শনিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

একদিকে পেট্রোলবোমা অন্যদিকে ক্রসফায়ার চারদিকে লাশের মিছিল


চলমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে আশার কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। সংকট সৃৃষ্টির পর আজ ৩৪ দিন পার হয়ে গেল। কিন্তু সুড়ঙ্গের ওপাশে কোনো আলোক রশ্মি তো দূরের কথা, আশার কোনো বিন্দুও দেখা যাচ্ছে না। দীর্ঘ ৩১ দিন পর গত শুক্রবার ৬ ফেব্রুয়ারির টিভি এবং বার্তা সংস্থাসমূহে একটি খবর এলো। ৩১ দিন পর এই প্রথম মনে হলো যে খবরটিকে ইতিবাচক হিসেবে গণ্য করা যায়। খবরটি সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে খবরটি নিচে তুলে ধরা হলো, “আলোচনায় রাজি : ইইউ রাষ্ট্রদূতকে আ.লীগ”। ‘শীর্ষ নিউজ’ ডটকম পরিবেশিত খবরে বলা হয়, “চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আলোচনায় রাজি বলে ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত পিয়েরো মায়াদুরকে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে আলোচনার আগে বিএনপিকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বন্ধ করতে হবে বলেও জানিয়েছেন তারা। বৃহস্পতিবার রাতে ইইউ রাষ্ট্রদূতের আমন্ত্রণে তার ঢাকাস্থ বাসভবনে আয়োজিত বৈঠকে আলাপকালে আওয়ামী লীগ নেতারা এ কথা জানান। উল্লেখ্য, আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা এ বৈঠকে যোগ দেন। বৈঠক শেষে নৈশভোজেরও আয়োজন করা হয়েছিল। সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু বৈঠক থেকে বেরিয়ে এসে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান, ইইউ রাষ্ট্রদূত আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তাই আমরা গিয়েছিলাম। আমরা তাকে জানিয়েছি, আলোচনা করতে হলে বিএনপিকে আগে সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সেই সঙ্গে ‘নাশকতা কেন করেছে’ তাও তাদের বলতে হবে। বৈঠকে যোগ দেন সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, আব্দুল মজিদ মৃধা এমপি প্রমুখ। এছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ার হাই কমিশনার, কানাডার রাষ্ট্রদূত এবং ইউএস এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর উপস্থিত ছিলেন। চলমান সহিংস পরিস্থিতি ছাড়া এসময় বৈদেশিক সাহায্য নীতিমালা নিয়ে তারা ইইউ রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
এই খবরটিকে আমরা ইতিবাচক ভাবেই গ্রহণ করতাম। কিন্তু আলোচ্য খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর একই দিন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ বিদেশীদের অত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে না। তার এই মন্তব্যের ফলে বলা যেতে পারে যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের দৌড়ঝাঁপের গুরুত্ব হারালো।
এছাড়া গত ৬ ই ফেব্রুয়ারি শুক্রবার আলোচনার প্রস্তাবকে সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রমুখ শীর্ষ আওয়ামী নেতৃবৃন্দ। এর ফলে আলাপ আলোচনার কোন রূপ সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল।
ঐ দিকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও প্রাক্তন মন্ত্রী মেজর হাফিজ উদ্দিন বলেন, চলমান সংকটের অবসান করতে হলে সরকারকে পদত্যাগ করে মধ্যবর্তী নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে। তাহলে একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বিষয়ে সংলাপ হতে পারে। দেশে শান্তিও ফিরে আসবে। তিনি আরও বলেন, ১৯৯৬ সালে শেরাটনের কাছে তারাই বাসে গান পাউডার দিয়ে মানুষ হত্যা করেছিল। দুই বছরে ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল। তাদের সহিংসতার কারণে ওই সময়ে এসএসসি পরীক্ষা তিন মাস পেছাতে হয়েছিল। রোজার দিনেও তারা হরতাল করছে। মেজর (অব.) হাফিজ অভিযোগ করেন, সরকার বার্ন ইউনিটে আহতদের দুর্দশা নিয়ে রাজনীতি করছে যা অশোভনীয় ও নিন্দনীয়। তিনি বলেন, বিএনপি বোমাবাজদের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। সরকারবিরোধী দলের ওপর দোষারোপ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করতেই আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে। আজকের পত্রিকায় আছে, রূপগঞ্জে বোমা বানাতে গিয়ে সরকারি দলের লোকজন আহত হয়েছে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের জন্য সরকারকে অভিযুক্ত করে সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন বলেন, পুলিশ হেফাজতে গত এক মাসে ৩৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ৭শ’ মামলায় ১৭ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুর্বৃত্তের সহিংসতায় ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসবের দায় সরকারকেই নিতে হবে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের মাধ্যমে সরকার দেশকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
॥ দুই ॥
আজ আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করছি। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর গত শুক্রবার সর্বপ্রথম বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করল। আমরা আমেরিকার সেই মন্তব্য নিচে তুলে ধরছি, “বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে বাধা না দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি মুখপাত্র ম্যারি হার্ফ বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতা ও সহিংসতায় যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা বাস পোড়ানো, দাহ্য বস্তু ছটুড়ে মারা, ট্রেন লাইনচ্যুতিসহ নানা অবিবেচক হামলার মাধ্যমে সাধারণ লোকজনকে হতাহতের নিন্দা জানাচ্ছি।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সহিংসতা চালানোর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে এ ধরনের আচরণ সমর্থনযোগ্য নয়।’ চলমান সহিংসতা বন্ধে শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সব বাংলাদেশীরই শান্তিপূর্ণভাবে তাদের মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের পরিবেশ নিশ্চিত করে।”
এসব ক্ষেত্রে আমেরিকার যে ভূমিকা হয়, এখানেও তাই হয়েছে। তারা এদিকেও বলেছে আবার সেদিকেও বলেছে। কিন্তু পরিষ্কার করে কোনো কথা বলেনি। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে সহিংসতার কথা বলা হয়েছে।
॥ তিন ॥
কিন্তু সহিংসতা তো শুধু মাত্র এক পক্ষেই হয়নি। এই কয়দিনে যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হয়েছে সেগুলো বলা না হলে অর্ধ সত্য কথা বলা হয়, পূর্ণ সত্য নয়। গত দুই সপ্তাহে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অন্তত ১৭ জন শাহাদাত বরণ করেছেন। আমরা এখানে তাদের একটি তালিকা দিচ্ছি।
১. নূরুল ইসলাম শাহীন। রাজশাহীর বিনোদপুর ইসলামীয়া কলেজের অধ্যাপক। গত ২৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার তাকে ডি বি পুলিশ উঠিয়ে নেয় এবং ২৮ জানুয়ারি বুধবার তিনি বন্দুক যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন।
২. ২৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার রাতে ইসলামী ব্যাংকের ল্যাব সহকারি নাহিদ জামালকে রাস্তা থেকে পুলিশ উঠিয়ে নেয়। ২৮ জানুয়ারি বুধবার তিনি ক্রস ফায়ারে নিহত হন।
৩. ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা সাকিবুল ইসলাম ২৮ জানুয়ারি বুধবার রাত ৩টায় এ্যাপোলো হাসপাতালে মারা যান। ২০ জানুয়ারি মঙ্গলবার ককটেলের আঘাতে আহত হন তিনি। তার অভিভাবকের অভিযোগ, পুলিশ তার চিকিৎসায় অবহেলা করেছে।
৪. চাঁপাইনবাবগঞ্জে সিটি কলেজের ছাত্র ও ছাত্র দল নেতা আসাদ উল্লাহ তুহিনকে ২৫ জানুয়ারি রোববার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। ১৩ ঘন্টা পর সোমবার রাত ৩ টার সময় ট্রাক চাপায় তিনি নিহত হন।
৫. ১৬ ই জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে ছাত্রদল নেতা মতিউর রহমানকে যৌথ বাহিনী হত্যা করে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
৬. বৃহস্পতিবার ৫ ফেব্রুয়ারি গভীর রাত অর্থাৎ শুক্রবার সাতক্ষীরার কাশিমপুর গ্রামের শিবির নেতা শহীদুল ইসলাম ভোররাতে যশোরে ক্রস ফায়ারে নিহত হন।
৭. বৃহস্পতিবার ৫ ফেব্রুয়ারি গভীর রাত অর্থাৎ শুক্রবার রাজশাহী শিবির নেতা শাহাবুদ্দিন রাত ১ টার দিকে তিনি ক্রস ফায়ারে নিহত হন।
৮. ১৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার নোয়াখালী যুবলীগের অস্ত্রবাজদের গুলীতে ছাত্রদল নেতা পারভেজ নিহত হন।
৯. ৫ জানুয়ারি সোমবার গণতন্ত্র হত্যা দিবসে দেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিল হয়। এসব মিছিলে পুলিশ গুলীবর্ষণ করে। ফলে বিএনপি, ছাত্রদল ও যুব দলের ৪ জন নেতা নিহত হন।
১০. ৭ জানুয়ারি বুধবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে পুলিশের গুলীতে ছাত্রদল নেতা মহসিন উদ্দিন নিহত হন।
১১. ৭ জানুয়ারি বুধবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে পুলিশের গুলীতে যুবদল নেতা মিজানুর রহমান রুবেল নিহত হন।
১২. এর আগে গত ১৮ জানুয়ারি চুয়াডাঙ্গা সদরে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত ও গুলীতে নিহত হন শঙ্কর চন্দ্রপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি মেম্বার ও ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি সিরাজুল ইসলাম (৪৭)।
১৩. সোমবার ১৯ জানুয়ারি ভোরে মতিঝিলে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত নড়াইল পৌরসভার কাউন্সিলর ও জামায়াত নেতা ইমরুল কায়েসকে পুলিশ ধরে নিয়ে হত্যা করেছে বলে পরিবার অভিযোগ করেছে। একই অভিযোগ করেছে জামায়াতে ইসলামীও।
১৪. ১৯ জানুয়ারি সোমবার খিলগাঁর জোড় পুকুর মাঠে ছাত্রদল নেতা নূরুজ্জামান জনির লাশ পাওয়া যায়। ছোট ভাইকে দেখার জন্য জনি সেন্ট্রাল জেলে গিয়েছিলেন। তার সাথে ছিলেন বিএনপির দিপু সরকার এবং যুবদলের মইনুদ্দিন। ডিবি পুলিশ জনিকে তুলে নেয়। তার সহগামী দুই বন্ধু এখনও নিখোঁজ। জনির সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, শরীরে ১৭টি গুলীর চিহ্ন রয়েছে। এর মধ্যে বাম কোমরে একটি, বুকের মাঝ বরাবর তিনটি, বুকের বাম পাশে দুটি, বুকের ডান পাশে তিনটি, পিঠের বামপাশে তিনটি, পিঠের বাম পাশের উপরে দু’টি, পিঠের ডান পাশের উপরে একটি, পিঠের মাঝামাঝি একটি এবং ঘাড়ের বাম পাশে একটি গুলী লেগেছে। অর্থাৎ তার শরীরের চারদিকে গুলী লেগেছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ সাদিয়া তাজনীনের উপস্থিতিতে সুরতহাল রিপোর্টটি তৈরি করেন খিলখগাঁও থানার একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই)।
১৫. গত বৃহস্পতিবার বিকেলে বাসা থেকে গ্রেফতারের পর সকালে হাসপাতালে গুলীবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম উপজেলা শিবির সভাপতি সাহাব পাটোয়ারীর। গ্রেফতারের পর পরই তার বোন আঞ্জুমান আরা তার জীবননাশের আশংকা করে বিবৃতি দিয়েছিলেন।
৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ‘সংগ্রামের’ রিপোর্ট মোতাবেক গত ৫ই জানুয়ারি থেকে ৬ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলীতে মৃত্যুবরণ করেছেন ২৫ জন রাজনৈতিক কর্মী। চলমান ঘটনাবলীতে উভয় পক্ষের সহিংসতায় প্রতিদিন যে লাশ পড়ছে সেই লাশ পড়ার শেষ কোথায়? আর কত রক্ত?
আসিফ আরসালান 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads