রবিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়া


অর্ধশত দিন অতিক্রমকারী বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের পরিস্থিতি সম্পর্কে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া একটি স্পষ্ট রূপলাভ করেছে। শাসক দল ছাড়া সবাই সংলাপ-সমঝোতার কথা জানিয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বি, চৌধুরী, বর্ষীয়ান নেতা ড. কামাল হোসেন, বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, বিকল্প রাজনীতির কান্ডারী মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ প্রায় সব দল ও নেতা ভাষণে, বক্তব্যে, বিবৃতিতে, অবস্থান কর্মসূচিতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় সংলাপ ও সমঝোতার দাবি করেছেন। বিভিন্ন পেশাজীবী ও খাতভিত্তিক সংগঠন; যেমন- শিক্ষক, পোশাক মালিক ইত্যাদি সেক্টর থেকেও চলমান আন্দোলনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের অমনোযোগী ও নির্লিপ্ত থাকার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করে সংলাপ ও সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনঅংশগ্রহণমূলক ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান-সূত্র উপস্থাপন করেছেন। দেশের মতো বিদেশের বিভিন্ন দাতা সংস্থা, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের সুস্পষ্ট মতামতও সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে চলমান সঙ্কট নিরসনের পক্ষেই ব্যক্ত হয়েছে। মোট কথা, বিগত সময়ের একদলীয় ও ভোটবিহীন একতরফা নির্বাচনের গর্ভেই যে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের বীজ রোপিত হয়েছিল, সেটাই সবাই স্বীকার করেছেন এবং গণতান্ত্রিক-সুস্থ ব্যবস্থায় উত্তরণের তাগিদ দিয়েছেন।
আন্দোলনরত বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী পক্ষ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্থর থেকে উত্থাপিত সংলাপ-সমঝোতার আহ্বানকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু আরেক পক্ষ তথা সরকার এখনো এ ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থানে আছে এবং সংলাপ বা সমঝোতা না করার ব্যাপারে অনঢ়। এমনকি আন্দোলনের নেত্রীর বেগম খালেদা জিয়াকে প্রায় বন্দিদশার মধ্যে ঘেরাও করে রাখা বা খাদ্য সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টির খবরও পাওয়া যাচ্ছে। জেলখানাগুলো উপচে পড়ছে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- প্রতিনিয়ত চলছে।
এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চুপ নেই। মানবাধিকার নেত্রী আইরিন খান, জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইত্যাদি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য-বক্তব্য প্রতিদিনই শোনা যাচ্ছে এবং তাদের বক্তব্য যে এখন খুব একটা নরম অবস্থায় নেই, সেটাও অনুধাবণ করা যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ফোনালাপ এবং চিঠির বিষয়ও মিডিয়ায় এসেছে। আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভাষা যারা বোঝেন, তারা ঠিকই কথার মর্ম বুঝতে পারছেন। যদিও সরকারের পক্ষে কথা ও কাজে তাদের স্বভাবসিদ্ধ-উগ্রতা চলছেই। কিন্তু একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, পথ-ঘাট-মাঠ পর্যায়ের হুঙ্কার বা আক্রমণাত্মক বক্তব্য সরকার চালানো বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ম্যানেজ করার উপায় নয়। বশংবদ ও চাটুকারদের মধ্যে যারা গরম-গরম কথায় সরকারের নীতিনির্ধারকদের মাথা গরম করে দিচ্ছেন বা কঠিন বাস্তব পরিস্থিতিকে আড়াল করার নামে শূন্যগর্ভ বাক্য-বাণিজ্য করে নিজের আখের গোছাচ্ছেন এবং সরকারের বারোটা বাজাচ্ছেন, তারা আসলে বিপদই ডেকে আনছেন। ঘরে ও বাইরের এমন বিপদ-সঙ্কুল রাজনৈতিক পরিস্থিতি মাথা-মোটা বুদ্ধি আর উগ্রচন্ডী কথায় সামলানো যাবে না। সংলাপ, সমঝোতা, বিচক্ষণতা, সুবিবেচনা আর উদারতার মাধ্যমেই উত্তরণ ঘটাতে হবে। এটাই সঙ্কট বিমোচনের পরীক্ষিত পথ।
এই সুযোগে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও কিছু কথা পরিষ্কারভাবে আলোচনা করা দরকার। চলমান একবিংশ শতাব্দীতে যে বিশ্বায়ন ব্যবস্থা চলছে, তাতে পৃথিবীর প্রতিটি দেশই একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রতিটি দেশই পরস্পরের খবর রাখে। বিশেষত জঙ্গিবাদের উত্থান হলে, গণতন্ত্র ও সুশাসন ব্যহত হলে, মানবাধিকার ও আইনের শাসন লঙ্ঘিত হলে বিশ্ব শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার নামে বিশ্ব সম্প্রদায় সরব হয়। তারা তখন নানা রকম ভূমিকাও পালন করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রকাশ্যে বা গোপনে, সরাসরি বা পরোক্ষে কি ভূমিকা পালন করছে, সেটা সবাই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। অতএব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করার পরিণাম সম্পর্কেও সচেতন থাকতে হবে। যারা সর্বাবস্থার একগুঁয়েমিকে হাতিয়ার করে দনিয়ার সবাইকে আন্ডারমাইন্ড করছেন, তারা শুধু নিজেদের বিপদ বাড়াচ্ছেন না, সবাইকেই বিপদে ফেলছেন। এমন অপরিণামদর্শিতার ফল ভালো হয় না।
প্রসঙ্গত আরো উল্লেখ করা দরকার যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে খুশি রাখার জন্য সর্বত্রই এখন একটি কুপ্রবণতা চলছে। সেটা হলো জঙ্গিবাদের জুজুর ভয়। গণতান্ত্রিক আন্দোলন আর জঙ্গিবাদ যে এক নয়, সেটা পরখ করার মতো মেধা, বুদ্ধি, শিক্ষা, যোগ্যতা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রয়েছে। জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ইত্যাদি বলে বলে চিৎকার করলেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় খুশিতে পেয়ার-মহব্বত করতে আরম্ভ করবে, বিষয়টি এমন নয়। কারণ গণতান্ত্রিক-মডারেট রাজনৈতিক শক্তিই বিশ্ববাসীর পছন্দ। জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ যেমন নয়, অজনপ্রিয়-অগ্রহণযোগ্য-অনির্বাচিত একনায়করাও নয়। বাংলাদেশের চলমান আন্দোলনের গণতান্ত্রিক রূপ-চরিত্র জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রকাশিত বিষয়। ফ্রি-ফেয়ার-ইনক্লুসিভ-পারটিসিপেটরি ইলেকশান, রুল অব ল’ এবং হিউম্যান রাইটসের কথাই গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলছে। যে বক্তব্য বিশ্বব্যাপী সব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানবিক মানুষেরই বক্তব্য। এখানে জঙ্গিবাদ বা মৌলবাদ খুঁজে বেড়ানো মূর্খতা। এমন অপচেষ্টা বারংবার করা হলেও সেটা ভন্ডুল হয়েছে আটক নাশকতাকারীদের প্রকাশিত পরিচয়ে। অতএব দিনে দিনে দুধ আর পানি পৃথক হচ্ছে।
নিজের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক, অগ্রহণযোগ্য আচরণ ও চেহারাকে আড়ালের জন্য যারা ভিন্ন বা অন্য কথা বলে কিংবা জঙ্গিবাদ, মৌলবাদের ভীতি ছড়ায় অথবা নিজেরাই নিজেদের লোক দিয়ে এমন সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়, তাদের বোধোদয়ের জন্য গান্ধী আর পোপের কথাগুলো খুবই শিক্ষণীয় হবে। মহাত্মা গান্ধীকে তার জ্যেষ্ঠপুত্র হরিলাল একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ১৯০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় যখন গান্ধীকে বীভৎসরকম প্রহার করা হয়, গান্ধী-পুত্র হিসেবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলে তার কী করণীয় ছিল? (১) শারীরিক বলপ্রয়োগ দ্বারা পিতাকে রক্ষা করা; নাকি (২) পিতাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে পালিয়ে যাওয়া? অহিংসাবাদী গান্ধীর উত্তর ছিল, “অবশ্যই রক্ষা করা। বলপ্রয়োগ করে হলেও।” অতএব অহিংসা আর আত্মঅধিকার রক্ষার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। আর আত্মরক্ষা এবং জঙ্গিবাদ/মৌলবাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। এ প্রসঙ্গে বিশ্বখ্রিস্ট সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতা পোপ ফ্রান্সিস এর উক্তিও স্মরণ করায় গান্ধীর কথা। পোপ বলেছেন, “কেউ যদি তার মাকে/বাবাকে কটূকথা বলে/আঘাত করে, তিনি তাকে ছাড়বেন না, চপেটাঘাত করবেন।” মনে হতে পারে, পোপ কি তবে হিংসাত্মক পন্থার পক্ষে কথা বলছেন? চরম সঙ্কটে গান্ধীও কি হিংসার পথ বেছে নিতে বলেছিলেন পুত্রকে? না, তা কিন্তু নয়। গণতান্ত্রিক জনশক্তিকে এগুতে হবে পরিস্থিতি বুঝে, প্রয়োজনীয় সংযম অবলম্বন করেই। পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে যে, কেউ এমনি এমনি হিংসাত্মক হয় না। হিংসাত্মক পথ যে বেছে নিচ্ছে, বুঝতে হবে, তাকে কতটা অসহায় করে তোলা হয়েছিল। কতটা অনন্যোপায় সে ছিল, সেটাও তখন সামনে চলে আসে। বিবেক তখন একটি প্রশ্নে জর্জরিত হয়, ‘আঘাতের পর প্রত্যাঘাত হলে, সে দায় কার?’ বিজ্ঞান ও যুক্তি বলছে, আঘাত-প্রত্যাঘাত খুব সরল কয়েকটি নিয়মে চলে। উভয়ের মধ্যে রয়েছে ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়ার নিবিড় সম্পর্ক। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী নিউটনের তৃতীয় সূত্র আসলে আর কিছু নয়; আঘাত ও প্রত্যাঘাতের বৈজ্ঞানিক বর্ণনা।
এই আঘাত আর প্রত্যাঘাতের বিষয়টিকে ভুলভাবে চিত্রিত করলে এবং বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হলে প্রকৃত সত্য লোপ পেয়ে যে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হবে, সেটা কারো জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে না। যেখানে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ নেই, সেখানে ভুলভাবে জঙ্গিবাদ বা মৌলবাদ যারা দেখাতে চান, তারা শান্তির পক্ষের লোক নয়। তাদের মতলবও ভালো নয়। কেউ যদি নিজের অপকর্ম ঢাকতে বা নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যা, চাতুরী, প্রবঞ্চনা, শক্তি ও ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে, তবে সেটা বুমেরাং হয়ে তাদের ওপরই নেমে আসে। মিথ্যার আবেশ কেটে সত্য প্রকাশিত হলে গিলোটিনের সামনে পড়তে হয়। এটাই নিয়তি। ভুলর্বাতা বা ভুলচিত্র তুলে ধরার কুফল পৃথিবীর ইতিহাসে কম নেই। অতীতে ফরাসি রাজাদের ক্ষেত্রেও এমনই ঘটেছিল। সাম্প্রতিক-অতীতে আরব বিশ্বে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ বাড়ছে, একদল লোক এমন মিথ্যা-তথ্য প্রচার করে করে মিথ্যাকেই সত্যে পরিণত করেছিল। আসল ঘটনা হলো, আরব কেন, ভারত বা ইসরাইলেও ক্ষুদ্র একটি মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী গ্রুপ আছে, যারা হিন্দু ধর্ম বা ইহুদি ধর্মকে সহিংসভাবে ব্যবহার করে। ইসলাম ধর্মকেও এমনভাবে অপব্যাখ্যা বা অপব্যবহারের লোকের অভাব নেই। কিন্তু এরা কখনোই সংখ্যাগরিষ্ঠ নয় এবং এরা গণতান্ত্রিক পন্থা মেনে প্রকাশ্য রাজনীতিও করে না। এখন প্রতিষ্ঠিত, নিয়মতান্ত্রিক, প্রকাশ্য রাজনৈতিক শক্তিকেও জঙ্গিবাদ বা মৌলবাদ বানিয়ে দিলে গুপ্ত সন্ত্রাসীরা আস্কারা পাবে। এবং আরবে যেমন হয়েছিল, জঙ্গিবাদ বা মৌলবাদ আছে, এমন প্রচারের সূত্র ধরে সম্মিলিত পশ্চিমা বাহিনী আক্রমণ চালালো। জঙ্গিদের বিশেষ কিছু না হলেও, যারা পশ্চিমের দয়া কুড়ানোর জন্য জঙ্গিবাদের জিগির তুলেছিল, তাদের মাথাকাটা গেল। জঙ্গিবাদের ভুল-তথ্য প্রচার করে স্বৈরাচারী-একনায়করা বাঁচতে পারেনি। আরব ও আফ্রিকার সাম্প্রতিক তথ্য সে কথাই বলছে। রূপকথা বা রাজনীতি, যেখানেই হোক, ‘বাঘ এলো, বাঘ এলো’ বলে চেঁচানো মিথ্যাবাদী রাখালদের শেষ পরিণতি ভালো হয় না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads