রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি বা সমঝোতা প্রসঙ্গ

 প্রধানমন্ত্রী দিল্লী সফরে যাচ্ছেন। সেজন্য দুই দেশ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তার পর তার এই সফরের ওপর বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় এটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ একথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ইতঃপূর্বে দুইবার এই সফরের সময় নির্ধারিত হয়। কিন্তু দুইবারেই অনিবার্য কারণবশত প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর স্থগিত হয়ে যায়। অবশেষে আগামী ৭ এপ্রিল থেকে প্রধানমন্ত্রীর তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফর চূড়ান্ত হয়েছে। গতবারে যেমন বলেছিলাম এবারেও তেমনি বলছি যে, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন দিল্লী সফরের সময় যে বিষয়টি নিয়ে আগেভাগেই তুমুল আলোচনা হচ্ছে সেটি হলো- প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা চুক্তি। আসলে এটি কি হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে বাংলাদেশ থেকে বলতে গেলে কিছুই বলা হচ্ছে না। তবে ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় এ সম্পর্কে অনেক কথাই বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য এই যে, মানুষ বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা পড়ে কোনো ধারণাই পায়নি। কূটনৈতিক পরিভাষায় যেমন আছে- Diplomatic Jugglery, তেমনি প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে চলছে কূটনৈতিক Jugglery. আসলে প্রতিরক্ষা খাতে যেটি হবে বলে শোনা যাচ্ছে সেটি হলো একধরনের চুক্তি। ইংরেজিতে এই ধরনের চুক্তিকে বলা হচ্ছে ‘Treaty’, আবার কোনো কোনো সময় বলা হচ্ছে ‘Pact’। তার পরেও কূটনৈতিক পরিভাষা থেমে নেই। কেউ কেউ বলেছেন যে, এটি হলো- ‘Memorandum of Understanding’, অর্থাৎ একটি সমঝোতা স্মারক। আবার কেউ কেউ বলেছেন প্রতিরক্ষা সম্পর্কে কোনো ‘Pact’ বা ‘Treaty’ হবে না। যেটি হবে সেটি হলো- ‘Deal’। আবার অন্য একটি মহল বলেছেন যে, এটি হবে এক ধরনের Agreement. এটি যে হবে একটি ডিফেন্স Deal বা Agreement সেটি কিন্তু আমরা ভারতীয় সূত্র অর্থাৎ ভারতীয় রেডিও এবং টেলিভিশন থেকে জানতে পেরেছি। এ সম্পর্কে সর্বপ্রথম খবর দেয় ভারতের একটি প্রিন্ট মিডিয়া। সেই খবরও ছিল ছোট্ট এবং ভাসা ভাসা। বাংলাদশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া নতুন করে কিছু বলেনি। বরং ভারতীয় মিডিয়াতে যেভাবে এগুলো এসেছে সেগুলো তারা লুফে নিয়েছে।
আমরা ঠিক জানি না যে, চুক্তি বা (MOU) যেটাই হোক না কেন সেটি কোন ধরনের হবে? তার মধ্যে কি থাকবে? ভারতের পত্র-পত্রিকায় বলা হচ্ছে যে, এটি হবে একটি ‘Comprehensive Defense Deal’. এসব Diplomatic পরিভাষা ব্যবহার করে তারা কি বোঝাতে চাচ্ছে সেটি তারাই ভালো জানেন। একটি ভারতীয় ইংরেজি পত্রিকায় লেখা হয়েছে যে, এই Comprehensive Defense Agreement-এ অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত থাকবে। প্রশ্ন উঠেছে যে, সামরিক ক্ষেত্রের সহযোগিতার এই বিষয়টিতে কি কোনো সময়সীমা থাকবে? নকি ঐ ধরনের কিছুই থাকবে না। তবে সাধারণভাবে মনে করা হচ্ছে যে এর ভেতরে সামরিক সহযোগিতা বলতে যা কিছু বোঝায় তার সবগুলোই ঐ চুক্তি বা Agreement-এ থাকবে। উদাহরণ স্বরূপ, এর মধ্যে থাকবে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং প্রদান, সমরাস্ত্র ক্রয় এবং মিলিটারি টু মিলিটারি কো-অপারেশন। এই মিলিটারি টু মিলিটারি কো-অপারেশনের জন্য দিল্লী বাংলাদেশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বা ৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতেও রাজি হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সামরিক খাতে এই ঋণ দেয়ার জন্য দিল্লী যে প্রস্তাবটি দিয়েছে, সেটি দিল্লী ইতঃপূর্বে আর কোথাও কাউকে দেয়নি। ভারত বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কিনছে এবং সেই অস্ত্র ক্রয় বাবদ শত শত কোটি রুপি ঋণও নিচ্ছে বিদেশ থেকে। সেখানে নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে বাংলাদেশের জন্য সমরাস্ত্রের আয়োজন করা বিস্ময়কর বৈকি। তবে শর্ত হলো এই যে, অস্ত্র খাতে ভারত যে ঋণ দেবে সেই ঋণের টাকা দিয়ে বাংলাদেশকে শুধুমাত্র ভারত থেকে যুদ্ধাস্ত্র ক্রয় করতে হবে।
॥ দুই ॥
কেন ভারত এসব করবে? ভারতের ইংরেজি পত্র-পত্রিকাতেই বলা হচ্ছে যে, এই ধরনের একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য বাংলাদেশ স্বেচ্ছায় রাজি হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে নাকি গাঁইগুঁই করছে। শেষ পর্যন্ত যদি বাংলাদেশ মোচড়ামুচড়ি করে তাহলে ভারত নাকি বলছে যে, অন্তÍত একটি সমঝোতা স্মারক সই হোক। দরকার লাগলে ঐ স্মারকটি বাধ্যতামূলক নাও হতে পারে। এমনকি সেখানে কোনো সময়সীমা নাও থাকতে পারে। তবুও বাংলাদেশ একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করুক। ভারতীয় সূত্র থেকে বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ ঠিক এই মুহূর্তে ঐ ধরনের কোনো চুক্তি করতে চাচ্ছে না। কারণ, বাংলাদেশ বলছে যে, আগামী বছরের ডিসেম্বরের দিকে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার আগে এখন যদি প্রতিরক্ষা চুক্তি বা ঐ ধরনের কোনো চুক্তি হয় তাহলে বাংলাদেশের বিরোধী শিবির বিশেষ করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের হাতে একটি নির্বাচনী অস্ত্র তুলে দেয়া হবে। ঐ অস্ত্র প্রয়োগ করে তারা আগামী ইলেকশনে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে বধ করবে। তবে এই নির্বাচনে জয়লাভের পর আওয়ামী লীগের আরও ৫ বছর সময় থাকবে। সেক্ষেত্রে চুক্তির ফলে যদি বাংলাদেশে জনমত কিছুটা প্রতিকূলে যায়, তাহলে তারা সেটা ম্যানেজ করতে পারবে। 
বাংলাদেশের একশ্রেণীর নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে করেন যে, বাংলাদেশ যদি এই ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর করে তাহলে সেটি সামরিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্যান্য অপশনকে সীমিত করে ফেলবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ এই ধরনের চুক্তির কোনো আবশ্যকতা অনুভব করে না। কিন্তু ভারত করে। বাংলাদেশের একধরনের মিডিয়া, যারা সেক্যুলার এবং আওয়ামী লীগের প্রতি কিছুটা দুর্বল বলে পরিচিত, তারাও এখন মনে করছেন যে, ভারত এখন এই ধরনের একটি চুক্তি করতে চাচ্ছে একটি বিশেষ কারণে। আর সেটি হলো সামরিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-চীন সহযোগিতা। চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন সংগ্রহের পর ভারতের উদ্বেগ আরও বেড়ে গেছে। হিন্দুস্থান টাইমসসহ একাধিক ভারতীয় পত্র-পত্রিকা লিখছে, যেখানে বাংলাদেশের সাথে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পন্ন হয়ে গেছে এবং যেখানে ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধেরও ফয়সালা হয়ে গেছে, সেখানে বাংলাদেশের জন্য দুইটি সাবমেরিন কেনার কি যুক্তি থাকতে পারে?
॥ তিন ॥
এই ধরনের স্পর্শকাতর চুক্তিতে অবশ্যই জনগণের অনুমোদন দরকার। সেজন্য প্রয়োজন প্রকাশ্য আলোচনার ব্যবস্থা। এই চুক্তিটি যদি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়, তাহলে সেটির ওপর ব্যাপক পাবলিক ডিবেট হতে পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এমন গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে যে, পাবলিক ডিবেট তো দূরের কথা, সরকার এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে মুখ খোলেনি। তারপরেও দেশপ্রেমিক জনসাধারণ গভীর উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে আছেন, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন দিল্লী সফরে কি ঘটে? বর্তমান সংসদ প্রতিনিধিত্বমূলক নয়। তবুও সেখানেও যদি এই চুক্তি সর্বসাধারণের অবগতির জন্য উত্থাপন করা হতো এবং সংসদে প্রকাশ্য বিতর্কের ব্যবস্থা করা হতো তাহলেও জনগণ কিছুটা জানতে পারতেন।
কতগুলো ব্যাপার মানুষকে জানতেই হবে। যেমন, চুক্তিতে নাকি এমন একটি ধারা থাকবে যেখানে বলা হবে যে, এমন কিছু বিষয় আছে যেটিকে দুই দেশই মনে করবে যে, সেটি তাদের বিরুদ্ধে একটি অভিন্ন হুমকি বা পারস্পারিক হুমকি, তাহলে সেটি মোকাবিলা করার জন্য ভারত-বাংলাদেশ যৌথভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এখন কথা হলো যে, ভারত যেটাকে মিউচুয়াল থ্রেট মনে করে বাংলাদেশ সেটিকে তো তার সার্বভৌমত্বের প্রতি থ্রেট মনে নাও করতে পারে। এমন ক্ষেত্রে তাহলে কি হবে?
সবশেষে একটি কথা। ভারতের জন্য অনেক বড় মাথাব্যথা ছিল উত্তর-পূর্ব ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদ বা সশস্ত্র বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহ দমনে বর্তমান সরকার যে অবদান রেখেছে সেটা কোনো মূল্য দিয়ে কেনা যায় না। আওয়ামী সরকার ভারতের সংহতি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এতবড় অবদান রেখেছে। কিন্তু কোনো চুক্তি ছাড়াই। ঐ জায়গায় যদি কোনো চুক্তির প্রয়োজন না হয়, তাহলে এখন কেন প্রয়োজন হচ্ছে? ভারত ছাড়া বাংলাদেশের তো এমন কোনো প্রতিবেশী নেই যার সাথে তার যুদ্ধ লাগতে পারে। যদি কোনো সময় মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধ লাগে তাহলে তার জন্য কি ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন আছে?


আফিস আরসালান 

বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি

হোসাইন আনোয়ার : নতুন নতুন সংঘটিত ঘটনাবলী যা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে প্রকাশিত, প্রচারিত, উপস্থাপিত ও প্রদর্শিত হয় এবং যা জানতে জনগণ আগ্রহী ও কৌতূহলী তাই সংবাদ বা খবর। যে মাধ্যমে তা প্রচারিত বা প্রকাশিত হয় তাকে সংবাদমাধ্যম বলে। যারা এই সংবাদ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত তাদেরকে সাংবাদিক বলা হয়। সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা। সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। সাংবাদিকরা সমাজের খুটিনাটি সংবাদপত্রের মাধ্যমে মানুষের কাছে তুলে ধরেন। বর্তমান সময়ে সংবাদপত্র বা মিডিয়াকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণ্য করা হয়। মিডিয়ার একটি মাধ্যমের নাম টেলিভিশন। বিশ্বের প্রায় ৮০% মানুষ টেলিভিশন দেখে। অতএব মিডিয়া বর্তমান বিশ্বকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
১৪০০ শত বছর আগে সাংবাদিকতা বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা. যে গাইড লাইন দিয়ে গেছেন তা এক কথায় অনন্য। ইসলামে সাংবাদিকতা এক ধরনের আমানত। এই আমানত হচ্ছে, যে কোনো তথ্য ও সংবাদকে অবিকৃত অবস্থায় সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরা। নিজস্ব চিন্তা কিংবা দল-মতের রং লাগিয়ে সংবাদকে আংশিক বা পুরোপুরি পরিবর্তন করে উল্টোভাবে পরিবেশন না করা। মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের আগে তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হয়। যে খবরটি মিডিয়ায় প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তা আদৌ সত্য কিনা তা যাচাইয়ের নিয়ম আছে সংবাদপত্র জগতে। তথ্য যাচাই-বাছাই করার ব্যাপারে পবিত্র কুরআনেও রয়েছে চমৎকার দিক-নির্দেশনা। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কাছে যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি সংবাদ নিয়ে আসে তবে তোমরা তা যাচাই-বাছাই করে নাও; যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হও।’ (সূরা আল-হুজুরাত: ০৬)
সাংবাদিকদের জন্য এই আয়াতটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদকর্মীরা যদি কোনো তথ্য সঠিকভাবে যাচাই না করে মিডিয়ায় প্রচার করে দেন, তাহলে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি হতে পারে। যার মাসুল ঐ সংবাদকর্মী দিতে পারবেন না। যাচাই বাছাই ছাড়াই সংবাদ প্রকাশের অনেকগুলো মাধ্যমের মধ্যে একটি মাধ্যমের নাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বর্তমানে এধরনের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম  ফেসবুক থেকে শুরু করে সবখানে বিদ্যমান। এ কারণে আল্লাহ তাআলা সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই না করে সংবাদ গ্রহণ ও পরিবেশন নিষেধ করেছেন। অনেক সংবাদকর্মী লোকমুখে যা শুনেন তাই মিডিয়ায় প্রচার করে দেন। এটিও ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহর রাসূল সা. বলেন, ‘একজন ব্যক্তি মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়’। (মুসলিম : ১/১০৭)
ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা দলীয়স্বার্থ বিবেচনা করে অনেক সাংবাদিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করেন। এ কাজটি করাও অন্যায়। জনস্বার্থে আসল তথ্য গোপন না করে তা প্রকাশ করা উচিত। মানুষ তথ্য জানার জন্য অধীর আগ্রহে পত্রিকা পড়েন কিংবা টিভির পর্দায় চোখ রাখেন। জ্ঞাত বিষয়কে গোপন করা সম্পর্কে পবিত্র হাদীসে কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞাত বিষয়কে গোপন করল কিয়ামতের দিন আল্লাহতাআলা তাকে আগুনের লাগাম পড়াবেন।’ (সহীহ ইবনে হিব্বান : হা. ৯৬) 
অনেকে আবার কাউকে হেয় করার মানসে তার ব্যক্তিগত তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরেন। যেমন গত ৩১ ডিসেম্বর দুর্বৃত্তদের গুলীতে গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন আহত হয়ে মেডিকেলে নেয়া হলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনার কোন যাচাই বাছাই ছাড়াই সরকারের পক্ষ থেকে জামাত শিবিরকে দোষারোপ করা হয়েছে এবং মিডিয়াও এ সংবাদটি ঢালাওভাবে প্রচার করেছে। অথচ পরবর্তীতে যখন জাতীয় পার্টি (জাপা-এরশাদ) সাবেক এমপি কর্নেল (অব.) এ কাদের খানকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো তখন বের হয়ে আসে আসল খুনির পরিচয়। 
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা জামায়াতকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপায় যার শিরোনাম ছিল ‘এবার ঘর পুড়ছে জামায়াতের’। এ খবরটি পরবর্তীতে বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকা ঢালাওভাবে ছাপায়। অথচ জামায়াতের পক্ষ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এটিকে মিথ্যা খবর হিসেবে দাবি করা হয়েছে। এ ধরনের অসংখ্য সংবাদ যাচাই বাছাই না করে পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে যা ঠিক নয়।
কারো গোপন বিষয় মানুষের কাছে প্রকাশ করে তাকে খাটো করা ইসলাম পছন্দ করে না। এক্ষেত্রে বরং ঐ ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষা করাই উত্তম। এ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে। হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন- ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ব্যক্তির দোষ গোপন রাখল আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন।’ (বুখারি : ২/৮৬২ হা.২৩১০) 
তবে কারো দোষ যদি এমন পর্যায়ের হয় যে, তাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় তখন তা উন্মুক্ত করে তার আসল চেহারা বের করা দরকার, যাতে সে আর মানুষের ক্ষতি না করতে পারে। আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী আছেন যারা তাদের লেখনীতে বিরুদ্ধমতাদর্শের লোকদের শক্তভাবে তিরস্কার কিংবা চরিত্রহনন করেন, যা একেবারে কাম্য নয়। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেন না, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেন না, সে উপহাসকারীনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাকে মন্দ নামে ডাকা গুনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তাওবা না করে, তারাই জালিম।’ (সূরা আল হুজুরাত: ১১)
খবরের সত্যতা যাচাইয়ের ব্যপারেও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কোনো ধর্ম, আদর্শ, মতবাদ ও সভ্যতাই মানুষকে মিথ্যাবাদী হতে শিখায় না। ইসলামও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসলামে মিথ্যা বলা মহাপাপ বা কবিরা গুনাহ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের কবিরা গুনাহ সম্পর্কে অবহিত করব না?’ কথাটি তিনি তিনবার বলেছেন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ‘হে আল্লহর রাসুল! হ্যাঁ, অবশ্যই।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা এবং মা-বাবার অবাধ্য হওয়া।’ এরপর হেলান দেয়া থেকে সোজা হয়ে বসে রাসুল (সা.) বললেন, ‘মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া ও মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা’- (বুখারি)। তাই সংবাদের তথ্য যাচাই ও সত্যতা নিরূপণ করা সাংবাদিকের অপরিহার্য কর্তব্য।
ব্যক্তি স্বার্থ, দলীয় স্বার্থ কিংবা নিজস্ব চিন্তা-চেতনা বিরোধী হওয়ায় অনেকে প্রাপ্ত তথ্য গোপন করে থাকে। শোনা যায়, নিউজ রুমে অনেক নিউজ ‘কিল’ করা হয়। এমনটি কিছুতেই কাম্য নয়। সত্য গোপন করাকে ইসলাম পাপ হিসেবে বিবেচনা করে। আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না, আর যে ব্যক্তি তা গোপন করে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী’ - (সুরা বাকারা : ২৮৩)। 
প্রিয় নবী সা. ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ ঐ ব্যক্তির চেহারা উজ্জ্বল করুন; যে আমার কথা শুনে অতঃপর তা হুবহু ধারণ করে অবিকল অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়’- (তিরমিজি শরিফ)। এ কাজটি অনেক কঠিন। কারণ সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কর্তব্যনিষ্ঠা ও পেশাদারিত্ব যখনই যার বিপক্ষে গেছে বা ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দলীয় ও এলিট শ্রেণির স্বার্থে আঘাত লেগেছ তখনই তাদের ওপর নেমে এসেছে বর্ণনীয় নির্যাতন ও নিগ্রহের ঘটনা। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকর্মীদের জীবন দিয়েও প্রায়শ্চিত্য করতে হয়েছে। আর সংখ্যাটাও একেবারে নগণ্য নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া তথ্যানুযায়ী শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই ১১৭ জন গণমাধ্যম কর্মী নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে সন্ত্রাসী হামলা ও নানাবিধ হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন ৩৭ জন, ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গসংগঠনের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন ২১ জন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ৯ জন। মামলার শিকার হয়েছেন ৯ জন। আর ২০১৫ সালে গোটা বিশ্বে ১১০ জন সাংবাদিক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
কোনো শক্তির কাছে মাথা নত না করে ভয়শূন্য চিত্তে সংবাদ পরিবেশন করাই ইসলামের দাবি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য উচ্চারণ করাই উত্তম জিহাদ’। অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত মুয়াজ (রা.) বললেন, ‘রাসুল (সা.) আমাকে বলেছেন, হে মুয়াজ, তুমি সত্য বলতেই থাকো, যদিও তা তিক্ত হয়।’ মূলত সত্য প্রকাশে আপসহীনতা একজন আদর্শ সাংবাদিকের অন্যতম কর্তব্য। সাংবাদিকরা নতজানু হয়ে কাজ করলে গণমাধ্যমের কার্যকারিতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। ইসলাম সাংবাদিকের সত্য বলার অধিকার আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই ‘সত্য প্রকাশে আপসহীন’ এটিই হোক সাংবাদিক সমাজের স্লোগান আর এই স্লোগানকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়া উচিত। তবেই সাংবাদিকরা সমাজের জাগ্রত বিবেকে পরিণত হতে পারবেন।




হোসাইন আনোয়ার 

রবিবার, ১২ মার্চ, ২০১৭

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাজনৈতিক হিংসার চক্রাকার ধারা

হারবার্ট ছবির একটি দৃশ্যে দেখা গিয়েছিল হিন্দুদের কালীদেবী এবং সশস্ত্র কমিউনিস্ট-নকশালিস্ট চারু মজুমদারের সহাবস্থান। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গে ছাত্র আন্দোলনে নিহত সুদীপ্তের মৃত্যুর ঘটনা দেখেও  অনেকের মনে হয়েছিল, এই কোলাজ কি কলকাতার বাঙালির মানস জগতের এক চিরায়ত প্যাকেজ? পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ায় এসব নিয়ে তুমুল বিতণ্ডা লক্ষ্য করেছিলাম। বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক হিংসার চক্রাকার ধারা দেখে এসব কথা মনে পড়ল। প্রায়শই পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে কথায় কথায় জেলায় জেলায় খুনোখুনির খবর কাগজে দেখি। কলকাতায় ষাটের দশকে যা চরম আকারে হয়েছে, তা আজো হচ্ছে। নির্বাচন যত এগিয়ে আসে ততই নাকি বাড়ে রাজনৈতিক হিংসা আর অন্য সময় চলতেই থাকে থেমে থেমে। রাজনীতির সঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হামলাও এসে যুক্ত হয়। বাংলাদেশে যেমন, পশ্চিমবঙ্গেও তেমনি রাজনৈতিক হিংসা ও সন্ত্রাসের বাড়-বাড়ন্ত। কেন? বাঙালি কি হিংসাশ্রয়ী? অনেকের সঙ্গে আলাপে এ ব্যাপারে জানতে চেষ্টা করেছি।
সমস্যাটির উত্তর এক কথায় পাওয়া যায় নি। কেউ উদাহরণ দিয়েছেন। কেউ দিয়েছেন বড় আকারের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। একটি উদাহরণ এমন: বেশ কয়েক বছর আগের কথা। বিজেপি সরকারের মন্ত্রীসভায় লালকৃষ্ণ আদভানী তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি এক বক্তব্যে বলেছিলেন, “উত্তরপ্রদেশ বা বিহারে জাতপাতের সংঘর্ষ সবচেয়ে বেশি, পশ্চিমবঙ্গে তা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক হিংসায় পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এহেন বক্তব্যে স্বাভাবিক কারণেই পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কর্তাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হওয়ার কথা। কিন্তু এত বছর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই একই কথা বলছে। আজো রাজনৈতিক হিংসার প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ ফার্স্ট বয়; কলকাতাই সেরা! এখানে হিংসা মানে  কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং সুসংহত এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? উনবিংশ শতাব্দীর পূর্ণ বা আংশিক ‘রেনেসাঁ নগরী’তে কেন এত হিংসা? রাজনৈতিক উন্মত্ততা? অসহিষ্ণু পুলিশ? বিতর্কিত লেখক নীরদ চৌধুরী একদা বলেছিলেন, “বাঙালি বৈষ্ণব নয়, আসলে শাক্ত”। বলাই বাহুল্য, শাক্ত বা কালীর উপাসনাকারী হিসাবে তিনি বিলক্ষণ বাঙালি হিন্দুদেরই বুঝিয়েছেন এবং সেটাও গান্ধির সঙ্গে সুভাষ বসুর সংঘাতের প্রেক্ষাপটকে দেখানোর প্রয়োজনে। সেসব ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের কথা। তখনকার সচিবালয় বা রাইটার্স বিল্ডিং বা আজকের ‘মহাকরণ’-এ গিয়ে বিনয়-বাদল-দীনেশের আক্রমণ ঐতিহাসিকভাবে নগর স্মারকে পরিণত করা হয়েছে পাশেই ধর্মতলায় তিন বীরের মূর্তি বানানোর মাধ্যমে। জায়গাটির নামও হয়েছে বীরত্রয়ীর নামে ‘বি-বা-দী বাগ’। কলকাতায় গিয়ে এক্সপ্লানেড ও ডালহৌসি স্কোয়ারের পাশে মূর্তিমান পরিস্থিতি সকলেরই চোখে পড়বে।
অতএব সেইসব অনুপ্রেরণা নগর-জীবন থেকে মুছে যাওয়ার বিষয় নয়। হাল আমলে তেজস্বী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুঙ্কার থেকে, কমিউনিস্ট বিরোধী লড়াই, সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলন, কলকাতার সব ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা মানেই আবশ্যিকভাবেই ‘সহিংস আন্দোলন’। সুদীর্ঘ বাম শাসনাধীন কলকাতার রাজনৈতিক সহিংসতা প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় এক মার্কসবাদী রাজনীতি বিজ্ঞানী হারবার্ট আপতেকার’কে, যিনি বলেছিলেন, “হিংসা হল একটা মাধ্যম যার মাধ্যমে ভাল লক্ষ্যেও পৌঁছানো যায়। আবার অন্তিম বা লক্ষ্যপ্রাপ্তির জন্য সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থাই যখন হিংসার ফসল, তখন সেই হিংসার মোকাবিলা করতেও পাল্টা হিংসার আমদানি হয়। আধিপত্য কায়েমের এই ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত আছে হিংসা, যাকে বলা যায় ‘সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স’। এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধও এক বিপরীতমুখী ঐতিহাসিক অনিবার্যতা।” পশ্চিমবঙ্গ সম্ভবত এমনই এক সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স সার্কেল বা চক্রের আবর্তে আটকে গেছে।
অথচ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির রাজনৈতিক সংস্কৃতি বহুত্ববাদী। কিন্তু সামাজিক বা সঙ্ঘজীবনে আত্মস্বার্থরক্ষা বাঙালির কাছে যতই বড় হয়ে ওঠে, পরমতসহিষ্ণুতা ততই কমে। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাবনা অনুসারে আত্মপরিচয়ের আধিপত্য কায়েমের জন্য অন্য মত বা অন্য পরিচয়ের প্রতি আস্থা না রাখাই হিংসার উৎস। আর তাই বাঙালি হয় হিন্দু নয় মুসলিম, হয় বাঙাল নয় ঘঁটি, হয় ইস্টবেঙ্গল নয় মোহামেডান নচেৎ মোহনবাগান, হয় কাবাব নয় চিংড়ি কিংবা ইলিশ, হয় তৃণমূল নয় সিপিএম। ঠিক এমন একটা কালো বা সাদার দ্বৈততায় চরমভাবে আক্রান্ত। উগ্রতার পাশে মধ্যপন্থা বলে আসলেই কিছু একটা আছে বলে কোনো প্রজাতির বাঙালিরই রাজনৈতিক জীবনে মনে করা হয় না। অথচ অভিধানের ভাষায় দ্বৈততা মানেই দ্বৈরথ নয়। ভাত বনাম রুটি না ভেবে, ভাত এবং রুটি মর্মেও যে একত্রে ভাবনার সুযোগ আছে, তা উন্মত্ততায় আচ্ছন্ন হয়ে কেউই স্বীকার করতে চায় না।
১৯৪৭ সালের পর দুই বাংলার ইতিহাস ভিন্ন খাতে বয়ে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ রাজের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কাহিনী প্রায় আড়াই শতকের ইতিবৃত্ত। সঙ্গে ভারতের অধীনে আরো ৭০ বছর। এই বাঙালির মনোজগতের আর সমাজ বিন্যাসের কথা বলতে গিয়ে বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক বিনয় ঘোষ জানাচ্ছেন, “বঙ্গসমাজে প্রাধান্যকারী সংস্কৃতিই মূলধারার সংস্কৃতি হয়ে গিয়েছে আর মূলস্রোতই চাপা পড়ে হয়ে গিয়েছে প্রান্তিক। বাংলার গ্রামীণ মধ্য শ্রেণী ও নাগরিক মধ্য শ্রেণীও বহু ভাবে একত্রীভূত হয়েছে সংস্কৃতির বাঙালি ধারায়।” এভাবেই কলকাতাকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর ভারতের কাঠামোয় গড়ে ওঠেছে কলকাতার বাঙালি মানস।
বিনয় ঘোষ আরো বলেছিলেন, “চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর নতুন জমিদার শ্রেণীর অধীনে মধ্যস্বত্ব ভোগীর উদ্ভব হয়।” বহু বছর পর যখন বামফ্রন্ট জমানায় ‘কেরানি কমিউনিজম’-এর উদ্ভব হল, তখনো মনে করা হল সেই প্রবাহই বয়ে চলেছে। কিন্তু সেই আপাত নিরীহ বাবু-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের মধ্যেও আছে আধিপত্যকামিতার সংস্কৃতি। আর পাশাপাশি পরিলক্ষিত হয়েছে সেই আধিপত্যর বিরুদ্ধে হিংসাশ্রয়ী লড়াই। বহু ক্ষেত্রে সেই লড়াইয়ে যতটা যুথবদ্ধতা দেখা যায়, তা আপাতদৃশ্য। আসলে বহু ক্ষেত্রেই তাতে আছে নেতৃত্বের আত্মকেন্দ্রিকতা, রাজনৈতিক মোক্ষলাভের নীল নকশা এবং ক্ষমতার লালসা।
সুদীর্ঘ বাম জমানায় যে দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জেলায় জেলায়, সেই সঙ্কীর্ণ দলীয় আধিপত্য আসলে সমাজকে অবৈধ ভাবে নিয়ন্ত্রণের জাল বিস্তার। শুরু হয় ‘আমরা-ওরা’র বিভাজন। একে বলা যায় রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা, এখনো যা বহাল হয়ে সহিংসতাকেই পুষ্টি যোগাচ্ছে সমাজ ও রাজনীতির সর্বস্তরে। রূপ নিচ্ছে কখনো রাজনৈতিক কিংবা কখনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতায়।
পশ্চিমবঙ্গে একদা শাসক কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা আন্দোলনে মুখর হয়েছিলেন। সে আন্দোলনে হিংসা ছিল, ছিল পুলিশের দমননীতির বিরুদ্ধে পাল্টা-হিংসাও। বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনের পর দেখা গেল মমতার জঙ্গি আন্দোলন। কেশপুর-গড়বেতা থেকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে হিংসা এসেছে বার বার। এমনকী, রাজ্যে যে দলটি দুর্বল সেই বিজেপি-র রাজ্য শাখাও বন্‌ধ-হরতাল, এমনকী, বাস পুড়িয়ে সফল আন্দোলনের দাবিদার সেজেছে; সাম্প্রদায়িকতাকে নতুনভাবে পুষ্টি যোগাচ্ছে। শুধু তাই নয়, রাজ্য থেকে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বের করে দেওয়ার দাবিতে মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আন্দোলনও সহিংস রূপ ধারণ করে। সেনাবাহিনী নামিয়ে তবেই সেটা থামানো হয়েছিল।
জঙ্গি ইমেজের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারাবাহিক হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতিকে আরো ঘোরালো করে তুলেছে। ব্রিটিশ পুঁজি প্রথমে বিদায় নিয়েছে। ‘ফ্লাইট অফ ক্যাপিটাল’, সেখান থেকে সিঙ্গুরে টাটার বিদায়, রাজ্যে এক দিকে রাজনৈতিক হিংসা, অন্য দিকে শিল্প ও বাণিজ্যের বিদায়। এই হলো হিংসার রাজনীতির প্রাথমিক ফলাফল।
ইতিহাস বলছে, বঙ্গ সংস্কৃতিবাদ মানেই কালীর আরাধনা করে সশস্ত্র হওয়া নয়; আবার সকলের মিশে যাওয়াও নয়। একটা মুক্তির পথের কথা অমর্ত্য সেন বলেছেন ‘প্লুরাল মোনোকালচারালিজম’ (বহু-এক-সংস্কৃতিবাদ)। বিভিন্ন সংস্কৃতি যখন রাতের অন্ধকারে জাহাজের মতো পরস্পরের পাশ কাটিয়ে চলে যায়, তখন তারা এক জায়গায় বসবাস করলেও তা বহু সংস্কৃতিবাদের সার্থক নিদর্শন নয়।
ফলে বিভক্তিতে পূর্ণ নিজস্ব পরিচয়বোধের এই ক্ষুদ্রায়ন পশ্চিমবঙ্গকে আরো হিংসার পথে ঠেলে দিয়েছে। ‘বিশ্বাসকে যোগে যেথায় বিহারো’, অধুনা তা শুধু একটা গানের লাইন মাত্র; সমাজ ও রাজনীতির বাস্তব কাঠামোতে অর্থহীন।
এ কথা সত্য, যেকোনো গোষ্ঠীজীবনে সংঘাত ও হিংসা অনিবার্য। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায়, জাতি বনাম জাতি ইত্যাদি নানা ভাবে হিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। এই সব দ্বন্দ্ব নিরসন করতে গিয়ে রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়; তৈরি হয় ‘নিরঙ্কুশ ক্ষমতা’র বলয়। এই মনোভাবের মধ্যেই আছে হিংসার সবচেয়ে বড় ও জ্বলন্ত উৎস‌। এখানে সিপিএম, তৃণমূল একাকার। বামপন্থীরাও হিংসাকে রাজনৈতিক অনুশীলন ও সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলেছেন। আজ তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতাসীন বটে, কিন্তু সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। দল ও আদর্শের বাইরে হিংসার জ্বলন্ত অগ্নিকু-টিই সকল কিছুর উৎসস্থল হয়ে থেকেই যাচ্ছে। 
হিংসার বিরুদ্ধে আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের আওয়াজ ওঠে। দলমত নির্বিশেষে সকলের পক্ষ থেকে গণতন্ত্রের আওয়াজও অর্থপূর্ণ হয় না। কারণ, যে প্রকৃত গণতন্ত্রই পারে এই হিংসার আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতিকে বিদায় জানাতে, সেটাই প্রকৃত অবয়বে আবির্ভূত হয় না বহুবিধ মতাদর্শিক ও সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতার কারণে। মানুষের মনে, সমাজের সাংস্কৃতিক পাটাতনে, রাজনীতির কাঠামোতে নোংরা লেপ্টে থাকলে সেটা দুর্গন্ধে ও কুশ্রীতে প্রকাশিত হবেই। হিংসার রাজনীতি হলো সেই নোংরা, যা ললাট লিপির মতোই অমোচনীয় হয়ে পুরো ব্যবস্থার চেহারা জুড়ে প্রকাশিত হচ্ছে। ধর্ম, বর্ণ ও মতাদর্শের ক্ষেত্রে ভিন্নতা পোষণকারী দুর্বল ও সংখ্যালঘুরা আইন ও সুশাসনের আওতায় প্রাপ্ত সুরক্ষায় নয়, পৌনঃপুনিক শাসিত হচ্ছে সন্ত্রাসের অধীনে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক হিংসা ও সন্ত্রাসের এই হলো চক্রাকার-নিয়তি।

Ads