বুধবার, ১৭ জুন, ২০১৫

হতাশার মাত্রা বৃদ্ধি তো কোনো সরকারের কাজ হতে পারে না


এটা কী ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি? অথচ এখন বলা হচ্ছে, টেন্ডারবাজি নাকি রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। আরও মারাত্মক কথা হলো, ক্ষমতার সাথে সংযোগ রেখে অর্থ-সম্পত্তির মালিক হতে হবে- এমন লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এখন রাজনীতিতে আসছেন লোকজন। তাহলে ‘আমরা দেশ ও জনগণের জন্য রাজনীতি করি’- এ কথার অর্থ কী দাঁড়ায়? এ প্রসঙ্গে ‘টেন্ডার সিন্ডিকেটে জিম্মি উন্নয়ন’ শিরোনামে পত্রিকান্তেরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা যায়। ১৬ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয় : টেন্ডারবাজি রোধে সরকার ই-টেন্ডারের ঘোষণা দিলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। বরং সারা দেশের টেন্ডার এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সরকারি দলের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও চলছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, হানাহানি। এমনকি টেন্ডার বাণিজ্য ঘিরে মূল দলের সঙ্গে সহযোগী সংগঠনের অভ্যন্তরীণ বিরোধও ব্যাপক রূপ ধারণ করেছে। বেশির ভাগ জেলায় সরকারি দলের এমপিরা নিজেরাই মূল সিন্ডিকেটের গডফাদারের ভূমিকা পালন করছেন। ফলে সিন্ডিকেটের লোকজনও ঠিকভাবে কাজ করতে পারছেন না। এতে ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়ন কার্যক্রম। টেন্ডার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড।
তারপরও সরকার সংস্থার অসহায় প্রকৌশলীরা চাপের মুখে সব মুখ বুজে মেনে নিচ্ছেন। অনেক সময় নিজেরাও সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়ছেন। এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘টেন্ডারবাজি এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগত স্বার্থ-সুবিধা এবং ক্ষমতার যোগসাজশে অর্থ-সম্পত্তির মালিক হতে হবে- এমন প্রবণতা থেকেই রাজনীতিতে আসছেন সবাই। এমন কি এই রীতিকে আজকাল নেতারা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাইছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগেও একজন এমপি বলেছেন, ‘ক্ষমতায় থাকলে তো সম্পদ বাড়বেই।’ উল্লেখ্য যে, রাজধানীতে একাধিক গোযেন্দা সংস্থার খাতায় পেশাদার টেন্ডারবাজ হিসেবে অর্ধশতাধিক ব্যক্তির নাম আছে। তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা। পেশা ঠিকাদারি না হলেও সরকারি ভবনগুলোতে তাদের পরিচিতি টেন্ডারবাজ হিসেবে। তাদের সবার নামে ঠিকাদারি লাইসেন্স নেই, তবুও তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন সরকারের উন্নয়ন কাজের দরপত্র। দরপত্র জমা দিয়েই তারা হাতিয়ে নেন কাজের ১০ শতাংশ অর্থ। নিয়মিত তাদের দেখা মেলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরে। এগুলো যেন তাদের নিজের অফিস। আসলে তারা টেন্ডারবাজ। তাদের মধ্যে যাদের ঠিকাদারি লাইসেন্স আছে, তারা কখনও নিজেরা কাজ করেননি। দরপত্র কিনে ‘নিকো’ অর্থাৎ কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য মধ্যস্থতা করাই তাদের মূল পেশা। রাজধানীতে কমপক্ষে ১০টি সরকারি ভবন ও অধিদফতরে দেখা মিলবে তাদের। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যায় যে, সরকারি অফিসে ই-টেন্ডার চালুর উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৯৮ সালে। তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে সরকারি সব প্রতিষ্ঠানে ই-টেন্ডার কার্যকর করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয় ২০১১ সালে। সরকার অন-লাইনে টেন্ডার জমা দিতে সবার জন্য একটি ওয়েব পোর্টাল (www.eprocure.gov.bd) চালু করে যা ই-গবর্নমেন্ট বা সংক্ষেপে ই-জিপি নামেও পরিচিত। বিভিন্ন সরকারি দফতর ও সংস্থার নিজস্ব ওয়েব সাইটের পাশাপাশি কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত এই ওয়েব সাইটেও টেন্ডার প্রকাশ ও জমাদানের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর কিছুই মানা হচ্ছে না। শতকরা ৮০ শতাংশ টেন্ডারই ই-টেন্ডারের বাইরে হচ্ছে বলে পত্রিকার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। এমন চিত্রে সহজেই উপলব্ধি করা যায় কেন দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করা যাচ্ছে না। আর এসব কারণেই দেশ ও জনগণের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সরকারি দলের সিন্ডিকেটের কারণে দেশের উন্নয়নসহ অনেক কল্যাণমূলক কাজই এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত ১৭ জুন প্রথম আলো পত্রিকায় মুদ্রিত এক প্রতিদেনে বলা হয়, মেহেরপুর জেলায় সরকারের সংগ্রহ অভিযান চললেও কৃষক তাদের উৎপাদিত গম গুদামে দিতে পারেনি। তবে গুদামে গম গেছে তাদের নামেই। আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের একাংশ দাবি করেছে, কৃষকদের বদলে দলের কয়েকজন নেতা গম সরবরাহ করে ৮ কোটি টাকার মতো আয় করেছেন। এ নিয়ে নেতাদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলীর ঘটনাও ঘটেছে।
টেস্ট রিলিফ (টিআর) ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি (কাবিখা) জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এসব কর্মসূচি নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। গত ১৪ জুন ‘কাবিখা লুটেখা’ শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিনে। রিপোর্টে বলা হয়, টিআর ও কাবিখার নামে বরাদ্দকৃত অর্থের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশেরই কোনো কাজ হয় না। অনেক সময় শত ভাগই গায়ের জোরে করে দেয়া হয়। টিআর এবং কাবিখার বরাদ্দে উন্নয়নের নামে উপজেলায় গড়ে উঠেছে ‘লুটেখা’ সিন্ডিকেট। নানা কৌশলে প্রশাসনের যোগসাজশেই এই লুটপাট এবং দুর্নীতি এখন ওপেন সিক্রেট বিষয়। অনেক সময় দেখা যায়, এমপিরা নিজেরাই এর সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। আবার কোনো কোনো এলাকায় এমপি না জড়ালেও স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি দলের নেতা-কর্মী ও সরকারি দল সমর্থিত জনপ্রতিনিধিরা ভাগাভাগি করে নেন পুরো প্রকল্পের টাকা। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক দলের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের তুষ্ট রাখতে প্রতিবছরই এই টিআর ও কাবিখা বরাদ্দ দেয়া হয়। অথচ এসব বরাদ্দের বিপরীতে আদৌ কোনো কাজ হলো কিনা তার কোনো রকম তদারকি হয় না। সুশাসনের অভাবে টিআর ও কাবিখা কর্মসূচি এখন দুর্নীতির বড় প্রশ্রয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের শেষ দিকে ৩০০ এমপি ও সংরক্ষিত আসনের ৫০ জন এমপির নামে টিআর ও কাবিখার বিপরীতে বরাদ্দ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। প্রতিজন এমপির বিপরীতে টিআর প্রকল্পের জন্য ৩০০ মেট্রিক টন ও কাবিখা প্রকল্পের জন্য ৩০০ মেট্রিক টন করে গম ও চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। টিআর ও কাবিখা মিলিয়ে মোট বরাদ্দের পরিমাণ জনপ্রতি ৬০০ মেট্রিক টন। জানা গেছে, এই বরাদ্দ প্রকল্পের বিপরীতে দেয়ার কথা থাকলেও, বাস্তবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রকল্প না পেয়েই। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার ভর্তুকি মূল্যে যে চাল ও গম ক্রয় করে, সেই চাল-গমই আরো কমমূল্যে টিআর ও কাবিখার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু কেনার মূল্য থেকে কমে বরাদ্দ দেয়া হলেও বাস্তবে সিন্ডিকেট চক্রের কারণে সেই চাল ও গম বিক্রি হয় সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও অনেক কম দামে। সূত্র জানায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় চলতি বছর টিআর ও কাবিখার বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া প্রতি টন চালের মূল্য ধরে দিয়েছিল ২২ হাজার ৫০০ টাকা করে। একইভাবে প্রতিটন গমের মূল্য সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছিল ১৯ হাজার ৫০০ টাকা করে। কিন্তু টিআর ও কাবিখা প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া প্রতি টন চাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে ১৪ হাজার টাকা ও গম বিক্রি করা হয়েছে ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা দরে। অথচ বর্তমানে চালের বাজার দর হচ্ছে প্রতি টন প্রায় ২৫ হাজার টাকা করে। আর গমের বর্তমান বাজার দর হচ্ছে প্রতি টন প্রায় ২০ হাজার টাকা। মাঠ পর্যায় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বরাদ্দকৃত চাল ও গম উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি দলের নেতা-কর্মীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সুলভ মূল্যে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে।
টিআর ও কাবিখার এসব দুর্নীতি প্রসঙ্গে টিআইবি’র ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জনপ্রতিনিধিদের হাতে এ বরাদ্দ দেয়ায় অর্থের অপচয় থেকে শুরু করে দুর্নীতির সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরকারের সরে আসা উচিত। আমি নীতিগতভাবে এই প্রক্রিয়াকে সমর্থন করি না। জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব এটি হওয়ার কথা নয়। স্থানীয় সরকারের হাতে, প্রকল্প বাস্তবায়নে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের হাতে এ দায়িত্ব দেয়া উচিত। এমপিদের হাতে বরাদ্দ দিলে দলীয়করণের সৃষ্টি হয়। এদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এসব বরাদ্দ এমপিদের হাতে দেয়াই অন্যায়। এটি সংসদ সদস্যদের কাজ নয়। তাদের কাজ হলো সংসদে আইন প্রণয়ন করা, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া অর্থবছরের শেষ সময়ে এসে বরাদ্দ দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে তার বাস্তবায়ন দেখাতে গেলে লুটপাট তো হবেই। কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার চেয়ারম্যান শাহজাহান মজুমদার বলেন, টিআর, কাবিখার টাকা কোনো কাজেই আসে না। এসব বরাদ্দ এমপি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যানদের হরিলুট ও ভাগ-বাটোয়ারার মধ্যে শেষ হয়। আমরা মনে করি, যে জনগণের জন্য বরাদ্দ তারাই যদি না পায় তাহলে এসব প্রকল্পে অর্থ খরচ করে লাভ কি? দুর্নীতির মাত্রা বৃদ্ধি তো কোনো প্রকল্পের লক্ষ্য হতে পারে না। টিআর ও কাবিখা তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, যখন তার সুফল জনগণ পাবে। এই ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় আছে। সরকার কর্তব্যকর্মে এগিয়ে আসে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে সরকারি দলের সিন্ডিকেটের কারণে যেভাবে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং টেস্ট রিলিফ ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির অর্থ যেভাবে লুটপাট হচ্ছে, তাতে সুশাসনের সংকট স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে। এসব ক্ষেত্রে প্রশ্রয়ের নীতি পরিহার করে সরকার যদি অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে দেশে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি আরো এগিয়ে যাবে। এমন বাস্তবতায় শুধু যে সুশাসন ও গণতন্ত্রই পিছিয়ে পড়বে তা নয়, জনমনেও বাড়বে হতাশার মাত্রা। হতাশার মাত্রা বৃদ্ধি কি কোনো সরকারের কাজ হতে পারে?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads