মঙ্গলবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

নরহত্যার উৎসব চলছেই


ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে মানুষের আহাজারির শেষ নেই। যানবাহনে পেট্রোল বোমা হামলার মতো নৃশংস ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। এই হামলায় যারা দগ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছেন, তারা কারও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নন। অতি সাধারণ মানুষ। এরা কারও হামলার টার্গেটও নন। পেট্রোল বোমা হামলার ঘটনাও কম রহস্যজনক নয়। গত মাসের ৬ তারিখ থেকে ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এ কর্মসূচি প্রথম দিক থেকেই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তাতে যে দু’চারটা বাসে আগুন দেওয়া হয়নি, দু’চারটা নিরীহ ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেনি, এমন কথা বলা যাবে না। এ ধরনের ঘটনা যে কোনো আন্দোলনেই ঘটে। এটা আমরা ষাটের দশক থেকেই দেখে আসছি। এ আন্দোলনের শুরুর দিকে তরুণরা এমনও করেছে যে, বাসের যাত্রীদের বলেছে, ভাই আপনারা নামেন, বাসে আগুন দেব। যাত্রীরা নেমে গেলে আগুন জ্বলেছে।
কিন্তু হঠাৎ করেই এই দৃশ্যপটে পরিবর্তন দেখা দিতে থাকলো। আমদানি হলো পেট্রোল বোমা কালচার। রাতের অন্ধকারে কে বা কারা বাস-ট্রাকে চালাতে শুরু করলো পেট্রোল বোমা হামলা। সে হামলায় জীবন্ত পুড়ে ছাই হয়ে যেতে থাকলো নিরীহ সাধারণ মানুষ। যারা প্রাণ হারালো তারা তো গেলোই, কিন্তু যারা দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতাল বেডে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় আছেন, তাদের দুর্দশার কোনো সীমা নেই। গোটা দেশবাসীই তাদের এই যন্ত্রণা আর শোকের ভাগীদার।
কিন্তু পেট্রোল বোমা হামলার ঘটনা শুরু হবার পর থেকেই সরকার এ নিয়ে শুরু করলো রাজনীতি। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে নিম্ন পর্যায়ের নেতারা একযোগে বলতে শুরু করলেন যে, এই হামলা চালাচ্ছে আন্দোলনরত বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দল। বিশেষ করে বিনা প্রমাণে এর সকল দায় চাপানোর চেষ্টা চালানো হলো জামায়াত-শিবিরের ওপর। কিন্তু তথ্য-প্রমাণ যা পাওয়া গেলো, তাতে দেখা গেলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর সাথে জড়িত সরকার দলের লোকেরা। রাজশাহীতে ছাত্রলীগ তাদের অফিসিয়াল ফেসবুকে পোস্টিং দিয়ে জানান দিলো যে, সেখানে হামলা চালিয়েছে তারাই। রূপগঞ্জে পেট্রোল বোমা বানাতে গিয়ে আহত হলো ছাত্রলীগের চার সদস্য। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ অফিসে পাওয়া গেল ১২টা পেট্রোল বোমা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এমপি আবদুল ওয়াদুদের ভাড়া বাড়িতে স্থাপিত পেট্রোল বোমার কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটলো। কিন্তু সেখানে কাউকে ঢুকতে দিলো না পুলিশ। কেউ গ্রেফতারও হলো না। এরপর দিনাজপুরে রাতে ট্রাকে পেট্রোল বোমা মারার সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ল ছাত্রলীগের দু’জন। তাদের কাছে পাওয়া গেলো আরও পেট্রোল বোমা। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতারা এসে তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যায় পুলিশের কাছ থেকে। আর সর্বশেষ চমক হলো, আমাদের দৃষ্টির আড়ালে পুলিশ আটক করেছিল পাঁচ শতাধিক আওয়ামী পেট্রোল বোমাবাজকে। কিন্তু তাদের ‘সৎ ও মেধাবী’ বলে সনদপত্র দিয়েছে আওয়ামী এমপি ও নেতারা, যাতে তারা আদালত বা পুলিশের কাছ থেকে সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়। গিয়েছেও তাই।
