বুধবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

রাষ্ট্র পরিচালনায় শুধু আইনগত দিক নয় নৈতিক দিকও গুরুত্বপূর্ণ


স্বদেশকে মানুষ ভালবাসে, স্বপ্নের জালও বোনে। স্বপ্ন সফল হলে মানুষ আনন্দিত হয়, হয় কর্মমুখর। তবে বাস্তবতা হলো সব মানুষের যেমন স্বপ্ন পূরণ হয় না, তেমনি সব দেশও হয় না স্বপ্ন-পূরণের দেশ। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নেতৃত্বের মান। নেতৃত্বের মান নির্ভরশীল ত্যাগ-তিতিক্ষা, আদর্শ-নিষ্ঠা, উদারতা ও সৃজনশীল নানা বৈশিষ্ট্যের ওপর। আসলে মানোত্তীর্ণ নেতৃত্বের গুণেই একটি দেশ সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যায়। এমন দেশে সুশাসন, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের কারণে নাগরিকরা আত্মমর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের কারণে নাগরিকরা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জীবন যাপনের আনন্দ উপভোগ করতে পারে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপ্নটাতো এমনই ছিল। নেতৃবৃন্দও এমন অঙ্গীকারেই দীপ্ত ছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরে এ কোন দেশে আমরা বসবাস করছি? দেশে দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধ চলছে। চলছে দমন-পীড়ন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের তান্ডব। ককটেল ও পেট্রোলবোমায় ঝলসে যাচ্ছে মানুষের জীবন। মানুষের বসবাস অনুপযোগী এমন নৃশংস পরিবেশ থেকে নাগরিকদের উদ্ধারের নেই কাংখিত আয়োজন। সরকার এবং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের দায়িত্ব পালনের এমন নমুনা দেখে জনগণ আশাবাদী হবে কেমন করে? মানুষ এখন সরকার এবং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের কাছ থেকে যৌক্তিক ও স্বাভাবিক বিষয়গুলো চাইতেও কুণ্ঠাবোধ করছে। এই কুণ্ঠাবোধ কি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি অনীহা প্রকাশ নয়? বিষয়টি আমাদের রাজনৈতিকি অঙ্গনের চ্যাম্পিয়নরা উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।
আমাদের পাঠকরা নিশ্চয়ই সাগর-রুনির কথা ভুলে যাননি। গতকাল ১১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকান্ডের ৩ বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই ৩ বছরেও হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটিত হয়নি। মামলা তদন্তের কোনো অগ্রগতি হয়নি। থানা-পুলিশ, ডিবি ঘুরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্ত করছে এলিট ফোর্স র‌্যাব। কিন্তু মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। আশার বাণী শোনাতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এদিকে অন্তহীন অপেক্ষায় পরিবারের সদস্যরা। জনমনে প্রশ্ন, ওই হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচিত হবে কি? খুনিরা কখনও ধরা পড়বে কি? ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে এমন শঙ্কা সুশাসনের নজির হতে পারে না। এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এখন নেতা-নেত্রীরা কথা বলছেন না। পত্র-পত্রিকা তথা মিডিয়াও এ ব্যাপারে নীরব। সবাই ব্যস্ত হরতাল-অবরোধ এবং দমন-পীড়ন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মত বিষয়গুলো নিয়ে। মানুষের মৌলিক অধিকার ও প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখ ও যন্ত্রণার বিষয়গুলো নিয়ে ভেবে দেখার সময় যেন কারো নেই। এমন এক সমাজে এখন আমাদের বসবাস। কী চমৎকার সমাজই না উপহার দিলেন আমাদের নেতা-নেত্রীরা!
গত ১০ ফেব্রুয়ারি সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একই দিনে ১০ শিশুসহ ৩২ রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় হতবাক দেশের জনগণ। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে এত রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্ন। সবচেয়ে বেশী  প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে ১০ শিশুর মৃত্যুর ঘটনা। ঘটনার তদন্তে ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমাদের দেশে কমিটি গঠনের ইতিহাস তেমন সুখপ্রদ নয়। ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য কমিটি গঠন করা হয়, এমন একটি ধারণা জনমনে বেশ প্রবল। আমাদের রাজনীতি তো এখন দমন-অবদমন এবং সরকার পতন আন্দোলনে ব্যস্ত। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও এখন কত সহজেই না চলে যায় পর্দার অন্তরালে।
দেশের বর্তমান সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে জনগণ মুক্তি চায়। জনগণের আকাংখার অনুকূলে দেশের প্রাজ্ঞজনরা কথা বলেছেন, কথা বলছেন বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গও। গত সোমবার ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বাংলাদেশ বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপির সঙ্গে সংলাপ শুরুর পরিবর্তে আওয়ামী লীগ যত বেশি বিরোধীদের দমনে শক্তি প্রয়োগ করবে, ততই বেশি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের লক্ষ্যকে খাটো করে দেখা হবে। দুর্বল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও জবাবদিহিতার সমতা নষ্ট হওয়ার কারণে দুর্নীতি বাড়ে, যা প্রবৃদ্ধি অর্জনকে দুর্দশায় ফেলে ও নিরুৎসাহিত করে। এসব বিষয়কে আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা তেমন গুরুত্ব দিতে চান না। নইলে আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ১০ ফেব্রুয়ারি কী করে নাগরিক সমাজের সংলাপের প্রস্তাবকে অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য বলে উড়িয়ে দেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য প্রদানকালে তিনি বলেন, শামসুল হুদা কেন অন্য কেউ এই উদ্যোগ নিলেও এটি বাস্তবসম্মত হবে না। যারা সংলাপের কথা বলছেন, তারা পরোক্ষভাবে নাশকতা, সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলেও মন্তব্য করেন। এই যদি হয় আমাদের মন্ত্রী বাহাদুর তথা সরকারের চিন্তা-ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি, তাহলে দেশের জনগণ কাদের কাছ থেকে সংকটের সমাধান চাইবে? ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সংলাপের উদ্যোগ নেয়া সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বিতর্কিত হিসেবে উপস্থাপনের কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সরকার বিরোধী জোটের সাথে আপাতত কোনো ধরনের সংলাপ বা সমঝোতায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত থাকায় এমন কৌশল নিয়ে দলটি এগুচ্ছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যেও সেই বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে। এদিকে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলছেন, নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব না পাওয়া পর্যন্ত লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাবে ২০ দলীয় জোট। নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো ইস্যুতে তথাকথিত সংলাপের উদ্যোগেও সাড়া দেবে না এই জোট। এই যদি হয় আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের চিত্র, তাহলে জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাপনের আকাক্সক্ষা পূরণ হবে কবে?
সভা-সামবেশের মতো স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিক তৎপরতা রুদ্ধ করার ফলে গত ৫ জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক সংকটের সূত্র ধরে হরতাল-অবরোধের যে ধারা শুরু হয়েছে তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। অথচ শুরুর দিকে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিরা বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে ৭ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, ৭ দিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। ৭ দিন তো বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। পরিস্থিতির উন্নতির বদলে আরো অবনতি ঘটছে। তাই জনমনে এখন প্রশ্ন, কতদিনে সাতদিন পূর্ণ হবে? প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সরকার বলি কিংবা বিরোধী জোট, অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক পথ কারো জন্যই কল্যাণকর বলে বিবেচিত হতে পারে না। অহংকার, দম্ভ ও জিদ আসলে মানুষের পতনকেই ত্বরান্বিত করে। এর আগে অবশ্য মানুষের, সমাজের ও দেশের ক্ষতির মাত্রা তারা বাড়িয়ে যান। এ জাতীয় নেতা-নেত্রীরা ক্ষমতা হারানোর পর তাদের ভুল বুঝতে পারেন। তবে অসময়ের এমন উপলব্ধি দেশ, জনগণ ও তাদের জন্য তেমন কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তাই সময় থাকতেই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানাই।
১১ ফেব্রুয়ারি মানব জমিন পত্রিকায় মুদ্রিত প্রধান শিরোনামটি লক্ষ্য করার মতো। ‘মধ্যবর্তী নির্বাচন বর্তমান সংবিধানেই সম্ভব’ শিরোনামে মুদ্রিত লেখাটিতে বলা হয়, স্বাধীনতার পর আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় তিন তিনবার মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর মধ্যবর্তী নির্বাচন মানেই জাতীয় সংসদের নতুন নির্বাচন। বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় মেয়াদপূর্ণ হওয়ার আগেই তৃতীয় সংসদ ভেঙ্গে ১৯৮৮ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। চতুর্থ সংসদের মেয়াদ পূর্তির  আগেই সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে ১৯৯১ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর ষষ্ঠ সংসদের মেয়াদ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংসদ ভেঙ্গে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯১ সালে প্রথম শপথ নিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া এবং মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম শপথ নিয়েছেন শেখ হাসিনা। উক্ত লেখায় শহীদুল্লাহ ফরায়জী উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ দুই কারণে বিলুপ্ত হতে পারে। প্রথমত, ৫ বছরের মেয়াদ অতিবাহিত হলে। দ্বিতীয়ত, মেয়াদ অবসানের পূর্বে ভেঙ্গে দিলে। সংসদের মেয়াদ অবসানের পূর্বে ভেঙ্গে দেয়ার পর যে নির্বাচন হয়, তারই নাম মধ্যবর্তী নির্বাচন। দেশের জনগণ জাতীয় সংসদের মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ হতে দেখেছে, আবার মাত্র ৪ কার্যদিবসের সংসদও দেখেছে। বর্তমান সংবিধানের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচন সম্ভব নয়, এমন একটি উদ্ভট বিভ্রান্তিমূলক ও অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য কেউ কেউ উপস্থাপন করছেন। অথচ বিশ্বের যত দেশে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সংসদ গঠন বা সংসদীয় পদ্ধতি বহাল আছে, সেসব দেশে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রসঙ্গত লেখার শেষ দিকে শহীদুল্লাহ ফরায়জী উল্লেখ করেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য জাতীয় রাজনীতির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১৫ সালে ২৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমে (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) বিচারপতিদের মর্যাদা বাড়িয়ে উচ্চ আদালতে দেয়া রায় নৈতিকতা বিরোধী। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, নিজেরাই নিজেদের মর্যাদা বাড়িয়ে রায় দিয়েছেন। এ রায় কোনোমতেই সমীচীন নয়। এ ধরনের রায় পক্ষপাতমূলক। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্ন দেশ নয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশ কিভাবে চলে সেটা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর এই সাহসী উচ্চারণ জাতিকে উচ্চতম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতায় সমৃদ্ধ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনায় কেবল আইনগত দিক নয়, নৈতিক দিক থাকাও অপরিহার্য। প্রধানমন্ত্রীর এই উপলব্ধি রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পৃক্ত সকলের এবং রাজনীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের নৈতিক জগতকে আরো বিস্তৃত, সুগভীর ও উচ্চতর করতে পারে। এমন উচ্চতর নৈতিকতার মাপকাঠিতেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বর্তমান সংসদ আইনগত হলেও কোনোভাবেই নৈতিকতাপূর্ণ কিনা। আমরা মনে করি, জনাব শহীদ উল্লাহ ফরায়জী প্রধানমন্ত্রীর সামনে যে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ভেবে দেখার মতো। আমাদের সরকার এবং বিরোধী জোট দেশ ও জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নৈতিক চেতনায় এগিয়ে এলে বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সহজেই হতে পারে বলে প্রাজ্ঞজনরা মনে করেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads