বৃহস্পতিবার, ৪ জুন, ২০১৫

বহির্বিশ্বে ইমেজ সংকটে দেশ


বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-, গুম-খুন, সর্বব্যাপী দুর্নীতি এবং একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনসহ রাজনৈতিক সংকটের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যায় মানব পাচারের মতো বিভিন্ন কারণে বহির্বিশ্বে মারাত্মক ইমেজ সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ হলেও সৌদি আরব বাংলাদেশীদের জন্য ওমরাহ ভিসা পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে দেশটিতে চাকরিও পাচ্ছে না বাংলাদেশের লোকজন। অন্য অনেক দেশেও বাংলাদেশের জন্য চাকরির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। এমন অবস্থার প্রধান কারণ হিসেবে দৈনিক সংগ্রামের এক রিপোর্টে মানব পাচারকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। সমুদ্র পথে তো হাজার হাজার মানুষ অবৈধভাবে যাচ্ছেই, ওমরাহ ভিসা নিয়ে সৌদি আরবে যাওয়া বাংলাদেশীরাও ফিরে আসছে না। একই খবর জানা যাচ্ছে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে বিভিন্ন দেশে যাওয়াদের সম্পর্কেও। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশের ভেতরে চাকরির অভাব এবং বৈধ পন্থায় বিদেশে চাকরি না পাওয়ার কারণেই মানুষ অবৈধ পন্থাকে আশ্রয় করেছে। আর এই সুযোগে সর্বাত্মক তৎপরতা চালাচ্ছে মানব পাচারকারীরা। তাদের উদ্যোগে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারসহ কয়েকটি দেশে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। চাকরির আশায় এসব সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত শত শত বাংলাদেশী সমুদ্রে মারা যাচ্ছে, অনেকের লাশ পাওয়া যাচ্ছে অন্য দেশের গণকবরে। কোনোভাবে বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশীরা পুলিশের ধাওয়া খেয়ে গভীর জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ধরা পড়ে যাওয়া অনেকে ঘাড়ে ধাক্কা খেয়ে অর্থাৎ বহিষ্কৃত হয়ে ফিরে আসছে। অন্যদিকে সরকারের দিক থেকে বিশ্বাসযোগ্য কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে না। ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার অঙ্গিকার এখনো কাগুজে ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী উল্টো তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছেন, যারা চাকরির খোঁজে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মানব পাচার প্রতিরোধ করতে হলে পাচারকারী সিন্ডিকেটগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। কিন্তু সরকার সেদিকে পা বাড়াচ্ছে না। পা না বাড়ানোর কারণ, এসব সিন্ডিকেটে জড়িতরা অত্যন্ত শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর। রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে তাদের লেনদেনের মাধ্যমে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এজন্যই মিডিয়ায় বেশি হৈচৈ উঠলে লোক দেখানোর জন্য জনাকয়েক চুনোপুটিকে গ্রেফতার করা এবং বন্দুকযুদ্ধের শিকার বানানো হয়। অন্যদিকে রাঘব-বোয়ালরা সব সময় পার পেয়ে যায়। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, প্রশাসন তথা সরকার এবং বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সহযোগিতা ছাড়া বছরের পর বছর ধরে এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে পাচার করা সম্ভব হতে পারে না। অর্থাৎ সব কিছুর পেছনে রয়েছে সরকারের প্রশ্রয় ও সহযোগিতা এবং সরকারের কারণেই বহির্বিশ্বে ক্ষুণœ হচ্ছে দেশের ইমেজ।
বলার অপেক্ষা রাখে না, পরিস্থিতির অত্যন্ত আশংকাজনক অবনতি ঘটেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। ওমরাহ ভিসা ও চাকরিই শুধু নিষিদ্ধ হয়নি, নেতিবাচক ইমেজের কারণে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগও আসছে না। যারা বিনিয়োগ করেছেন তারাও তাদের বিনিয়োগ অন্য কোনো দেশে সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। বিদেশীদের কাছে মানব পাচারের পাশাপাশি দুর্নীতি এবং গুম-খুনসহ রাজনৈতিক সংকট এসেছে প্রধান সমস্যা হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসা হয়েছে, গুম-খুন তথা বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- শুধু বন্ধ করলে চলবে না, প্রতিটি হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারও করতে হবে। না হলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য বিক্রি কঠিন হয়ে পড়বে। আমরা মনে করি, ওমরাহ ভিসা ও বিদেশের গণকবর থেকে শুরু করে চাকরির দরজা বন্ধ হওয়া এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য কঠিন হয়ে পড়ার মতো প্রতিটি সমস্যার পেছনে একটি মাত্র প্রধান কারণই রয়েছে। সে কারণটি দেশের ভেতরে চাকরি ও ব্যবসার সুযোগ না থাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানব পাচারকারী সিন্ডিকেটগুলোর সঙ্গে সরকারের প্রায় প্রকাশ্য সখ্য। একই কারণে দেশের খুইয়ে ফেলা ইমেজ পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নতুন পর্যায়ে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হলে সরকারকে অবশ্যই দেশের ভেতরে চাকরি ও ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, হাজার হাজার মানুষ যাতে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি না জমায়। সরকারকে সেই সাথে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেজ্ঞদের মতো আমরাও মনে করি, সরকারের সহযোগিতা পাচ্ছে বলেই সিন্ডিকেটগুলো তৎপরতা চালানোর দুঃসাহস দেখাতে পারছে। অতএব, চাকরির আশায় দেশত্যাগী সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে হুমকি উচ্চারণের পরিবর্তে সরকারকে পাচারকারী রাঘব-বোয়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রমাণ রাখতে হবে সততা ও সদিচ্ছার। এটাই বহির্বিশ্বে দেশের ইমেজ তথা সম্মান পুনরুদ্ধারের একমাত্র উপায় বলে আমরা মনে করি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads