সোমবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

মানুষকে অপমান করে কেউ সম্মান আশা করতে পারে না


সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ২০ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সম্প্রতি তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে হারিয়েছেন। কোকোর বিধবা স্ত্রী ও দুই মেয়ে এখন তার কাছে। পুত্রশোকে মুহ্যমান অবস্থায় তাকে বিধবা পুত্রবধূ এবং দুই নাতনীকে যখন সান্তনা দিতে হচ্ছে তখন যাত্রাবাড়ীতে বাসে দুর্বৃত্তদের পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের দায়ে হুকুমের আসামী হিসেবে সরকার তার বিরুদ্ধে দু’টি মামলা দায়ের করেছেন। অবশ্য এর আগে প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনায় বেগম জিয়াকে হুকুমের আসামী করার বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় আছে বলে জানিয়েছেন। সরকার তার কথা অনুযায়ী কাজ করেছেন বলে মনে হয়।
বলাবাহুল্য, বিএনপির নেতৃত্বে সরকারের বিরুদ্ধে এখন ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন চলছে। অবরোধ হরতালে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে এবং অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। সরকার এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে এখনো স্বীকৃতি দেননি। সরকার প্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, নেতা-উপনেতা সবাই একে সন্ত্রাস ও জঙ্গিপনা আখ্যায়িত করে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি এবং সশস্ত্র দলীয় ক্যাডার লেলিয়ে দিয়ে এই আন্দোলন দমন করতে চাচ্ছেন। তারা কয়েক হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে গুলী করে হত্যা করেছেন, অসংখ্য আহত হয়েছেন, লাখ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন। তাদের বেশির ভাগ গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতার বাণিজ্য ও মামলা খরচ বহন করতে গিয়ে আসামীরা ফতুর হচ্ছেন। যৌথ বাহিনী গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, বাড়িঘর তছনছ করে দিচ্ছে। বাড়ি থেকে নেতাকর্মী ধরে নিয়ে হত্যা করে বলা হচ্ছে ‘বন্দুক যুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং আন্দোলন দমনের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণের স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছেন এবং পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী এর দায় তিনি বহন করবেন। এর অর্থ ও তাৎপর্য বলার অপেক্ষা রাখে না।
বেগম জিয়াকে নিয়ে আমি কথা বলছিলাম। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর বেগম জিয়ার ব্যাপারে তারা প্রথম যে কাজটা করেছেন সেটা হচ্ছে তাকে ভিটে ছাড়া করেছেন। অত্যন্ত অপমানকরভাবে তাকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উৎখাত করেছেন। শুধু তাই নয় ঐ বাড়ির নাম নিশানাও মুছে ফেলেছেন। এর বিপরীতে ‘জাতির পিতা ও তার পরিবার সদস্যদের’ নিরাপত্তা আইন করে প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার সদস্যদের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করেছেন। বঙ্গভবনের মালিকানা হস্তান্তর করে প্রধানমন্ত্রী নিজে তা গ্রহণ করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বেগম জিয়া যে নিরাপত্তা পেতেন তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে কেয়ারটেকার সরকার কর্তৃক রুজুকৃত সব মামলা প্রত্যাহার করলেও বেগম জিয়াসহ বিএনপি নেতাদের মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি বরং তাদের নতুন মামলায় জড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ যে কাজটি করা হয়েছে সেটি হচ্ছে বেগম জিয়ার বর্তমান দফতর-কাম আবাসিক ভবনের বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট, ডিশ এন্টিনা, ওয়াইমেক্স সংযোগও সেখানে বন্ধ করে দেয়া হয়। সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এই কাজটি করা হয়। একজন মন্ত্রী তো তার খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার কথাও বলেছেন। অবশ্য এখানে আরেকটি ঘটনাও ঘটেছে। সেটা হচ্ছে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ২০ ঘণ্টার মধ্যে তারা এই সংযোগ পুনঃস্থাপনও করেছেন। এই ঘটনাটি কার নির্দেশে করা হলো তা বোধগম্য নয়। এই ২০টি ঘণ্টা বেগম জিয়া তার সদ্য বিধবা পুত্রবধূ ও এতিম দুই নাতনী নিয়ে অত্যন্ত দুর্বিষহ সময় কাটিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তার নাফরমান নিকৃষ্ট কোন বান্দার রেজেকও বন্ধ করেন না। আমাদের বর্তমান মন্ত্রিসভার কোনও সদস্যকে যদি সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীর রেজেক বন্ধ করার ঘোষণা দিতে দেখা যায় তাহলে অত্যন্ত নিষ্ঠুর শোনায়। আরো কিছু আছে। মন্ত্রী তোফায়েল বেগম জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেছেন, “আল্লাহর আরশ কেঁপেছে, নইলে আপনার ছেলে মরবে কেন?” মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক একইভাবে বলেছেন, “নেশাগ্রস্ত মানিলন্ডারিং এ অভিযুক্ত কোকোর জন্য খালেদা আর্তনাদ করছে।” কোকোর নেশাগ্রস্ততার কথা আমরা আগে শুনিনি। তবে আরেক জনের কথা শুনেছি যিনি গভীর রাতে নেশা করে ড্রাইভিং করতে গিয়ে রাস্তায় এক্সিডেন্ট করেছিলেন। এটা প্রাসঙ্গিক কথা নয়। আমাদের মন্ত্রীর পদগুলো অত্যন্ত সম্মানিত পদ। এই পদে যারা থাকেন তারা যা তা বলতে পারেন না। তাদের আচার আচরণ, আদব কায়দা থেকে অন্যরা শিখবেন। আগের দিনে যাত্রীবাহী যানবাহনে লিখা থাকতো “ব্যবহারে বংশের পরিচয়” অন্য কোন মন্তব্য না করে আমি তাদের এই কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। অন্যদের ছোট করে নিজে বড় হওয়া যায় না।
আওয়ামী লীগের গত ছয় বছরের শাসনামল দুঃশাসন, দুর্নীতি, লুটপাট, অত্যাচার, নির্যাতন, ক্ষমতার অপব্যবহার, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ, নৈতিক স্খলন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পদদলন, হত্যা, গুমসহ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর অমানবিক অত্যাচার, সংবিধান লঙ্ঘন এবং শুধু স্বৈরাচার নয় নিকৃষ্ট ব্যক্তিতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অবাঞ্ছিত ঘটনায় ভরপুর।
গ্রামাঞ্চলের খবর নিয়ে দেখুন, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী  বিশেষ করে জামায়াত-বিএনপি ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা ছয় বছর ধরে শান্তিতে এলাকায় থাকতে পারছেন না, তাদের জীবন, বাড়িঘর, সম্পত্তি ও মান-ইজ্জতের কোনও নিরাপত্তা নেই। বহু মসজিদ থেকে ইমামদের বের করে দেয়া হয়েছে। বাগেরহাটের শরণখোলায় আমি একজন ইমামের কথা জানি যার বিরুদ্ধে ২৭টি মামলা দেয়া হয়েছে। মাদরাসার শিক্ষকরা কার্যত জিম্মি। টুপিধারী ব্যক্তিরা আলেম হোক কিংবা নন-আলেম, তাদের মাথার ওপর এখন দু’টি খড়গ একটি রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীর, আরেকটির জেএমবি’র। কাদের বিরুদ্ধে তারা কখন কি অভিযোগ আনেন তারাই শুধু বলতে পারেন। পাড়ায় পাড়ায় আওয়ামী লীগ একশ্রেণীর টাউট-বাটপার তৈরি করে ছেড়ে দিয়েছে যারা এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে বেড়ায়। নতুন বাড়ি করবেন? ব্যবসা শুরু করবেন? ছেলের মুসলমানী করাবেন? মেয়ে বিয়ে দিবেন? তাদের চাঁদা দিতে হবে। না দিলে তাদের কথা না শুনলে ঘরে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি রাখা যায় না। চুরি হয়ে যায়। সম্প্রতি অবরোধে হরতালে অপরাধীর তথ্য ও অবস্থান দিয়ে পুলিশ র‌্যাবকে সহায়তা করলে লক্ষ টাকার পুরস্কারের যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে তাতে তাদের অত্যাচার আরও বেড়ে গেছে। নিরপরাধ ব্যক্তিরা তাদের শিকার হচ্ছে। যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও বোমা নিক্ষেপের ঘটনা তারা নিজেরা ঘটিয়ে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি-ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ফাঁসিয়ে দিচ্ছে।
বিগত ছয় বছরের মধ্যে সম্ভবতঃ একটি মাসও এমন ছিল না, যে মাসে দলটি ও তার অংগ সংগঠনের নেতাকর্মীরা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েনি। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, ছিনতাই রাহাজানি, হল জবর দখল, প্রতিদ্বন্দ্বী দল উৎখাত, কাউন্সিল সভা সর্বত্র তারা ব্যাপকভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে। দৈনিক প্রথম আলো, যুগান্তর ও কালের কণ্ঠে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী শুধু ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত তাদের নিজেদের কর্মীর সংখ্যা হচ্ছে শতাধিক। অস্ত্র হাতে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষরত অবস্থার সচিত্র রিপোর্ট উপরোক্ত পত্রিকাগুলো ছাড়াও জাতীয় দৈনিক এবং টিভি চ্যানেলসমূহে প্রায়শঃই প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। অবরোধ চলাকালে যানবাহন ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ এবং বোমা নিক্ষেপকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা হাতেনাতে ধরা পড়েছে। তারা গ্রেফতার হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র, বোমা ও গোলাবারুদ উদ্ধারের কোনো উদ্যোগও গত ৬ বছরে নেয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
অতি সম্প্রতি বকশী বাজারে আলীয়া মাদরাসা প্রাঙ্গণে গঠিত আদালতে বেগম জিয়ার হাজিরা উপলক্ষে বিএনপি-ছাত্রদলের কয়েক হাজার নেতাকর্মী মিছিল করে সেখানে যাচ্ছিলেন। মিছিলটি ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। এই মিছিলের ওপর ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ ও বুয়েট ইউনিটের প্রায় ২০০ নেতাকর্মী লাঠিসোটা, লোহার বড়, কিরিছ এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করে। এতে বিএনপির অর্ধ শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়। ইংরেজি দৈনিক Daily Star এর ওপর একটি সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশ করে এবং হামলায় অংশগ্রহণকারী ১২ জন ছাত্রলীগ নেতা যথাক্রমে ঢাকা কলেজের আব্দুল আজিজ ফয়েজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের মনির হোসেন চঞ্চল, রিফাত জামান, মঞ্জুরুল হক শুভ, নাহিয়ান খান জয়, কেন্দ্রীয় কমিটির জয়দেব নন্দী, কাজী এনায়েত, তিতুমীর হলের আবু সায়িদ কনক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচএম আল আমীন, নিজামুল হক দীদার ও ওমর ফারুকের অস্ত্র হাতে একশনরত ছবি প্রকাশ করে। পত্রিকাটি এই ঘটনার ওপর ভিত্তি করে “BCL violence deflorable, unwanted: Goat Mist clarify its Stance“ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধও প্রকাশ করে। সরকার এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, তাদের কাছ থেকে অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি। সরকার নিজ দলে সন্ত্রাসী-জঙ্গি পোষণ করে মৌলিক মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের ওপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাচ্ছেন এটা শুধু স্ববিরোধিতা নয় লজ্জাজনকও। একটি দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে অবরুদ্ধ রাখার লক্ষ্যে তার বাড়ি ও দফতরের সামনে রাস্তা থেকে ইট, বালু ও ময়লাবাহী ট্রাক ধরে এনে আগমন বহির্গমনের পথ রুদ্ধ করে রাখা এবং/অথবা দু’টি গেট তালাবদ্ধ করে দেয়া এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে অভূতপূর্ব একটি ঘটনা। স্বাধীন একটি জাতি সভ্যতা-ভব্যতার দিকে এগিয়ে যায়, আমরা বর্বরতা ও অসভ্যতার পথে পিছু হাঁটছি। এর নাম কি স্বাধীনতার চেতনা?
আন্দোলন এখন তুঙ্গে উঠতে শুরু করেছে। অবরোধের এক মাস পার হচ্ছে। সরকার অনমনীয়ভাবে দলন পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছেন। আন্দোলন নির্মূলের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছে। আমি সরকারকে অনুরোধ করবো রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সাথে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসুন। পরাজিত ও ধাবমান সেনাবাহিনীর মতো ধ্বংসাত্মক এমন কোনো কাজ করবেন না যাতে হিংসা বিদ্বেষ বাড়ে, মানুষ এটা মনে না করে যে এরা দেশে থাকার রাজনীতি না করে বিদেশ ও অস্ত্রনির্ভর এমন রাজনীতি করছে যার পরিণতি শুভ নয়। মানুষকে সম্মান করতে শিখুন মানুষও আপনাদের সম্মান করবে।
ড. মোঃ নূরুল আমিন 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads