অতীতে কারা গান পাউডার ও পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে, কারা গাড়ি পুড়িয়েছে এবং দেশের সম্পদ ধ্বংস করেছে। সুতরাং অপপ্রচার চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা যাবে না, সরকারও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পারবে না। ক্ষমতাসীনদের সামনে একটি মাত্র পথই খোলা রয়েছে- সেটা তার সাত দফা মেনে নেয়া, ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া এবং সমঝোতা ও সংলাপের মাধ্যমে নতুন জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা। সেটা না করে ক্ষমতাসীনরা যদি নাশকতা ও নিষ্ঠুর কর্মকা- অব্যাহত রাখেন তাহলে অবরোধ তো চলবেই, সরকারকে বিদায় করার লক্ষ্যে আরো কঠোর কর্মসূচিও দেয়া হবে- যার পরিণতি ক্ষমতাসীনদের জন্য ‘শুভ’ হবে না। বেগম খালেদা জিয়া প্রসঙ্গক্রমে দেশের সকল অঞ্চলে যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দমনের অভিযান চালানো হচ্ছে তারও বর্ণনা দিয়েছেন। বলেছেন, এভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন ও নির্মূল করা যাবে না। তিনি তাই সংলাপ ও সমঝোতার গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসার জন্য ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্য কিছু প্রসঙ্গেও বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া, কিন্তু প্রাধান্যে এসেছে সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকেন্দ্রিক দাবি এবং অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা। দু’ মাসেরও বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ থাকার পরও অত্যন্ত বলিষ্ঠতার সঙ্গে বক্তব্য রেখেছেন তিনি যা কেবল একজন দেশপ্রেমিক জাতীয় নেত্রীর পক্ষেই সম্ভব। বিশেষ করে গান পাউডার ও পেট্রোল বোমার মাধ্যমে প্রাণ ও সম্পদবিনাশী নাশকতা, দমন-নির্যাতন এবং গ্রেফতার ও হত্যা সম্পর্কিত তার কথাগুলোর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, অভিজ্ঞতার আলোকে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, সব কর্মকা-ই সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে চালানো হচ্ছে। হামলার ক্ষেত্রে হতাহত হচ্ছেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোটের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা, যাদের মধ্যে বেগম জিয়ার উপদেষ্টাসহ সিনিয়র নেতারাও রয়েছেন। এসবের নির্দেশদাতা কারা সেকথা এমনকি সাধারণ মানুষকেও বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। প্রতিটি ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেছে, সরকারের ফ্যাসিস্ট নীতি ও কর্মকান্ডে পরিবর্তন ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই। ক্ষমতাসীনরা বরং আরো চন্ড-তার সঙ্গে দমন-নির্যাতন এবং গ্রেফতার ও অঘোষিত হত্যাকান্ডের অভিযান চালানোর চেষ্টা চালাবেন। তেমন সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই এগিয়ে যেতে চাচ্ছেন তারা। কথিত বোমাবাজদের ধরিয়ে দিলে এক লাখ টাকা পুরষ্কার দেয়ার ঘোষণার পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায় নাগরিক কমিটি গঠন করার মাধ্যমে এ সম্পর্কে জানানও যথেষ্টই দিয়ে চলেছেন তারা। এই সুযোগে একদিকে আওয়ামী গুন্ডা-সন্ত্রাসীরা আইন হাতে তুলে নিচ্ছে অন্যদিকে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোও নতুন পর্যায়ে ভাড়াটে লাঠিয়ালের ভ’মিকায় নেমে পড়েছে। একযোগে আবারও তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নাটক মঞ্চায়িত হতে শুরু হয়েছেÑ প্রতিটি ক্ষেত্রে যার শিকার হচ্ছেন বিএনপি-জামায়াত ও এ দুটি দলের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। বলা বাহুল্য, অবৈধ হিসেবে নিন্দিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে অবলম্বন করে যে কোনোভাবে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা চালানো এবং মাঝখানের চার বছরে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত করা এবং সম্ভব হলে নির্মূল করে ফেলাই ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য। এই নীতি-কৌশল ও কর্মকা-ের ফলে রাজনৈতিক সংকটই শুধু ঘনীভূত হবে না, সারা দেশে সহিংসতাও ছড়িয়ে পড়বেÑ বাস্তবে পড়ছেও। কারণ, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আক্রান্তরা বিনাপ্রতিবাদে মার খেতে রাজি হন না, তারা বরং প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। সে অবস্থায় দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে পড়বে, নির্বাসনে যাবে গণতন্ত্রও।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে সাত দফা সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্রুত নতুন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিসহ এই সাত দফা প্রস্তাব পেশ করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, এই সরকারকে এমন হতে হবে যাতে সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে এবং সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সুযোগের সমতা নিশ্চিত হয়। অন্য এক প্রস্তাবে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিসভা ও সংসদ বিলুপ্ত হবে এবং দায়িত্ব নেবে সব দলের সম্মতিক্রমে গঠিত নির্দলীয় সরকার। প্রতিদ্বন্দ্বী সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ, দক্ষ, যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনেরও দাবি জানিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। বলেছিলেন, কমিশনের সচিবালয় ও মাঠ পর্যায় থেকে পক্ষপাতদুষ্ট কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করতে হবে এবং নির্বাচনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে তারিখ ঘোষণার পরপরই বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তার জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সারা দেশে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করতে হবে। ভোটার তালিকার ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করা, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার এবং রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির পাশাপাশি বর্তমান সরকারের আমলে নিষিদ্ধ করা সকল সংবাদপত্র ও টেলিভিশন খুলে দেয়ার দাবিও জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। তার ভাষায় সম্পূর্ণ ‘অবৈধ ও দখলদার’ সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, সমঝোতা ও আলোচনার পথে তার উপস্থাপিত সাত দফা মেনে না নিলে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করা হবে। তাকে ‘মাইনাস’ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে জানিয়ে খালেদা জিয়া বলিষ্ঠতার সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, শুধু দেশবাসীই তাকে রাজনীতি থেকে ‘মাইনাস’ করতে পারে- স্বার্থান্বেষী কোনো গোষ্ঠীরই তেমন সাধ্য নেই। জামায়াতে ইসলামীকে জোটে রাখা প্রসঙ্গে বিএনপি নেত্রীর জবাব ছিল, আওয়ামী লীগও অতীতে দলটিকে সঙ্গে রেখেছে। তাছাড়া ২০ দলীয় জোট গঠিত হয়েছে অবৈধ এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য। জোটে জামায়াতের মতো আরো অনেক দলও রয়েছে। সুতরাং কেবলই জামায়াতের ব্যাপারে আপত্তি জানানোর সুযোগ নেই।
সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে অন্য কিছু বিষয়ও রয়েছে, কিন্তু আবারও প্রাধান্যে এসেছে সাত দফা- যার মধ্যে মন্ত্রিসভা ও সংসদের বিলুপ্তি ঘটানোর পাশাপাশি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তুলে ধরেছেন খালেদা জিয়া। বলার অপেক্ষা রাখে না, খালেদা জিয়ার উপস্থাপিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও সরকারের এই প্রস্তাব সবদিক থেকেই বাস্তবসম্মত এবং দেশের সকল মহলেই এটা ব্যাপকভাবে সমর্থিত হবে। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যই তিনি দাবি জানিয়ে এসেছেন, আন্দোলনও করেছেন। জনগণের আশা ও ধারণা ছিল, ক্ষমতাসীনরা এই দাবি মেনে নেবেন এবং সে অনুযায়ী সংবিধানে সংশোধনী আনবেন। অন্যদিকে সরকার এগিয়েছে নিজেদের ছক অনুযায়ী, যার প্রকাশ ঘটেছে গত বছরের ৫ জানুয়ারি আয়োজিত ভোটারবিহীন সংসদ নির্বাচনে। সে নির্বাচনও এমন এক ‘সর্বদলীয়’ সরকারের অধীনে হয়েছে যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতেই পরিষ্কার হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর পদটি তিনি আঁকড়ে থাকবেনই। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তখন বলা হয়েছিল এবং একথা প্রমাণিতও হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী আদৌ চাননি, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ওই নির্বাচনে অংশ নিক। অমন এক পরিস্থিতিতেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে ছাড় দিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। বলেছিলেন, যে কোনো নামেই গঠন করা হোক না কেন, নির্বাচনকালীন সরকারকে নির্দলীয় হতে হবে এবং প্রধানমন্ত্রীর পদে শেখ হাসিনা থাকতে পারবেন না। কিন্তু বিএনপি নেত্রীর সে দাবিও নাকচ করা হয়েছিল। সেই থেকে সংকট ক্রমাগত আরো ঘনীভূত হয়ে চলেছে বলেই সমাধানের পন্থা হিসেবে নতুন পর্যায়ে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রস্তাব পেশ করেছেন খালেদা জিয়া। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা অতীতের মতো এখনো সহিংসতা ও সংঘাতের পথকেই বেছে নিয়েছেন, সমঝোতামুখী অবস্থান নেননি। বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকার যে নীতি-কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে, যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দমন-নির্যাতন ও হত্যাকান্ড চালাচ্ছে এবং মিথ্যা মামলায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আটক করছে- অনেককে এমনকি গুম পর্যন্ত করছে তার ফলে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব হয়ে উঠবে।
রাজনৈতিক সংকট তো ঘনীভূত হবেই, সারা দেশে সহিংসতাও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি অবশ্যই আশংকাজনক এবং জনগণের আকাক্সক্ষার পরিপন্থী। এজন্যই সরকারের উচিত সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নীতি-অবস্থান পরিবর্তন করা। শুনতে খারাপ লাগলেও শেষ করার আগে বলা দরকার, গণতন্ত্রের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের সামান্যও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু জনগণ উদ্বিগ্ন এজন্য যে, অমন পরিস্থিতি অবশ্যই ভীতিকর এবং জাতির জন্য ধ্বংসাত্মক। এ ধরনের সম্ভাবনা ও আশংকার পরিপ্রেক্ষিতেই জনগনের সচেতন অংশ মনে করেন, সরকারের উচিত অবিলম্বে বেগম খালেদা জিয়ার দাবি ও পরামর্শ মেনে নেয়া এবং প্রথমে নিজেরা পদত্যাগ করে ও সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তৎপর হওয়া। এই নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি বিষয়ে দিকনির্দেশনা রয়েছে সাত দফায়। ১৩ মার্চের সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনেও সে সবেরই পুনরাবৃত্তি করেছেন খালেদা জিয়া। সংকটের সত্যি সমাধান চাইলে দরকার এখন সরকারের পক্ষ থেকে সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটানো, যে বিষয়ে সংশয় রয়েছে দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রকামীদের।
আহমদ আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads