পৃথিবীতে নানা ধরনের ‘স্মরণ’ অনুষ্ঠান হয়। মৃত আত্মীয়, জাতীয় বীর, যুদ্ধের শহিদ ইত্যাদি খ্যাতনামাদের স্মরণে অনুষ্ঠান বা দিবস পালনের রেওয়াজ নতুন নয়। বাংলাদেশে এখন যুক্ত হয়েছে নতুন এক স্মরণ-সংস্কৃতি। এর নাম ‘গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণ’। সন্দেহ নেই, গুমের কারণে স্মরণযোগ্য ব্যক্তির গুরুত্ব ও সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনাই প্রমাণ করে যে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে মানুষ অনুষ্ঠান পর্যন্ত করতে বাধ্য হচ্ছে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিক ব্যবস্থা আর আইন-শৃঙ্খলা কাঠামোতে বিষয়টি একটি অভিনব, উল্লেখযোগ্য অথচ বেদনা-বিধুর সংযোজন। অনুষ্ঠানে যে বক্তব্যটিই শিরোনামে এসেছে মিডিয়ার এবং সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তা হলো: ‘রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এভাবে গুম হয় না’।
বাংলাদেশে ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও গুম নিয়ে এতো আলোচনা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে কি না, জানা নেই। এটাও কারো জানা নেই যে, অসংখ্য মানুষ, যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা জায়গায় বহাল তবিয়তে ছিলেন, তারা অকস্মাৎ গুম বা নিখোঁজ হয়ে গেছেন, এমন ঘটনা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও ঘটছে কি না? পরিবার-পরিজনকে অকূলে ভাসিয়ে তারা কোথায় চলে গেছেন? প্রশাসন কিছুই বলতে পারছে না। যারা নাগরিক সমাজের দায়িত্বে নিয়োজিত, তারাও মুখ বন্ধ করে আছে। এজন্যই সম্ভবত গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে অনুষ্ঠিত সভায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এভাবে গুম হয় না’।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত্র রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, দেশে এভাবে গুম রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া হয় না। তারা (সরকার) হচ্ছে ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন। এ পর্যন্ত যতগুলো গুম হয়েছে তার বিচার করতেই হবে। গত শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে পালিত আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেন, দলমত নির্বিশেষে মৌলিক অধিকারের প্রয়োজনে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জান-মালের নিরাপত্তার প্রশ্নে কোন আপস নাই। তিনি বলেন, তদন্ত হয় না, বিচার হয় না, এই রোগ আমাদের পেয়ে বসেছে। শাসন ব্যাবস্থা বিচার ব্যাবস্থার উপর এই রোগ আছে। গুম খুনের শিকার ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, স্থানীয় এমপির মাধ্যমে মন্ত্রী এবং সরকারের কাছে লিখিত জবাবদিহিতা চাইতে হবে। আমাদের সবাইকে গুমের বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। এটা বিএনপি আওয়ামী লীগ এর বিষয় নয়। আমরা জাতি হিসেবে অসহায় না। আজকের সম্মেলনের মাধ্যমে সবার ভয় ভেঙ্গেছে। মনে রাখতে হবে জনগণই ক্ষমতার উৎস, সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক নেতৃবৃন্দ। ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সম্মেলন কক্ষে সারা দেশ থেকে আসা শতাধিক ভুক্তভোগী পারিবারের স্বজনদের উপস্থিতিতে সম্মেলন শুরু হয়। প্রথম অধিবেশনে ২০-২৫ জন ভুক্তভোগী স্বজন বক্তব্য রাখেন। সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে ক্ষতিগ্রস্ত স্বজনরা বলেন, দেশে গুম, খুনের মতো কোনো ঘটনা আর কেউ দেখতে চায় না। এমন নির্মম পরিণতি আর কেউ চায় না। স্বজনদের বেশিরভাগই সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের গুম হওয়া স্বজনদের সন্ধান এবং বিচার দাবি করেন। বক্তব্যে স্বজনরা গুম, অপহরণের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাবকে দায়ী করে এর প্রতিকারের দাবি জানান।প্রত্যেক স্বজন ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তখন গোটা সম্মেলন কক্ষেই নেমে আসে স্বজন হারানোর হাহাকার। সেই হাহাকার ছুঁয়ে যায় সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের। সম্মেলনে লাকসামের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামের হিরুর মেয়ে মাসরুফা ইসলাম বলেন, গত ২৭ নভেম্বর ২০১৩ সালে আমার বাবা গুম হন। গত ৯ মাসেও আমরা তাকে ফিরে পাইনি। সম্মেলনে বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমের মেয়ে মাহফুজা আক্তার বলেন, “গুম হয়ে যাওয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ দেশে বিরাজ করছে বলেই এমনটা হচ্ছে। আমরা কেউই এ রকম সমাজ বা রাষ্ট্রে বাস করতে চাই না। আমারা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের এাঁ মৌলিক অধিকার।” কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আল মুকাদ্দেস ২০১২ সালে সাভারের নবীনগর থেকে তার আরেক সহপাঠীর সাথে গুম হন। তার বাবা মওলানা আবদুল হালিম সেমিনারে বলেন, দুই বছর পার হয়ে গেলেও আমরা তার কোনো খোঁজ পাইনি। দেশে সাধারণ মানুষও গুম হয় এটাই তার প্রমাণ।
এমন পরিস্থিতিতে আমাদের ভাবতেই হয়, ‘গুম’ বলতে কি বোঝায়? নিখোঁজ হওয়া? ধরে নিয়ে যাওয়া? তার নয়। কারণ, নিখোঁজ হলে এক সময় খোঁজ পাওয়া যায়। জীবিত বা মৃত হলেও উদ্ধার হয়। ধরে নিলে বা গ্রেফতার করা হলেও একটি রেকর্ড থাকে। মামলা-মোকাদ্দমা হয়। এক সময় শাস্তি শেষে ছাড়া পাওয়ারও ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু গুম? এর তো কোনো রেকর্ড থাকে না। গুম হওয়া ব্যক্তির কোনো রেকর্ডও থাকে না। পরিবার-পরিজন জানে না, লোকটি আছে, নাকি নেই। এমন অবস্থা বড়ই মর্মান্তিক। করুণ। বাংলাদেশে ব্যাপক হারে এমনটিই হচ্ছে। অনুষ্ঠান করে গুম-হওয়া লোকদের স্মরণও করতে হচ্ছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার চরম নিরাপত্তাহীনতার প্রতিচ্ছবি এমন খবরের মধ্যেই সুপ্ত রয়েছে। মানবাধিকারের বিরাট লঙ্ঘনের চিত্রও এসব গুমের ঘটনায় লুকিয়ে রয়েছে। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে দেশে তো বটেই, বিদেশেও উৎকণ্ঠা প্রকাশিত হয়েছে।
সচেতন মানুষ মাত্রেই এ প্রসঙ্গে জানেন যে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এতে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া আইনশৃৃংখলা বাহিনীর খেয়ালখুশিমতো গ্রেফতার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও কর্মক্ষেত্রে দুর্বল ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে রাজনেতিক সহিংসতা, সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি, নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা, পরোক্ষ হুমকি ও হয়রানির মাধ্যমে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয় ওঠে এসেছে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের ‘ব্যুরো অব ডেমোক্রেসি হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লেবার’ শিরোনামে প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে বিগত ২০১৩ সালে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ওয়াশিংটনে তার দফতরে বার্ষিক এ প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন। ৪২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো খেয়ালখুশিমতো গ্রেফতার, মতামত প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের দুর্বল অবস্থা ও শ্রম অধিকার। এতে আরও বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটছে। তবে এতে বিন্দুমাত্র ছাড় না দেয়া এবং তদন্তের অঙ্গীকার করা হয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে। এরপরও বিচার বহির্ভূত হত্যা থেমে নেই। বলা হয়, এমন ঘটনায় সব মিলিয়ে কতজন প্রাণ হারিয়েছেন, সরকারের পক্ষ থেকে তারও পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হচ্ছে না। আবার এসব ঘটনার তদন্তে সমন্বিত ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না সরকার। গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগের ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি শাস্তি দেয়া হয়েছে কিনা, এমন তথ্যও পাওয়া যায়নি। সরকার র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা তদন্তে অভ্যন্তরীণ সেল গঠন করলেও গত বছর এ বাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে সন্দেহভাজন হত্যার অভিযোগে কোনো বিচার হয়েছে কিনা, তাও জানা যায়নি।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রকে (আসক) উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের প্রথম নয় মাসে র্যাবসহ নিরাপত্তা বাহিনীর বিভিন্ন সদস্যের হাতে ১৪৬ জন নিহত হয়েছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মানুষের প্রাণহানির ঘটনাকে কখনও ‘ক্রসফায়ার’, কখনও ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কিংবা ‘মুখোমুখি সংঘর্ষ’ হিসেবে তুলে ধরেছে প্রশাসন। ২০১২ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন প্রায় ৭০ জন।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারকে উদ্ধৃত করে মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ১৪ জন গুম হয়েছেন। ২০১২ সালে ওই সংখ্যা ছিল ২৪ জন। অন্যদিকে, আসকের তথ্যানুযায়ী ২০১৩ সালে গুম হয়েছেন ৩৩ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের প্রথম নয় মাসে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৮৯ জন নিহত এবং ১০ হাজার ৪৮ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সহিংসতা হয়েছে ১৩৫ বার। এতে নিহত হয়েছেন ১৫ জন। বিএনপিতে এ সংখ্যা যথাক্রমে ৭৫ ও ৬।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে হরতাল চলাকালে মানিকগঞ্জের সিংগাইরে পুলিশ প্রকাশ্যে গুলী ছোঁড়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর। এতে নিহত হন ৫ জন। তবে নিহতরা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। তারা হরতালেও অংশ নেননি। নিহতরা হলেন কৃষক আলমগীর হোসেন, ব্যবসায়ী নাসির আহমেদ, নাজিমুদ্দিন মোল্লা ও শাহ আলম। ২৫ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে ন্যাশনাল কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোহাম্মদ আলী মোহাব্বতকে অপহরণ করে র্যাব। তার পরিবারের সদস্যরা বলেছেন তারপর থেকে তিনি কোথায় আছেন তারা তা জানেন না। বছর শেষ হয়ে গেলেও তার কোনো হদিস মেলেনি। ১৫ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি ‘দ্য নিউ এজ’ পত্রিকাকে বলেন, ২০১২ সালে আদালত থেকে তাকে সাদা পোশাকের পুলিশ অপহরণ করে। এ বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছেন। এতে কোনো তদন্তও হয়নি। উল্টো প্রসিকিউশন তাকে অপহরণের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সুখরঞ্জন দাবি করেছেন, তাকে সীমান্ত পেরিয়ে অবৈধ উপায়ে ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার আগে কয়েক সপ্তাহ রাখা হয় নিরাপত্তা হেফাজতে। বছর শেষেও তিনি কলকাতার জেলে বন্দী ছিলেন। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে হত্যা করা হয় বিশ্বজিৎ দাসকে। এ ঘটনায় জড়িত ৮ জনের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট মৃত্যুদ-ের শাস্তি ঘোষণা করেন। ১৩ জনকে দেন যাবজ্জীবন কারাদ-। বছরজুড়েই অব্যাহত ছিল গুম ও অপহরণ। এজন্য দায় দেয়া হয় নিরাপত্তাবিষয়ক সংস্থাগুলোকে। যার মধ্যে রয়েছে র্যাব ও সিআইডি। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জেলখানার চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, জেলখানাগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। এতে আসামীতে ঠাসাঠাসি। পর্যাপ্ত সুবিধা নেই। পয়ঃনিষ্কাশনের অভাবসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত।
প্রতিবেদনে মিডিয়া প্রসঙ্গে বলা হয়, মুক্ত মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখাতে মাঝে মাঝেই ব্যর্থ হয়েছে সরকার। হয়রানি ও হুমকির আতংকে কিছু সাংবাদিক সরকারের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে সেলফ সেন্সরশিপ করেন। সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন করেছে পুলিশ। অধিকারের উদ্ধৃতি দিয়ে এতে বলা হয়, ২০১৩ সালে কোনো সাংবাদিক নিহত না হলেও জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১৪৪ সাংবাদিকের ওপর হামলা হয়েছে না হয় তাদের হুমকি দেয়া হয়েছে। তবে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন দুই সাংবাদিক। আর হামলা হয়েছে, ৩৯ জনের ওপর। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে খুন করা হয় সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে। এ ঘটনায় ২০১৩ সালেও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। এছাড়া সরকারবিরোধী-সমর্থিত কিছু মিডিয়া বিভিন্ন অভিযোগে বন্ধ করে দেয়া হয়।
৫ ও ৬ মে সরকার হেফাজতে ইসলামের ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি প- করে দিতে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদেও মোতায়েন করে। সরকার দাবি করে, পুলিশ ও ইসলামী দলটির মধ্যে সংঘর্ষে ১১ জন নিহত হয়েছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও আল জারিরা রিপোর্টে বলা হয়, নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫০ জন। জুনে অধিকার জানায়, দু’দিনের ওই সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৬১ জন।
২০১৩ সালের দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করেছে মানবাধিকার গ্রুপগুলো, মিডিয়া, দুর্নীতি দমন কমিশন ও অন্যান্য কিছু সংস্থা। যেসব কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িত হয়েছেন তারা দায় মুক্তির সুযোগ পেয়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার সরকারি প্রতিষ্ঠান হল দুদক। ২০১০ সালের বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, সরকার দুদকের কাজকে খর্ব কওে দেখে এবং তারা দুর্নীতির বিচারকে বাধাগ্রস্ত করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের চেয়ে কম দুর্নীতির মামলা করেছে। পাশাপাশি সরকারি কমিশন হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার করার জন্য দুদককে সুপারিশ করেছে। সরকার ৩১ জানুয়ারি পদ্মাসেতু প্রকল্প থেকে ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ঋণ আবেদন প্রত্যাহার করে নেয়। বিশ্বব্যাংকের বৈদেশিক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সমালোচনার পর সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রতিবেদনে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭২৯টি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ওঠে আসে শ্রমিক অধিকার প্রসঙ্গও। বলা হয়, শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার দেয়া হলেও নিবন্ধনের ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা। মার্কিন প্রতিবেদনে সাভারের রানা প্লাজা ধসের প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়, ওই দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১ হাজার ১৩৩ জন শ্রমিক নিহত ও ২ হাজার ৫০০ শ্রমিক আহত হয়েছেন।
তথ্য-পরিসংখ্যান আরো বিস্তারিতভাবে দিলে এ লেখার কলেবর বিরাট আকার ধারণ করবে। উপরে উদ্ধৃত দেশী-বিদেশী স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানসমূহের বিবরণে বাংলাদেশের মানবাধিকার তথা গুম-হত্যা-নির্যাতনের ভয়াবহতা আঁচ করা সম্ভব। এ সমস্যা দূরীকরণের বদলে দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। যে কারণে গত শনিবার প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত গুমের স্মরণে সভা থেকে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগের আঙুল নির্দেশ করা হয়েছে। গুম ও নির্যাতনের শিকার পরিবারগুলোও জানে, কারা এসব ঘটাচ্ছে। সাধারণ জনগণের চোখও খুলে গেছে। তারপরও উচ্চ পর্যায় থেকে গুম-খুনের মতো মৌলিক অপরাধ আর মানবতার প্রতি জঘন্য আচরণ বন্ধ করা হচ্ছে না। এমন কি, অপরাধ স্বীকার বা দোষীদের চিহ্নিত করারও কোনো খবর জানা যায় নি। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে মানবাধিকার বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। মানুষের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক আইনগত অধিকার এবং নিরাপত্তার বিষয়টিও ভূলুণ্ঠিত হবে। সভ্য সমাজে এমনটি কখনোই কাম্য হতে পারে না।
কনক জ্যোতি