ফলে পেট্রোল বোমা, বার্ন ইউনিট এসব এখন এক হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ কথা কোনো পাগলেও বলবে না যে, পেট্রোল বোমা হামলার মাধ্যমে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা কিংবা চিরজীবনের জন্য পঙ্গু করে দেওয়া কোনো যৌক্তিক ঘটনা না। এর নিন্দা করবে সবাই। নিন্দা করছে। আমারও ইচ্ছে করে একটি সামান্য প্ল্যাকার্ড হাতে প্রেসক্লাব বা অন্য কোনো প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলি বন্ধ করো এই পেট্রোল বোমা হামলা। তার কী ফল দেবে জানি না।
কিন্তু এই পেট্রোল বোমা হামলা নিয়ে দারুণ নাটক শুরু হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পেট্র্রোল বোমা হামলার শিকার যারা, তাদের নিয়ে নাটক তৈরীর শুটিং হচ্ছে। পেট্রোল বোমা হামলাকারীরা যদি পিশাচ হয়ে থাকে, তবে যারা এদের নিয়ে নাটক তৈরীর শুটিং করছেন, তারা পিশাচের চাইতেও অধম পিশাচ। আহ্, দু’ হাত, দু’ পা মুখ অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন। তাদের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে দগ্ধ ব্যান্ডেজ বাঁধা হাত তুলে শুটিং করেছে কিছু নরপিশাচ। সরকার বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা অনুমোদন করেছে। তারা বলেছেন, ভবিষ্যতে নাটক-নোবেল করার জন্য এই শুটিং বিটিভির পক্ষ থেকে করা হয়েছে। বিটিভি চিরজীবী হউক।
এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে গিয়ে যে শিশুটির পাশে দাঁড়িয়ে ৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়া ঐ শিশুর দুর্দশা দেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলেন, সেই শিশুটিও ছিল না কোনো পেট্রোল বোমা হামলার শিকার। মোমবাতির আগুনে সে দগ্ধ হয়েছিল। পেট্রোল বোমার শিকার বলে প্রতীয়মান করা গেলে অনেক টাকা অনুদান পাওয়া যাবে, এই জন্য নানান প্ররোচনায় শিশুটিকে তার পিতামাতা নিয়ে এসেছিল বার্ন ইউনিটে। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে শোকর করি, এই শিশুটির পরিবারও ১০ লক্ষ টাকার সঞ্চয় সার্টিফিকেট পেয়েছে। পাক। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর গোয়েন্দা সংস্থার খবর কী? তারা নিশ্চিত করে প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে পারেনি যে, এই শিশুটি মোমবাতির আগুনে পুড়ে বার্ন ইউনিটে এসেছে, বাসে পেট্রোল বোমার আঘাতে নয়। অর্থাৎ মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে কৌতুক চলছেই।
রহস্যজনক পেট্রোল বোমা হামলা যখন থেকে শুরু হলো তখন থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের চাপাবাজ নেতামন্ত্রীরা এই মর্মে চাপা চালিয়ে যেতে থাকলেন যে, বিএনপি-জামায়াত মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করছে। তাদের সঙ্গে আবার কীসের সংলাপ? যদিও সংলাপের দাবি দেশে সরকারের বাইরে সকল রাজনৈতিক দল, সুধী সমাজ ও আন্তর্জাতিক দুনিয়ার। কিন্তু অনির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেই যাচ্ছেন যে, খালেদা জিয়ার হাতে মানুষ পোড়ার গন্ধ। তার সঙ্গে আবার কীসের সংলাপ? এই গীত অবিরাম প্রচারিত হচ্ছে। ফলে পেট্রোল বোমা বিষয়টি নিয়ে সরকারের অভিযোগ এখন হাস্যকর ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
কিন্তু এখন থেকেই আওয়ামী নরহত্যা উৎসবের শুরু। পেট্রোল বোমা হামলা যখন থেকে শুরু করা হলো তখন থেকেই সরকার তার নিয়ন্ত্রণাধীন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যেন বিনামূল্যে গণহত্যার অনুমতি দিয়ে বসলেন। বিজিবি প্রধান, র‌্যাব প্রধান, পুলিশ প্রধান- এই তিন বাহিনীকে এমন ক্ষমতা প্রদান করলেন যে, তারা যখন তখন যেখানে খুশি যে কোনো মানুষের বুক বরাবর বিনা বিচারে গুলি করতে পারবে এবং হত্যা করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী নিজে তাদের জানিয়ে দিলেন যে, বধ্ করো, দায়দায়িত্ব আমার। দারুণ মজার ঘটনা। তার এই বক্তব্যের পর বিজিবি প্রধান বললেন, তাদের কাছে যেসব অস্ত্র রয়েছে, তা খেলনা নয়, সেগুলো মরণাস্ত্র। ওসব অস্ত্র হা-ডু-ডু খেলার জন্য নয়। তারা বুক বরাবর গুলি করবে। একই কথা বললেন, র‌্যাব প্রধান ও পুলিশ প্রধান।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কোনো প্রধান আওয়ামী লীগের নিকৃষ্ট নেতাদের অনুকরণে বললেন যে, ২০১৯ সালের আগে আর কোনো নির্বাচন হবে না। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়ে গেল যে, মনে হলো, রাষ্ট্র পরিচালনা শেখ হাসিনা নন, বিজিবি-র‌্যাব প্রধানরা করছেন। না। এখন প্রধানগণই ফ্যাক্টর নন। ডিআইজিরা যা বলছেন, তাও চমকপ্রদ। তারা স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার কথা বলছেন। হত্যা করার ন্যায্যতার কথা বলছেন। সন্ত্রাসীদের সমূলে উৎখাত করার কথা বলছেন। কেউ পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করতে পারে এমন সন্দেহ হলে তাকেও হত্যা করার অধিকারের কথা বলছেন। এটা চলছেই। সর্বশেষ রাজশাহীর ডিআইজি বলেছেন, জানমাল রক্ষার স্বার্থে কাউকে হত্যা করা অপরাধ নয়।
তিনি দারুণ বলেছেন। এখন আমাদের জীবনের নিরাপত্তার সবচাইতে বড় সমস্যা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারা চায়ের দোকান থেকে যে কাউকে তুলে নেয়। আড্ডা থেকে যে কাউকে তুলে নেয়। দোকান থেকে যে কাউকে তুলে নেয়। নিয়ে বলে, তুমি সন্ত্রাসী, বোমাবাজ। পাঁচ লক্ষ টাকা দাও। নইলে শেষ। তার উপর প্রতি রাতে থানাগুলোতে শত শত লোককে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে নিয়ে আসা হয়। তারপর চাঁদাবাজি। দশ লাখ। পাঁচ  লাখ। দুই লাখ। দশ হাজার। বিশ হাজার। পাঁচ হাজার। এগুলো দিয়ে বা না দিয়েও মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে অথবা পঙ্গুত্ব বরণ করতে হচ্ছে। অনেক সাধারণ মানুষ দেশের সংবাদপত্রগুলোতে তাদের করুণ কাহিনী বর্ণনা করে আসছেন। নিয়ন্ত্রিত ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সে সংবাদ না থাকলেও প্রিন্ট মিডিয়ায় তার কিছু উপস্থিতি এখনও লক্ষণীয়।
এখন সরকার দেশকে দাসানুদাস করার জন্য ভিন্নমত দলনে সকল বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ বাহিনীকে কার্যত গণহত্যার লাইসেন্স দিয়ে বসেছে। তারা ভুলেই গেছেন যে, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। বরং মনে হচ্ছে যে, তারা সরকারি দলের কর্মী বাহিনী। কিন্তু তাদের হাতে সাধারণ মানুষকে হত্যা করার ওপেন জেনারেল লাইসেন্স (ওজিএল) রয়েছে। আর সে কারণেই এখন দেশব্যাপী চলছে সরকারের মদদেই নাগরিক হত্যার উৎসব।
যে বিজিবির দায়িত্ব সীমান্ত রক্ষা। সেদিকে এখন তাদের কোনো নজর নেই। সেখান দিয়ে প্রতিদিন আসছে লাখ লাখ ইয়াবা, ফেনসিডিল, অস্ত্র। সেখানে বিজিবি প্রধান নির্বিকার। সীমান্ত অরক্ষিত রেখে তিনি এদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করে বললেন, তাদের হাতে যে অস্ত্র সেটি খেলনা নয়, মরণাস্ত্র। কিন্তু এখনও সীমান্তে প্রতিদিন বিএসএফ কাউকে না কাউকে হত্যা করছে। কোনো না কোনো বাংলাদেশীকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বিজিবি প্রধানের দায়িত্ব সেদিকে নজর দেওয়া, জনগণকে হুমকি দেওয়া নয়।
কিন্তু এই সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশের জনগণকে হত্যা যেন লাইসেন্স পেয়ে গেছে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ। এবং সোৎসাহে সে হত্যাযজ্ঞ চলছেই। বার্ন ইউনিটের করুণ মৃত্যু বেদনাদায়ক সন্দেহ নেই। কিন্তু এর মধ্যে যে শতাধিক নিরীহ অতি সাধারণ মানুষকে সরকারের মদদে হত্যা করা হলো তার কি কোনো জবাবদিহিতা থাকবে না? এর সকল হত্যাই সন্ত্রাস বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না। এমনকি যদি সন্ত্রাসও হয়ে থাকে, হত্যা তার সমাধান নয়, বিচার তার সমাধান। তবে কি বাংলাদেশ থেকে বিচার আইন উৎখাত হয়ে গেলো? হয়তো গেলো। কিন্তু এর জন্য দায়ী কে? শুধুই সরকার? আমরা কি স্বাধীন বিচার বিভাগের উপর নির্ভর করতে পারবো না? আশা করি, নিশ্চয়ই পারবো।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads