বুধবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

বিষফল এখন রাজনীতিতে এবং জীবনে


ঘরে-বাইরে এখন আতঙ্কের পরিবেশ। ঘরের আতঙ্কটা অবশ্য মানসিক স্তরের। মানুষ এখন ঘরের বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছে। জীবন-যাপনের প্রয়োজনে কেউ বাইরে গেলে ঘরে স্বজনদের ভাবনা, মানুষটি অক্ষত শরীরে ফিরে আসতে পারবে তো? দেশের এমন পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। রাজনৈতিক কারণে এখন দেশের যে পরিবেশ তাকে গণতান্ত্রিক সমাজের পরিবেশ হিসেবে ভাবা যায় না। এমন অবস্থায় মানুষের জীবন-যাপনের চিত্র নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। এমন একটি প্রতিবেদনে বলা হয় : বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবরোধ-হরতাল কর্মসূচিতে নগরবাসী নিজের প্রয়োজনে ও জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হচ্ছেন। তবে তাদের এ পথ চলায় স্বস্তি নেই, আছে আতঙ্ক। গত মঙ্গলবার প্রতিবেদক দেশের অবস্থা কেমন জানতে চাইলে আবদুল ওয়াহাব নামের এক রাজধানীবাসী বললেন, ‘সব কিছু স্বাভাবিক আবার অস্বাভাবিক। এই যে অফিস করছি, বের হচ্ছি, রাস্তায় গাড়ি চলছে, কিন্তু তার পরও সব সময় আতঙ্কে থাকি। যদি একটা বোমা এসে গায়ে লাগে।’ দুই নেত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা একটু শান্তিতে থাকতে চাই’।
আবদুল ওয়াহাবের বক্তব্যে জনমনের বার্তা পাওয়া যায়। কিন্তু সে বার্তা আমাদের শীর্ষ নেতা-নেত্রীদের কর্ণকুহরে কতটা প্রবেশ করে কিংবা তাদের হৃদয়ে কতটা কম্পন সৃষ্টি হয়, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, শঠতাপূর্ণ অগণতান্ত্রিক রাজনীতির কারণে দেশে এখন অগ্নি, দাহ এবং দমন-অবদমনের মাত্রা বেড়েই চলেছে। আবারও দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পেট্রোলবোমা কেড়ে নিল সাতজন বাসযাত্রীর প্রাণ। বাসের মধ্যে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন অনেকেই। এর মধ্যেই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনে পুড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান ৭ জন। আহত হন আরও ২৮ বাসযাত্রী। গত সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে আইকন পরিবহনের বাসটি কক্সবাজার থেকে ঢাকায় যাচ্ছিল। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের জগমোহনপুর এলাকায় ওই সময় পেট্রোলবোমা ছোঁড়া হয় বাসটিতে। এমন নৃশংস ঘটনার বিরুদ্ধে সবাই কথা বলছে। পাল্টাপাল্টি অভিযোগের দৃশ্যও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকারি দলের ইঙ্গিত বিরোধী দলের দিকে, আর বিরোধী দলের ইঙ্গিত সরকারি দলের দিকে। পেট্রোলবোমা ছোঁড়ার দায়িত্ব কেউই স্বীকার করতে চাইছে না। তাহলে এই বোমা কারা মারছে? নিশ্চয়ই জিন-ভূত এসে এমন কান্ড করছে না। অবশ্য যারা পেট্রোলবোমায় নিহত হচ্ছেন তাদের স্বজনদের বক্তব্যেও কিছু বার্তা পাওয়া যায়। চৌদ্দগ্রামে বাসে দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পেট্রোলবোমায় নিহত হয়েছেন যশোরের নুরুজ্জামান পপলুর। পপলুর খালাতো বোন আফরোজা পারভীন ভাই কামরুজ্জামান ডাবলুকে জড়িয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেছেন, ‘পেট্রোলবোমা জামায়াত মেরেছে, না আওয়ামী লীগ মেরেছে তা আমরা জানি না। আমরা কাউকে বিশ্বাস করি না। মানুষের জীবন নিয়ে ওরা নাটক করছে’।
ভুল রাজনীতির কারণে এখন দেশে যে সহিংস অবস্থা বিরাজ করছে তার দায় জনগণের নয়, বরং রাজনীতিবিদদের। আর সরকার কোনোভাবেই এই দায় এড়াতে পারেন না। কারণ দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ সরকারের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। আর এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সরকার অনুরাগ-বিরাগ কিংবা গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি বহির্ভূত কোনো কাজ করেছে কিনা, তাও ভেবে দেখার মতো বিষয়। আমরা জানি, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রেও দায়িত্ববোধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অথচ এ ক্ষেত্রে আমাদের দৈন্য বেশ প্রকট। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে আইকন পরিবহনের বাসে পেট্রোলবোমা ছোঁড়া হয়েছিল। পত্রিকার রিপোর্টাররা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, পেট্রোলবোমার শিকার আইকন পরিবহনের বাসটির কক্সবাজার রুটে চলার অনুমোদন ছিল না। আইকন পরিবহনের বাসগুলো অনুমোদন ছাড়াই ওই রুটে চলাচল করছে। এ ছাড়া কক্সবাজারে পর্যটক পরিবহনে পুলিশ-বিজিবির নিরাপত্তা ব্যবস্থার বাইরেই চলাচল করছিল আইকন পরিবহনের বাস। ওই পরিবহনের সাথে কক্সবাজারের প্রশাসন, নাগরিক সমাজ এবং কক্সবাজার এলাকার পরিবহন সেক্টর, একেবারেই অপরিচিত। কক্সবাজারে তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো কাউন্টার নেই। নেই কোনো সুনির্দিষ্ট বুকিং-ম্যানও। কক্সবাজার থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের পেট্রোলবোমা হামলার শিকার হওয়ার পর আইকন পরিবহন নিয়ে কক্সবাজারের জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার আগে কক্সবাজারের মানুষ এই পরিবহনের নাম শোনেনি। পর্যটক পরিবহনে প্রশাসনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বাইরে থেকে আইকন পরিবহনের বাস কেন ও কিভাবে চলছিল তা বড় প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ বিষয়টিকে রহস্যজনক বলেও বিবেচনা করছেন। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কক্সবাজার অফিসের সহকারী পরিচালক এবং আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির সদস্য সচিব পারকন চৌধুরী জানান, ‘দেশে আইকন পরিবহন নামে যে একটি বাস আছে ও তা কক্সবাজার রোডে চলাচল করছে আমি আজই (মঙ্গলবার) তা শুনলাম’। তিনি আরো জানান- লাইসেন্স ও পারমিটের শর্তমতে যে কোনো পরিবহনের স্টার্টিং পয়েন্ট এবং লাস্ট স্টপেজ তথা সর্বশেষ গন্তব্য এলাকায় রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি তথা আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির (আরটিসি) অনুমোদন নেয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু আইকন পরিবহনের বাসগুলো আরটিসির অনুমোদন ছাড়াই কক্সবাজার রুটে চলাচল করছে। পত্রিকার রিপোর্টের আলোকে প্রশ্ন জাগে, অনুমোদন ছাড়া আইকন পরিবহনের বাসগুলো কক্সবাজার রুটে চলাচল করছে কিসের জোরে? আর আইকন পরিবহনের কোচ বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্দেশিত বিজিবি-পুলিশের বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ না করে ওই রুটে চলাচল করলো কেন? এসব প্রশ্নের আলোকে যথাযথ তদন্ত হলে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসতে পারে। এই ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো যে, দায়িত্ববোধের অভাব আমাদের সমাজে প্রকট।
আমরা সবাই জানি যে, বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। সুশাসনের সংকট ও গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির দৈন্যের মধ্যেও দেশ এগিয়ে চলেছে। তবে দেশ যতটা এগুতো পারতো, সেখানে পৌঁছা সম্ভব হচ্ছে না। আর অগ্রগতির পেছনে নিয়ামক হিসেবে তো কাজ করছে গার্মেন্টস কর্মী, বিদেশে কর্মরত শ্রমিক এবং ব্যক্তিগত উদ্যোক্তারা। সুশাসন ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিরাজ করলে দেশ বহুদূর এগিয়ে যেতে পারতো এবং দেশের মানুষের মুখে ফুটে উঠতো কাক্সিক্ষত হাসি। কিন্তু আমাদের রাজনীতি তো কাক্সিক্ষত পথে চলছে না। একদিকে চলছে দমন-পীড়ন, অন্যদিকে জ্বালাও-পোড়াও। ২ ফেব্রুয়ারি মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এর মাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রতি দুই দিনে ১ জন মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। জানুয়ারি মাসে সারাদেশে মোট ১৭ জনকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে কথিত বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছেন ১২ জন, যার মধ্যে ৬ জন র‌্যাবের হাতে, ৫ জন পুলিশের হাতে ও ১ জন যৌথবাহিনীর হাতে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। নিহত অপর ৫ জনের মধ্যে ৪ জন পুলিশের গুলিতে ও ১ জনকে র‌্যাব পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অধিকারের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, রাজনৈতিক ধর-পাকড় ও গণ-গ্রেফতারের ফলে দেশের ৬৮টি কারাগারে ধারণক্ষমতার অধিক বন্দী রয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত বন্দী সামলাতে কারাকর্তৃপক্ষকে হিমসিম খেতে হচ্ছে। কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতা যেখানে ২৯ হাজার, সেখানে বন্দী রয়েছে ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ। দেশে দমন-পীড়নের মাত্রা কতটা বেড়েছে তার একটি চিত্র পাওয়া যায় মানব জমিনে মুদ্রিত ৩ ফেব্রুয়ারির একটি রিপোর্টেও। উক্ত রিপোর্টে বলা হয়, চট্টগ্রামে পুলিশের দায়ের করা মামলার ফাঁদে পড়েছে বিরোধী জোটের প্রায় ৫০ হাজার নেতা-কর্মী। এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। চট্টগ্রামে সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামি হিসেবে নাম থাকছে ২০/২৫ জনের। কিন্তু অজ্ঞাত হিসেবে উল্লেখ করা হয় কয়েকশ’ থেকে কয়েক হাজার নেতা-কর্মীর কথা। এভাবে বিরোধী জোটের নেতা-কর্মীদের হয়রানি করছে পুলিশ। এসব দমন-পীড়নের ঘটনা যে সুশাসনের লক্ষণ নয়, গণতন্ত্রসম্মতও নয়, তা আমরা জানি। এসব নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সরকারি দলের কেউ কেউ বলেন, বিরোধী দলের সহিংসতার জন্য তারা গণতান্ত্রিক অধিকার পেতে পারেন না। কিন্তু বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচির সাথে সরকার এ কেমন আচরণ করলেন? কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের অবস্থান কর্মসূচির মঞ্চ, চেয়ার সবকিছু নিয়ে গেছে পুলিশ। রোববার দিবাগত রাতে এ ঘটনা ঘটে। দলটির পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। পুলিশ ভয়-ভীতি প্রদর্শন করেছে বলেও অভিযোগ করেছে দলটি। ভয়-ভীতি প্রদর্শন তো সুশাসনের লক্ষণ হতে পারে না। কোনো দেশের সরকার যদি দমন-পীড়ন ও ভয়-ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে দেশ শাসন করতে চায়, তবে তার ফলাফল কখনও শুভ হয় না। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বদলে যদি ছল-চাতুরি ও প্রহসনের নির্বাচন করা হয়, তার ফলাফলও হয় মন্দ। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন তার বড় প্রমাণ। ওই নির্বাচনের বিষফল এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে রাজনীতিতে এবং সমাজে। এ কথার অর্থ আবার এই নয় যে, দেশে অবরোধ-হরতাল, ভাংচুর ও পেট্রলবোমার তা-ব চলতে থাকবে। এমন পরিস্থিতি থেকে জাতি মুক্তি চায়। তবে মুক্তির সে পথ রচনায় বিরোধী জোটের চাইতেও দায়িত্ব বেশি সরকারের। দায়িত্ব পালনের সেই পথে সরকার অগ্রণী ভূমিকা পালন না করলে দিন-বদলের স্লোগান কি প্রহসনের মত মনে হবে না?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads